মিসেস চৌধুরী পর্ব-১৭

0
1946

#মিসেস_চৌধুরী
#Part_17
#Writer_NOVA

হাসপাতালে ভর্তি ফিহা।ওর কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে আনিস চৌধুরী, সাফান,আবদুল আজিজ সাহেব।সাফানের কোলে অনিয়া। অনি চিৎকার করে কেঁদে পুরো হাসপাতাল তুলে ফেলেছে।কেউ শান্ত করতে পারছে না।টেবলেট দরজার একপাশে ঘাপটি মেরে চুপ করে বসে আছে। তার মনটাও খারাপ। সাফান অনিকে সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। কিছুতেই কান্না থামাতে পারছে না।কান্না করতে করতে অনি গলাস্বর ডাবিয়ে ফেলেছে।যেটাকে আমরা আঞ্চলিক ভাষায় গলা ভেঙ্গে যাওয়া বলি।

অনি সকাল থেকে এক চুমুক দুধও মুখে দেয় নি।
সবাই এখন অপেক্ষা করছে ফিহার ঘুম ভাঙ্গার।ফিহা কোমড়ে বেশ চোট পেয়েছে। আল্লাহ রহমত করছে বলে মাথায় আঘাত পাইনি।ডক্টর ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পারিয়ে রেখেছে।শরীর অনেক দূর্বল ফিহার।স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। হাতে স্যালাইনে চলছে।মুখটা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে আছে।সবার খেয়াল রাখতে গিয়ে বেচারী ফিহা নিজের খেয়াল রাখতে পারে না।

আকশির কানে আদিয়াত ফিহার অসুস্থতার খবর দিতেই গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেছে।এতটা তাড়াহুড়ো করে এসেছে যে আদিয়াতকে ফেলেই চলে এসেছে। টেনশনে পাগল হওয়ার জোগাড় সে।নিজের ছদ্মবেশ না নিয়েই চলে এসেছে।রিসিপশন থেকে কেবিন নং জেনে ছুটে চলে এলো। দৌড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে আনিস চৌধুরীর সামনে থেমে বললো।

আকশিঃ বাবা, ফিহা কেমন আছে?ওর কিছু হয়নি তো।ওর অবস্থা কি রকম?ফিহা ঠিক আছে তো।

আকশিকে দেখে আনিস চৌধুরী ও আবদুল আজিজ সাহেব চোখ ডলতে লাগলো।তারা দুজন ভূত দেখার মতো করে চমকে উঠেছে।তাদের মনে হচ্ছে তারা ভূল দেখছে।নিজের গায়ে চিমটিও কাটলে।যখন ব্যাথা পেলো তখন নিজের চোখকে বিশ্বাস করলো তারা।

আকশিঃ কথা বলছো না কেন তোমরা?ফিহা ভালো আছে তো?আমার ফিহার কিছু হতে পারে না।
আনিসঃ আকশি বাবা আমার। (খুশি হয়ে)

আনিস চৌধুরী প্রায় দৌড়ে আকশিকে জরিয়ে ধরলো। কত মাস পর নিজের ছেলেকে দেখছে।চোখের পানি পরছে অনবরত। আকশিও তার বাবাকে জরিয়ে ধরে কান্না করছে।সাফানের মাথার ওপর দিয়ে সব গেছে। বাপ-বেটাকে এভাবে দেখে আবদুল সাহেবের চোখের পানি ভরে গেছে। বর্তমানে আনিস সাহেব এতো খুশিতে কি বলবে তার ভাষা হারিয়ে ফেলছে।

আকশিঃ বাবা, আমি তোমাদের অনেক মিস করেছি।কেমন আছো তুমি?

আনিসঃ আমি ভেবেছি তুই মারা গিয়েছিস।আমি পুরো নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলাম তোদের হারিয়ে। কিন্তু ছোট বউমা বলেছিলো তুই একদিন ঠিক ফিরে আসবি।ওর কথাই ঠিক হলো।আমাদের সবার চিন্তা করতে করতে নিজের শরীরের কি হাল করেছে দেখ।আজ ওর কিছু হলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না।তোকে তো ছোট বউমার ব্যাপারে বলাই হয়নি।আসলে তোরা না থাকায়—

আকশিঃ আমি সব জানি বাবা।আমি তোমাদের সব খোঁজ -খবর রেখেছি।আর আমি ফিহাকে এবার সত্যি তোমার ছোট বউমা বানাতে চাই। আমি ফিহাকে ভালবাসি।

আকশির কথা শুনে সাফান,আনিস চৌধুরী, আবদুল সাহেব অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। কেবিনের সামনে গিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে ফিহাকে এক নজর দেখলো আকশি।তারপর সাফানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। অনিকে সাফানের কোল থেকে নিলো।অনি আকশির কোলে গিয়ে চুপ হয়ে গেল।

সাফানঃ যাক বাবা,সারাদিন এতকিছু করেও বজ্জাত মেয়ের কান্না থামাতে পারলাম না।আর ছেলেটা কোলে নিতেই সব ঠান্ডা। চাচার কথায় যতটুকু বুঝলাম,ছেলেটা আকশি চৌধুরী। মানে ফিহার পাতানো স্বামী। (মনে মনে)

আকশিঃ এই ছেলেটা কে বাবা?(সাফানকে দেখিয়ে)
আনিসঃ ওর নাম সাফান।বউমার বেস্ট ফ্রেন্ড।

আকশি সাফানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো

আকশিঃ আমি আকশি চৌধুরী।
সাফানঃ আমি সাফান হাসান।

দুজন একসাথে হাত মিলালো।টেবলেটের মনটা এতই খারাপ ছিলো যে ওর আশেপাশে কি হচ্ছে সেদিকে ওর খেয়াল ছিলো না।হঠাৎ নাকে একটা পরিচিত ঘ্রাণ পেতেই এদিক সেদিক তাকিয়ে আকশিকে দেখতে পেলো।খুশি মনে এক ছুটে টেবলেট আকশির কাছে চলে এলো।আকশি এক হাঁটু মুড়ে টেবলেটের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। টেবলেট খুশি হয়ে লেজ নাড়িয়ে দুই বার ঘেউ ঘেউ করে আনন্দ ধ্বনি করলো।

আকশিঃ কেমন আছিস তুই? তুই থাকতে ফিহা ব্যাথা পেলো কি করে?আমি না থাকায় ফাঁকিবাজি শিখে গেছিস। এটা তো ভালো কথা নয়।

আবদুলঃ আমার যে কি খুশি লাগছে তা তোমাকে বোঝাতে পারবো না আকশি বাবা।চৌধুরী বাড়ির এক পুত্র এখনো বেঁচে আছে, এটা যে আমাদের জন্য কতবড় খুশির সংবাদ। আমি আজই পুরো কোম্পানিকে খবরটা জানাবো।

আকশিঃ এখন নয় চাচা। আর কিছু দিন যাক।
আনিসঃ আকশি তুই নিখোঁজ হওয়ার পর অনিল ও লিয়া এক্সিডেন্টে মারা গেছে। আমি ও অনি দিদিভাই ভাগ্য জোরে বেঁচে যাই।তারপর ফিহাকে সবকিছু দেখার জন্য নিয়ে আসি।

আকশিঃ আমি জানি বাবা।আমি তখন অনেক অসুস্থ ছিলাম।যার কারণে আমি ভাইয়া,ভাবীকে শেষ দেখাও দেখতে পারি নি।(ছলছল চোখে)

আনিসঃ তোর কি হয়েছিলো?এয়ারপোর্ট থেকে নিখোঁজ কি করে হলি তুই?

আকশিঃ আমাকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল।

আনিসঃ আমার মনে হচ্ছে আমাদের বড় কোন শত্রু আছে।যে তোর কিডন্যাপ ও আমাদের গাড়ি এক্সিডেন্ট করিয়েছে।

আকাশিঃ আমি ১মে এমনটাই ভেবেছিলাম বাবা।যার কারণে আমি এতদিন লুকিয়ে ছিলাম।তবে এই একমাস পুরো দমে খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারলাম,তোমাদের গাড়ি কেউ এক্সিডেন্ট করায়নি।

আনিসঃ তাহলে!!!! (অবাক হয়ে)

আকশিঃ গাড়ির আগের থেকে সমস্যা ছিলো।হঠাৎ করে ব্রেকফেল হয়ে যাওয়ায় এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে।
আনিসঃ তোকে কিডন্যাপ কে করলো?

আকশিঃ আমাকে ভূলে কিডন্যাপ করা হয়েছিলো।অন্য একটা ছেলের বদলে আমি কিডন্যাপ হয়েছি।ঐ ছেলে ও আমার দুজনের পরনে কালো শার্ট,প্যান্ট ছিলো।কিডন্যাপাররা ঐ ছেলে ভেবে আমাকে তুলে নিয়ে গিয়ে রাম ধোলাই দিয়েছে। আদিয়াত যদি আমাকে সঠিক সময়ে খুঁজে না পেতো তাহলে আজ আমি বোধ হয় তোমাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম না।

(বিঃদ্রঃ আশা করি আমি আপনাদেরকে অনিল, লিয়ার মৃত্যু ও আকশির কিডন্যাপের বিষয়টা বুঝাতে পেরেছি।এই দুটো ঘটনাই যাস্ট এক্সিডেন্ট। এর পেছনে কোন মেইন মাস্টার মাইন্ড বা ভিলেন নেই।)

আকশির কথা শুনে আনিস চৌধুরী মুখে হাসি ফুটে উঠলো। তার ধারণা ছিলো তাদের বিজনেসের কোন শত্রু এমন করছে।যদিও তার জানামতে তাদের কোন শত্রু নেই।আনিস চৌধূরী চোখের পানি মুছে বললেন।

আনিসঃ আমি যদি ছোট বউমাকে খুঁজে না পেতাম তাহলে তুই আজকে আমাকে ও অনি দিদিভাইকে জ্যন্ত পেতি না।এখন তুই এসে পড়েছিস।মেয়েটাকে এবার এসবের ভেজাল থেকে বের করে দিবো।আর সারাজীবনের জন্য ফিহাকে তোর বউ করে আমাদের সাথে রেখে দিবো।তাহলে অনি দিদিভাই তার মা-কে হারাবে না।আমিও আমার মেয়েকে হারাবো না।

আকশিঃ আর আমি আমার বউকে হারাবো না।

আকশির কথা শুনে সবাই একসাথে হেসে উঠলো। সাফান ভীষণ খুশি হলো।যাক ফিহার তাহলে একটা সুন্দর পরিবার হবে।তখনি আদিয়াত দৌড়ে ওদের সামনে এসে হাঁপাতে লাগলো।আকশিকে টেনে আড়ালে নিয়ে বললো।

আদিয়াতঃ হারামী,তোকে আমি খবর দিলাম।আর তুই কি না আমাকে ফেলে চলে এলি।এই তোর বন্ধুত্বের পরিচয়।আমি তোর জন্য এতকিছু করলাম আর তুই কিনা আমাকে নিয়ে আসার প্রয়োজন মনে করলি না।তোর সাথে কোন কথা নেই। যা ভাগ, শালা।যেদিন থেকে তুই ফিহার প্রেমে পরেছিস সেদিন থেকে আমার কথা ভূলে বসে আছিস।তোর ভাব দেখে মনে হয় পৃথিবীতে তুই একাই প্রেম পরেছিস।ফিহা যদি তোকে মানা করে দেয় তাহলে আমার থেকে বেশি কেউ খুশি হবে না।
আকশিঃ সরি দোস্ত। আমার তখন মাথা কাজ করছিলো না। তাই তোকে না নিয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে এসেছি।
আদিয়াতঃ বুঝি বুঝি সবই বুঝি।ছোটবেলায় খাইছি সুজি, একটু হলেও কিছুটা বুঝি।তুই যে ফিহার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিস সেটা কি আঙ্কেল জানে?

আস্তে করে আকশির কানের কাছে গিয়ে শেষের কথাটা বললো আদিয়াত।

আকশিঃ আমি বাবাকে বলে দিয়েছি যে আমি ফিহাকে ভালবাসি আর বাবাও বলেছে ফিহা সুস্থ হলে আমাদের বিয়ে দিবে।
আদিয়াতঃ তুই তো দেখছি আমার সাথে থেকে থেকে অনেক বুদ্ধিমান হয়ে গিয়েছিস।যাক,আমি তাহলে গাধা পিটিয়ে মানুষ করতে পেরেছি😜।
আকশিঃ আমি ভালো কিছু করলে তোর ক্রেডিট আর খারাপ করলে আমার।এত চালাকি আমার সাথে চলবে না।বরং তুই আমার সাথে থেকে এতো চালাক হয়ে গেছিস।
আদিয়াতঃ খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই। তোর মতো হাঁদারাম আমাকে ধূর্ত বানাবে।
আকশিঃ তুই কি হসপিটালের মধ্যেও ঝগড়ার মুডে আছিস।তোকে আল্লাহ ভূলে কি ছেলে বানিয়ে ফেলেছে নাকিরে?ঝগড়া করা তো মেয়েদের অভ্যাস।
আদিয়াতঃ চুপ কর।কখন থেকে বকবক করেই যাচ্ছিস।এটা একটা হসপিটাল ভূলে গেছিস।
আকশিঃ 😲😲
আদিয়াতঃ 😎🥴

একটা নার্স এসে ওদের সামনে দাঁড়ালো। সাফান দূরে দাঁড়িয়ে ওদের দুজনের খুনসুটি গুলো দেখছিলো।এতিমখানায় থাকতে সাফান আর ফিহাও এমন করতো।

নার্সঃ মিসেস.ফিহার বাড়ির লোক কি আপনারা?
আকশিঃ জ্বি আমরা।কিছু লাগবে।
নার্সঃ এই ঔষধগুলো পেসেন্টের জন্য লাগবে। দয়া করে নিয়ে আসুন।
আকশিঃ প্রেসক্রিপশনটা দিন।
নার্সঃ এই নিন।

নার্স চলে যেতেই আকশি সাফানের কোলে অনিয়াকে দিলো।আদিয়াতকে ডেকে সাফানের সাথে পরিচয় করে দিলো।
আকশিঃ আদি, ওর নাম সাফান।ফিহার বেস্ট ফ্রেন্ড। আর সাফান ওর নাম আদিয়াত।আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।
আদিয়াতঃ আমি ওর বেস্ট ফ্রেন্ড নই।মিথ্যা কথা বলছে বকশি।না সরি আকশি।আমি উনাকে চিনিই না।আজকে ১ম দেখলাম।তা সাফান কেমন আছো?
সাফানঃ আলহামদুলিল্লাহ ভালো, আপনি?
আদিয়াতঃ আমিও ভালো আছি।
আকশিঃ সাফান তুমি একটু অনিকে দেখে রাখো।আমি জলদী করে ঔষধ নিয়ে আসছি।
আদিয়াতঃ আমিও যাবো।
আকশিঃ কে ভাই আপনি?আপনাকে তো আমি চিনি না। জীবনের ১ম দেখলাম আপনাকে।
আদিয়াতঃ হারামী, আমার কথা আমাকেই ফিরত দিচ্ছিস।সবার দিন কিন্তু একসমান যায় না।
আকশিঃ যা ভাগ।

আকশি ঔষধ আনতে ফার্মেসীতে রওনা দিলো।আনিস চৌধুরী ও আবদুল আজিজ সাহেব একসাথে বসে কথা বলছে।সাফান অনি ও টেবলেটকে নিয়ে বাগানের দিকে চলে গেল। আদিয়াত আকশির পেছনে দৌড়ে যাচ্ছে।
আদিয়াতঃ আকশি দাঁড়া। আমাকে নিয়ে যা।

♪♪♪♪♪♪♪♪♥♥♥♪♪♪♪♪♪♪♪♪

এক মুঠো রোদ্দুর হাতে, এক আকাশ নীল
আজ তোমার জন্য ব্যস্ত শহরে,
চলছে ভালোবাসার মিছিল
শুধু তোমার জন্য,
প্রেমের জোয়ারে ভাসলো দুকূল।(×২)

এক মুঠো রোদ্দুর হাতে, এক আকাশ নীল
আজ তোমার জন্য ব্যস্ত শহরে,
চলছে ভালোবাসার মিছিল।

রাতের আকাশ জাগে,তারার চাদরে।
বৃষ্টি ভেজা বাতাস বহে,রাতের আদরে।
পাহাড়ে পাহাড়ে ফুটলো বনফুল।
শুধু তোমার জন্য,
প্রেমের জোয়ারে ভাসলো দুকূল।(×২)

♪♪♪♪♪♪♪♪♥♥♥♪♪♪♪♪♪♪♪♪

ফার্মেসীতে থাকা কিশোর বয়সের ছেলেটা একাকিত্ব দূর করতে মোবাইলে গান শুনছে। আদিয়াত ঔষধের প্রেসক্রিপশন এগিয়ে দিলে, ছেলেটা ঔষধ খুঁজে খুঁজে বের করে দিতে লাগলো। কিন্তু আকশির সেই দিকে কোন ধ্যান নেই। সে একমনে গানটা উপভোগ করছে। শিল্পী বালামের “এক মুঠো রোদ্দুর” গানটি এখন যেনো তার পরিস্থিতির সাথে হুবহু মিলে গেছে।

#চলবে

রিচেক দেওয়া হয় নি।তাই ভূল-ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর
দৃষ্টিতে দেখবেন।🥰🥰

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে