#মায়াদেবের_মায়া
#পর্ব_১
#তাহমীম
মেয়েটা বড্ড দোটানায় পড়েছে চাচাতো ভাইকে বিয়ে করবে নাকি ফুফাতো ভাইকে বুঝতে পারছে না। সদর দরজা পেরিয়ে ড্রয়িংরুমে ডুকতেই কথা গুলো শুনতে পেলো মায়া। প্রতিবেশি কয়েকজন আন্টি এসব বলে হাসাহাসি করছে। মায়া তাদের কথার তোয়াক্কা না করে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে যাবে তখনি একটা আন্টি ডাক দিতেই মায়া পিছনে ফিরে তাকায়
—” কিরে মায়া কাকে বিয়ে করবি ঠিক করলি নাকি কিছু ?
মায়া কিছু না বলে জোর করে একটা হাসির রেখা টেনে চলে গেলো । ভীষণ দম বন্ধ লাগছে মায়ার। কেনো এমন হচ্ছে ওর সাথে, এমন না হলে ও পারতো।
এতো সুন্দর মায়াদেবের মায়াবী মায়ার এমন হাল যেন কেউ দেখলে মেনে নিতে পারবে না।
নিভু নিভু আলোয় ধীর পায়ে আয়নার সামনে যাচ্ছে মায়া। অনেক দিন ধরে আয়না দেখা হয় না। এতো সুন্দর মুখে অনেক গুলো ব্রন বের হয়েছে। চোখের নিচে কালি পরে গেছে। চুল গুলো পাটের ন্যায় উসকোখুসকো হয়ে পরে আছে কোমড়ে। মায়া আয়নার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিলো নিজেকে দেখে। হাসি দিলো কারন মায়া ভাবছে এটাই কি সে মায়া যে ছিলো ভিষণ পরিপাটি। নিজেকে সব সময় একটা অপ্সরার মতোই রাখতো।
কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত মুহুর্ত জীবনকে দূর্বিষহ করে ফেলেছে মায়ার। বেচেঁ আছে তবে বাচাঁর ইচ্ছে টুকু আজ নেই। শুনশান-নিস্তব্ধ রাতের শেষ প্রহরে এমন করাটা ঠিক কোন পর্যায়ে পরে জানা নেই মায়ার। কিন্তু ভাবতে তো কোনো ঠিক সময়ের প্রয়োজন হয়না। গভীর রাতে ভাবতে বেশ ভালো লাগে। কোনো কোলাহল থাকে না। চিৎকার চেচামেচি, গাড়ির হর্ন এমন কি পাখির কিচিরমিচিরের শব্দ থাকে না।গভীর রাতটা শুধু মাত্র একান্ত নিজের। যেখানে কারো হস্তক্ষেপ থাকে না। কেউ ভাবনার বেঘাত ঘটাতে পারে না। বেঘোরে ঘুমায় সবাই আর ভালো না থাকা মানুষ গুলো জাগে।
মায়ার এই অবস্থার জন্য তার মায়াদেবই দায়ী। কতো সুন্দর করে বলে দিলো মায়াদেব
—” মায়া আমি তোমায় বিয়ে করতে পারবো না।
তুমি আমানকে বিয়ে করে নাও। ও তোমায় অনেক ভালোবাসে, অথচ মায়াদেব একবার ও দেখলো না মায়া তাকে কতটা ভালোবাসে।
মায়াদেব নামটা মায়া ই দেই তার মায়াদেবকে। মায়াদেবের আরেকটা নাম আছে সেটা হচ্ছে নিঝুম চৌধুরী। মায়ার বাবারা দু-ভাই আর আর একবোন। নিঝুম মায়ার ফুপাতো ভাই আর আমান আহমেদ চাচাতো ভাই। নিঝুম মায়ার চার বছরের বড় আর আমান তিন বছরের বড়।
ছোট বেলার প্রায় অর্ধেক সময়ই কেটেছে তিনজনের এক সাথে। মায়া আর আমানের সব সময়ই ঝগড়া লেগে থাকতো আর নিঝুম তাদের আটকাতো। মায়া যখন কিছুই বুঝে না তখন মায়ার বড় মা মজা করে জিজ্ঞেস করতো সে বড় হলে কাকে বিয়ে করবে মায়া অবুঝের মতো না বুঝেই বলতো নিঝুমকে আর খিলখিল করে হাসতো। সাথে সবাই হাসতো মায়ার কথা শুনে।
একবার আমান মায়াকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় আর মায়ার হাত কেটে যায় নিঝুম দৌড়েঁ এসে নিঝুমের শার্ট খুলে মায়ার হাত পেচিয়ে ফেলে যাতে রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যায়। তারপর ব্যান্ডেজ করে দেয়৷ মায়া অপলক চোখে দেখছিল নিঝুমকে মেয়েদের মতো বড় বড় চোখের পাপড়ি, লাল ঠোট কি মায়াবী হাসি। সেই থেকেই মায়া নাম দিয়েছিলো নিঝুমকে মায়াদেব। আমান যখন কিছু খেত আর মায়াকে দিতো না তখন নিঝুম এনে দিতো। কত যত্ন নিতো মায়ার।
হঠাৎ নিঝুম পড়াশুনার জন্য আমেরিকায় চলে যাবে শুনে মায়া অনেক কেদেঁছিলো। মনে হয়েছিলো সারাজীবনের জন্য নিঝুমকে হারিয়ে ফেলছে সে। কিছু মানুষ দূরে গেলে আর কখনো ফিরে আসে না। আর তাই সত্যি হলো নিঝুম ফিরে এসেছে ঠিকি কিন্তু মায়ার কাছে ফিরে আসেনি।
মায়ার আজ সব কথা কেন যেন মনে পরছে। আমানকে তো সে ভাই হিসেবেই জেনে এসেছে এতদিন আমান মায়াকে ভালোবাসে সে জানতো না। কেন করলো আমান এমনটা মায়ার সাথে। আমান এমনটা না করলে হয়তো মায়াদেবের সাথে বিয়েটা হয়ে যেতো। সব এলোমেলো করে দিয়েছে আমান, সাথে মায়ার জীবনটা ও।
একটু একটু করে যখন মায়া বড় হচ্ছিলো নিঝুম বেড়াতে আসতো আর মায়া সারাক্ষন নিঝুমের সাথেই লেগে থাকতো।কবে নিঝুম তাদের বাড়ি আসবে সেই অপেক্ষায় বসে থাকতো। এসব করে কবে কখন নিঝুমকে মায়া ভালোবেসে ফেলে বুঝতেই পারেনি।
.
.
.
দরজায় ঠক ঠক শব্দে ঘুম ভেঙে যায় মায়ার।সারা রাত ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে গেছে বুঝতে পারেনি, ঘুম জড়ানো কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো
—‘ কে?
—‘ নিঝুম
নিঝুম নাম শুনেই মায়া তড়িঘড়ি করে উঠে পড়ে। দরজা খুলে দিতেই নিঝুম ভিতরে এসে খাটের মাথায় বসে।
নিঝুম মায়াকে দেখছে কেমন একটা হয়ে গেছে নিজের যত্ন নেয়না একদমই বুঝা যাচ্ছে। মায়ার মায়া মলিন হয়ে গেছে। মুখ ফ্যাকাসে লাগছে, চুল ও চিরুনি করে ঘুমায়নি। পরিপাটি মায়াকে কেমন এলোমেলো লাগছে।
নিঝুমকে নিরব চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে মায়া প্রশ্ন করলো
—‘ কেনো এসেছেন?
—‘ তোমাকে নিয়ে যেতে।
—‘ আমাকে নিয়ে যেতে মানে?
—‘ আম্মু বললো নিয়ে যেতে। বিকেলে চলে আসবে।
—‘ ওহ তাই নিতে এসেছেন? ( নিঝুমের চোখের দিকে তাকিয়ে)
—‘ হ্যা।
মায়ার মনটা আবার খারাপ হয়ে গেলো ফুপি মা পাঠিয়েছে তাই মায়াদেব নিতে এসেছে। না হয় আসতো না। আচ্ছা নিঝুম কি এক মুহুর্তের জন্য ও আমায় ভালোবাসেনি? আমি কি শুধু একাই বেসেছি? আর অবুঝের মতো ভেবেছি সে ও আমায় ভালোবাসে!? আমায় ভালোবাসলে কি খুব বেশি ক্ষতি হতো তার? আমি তার খুব বেশিই অযোগ্য? নিঝুকে অনেক গুলো অভিযোগ করতে ইচ্ছে হচ্ছে কিন্ত বলার সাহস পাচ্ছে না মায়া।
মায়া ঠায় দাঁড়িয়ে আছে দেখে নিঝুম মায়ার সামনে হাত নাড়িয়ে
—‘ কি হলো ফ্রেশ হতে যাও। আমি তোমাকে দিয়ে অফিসে যাবো অনেক কাজ আছ।
—‘ কেন যেতে বলেছে ফুপি মা?
—‘ জানি না কিছু বলবে তোমায় বললো ইমারজেন্সি।
মায়ার চোখে মুখে আশার আলো ফুটে উঠলো মনে হচ্ছে। মায়া নিঝুম কে ভালোবাসে এটা তার ফুপিমা জানে। হয়তো ফুপিমা মায়াকে বুঝবে। মায়া দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে। ওয়াশরুমের দরজা একটু ফাঁক করে মায়ার তোয়ালেটা দিতে বললো নিঝুমকে।
নিঝুম মায়ার দিকে তাকিয়ে দেখে সারা মুখে ফেসওয়াশ লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। নিঝুম মুচকি হেসে তোয়ালে এগিয়ে দিলো মায়াকে।
মায়া ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে দেখে নিঝুম এখানো আছে ফোন টিপছে বসে বসে।
মায়া কিছু না বলে আয়নার সামনে গিয়ে চুল আচরাতে লাগলো।
নিঝুম আড় চোখে তাকিয়ে বললো
—‘ মাথায় কি চিরুনি লাগাও না নাকি চুল তো কাকের বাসা করে ফেলেছো ।
—‘ তাতে আপনার কি? আমার চুল কাকের বাসা বানাবো নাকি কোকিলার বাসা বানাবো ওটা আমার ব্যপার।
—‘ যত্ন নিতে না পারলে এতো লম্বা চুল রাখার কি প্রয়োজন।
—‘ আমরা কিছু মানুষকে পাবো না জেনে ও যেমন ভালোবাসি তেমন প্রয়োজন। ( নিরব হয়ে)
পুরো ঘর থম থম করছে নিরবতায়। নিঝুম বুঝতে পারছে এখন কি কথা উঠবে তাই দাঁড়িয়ে
মায়া চুপ হয়ে গেছে কি বলতে গিয়ে কি বলে ফেললো ভাবছে।
—‘ আমি নিচে যাচ্ছি তুমি তাড়াতাড়ি আসো।
নিঝুমের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে মায়া। মায়া বুঝতে পারছে নিঝুম পালিয়েছে। চোখের কোনে অবাধ্য কিছু পানি চলে আসতেই মায়া হাত দিয়ে তা মুছে দেয়।
মায়া নিঝুম নাস্তা করে নিঝুমদের বাসার উদ্দেশ্য রওনা দেয়। মায়া চুপ করে বসে আছে। নিঝুম বার বার মায়ার দিকে তাকাচ্ছে ওকে চুপ দেখে।অতিরিক্ত কথা বলা মেয়েটা কেমন চুপ হয়ে গেছে। মায়ার কান্না আসছে কিন্তু কান্না করতে পারছে না। এখন একমাত্র ভরষা তার ফুপিমা। কি বলতেই বা ফুপিমা যেতে বলেছে মায়াকে! এখন সবাই মায়ার বিরুদ্ধে এমনকি মায়াদেব ও। হয়তো মায়াদেব কখনো মায়ার পক্ষেই ছিলো না।
বাড়িতে ডুকতি মুনিয়া আহমেদ ( মায়ার ফুপি) মায়াকে তার রুমে নিয়ে যায়। মায়া চুপ করে তার সামনে বসে আছে।
মুনিয়া আহমেদ মায়ার দিকে তাকিয়ে
—‘ এখনো ভালোবাসিস নিঝুমকে?………
চলবে……..