মেঘবদল পর্ব-১৩+১৪

0
608

#মেঘবদল
লেখক – এ রহমান
পর্ব ১৩

মুখে পানির ঝাপটা পড়তেই আধো আধো চোখ মেলে তাকাল ফারিয়া। মাথাটা ভার লাগছে। নিশ্বাস আটকে আসছে তার। জারিফ অস্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ফারিয়া শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু কোনভাবেই তার শ্বাস প্রশ্বাস সাভাবিক হচ্ছে না। জারিফ অস্থির ভাবে জিজ্ঞেস করলো
— ফারিয়া কষ্ট হচ্ছে তোমার?

ফারিয়া উঠতে চেষ্টা করতেই জারিফ তাকে ধরে উঠিয়ে দিলো। ফারিয়া পুরো শরীরের ভর জারিফের উপরে ছেড়ে দিলো। জারিফ খুব যত্ন করে তাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো। আদুরে কণ্ঠে বলল
— কিচ্ছু হবে না। একদম ভয় পাবে না। কিছুক্ষণ পরেই ঠিক হয়ে যাবে।

ফারিয়া শুনতে পেলেও কোন কথা বলল না। জারিফ ফারিয়ার মুখটা একটু তুলে পাশ থেকে মধু আর আদা মেশানো কুসুম গরম পানির গ্লাসটা মুখে ধরলো। কিন্তু ফারিয়া খেতে চাইলো না। হাত দিয়ে সরে দিলো। জারিফ আদুরে কণ্ঠে বলল
— খাও প্লিজ।

জারিফের এমন কথা শুনে ফারিয়া আর না করতে পারলনা। একটু খানি খাইয়ে দিয়ে জারিফ গ্লাসটা পাশে রেখে তাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে আছে। মস্তিষ্কে তার এলোমেলো ভাবনা। হঠাৎ করেই মেয়েটা এমন অসুস্থ হয়ে গেলো কেনো। ফারিয়ার মাথার চুলগুলো আলতো করে নাড়িয়ে দিয়ে বলল
— কাল রাতে তুমি এখানে কেনো শুয়েছিলে? ভয় পেয়েছিলে কোন কারণে?

ফারিয়া জারিফের বুকে মাথা রেখেই নেড়ে সম্মতি জানালো যে সে ভয় পেয়েছিলো। জারিফ এখন বুঝতে পারছে তার অসুস্থ হবার কারণ। আবারও বলল
— কিসের ভয়? আর আমাকে ডাকোনি কেনো?

ফারিয়া ক্লান্ত কণ্ঠে মৃদু সরে বলল
— ডেকেছিলাম। তুমি গভীর ঘুমে ছিলে তাই বুঝতে পারনি। তাই তোমার পাশে শুয়েছিলাম। তুমি রাগ করেছো?

জারিফের কপালে ভাঁজ পড়ে গেলো। তার পাশে শোয়া নিয়ে সে রাগ করবে কেনো? বরং ফারিয়ার এই অবস্থার জন্য তার এখন নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। কারণ ফারিয়ার হাইপারভেন্টিলেশন সিন্ড্রোম এর প্রবলেম আছে। ভয় পেলে বা খুব বেশি টেনশন করলে প্যানিক এটাক হয়। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয় তার। আর কাল রাতে ভয় পেয়েই এমন অসুস্থ হয়ে গেছে। তাছাড়া ঢাকায় আসার পর থেকেই ফারিয়া বেশ উদাসীন। জারিফ সারাদিন অফিসে থাকে। আর সে একা একা বাসায় থাকে। তেমন কথা বলার মত কেউ নেই। তার এই সমস্যার কথা জারিফ জানতো। কিন্তু খেয়াল করেনি। জারিফের এখন খুব খারাপ লাগছে। তার খেয়াল করা উচিত ছিল। কারণ ফারিয়া এখন তার দায়িত্ব। ফারিয়া এখনো জারিফের বুকেই মাথা রেখে আছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তার চুলের ভাঁজে হাত চালিয়ে মৃদু সরে বলল
— সরি। হয়তো গভীর ঘুমে ছিলাম। তাই বুঝতে পারিনি। আর আমার পাশে শোয়ার জন্য রাগ করার কি আছে। বিয়ে করা বর আমি তোমার। এর জন্য তোমাকে কেউ শাস্তি দেবে না।

ফারিয়া মাথা তুলে অবাক চোখে তাকাল। জারিফ জিজ্ঞেস করলো
— এখন ভালো লাগছে?

মাথা নাড়ালো। এখন তার একটু ভালো লাগছে। জারিফ গালে এক হাত আলতো করে রেখে বলল
— ইউ নিড রেস্ট। তুমি শুয়ে থাকো আমি আসছি।

জারিফ চলে গেলো। ফারিয়া বসেই থাকলো। সে জারিফের এমন আচরণ নিয়ে খুব চিন্তিত। বিয়ের আগে তাদের মাঝে বন্ধুত্বটা বেশ ভালো ছিলো। দুজন দুজনের মনের সব কথা একে অপরকে বলতো। কিন্তু বিয়ের পর থেকেই দুজনের মাঝে তৈরি হয় আকাশসম দূরত্ব। ভালো করে দুজন দু মিনিট কথাও বলে না। কথা বলা তো দূরে থাক কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না। কিন্তু আজ জারিফ একেবারেই সাভাবিক। বেশ অনেক্ষণ পর জারিফ ঘরে আসলো। হাতে খাবার নিয়ে। ফারিয়া বিস্ময়কর দৃষ্টিতে সেদিকে তাকাল। জারিফ পাশে বসে খাবার নিয়ে ফারিয়ার মুখের সামনে ধরলো। কিন্তু ফারিয়া খাবার না খেয়ে সেটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। জারিফ বিরক্ত হলো। ধমকের সরে বলল
— এভাবে দেখার কি আছে? বিষ খাওয়াচ্ছি না তোমাকে? চুপচাপ খেয়ে নাও।

ফারিয়া হা করতেই জারিফ মুখে খাবার ঢুকিয়ে দিলো। মুখে খাবার নিয়ে চিবুতে চিবুতে ফারিয়া বলল
— তোমার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে তো। যাবে না অফিসে?

জারিফ তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল
— নাহ।

ফারিয়া ভ্রু কুচকে তাকাল। বলল
— কেনো?

জারিফ প্লেটের দিকে তাকিয়ে বলল
— তোমার বাবার অকাজের মেয়েকে কে দেখবে আমি চলে গেলে। সে যে নিজের খেয়াল রাখতে পারে না। তার খেয়াল রাখার জন্য আমি ছাড়া এখানে আর কেউ নেই। তাই এখন সব কাজ ফেলে আমাকেই সামলাতে হবে।

অন্যকোন সময় হলে জারিফের কথা শুনে রাগ করতো সে। এই কথার প্রেক্ষিতে হাজার খানেক উত্তর দিয়ে বসত। কিন্তু এখন এরকম কোন ইচ্ছা নেই। কোন আশ্চর্য কারণে এই মুহূর্তে ভীষন ভালো লাগছে তার। তাই নিশ্চুপ হয়ে খাবার খাচ্ছে। ফারিয়ার এমন চুপ করে থাকাটা জারিফের ভালো লাগলো না। এখন প্রায় সব সময়ই সে ফারিয়াকে চুপ করে থাকতে দেখে। প্রয়োজন ছাড়া দুজন কথা বলে না। জারিফের মনে হলো কোন না কোনভাবে আজ ফারিয়ার অসুস্থতার জন্য সে নিজেও কিছুটা দায়ী। সে চায় ফারিয়া ঠিক আগের মতো সাভাবিক হয়ে যাক। তাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা ঠিক হয়ে যাক। ফারিয়া খাবার মুখে নিয়ে বসে ভাবছে। জারিফ বিষয়টা খেয়াল করলো। ভ্রু কুঁচকে বলল
— খাচ্ছো না কেন?

ফারিয়া খাবার চিবিয়ে মিনমিনে কণ্ঠে বলল
— খাচ্ছি।

জারিফ সন্দিহান কণ্ঠে বলল
— আচ্ছা তুমি ঠিক মত খাওয়া দাওয়া করো তো? আমার মনে হচ্ছে না তো। সারাদিন আমি থাকি না। একা একা কি করো কে জানে? তোমাকে খাওয়াতে যে একটা এসিস্ট্যান্ট লাগবে সেটাও তোমার বাবার আগেই বলে দেয়া উচিত ছিলো।

কথা বলে খানিকসময় থামলো জারিফ। আবার বলল
— এরপর থেকে ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া না করলে ধরে মাইর দিবো। তারপর খাওয়াবো।

ফারিয়া সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকাল। জারিফের আচরণ তার কাছে কেমন অদ্ভুত মনে হচ্ছে। বিয়ের পর এই প্রথম জারিফ তার সাথে ভালো করে কথা বলছে। কাল পর্যন্ত তো ঠিক মতো কথাই বলতো না। কিন্তু আজ এমন কি হলো যে হুট করেই এমন আচরণ করছে। সব কিছু কেমন লাগছে তার।

————–
নুরুল রহমান সোফায় বসে টিভি দেখছেন। দেখছেন বললে ভুল হবে তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন। মাহমুদা আর ঈশা রান্না ঘরে চা বানাচ্ছে আর গল্প করছে। ভালো লাগছিলো না বলে মাহমুদা ঈশাকে ডেকেছে গল্প করতে। ঈশা এক পর্যায়ে বলল
— তুমি যাও বড়ো মা। আমি চা নিয়ে আসছি।

মাহমুদা এসে বসলেন পাশে সোফায়। নুরুল রহমানের দিকে তাকিয়ে বললেন
— তোমার কি শরীর খারাপ? আজ বাসায় আছো যে?

তিনি কোন কথা বললেন না। হতাশ শ্বাস ছাড়লেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন
— মাহমুদা তোমার ছেলে কি সত্যিই বিদেশে চলে যাচ্ছে?

মাহমুদা থেমে গেলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল
— জানি না। আমার কাছে এতো কিছু জানতে চাও কেনো? নিজেই ছেলেকে জিজ্ঞেস করতে পারো না?

— কিভাবে জিজ্ঞেস করবো তোমার ছেলে তো আমার সাথে কথাই বলে না। এসব বিষয়ে কিছু জানতে চাইলেও এড়িয়ে যায়। বাবা হিসেবে ঠিক কতটুকু মূল্যায়ন করে সে আমাকে?

হতাশ হয়ে নুরুল কথাটা বলতেই মাহমুদার মন খারাপ হয়ে গেলো। ইভান তার বাবার সাথে কেনো এসব নিয়ে কথা বলে না সেটাই সে বুঝতে পারে না। কিন্তু ইভানের এমন আচরণে তার বাবা বেশ কষ্ট পায়। সেটা কি সে বুঝতে পারে না। এভাবে আর কতদিন চলবে। মাহমুদা ভেবে ঠিক করে ফেললো সে ইভানের সাথে এটা নিয়ে কথা বলবে। ইভান আর তার বাবার সম্পর্কটা সাভাবিক করার যথেষ্ট চেষ্টা করবে। তার ভাবনার মাঝেই ইভান বাইরে থেকে এলো। নুরুল সাহেব ছেলের দিকে একবার তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিলো। মাহমুদা ইভানের কাছে গিয়ে খুব শান্তভাবে বলল
— কিছু খাবি?

ইভান মাথা নাড়ল সে খাবে না। মাহমুদা আবার বলল
— চা দেই?

ইভান বিরক্ত হলো। কিছু লাগলে সে তো নিজে থেকেই বলে। তাহলে আজ এভাবে বারবার তাকে বলার কারণ কি। বিরক্ত হয়ে বলল
— কিছু লাগলে আমি নিজেই বলবো।

ইভান কথা শেষ করে ঘরের দিকে পা বাড়াতেই মাহমুদা গম্ভীর সরে বলল
— ইভান তোর বাবা তোর সাথে কথা বলতে চায়।

ইভান থেমে গেলো। মায়ের দিকে ঘুরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মৃদু সরে বলল
— বাবা কি কথা বলবে সেটা জানি। আমি…।

— তুমি কি জানো সেটা বড়ো কথা নয়। তোমার বাবা তোমার সাথে কথা বলতে চায় সেটাই বড় কথা। কথা বাড়ায়ওনা। বাবা কি বলে সেটা শোনো।

ইভানকে থামিয়ে দিয়ে মাহমুদা কঠিন কথা বলতেই সে অবাক চোখে তাকাল। মাহমুদা এভাবে কখনো কথা বলে নি বাবা ছেলের সম্পর্ক নিয়ে। কিন্তু আজ এরকম করার কারণ ইভানের কাছে স্পষ্ট নয়। সে আর কথা না বলে সোফায় গিয়ে বসলো। অত্যন্ত শান্ত সরে বলল
— বাবা তুমি নাকি কি বলবে?

নুরুল রহমান ছেলের দিকে তাকালেন। ইভান তার সাথে কথা বলতে আসবে সেটা তিনি ভাবেন নি। নিজের বিস্ময় টা খুব চতুরতার সাথে গোপন করে সাভাবিক ভাবেই বললেন
— তোমার বিদেশ যাওয়ার কি খবর? কিসব মেইল না কি আসার কথা ছিল যে এসেছে?

ইভান নিচের দিকে তাকিয়ে মৃদু সরে বলল
— সব রেডি বাবা। খুব তাড়াতাড়ি হয়তো যাওয়ার ডেট দেবে।

ছেলের কথা শুনে নুরুল সাহেবের বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা হয়ে গেলো। চোখটাও ছলছল করে উঠলো। প্রকাশ করলেন না তিনি। কিন্তু মনে মনে ভীষন কষ্ট হচ্ছে তার ছেলেটা চলে গেলে তিনি কিভাবে থাকবেন। রান্না ঘর থেকে ঈশা সবটা শুনে চোখের পানি আটকাতে পারলো না। অঝোরে কাদতে লাগলো।

চলবে……

#মেঘবদল
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১৪

চুলার আঁচটা বাড়ানো। শনশন শব্দে চায়ের পানি ফুটছে। পুরো রান্না ঘরে ভ্যাপসা ভাব। মাহমুদা রান্না ঘরে ঢুকতেই ঈশা বুঝতে পারল। খুব গোপনে চোখের পানিটা মুছে নিলো। চা হয়ে গেছে। চুলাটা বন্ধ করে দিয়ে মাহমুদার দিকে ঘুরে বলল
–তুমি কেন এলে বড় মা? আমি তো নিয়েই যাচ্ছিলাম।

মাহমুদা ইশার দিকে তাকালেন। নাকের ডগা এখনও লাল। চোখ গুলো সিক্ত। তাকে দেখেই বোঝা জাচ্ছে যে সে কাঁদছিল। তার কান্নার কারন কি হতে পারে সেটা মাহমুদা আন্দাজ করে নিলো। চায়ের কাপগুলো ঠিক করে সামনে রেখে চা কাপে ঢেলে নিলো। দুই কাপ চা দুই হাতে নিয়ে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–ইভান ঘরে গেছে ওর চা টা একটু দিয়ে আসবি?

ঈশা শান্ত চোখে তাকাল। হতাশ শ্বাস ছেড়ে বলল
–আমার বানানো চা খাবে তোমার ছেলে?

মাহমুদা চায়ের কাপ নিয়ে বাইরে যেতে যেতে বললেন
–খাবে না কেন? তুই তো ভালই চা বানাস। নিয়ে যা।

ঈশার এখন ইভানের ঘরে যেতে ইচ্ছা করছে না। তার মন খুব খারাপ। তারপরেও বড় মার কথা সে ফেলতে পারে না। তাই চা নিয়ে ইভানের ঘরের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে নিয়ে দরজায় ধাক্কা দিতেই সেটা খুলে গেলো। ভেতর থেকে লাগানো ছিল না। ঘরে কেউ নেই। ওয়াশ রুম থেকে আওয়াজ আসছে। ইভান ওয়াশ রুমে। ঈশা চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে ঘুরতেই ইভান ওয়াশ রুম থেকে বের হল। পানি গড়িয়ে গলা বেয়ে টি শার্টের উপরের অংশ কিছুটা ভিজে গেছে। মাথার চুলগুলোর সামনের অংশে রুপোলী পানির ফোটা জ্বলজ্বল করছে।
–তুই?

ইভান গম্ভির গলায় বলতেই ঈশা চোখ ফিরিয়ে নিলো। নিচের দিকে তাকিয়ে বলল
–তোমার চা দিতে এসেছিলাম।

ইভান টাওয়াল হাতে নিয়ে বলল
–বললাম তো আমি চা খাব না।

ঈশা ঘুরে তাকাল। বেশ কঠিন গলায় বলল
–জানতাম খাবে না। তাই আমি তো দিতেই চাই নি। তোমার মা ই তো জোর করে পাঠাল।

বলেই ঈশা চায়ের কাপ হাতে নিতেই ইভান হাত ধরে ফেলল। আরেক হাতে কাপটা নিয়ে বলল
–থাক। এনেছিস যখন আর নিয়ে যেতে হবে না।

ঈশা বিরক্ত হল খুব। বিরক্তিকর সরে বলল
–তুমি আর তোমার মন। কখন কি চায় নিজেই জানে না।

ইভান শান্ত ভাবে তাকাল। করুন সরে বলল
–তুই জানিস?

ঈশা সন্দিহান চোখে তাকাল। মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–তোমার মনের খবর আমি কিভাবে রাখবো? তুমি তো নিজেই জান না।

ঈশা তার কথা শেষ করতেই ইভান বলল
–আমি জানি কিনা সেটা ইম্পরট্যান্ট না। তুই কেন জানিস না সেটা ইম্পরট্যান্ট। খুব তো বললি আমাকে ভালবাসিস। ভালবাসলে সেই মানুষটার মনের খবর রাখতে হয়। শুধু মনের কেন তুই তো আমার কোন খবরই রাখিস না। কোনদিন জানতে চেয়েছিস আমার মনের কথা? আমি কেমন আছি? আমাকে দেখে বুঝতে পারিস তুই?

ঈশা ইভানের চোখের দিকে তাকাল। অভিমানে পরিপূর্ণ চোখ জোড়ায় না বলা হাজারো কথা। ভারি হয়ে এলো ঈশার বুক। চোখ দুটো দপদপ করছে। এখনই পানি গড়িয়ে পড়বে। চোখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। ইভান ঠোট বাকিয়ে হাসল। বলল
–একসাথে সবার খবর রাখাও সম্ভব না। তোর জীবনে যার গুরুত্ব বেশী তার খবর তুই ঠিকই রাখিস।

ঈশা ভ্রু কুচকে ঘুরে তাকাল। ইভান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। ঈশা প্রশ্নবিদ্ধ কণ্ঠে বলল
–কি বললে তুমি?

–কিছু না।

ইভানের মৃদু কণ্ঠে বলা কথাটা শুনেই ঈশা এগিয়ে আসলো। কঠিন সরে বলল
–কার গুরুত্ব বেশী আমার জীবনে?

ইভান কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। বলল
–তোর সব প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই। আমার এখন কথা বলতে ভাললাগছে না। আমার ঘর থেকে চলে যা।

ঈশা দূরত্ব ঘুচিয়ে দাঁড়াল। ইভানের হাতের চায়ের কাপটা এখন দুজনের মাঝের দূরত্ব। ঈশা হুট করেই এভাবে কাছে আসায় ইভান ঘাবড়ে গেলো। বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে। ঈশা দাতে দাত চেপে বলল
–কার কথা বলছ সেটা না শুনে আমি এখান থেকে কোথাও যাব না।

ইভান শুকনো ঢোক গিলে বলল
–দূরে যা। ইনফ্যাক্ট ঘর থেকে বেরিয়ে যা।

ঈশা হাত নাড়াতেই চায়ের কাপে লেগে উল্টে তার হাতে পড়ে গেলো। গরম চা পড়ায় সে চিৎকার দেয়ার প্রস্তুতি নিতেই ইভান মুখ চেপে ধরল। শান্ত কণ্ঠে বলল
–চিৎকার করিস না এভাবে। বাইরে বাবা মা বসে আছে। বিষয়টা খারাপ হয়ে যাবে।

ঈশার চোখে পানি চলে এসেছে। ইভান তাকে ওয়াশ রুমে নিয়ে বেসিনের নিচে হাত ধরল। ঠাণ্ডা পানি হাতে লাগতেই একটু আরাম পেল ঈশা। ইভান তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল
–খুব জ্বলছে?

–তেমন না। এখন ঠিক আছে।

ঈশার অত্যন্ত নরম কণ্ঠ শুনেই ইভান বুঝে গেলো চা খুব একটা গরম ছিল না। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বলল
–হাত পা স্থির থাকে না? এতো নড়াচড়া করিস কেন সব সময়? অল্পের উপর দিয়েই পার হয়ে গেছে। ভাগ্য খারাপ হলে অনেক কিছুই হতে পারতো।

ইভান ঈশার হাত ধরেই ছিল তখনও। ঈশা কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। ইভান বেশ অবাক হল যে ঈশা তার ধমক খেয়েও ভয় পাচ্ছে না। ঈশা নিজের হাত টান দিয়ে বলল
–এভাবে ধমকে আমাকে চুপ করিয়ে রাখবে সেটা ভেবে থাকলে ভুল ভাবছ। আমি এখনও কিছুই ভুলিনি। পুরো কথা না শুনে আজ আমি কোথাও যাব না।

ইভান হাত ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়াল। বলল
–ভেবে বলছিস তো?

ঈশা ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে বলল
–একদম।

–তাহলে আজ রাতে তোর আর বাসায় যাওয়া হল না।

ইভান ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লো। ঈশাও পিছে পিছে আসলো। ইভান কে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে তাকাল। ইভান অমায়িক হেসে বলল
–ভালো করে দেখে নে। আর যদি দেখার সুযোগ না পাস।

কথাটা ঈশার বুকে গিয়ে লাগলো। মুখভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে গেলো। চোখে পানি চলে এলো। ইভান পুরোটা খেয়াল করল। ঈশা চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই সে হাত ধরে ফেললো। এক টানে নিজের কাছে এনে বলল
–কথা না শুনে নাকি যাবি না? এখন কোথায় যাচ্ছিস?

ঈশা নিচের দিকে তাকাল। অভিমানি কণ্ঠে বলল
–শুনতে চাই না। আমি আর তোমাকে বিরক্ত করব না।

চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো। ইভানের কাছ থেকে হাত ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করল। ইভান আরও শক্ত করে ধরে শান্ত সরে বলল
–আমি তো এখন কোনভাবেই যেতে দেবো না। এতক্ষন আমার কথা বলার মুড ছিল না। এখন আমি বলতে চাই। আর তোকে শুনতে হবে।

ঈশা নাক টেনে ইভানের দিকে তাকাল। বলল
–আমি তোমার কথা শুনতে বাধ্য নয়। এতক্ষন আমার ইচ্ছা ছিল এখন আর আমার ইচ্ছা নাই।

ইভান স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–কথা শোনার ইচ্ছা নেই ভালো কথা। কিন্তু কাদছিস কেন?

ঈশা নিচের দিকে তাকিয়ে বলল
–আমার ইচ্ছা তোমার সমস্যা কোথায়?

–আমার বাড়ি। আমার ঘর। দয়া করে তোকে দুই একটা কাজ ইচ্ছা মত করতে দিচ্ছি বলে সবটাই তোর ইচ্ছামতো হবে সেটা তো আমি মেনে নেব না।

ঈশা বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকাল। বলল
–কি বলতে চাও তুমি। স্পষ্ট করে কথা বল। তোমার এসব হেয়ালি কথা আমার ভালো লাগছে না। আর যদি কিছু বলার না থাকে তাহলে আমি চলে যাচ্ছি। আমার কাজ আছে।

–রাতুল অপেক্ষা করছে বুঝি?

ঈশা গভীর দৃষ্টিতে তাকাল ইভানের দিকে। ইভান বিছানায় বসে পড়লো। কথাটা ঈশার মোটেই ভালো লাগলো না। সে ঝাঁঝাল গলায় বলল
–রাতুল ভাইয়া আমার জন্য অপেক্ষা করবে কেন?

ইভান ফোন হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বলল
–কেন করবে জানিস না? নাকি আমার সামনে নাটক করছিস?

ঈশা কৌতূহলী চোখে তাকাল। বলল
–কি বলছ তুমি? আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না।

ইভান ঈশার সামনে এসে হাত চেপে ধরে দাতে দাত চেপে বলল
–বুঝতে পারছিস না কি বলছি? মাঝ রাতে রাতুলের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলিস অথচ এখন আমার কথা বুঝতে পারছিস না। এতটাও অবুঝ তুই নয়। সবটা তোর নাটক। আমার বোঝা শেষ।

ঈশা শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইভানের দিকে। ইভানের এমন আচরনের কারন এখন তার কাছে স্পষ্ট। ইভান ঈশাকে ছেড়ে দিয়ে খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল
–তুই কার সাথে কথা বলবি কার সাথে বলবি না সেটা তোর ব্যাক্তিগত ব্যাপার। আমার এসব নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই। নাউ গেট লস্ট।

–তুমি ভুল বুঝছ আমাকে।

ঈশার কথা শেষ হল না। তার আগেই ইভান তাচ্ছিল্য হেসে বলল
–তাই নাকি? তো কোনটা আমার বোঝার ভুল সেটা জানতে পারি? তনুর সাথে আমার কথা শুনেই তুই সিওর হয়ে গেছিস যে তনু আর আমি রিলেশনশিপে আছি আর খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করছি। সেটা নিয়ে আমার সাথে একবারও কথা বলার প্রয়োজনও মনে করিস নি। আর রাতুলের সাথে এতো লম্বা আলাপের পরেও তুই বুঝতে পারিস নি যে সে তোর উপরে উইক।

ঈশা অসহায়ের মতো বলল
–তনু আপু তোমার বিষয়টা আমার ভুল ছিল। কিন্তু বিশ্বাস করো তুমি যেমন ভাবছ রাতুল ভাইয়া আর আমার সম্পর্ক এমন না।

ইভান ঘুরে তাকাল। ঠোট বাকিয়ে হেসে বলল
–‘ When you look at me and smile, there is a breath of happiness in my life. When you speak, your voice has the power to take me to a place of peace.’
কিছু মনে পড়ে? নাকি মনে করিয়ে দেবো। এখন এটা বলিস না যে রাতুলের এই মেসেজের অর্থ তুই বুঝিস নি।

ঈশা হতভম্ভ হয়ে গেলো। রাতুলের এই মেসেজের কথা ইভানের জানার কোন প্রশ্ন আসে না। কিভাবে জানল সে। আকাশ পাতাল ভেবে ঈশা বলল
–তুমি এতো কিছু কিভাবে জানলে? আমার ফোন চেক করেছ?

ইভান ঈশার কথা শুনে প্রচণ্ড রেগে গেলো। নিজের রাগ কমাতে ঈশাকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। ঈশা অসহায়ের মতো ইভানের ঘরের সামনে দাড়িয়ে কাদতে লাগলো।

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে