ভুল সত্য
৭
আমার মাস্টার্সের ক্লাস শুরু হয়েছে। প্রথম দিন মুকুল আমাকে পৌঁছে দিয়ে এসেছে। বোধ হয় ইচ্ছে করেই কাজটা করেছে, কারণ তার মায়ের চরিত্র সে খুব ভালো করেই জানে। বেরোনোর সময় অবশ্য আমার শাশুড়ি একটু ঝামেলা করার চেষ্টা করেছিলেন তবে মুকুল আগে থেকেই সেটার জন্য প্রস্তুত ছিল। একেবারেই তৈরি হয়ে নিচে নেমে নাস্তার টেবিলে বসেই ঘোষণা দিল। অবশ্য কদিন আগে থেকেই বলছিল। কিন্তু উনি শুনেও না শোনার ভান করছিলেন।
আমাদের বাড়িতে মানে, মুকুলদের বাড়িতে আর কি, এখন ওই মোটা মহিলাই নিয়মিত কাজ করছে। তার নাম নাজনীন। এটা অবশ্য আরেকটা কারণ, আমার শাশুড়ির তাকে অপছন্দ করার। তার নিজের নাম মেহেরিন। মেহেরিন জামান। হুট করে কেউ শুনলে মনে করবে দুই বোন। এছাড়া আরেকটা কারণ ও অবশ্য আছে। নাজু আপা ( এই নাম আমিই তাকে দিয়েছি) তাকে খালাম্মা বলে ডাকে, মুকুলকে ভাইজান আর আমাকে ভাবি। ভদ্রমহিলার বয়স আমার শাশুড়ির সমসাময়িক হবে কিংবা বেশি ও হতে পারে। অবশ্য বলা যায় না উনি কিটো ডায়েট করে নিজেকে বেশ ফিট রেখেছেন। বয়স বোঝার কোন উপায় নেই। তা ছাড়া আগেও বলেছি ভদ্রমহিলা বেশ সুন্দরী। এখন ছিপছিপে হাওয়াতে আরো সুন্দর লাগে, অবশ্য যতক্ষণ পর্যন্ত মুখটা বন্ধ থাকে। একবার মুখ খুলে গেলেই কেল্লাফতে।
মুকুল আমাকে কলেজের সামনে নামিয়ে দিল। গাড়ি থেকে বের হবার কোন প্রয়োজন ছিল না তবু বোধহয় ইচ্ছে করেই বের হল। আমাকে বিদায় জানানোর ভান ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েই রইলো। ও কি চাইছে কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়ে গুলো ওকে দেখুক? হল ও তাই। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা জুনিয়ার মেয়েগুলো সব ড্যবড্যব করে তাকিয়ে রইল। আমার একটু বিরক্ত লাগল। এত তাকানোর কি আছে? আমি নিজেও একবার তাকিয়ে দেখলাম। মুকুলকে বেশ ভালো দেখাচ্ছে। কেমন একটা নায়ক নায়ক ভাব। নিজের উপর খুব রাগ হলো আমার। অবশ্য রাগ হওয়ার কিছু নেই। মুকুল দেখতে ভালো এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে যে জিনিস বাইরে থেকে যত সুন্দর তার ভেতরটা ততটাই কুৎসিত। আমি গেটের কাছে পৌঁছে একবার পেছন ফিরে দেখলাম মুকুল ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসেছে। আমাকে দেখে হাত নাড়ল তারপর হুস করে গাডি নিয়ে বেরিয়ে গেল।
অফিস রুমে কিছু ফরমালিটি সেরে ক্লাসে পৌঁছতেই বুঝলাম মেয়েরা সব ওত পেতে বসে আছে আমার বিবাহোত্তর জীবনের মুখরচক গল্প শোনার জন্য। আমি যতই বাড়ি ঘর, শাশুড়ি কিংবা অন্যান্য গল্প করতে চাই ততই তারা গল্পের মোড় ঘুড়িয়ে অন্যদিকে চলে যায়। সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু এক জায়গায়। আমি প্রচন্ড বিরক্ত হলেও বাইরে সেটা প্রকাশ করলাম না। অহেতুক মেয়েরা ভাববে আমি ভাব দেখাচ্ছি। আমাকে বাঁচিয়ে দেরার জন্যই বোধ হয় ফোনে একটা টেক্সট মেসেজের শব্দ এল। দেখলাম মুকুল মেসেজ করেছে। জানতে চেয়েছে কখন শেষ হবে ড্রাইভারকে পাঠাবে। আমাকে মেসেজ পড়তে দেখে অন্য মেয়েরা গা টিপাটিপি হাসাহাসি করছিল। আমি পাত্তা না দিয়ে উঠে গেলাম। বললাম সোসিওলজি ডিপার্টমেন্টে যাচ্ছি তিথির সঙ্গে দেখা করতে। আমার আর তিথির বন্ধুত্বের ব্যাপারে সবাই জানে, কাজেই কেউ আর কোন কথা বলল না।
সোসিওলজি ডিপার্টমেন্টে গিয়ে জানতে পারলাম আজ ওদের কোন ক্লাস নেই। মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল। হঠাৎই কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগতে লাগলো। আমি ফোন বের করে তিথিকে কল করার বদলে মুকুলকে মেসেজ করলাম একটু আগেই ওকে বলেছিলাম তিথির সঙ্গে ফিরব। লিখলাম তিথি আসেনি আমার আরেকটা ক্লাস বাকি আছ শেষ করে রিক্সা নিয়ে চলে যাব। গাড়ি পাঠানোর দরকার নেই। মুকুলের বোধহয় অফিসে কোন কাজকর্ম নেই তৎক্ষণাৎ জবাব এলো, ক্লাসের পর অপেক্ষা কর। আমি আসছি।
আমার অসম্ভব বিরক্ত লাগছে কি দরকার ছিল মেসেজ করার। সবকিছু ওকে জানাতেই হবে? নিজের উপর রাগ হচ্ছে ভীষণ। তাছাড়া অফিস ফেলে ও আসবেই বা কি জন্য? আমি আবারো মেসেজ করলাম। অফিস ফেলে আসার দরকার নেই। মুকুল সঙ্গে সঙ্গে জবাবে লিখল, আজ বৃহস্পতিবার। হাফ ডে।
আজীব ব্যপার! আজকাল মনে হচ্ছে সপ্তাহে একাধিক বৃহস্পতিবার আসছে। এইতো সেদিন বৃহস্পতিবার ছিল মুকুল হাফ ডে অফিস করে ফিরে এসে আমাকে ঘর মুছতে দেখে তুলকালাম করল। এরপর শুক্রবার দিন আমরা ঘুরতে গেলাম। সেদিনের পর থেকে আমি নিজেকে খুব গুটিয়ে ফেলেছি। সেদিন আমি দুটো বিশাল ভুল করেছি। এ ধরনের ভুল আর করা যাবে না।
সেদিন গাড়ি নিয়ে অনেকক্ষণ শহরতলীর এদিক ওদিক ঘোরাঘুরির পর মু্কুল একটা বিশাল বাড়ির সামনে এসে গাড়ি দাঁড় করিয়েছিল। ও নিজে গাড়ি থেকে নেমে বাইরে চলে গেল আমাকে একবার কিছু বলল পর্যন্ত না। কিছুক্ষণ বসে থেকে আমিও নামলাম। বিশাল বড় বাড়ি, সামনে লোহার গেট। ভেতরে বিস্তৃত উঠান দেখা যাচ্ছে। গাড়ি বারান্দা পার হয়ে তারপর মূল বাড়ি। মুকুলকে দেখা যাচ্ছে, গেটে দাঁড়িয়ে কারো সঙ্গে কথা বলছে। তারপর দুজন একসঙ্গে বেরিয়ে এলো। ওর সঙ্গে সমবয়সি আরেকটা ছেলে। কাছে এলে মুকুল পরিচয় করিয়ে দিল
ফরহাদ, ও আমার বউ তুলি
আমি তার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললাম
স্লামালিকু্ম ফরহাদ ভাই। কেমন আছেন আপনি?
আমার অতিরিক্ত আন্তরিক ব্যবহার দেখে ভদ্রলোক একটু হককিচয়ে গেলেন। অবশ্য নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন
জি ভাবী ভালো আছি। আসেন ভেতরে আসেন। চা খেয়ে যান
আমরা একটু আগেই চা খেয়েছি ফরহাদ ভাই
তাহলে শরবত বা দুপুরে লাঞ্চ…
মুকুলের বোধহয় আমাদের এই অহেতুক আলাপচারিতা ভালো লাগছিল না তাই ও উপসংহার টানতে বলল
না আমাদের আরেক জায়গায় যেতে হবে। ওখানে গিয়ে লাঞ্চ করব। আজ আসি ফরহাদ
আরে যাবি তো, এত তাড়া কিসের? ভাবিকে উপহারটা দে
ফরহাদ ভাই একটা ছোট্ট বেতের ঝুড়ি মুকুলের হাতে এগিয়ে দিল। মুকুল ঝুড়িটা আমার হাতে চালান করে দিয়ে বলল
দেখতো তুলি পছন্দ হয় কিনা?
আমার তর সইছিল না দেখার জন্য যে এর মধ্যে কি আছে, কিন্তু কেন যেন ভয় করছিল। ছোট্ট একটা ঢাকনা দেয়া বেতের ঝুড়ি। কি থাকতে পারে ভেতর? ফুলের ঝুড়ি হলে তো ফুলগুলো বাইরে থেকে দেখা যেত। আমি কাঁপা হাতে ঝুড়িটা নিয়ে ঢাকনা খুলে হতভম্ব হয়ে গেলাম। ভেতরে ছোট্ট ফুটফুটে সাদা তুল তুলে একটা বিড়াল ছানা। । ঠিক আমার টুকটুকির মতন। ছোটবেলায় নানু ভাই আমাকে উপহার দিয়েছিল এরকম একটা বিড়াল ছানা। আমি ওর নাম রেখেছিলাম টুকটুকি। নানু ভাই মারা যাবার পর যখন আমরা বাড়ি বদল করে লালমাটিয়ায় যাই সে সময় ওকে কি করা হয়েছিল আমি জানিনা। কিন্তু আমি ওকে আর দেখিনি। কত রাত গেছে, আমি ঘুমের মধ্যে হাত বাড়িয়ে আমার টুকটুকিকে খুঁজেছি কিন্তু পাইনি। আজ হঠাৎ করেই এই ছোট্ট তুলতুলে বেড়াল ছানাটা আমাকে বহু বছর পেছনে নিয়ে গেল। যে আমি পণ করেছিলাম কোনদিন কাঁদবো না এমনকি বিয়ের দিন পর্যন্ত কাদিনি সেই আমি হঠাৎ করেই টের পেলাম আমার দু চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমেছে। আমি এক হাতে বিড়াল ছানাটাকে তুলে নিয়ে অন্য হাতে মুকুলকে জড়িয়ে ধরলাম।
কয়েক সেকেন্ড মাত্র। নিজেকে সামলে নিয়ে আমি কয়েক পা পিছিয়ে যেতেই দেখলাম মুকুল হতভম্ব মুখ করে তাকিয়ে আছে আর ফরহাদ ভাইয়ের ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি।
যতই অপ্রস্তুত হই না কেন আমি কখনোই সেটা বাইরে জাহির করি না, আজও করলাম না। ওদের দুজনকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে টুকটুকিকে ঝুড়ির ভেতর রেখে গাড়িতে উঠে বললাম
আজ আসি ফরহাদ ভাই আপনাকে অনেক কষ্ট দিলাম অসংখ্য ধন্যবাদ
ফরহাদ ভাই হেসে হাত নাড়লেন। মুকুল ড্রাইভিং সিটে এসে বসেছে। ওর হতভম্ভ ভাব তখনও কাটেনি। রাগে দুঃখে তখন আমার হাত কামড়াতে ইচ্ছা করছে। এত বড় ভুল আমি কি করে করলাম। এতটা আবেগপ্রবণ তো আমার হবার কথা নয়। ও ড্রাইভ করতে করতে একটু পর পর আমার দিকে তাকাচ্ছে। হয়তো বোঝার চেষ্টা করছে বিষয়টা কি। আমি ওকে একেবারেই গুরুত্ব দিচ্ছি না। টুকটুকি কে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছি। যদিও ভেতরে ভেতরে আমার তখন ইচ্ছা করছে নিজের দু গালে দুটো কষে থাপ্পর মারতে। এরকম একটা কাজ আমি কি করে করলাম? সেটাও আবার মাঝ রাস্তায় এত মানুষের সামনে। আর ঐ বদমাইশ ছেলে ফরহাদ আমাকে দেখে মুচকি মুচকি হাসছিল। আমি ঠিক করলাম জীবনে আর এই কাজ করা যাবে না, যদি করি তাহলে নিজের গালে দুইটা জুতার বাড়ি মারবো। । যেনতেন জুতা নয় একেবারে বাটার জুতা। যদিও দিন শেষে আমার আফসোস হচ্ছিল যে কেন বাটার জুতা পরে আসিনি কারণ দুপুরের পর এই ভুলটা আমি আবারও করলাম।
চলবে………