ভুল সত্য পর্ব-০৬

0
104

ভুল সত্য

আজকের সকালটা একেবারেই অন্যরকম। ঘুম ভেঙ্গেই মনে হল আজ ভালো কিছু হবে। অনেক অনেক বছর পর আমার এমন অনুভুতি হল। খুব ছোট বেলায় এমনটা হত। তখন আমারা ধানমন্ডি লেকের ধারে একটা একতলা বাসায় থাকতাম। মায়ের কাছে শুনেছি আমার জন্ম এই বাসাতেই। আমি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়াতে আদর যেমন পেয়েছি তেমনি ছোটবেলা থেকে অনেক দায়িত্বও নিতে হত। আমার যখন পাঁচ বছর তখন থেকে মাকে চাকরি করতে দেখেছি। সেসময় আমি থাকতাম নানুভাই এর সঙ্গে। উনি আমার মায়ের খালা। আমি ছটবেলা থেকেই তাকে আমাদের সঙ্গে থাকতে দেখেছি। সকাল হলেই মা বাবা দুজনেই অফিসে চলে যেত। আমি আর নানু ভাই থাকতাম। আমাদের একতলা বাড়ির সামনে বিশাল উঠান। উঠান পার হলে রাস্তা। রাস্তার ওপারে লেক।
বাবা মা বেড়িয়ে যাবার পর আমি সারাদিন উঠানে বসে খেলতাম। তখনো স্কুলে যাওয়া শুরু করিনি। দুপুর হলে নানুভাই গোসল করিয়ে ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিত। কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াত দুপুর গড়ালে। ঘুম ভেঙে দেখতাম শেষ বিকেলের কমলা রঙের রোদ আমার বিছানার পাশে মেঝেতে চার কোনা ফুলের নকশা তুলেছে। চোখ ডলে দেখতাম নানু ভাই বারান্দায় ফুল গাছে জল দিচ্ছে। আমাকে দেখে মিস্টি করে হেসে কোলে তুলে নিত। যতদিন নানুভাই বেচে ছিল আমার জীবনটা কেমন স্বপ্নের মতন ছিল। নানু ভাই চলে যাবার পর আমার জীবনটা এমনভাবে বদলে যাবে আমি কোন দিনও ভাবিনি। সে সব ভায়ানক দিনের কথা আমি ভাবতেও চাইনা।

সেই সব দিনের কথা মনে পরতেই সকালের ফুরফুরে মন ভালো হওয়া আমেজটা কেমন নষ্ট হয়ে গেল। আমি কথা না বাড়িয়ে নিচে নেমে গেলাম। নিচের পরিবেশ যেমনটা ভেবেছিলাম একেবারেই তেমন নয়। খাবার টেবিলে গরম গরম রুটি আলু ভাজি, সুজির হালুয়া পরিবেশন করা। আমার শাশুড়ি মুখ গোজ করে বসে আছেন। রান্নাঘর থেকে মোটাসোটা থলথলে এক মহিলাকে বেরিয়ে আসতে দেখলাম, তার হাতে গরম রুটি। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুকুল বলল
খেতে বস তুলি।
খালি বউরেই কবি, আমারে চোখে দেখস না?
আপনার বাড়ীতে আপনাকে বলতে হবে কেন? নিন খাওয়া শুরু করুন।
উনি আর কথা বাড়ালেন না। রুটি ছিড়ে ভাজি দিয়ে মুখে দিলেন; পরমুহূর্তেই মুখ বিকৃত করে বললেন
এমুন লেপের মতন মোটা রুটি খাওন যায় নাকি? ভাজিতেও তো লবন বেশী।
মোটা মিহিলাটি একটা বিরক্তি সুচক মুখভঙ্গি করল। মুকুল আমার প্লেটে রুটি আর আলুভাজি তুলে দিল। সাত সকালে এই মহিলা কোথা থেকে আমদানি হল আমি ঠিক বুঝলাম না। খাবার মুখে তুলতেই যাচ্ছিলাম এর মধ্যেই আমার শাশুড়ি হুংকার দিয়ে উঠলেন
ওই মাথারি, চিনি কি বাড়ি থেকা লোয়া আইসো? হালুয়ার মধ্যে কেউ এত চিনি দেয়?
এবার বোধহয় মহিলার ধৈর্যের বাধ ভাঙল। সে বেশ উচ্চস্বরেই বলল
যতটুক সুজি ততটুকই তো চিনি দিসি। এমুন ই তো দেই।
ওই বেটি। গলা নামায়া কথা ক
আমি নিরব দর্শকের মত দুজনের নাটক উপভোগ করছিলাম। মুকুলের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও খাবারে অতিরিক্ত মনযোগী। যেন এত উপাদেয় খাবার এই জীবনে আর খাওয়ার সুযোগ হয়নি। তাদের দৃশ্য তখনো চলছে। যবনিকাপাত হয়নি। এক পর্যায়ে মোটা মহিলা দাত মুখ খিচিয়ে বলল
ভাইজান এমুন হইলে কিন্তু আমি আর কাম করুম না
উনি তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন
করিস না। কে তরে পায়ে ধইরা সাদসে
মুকুল এবার মুখ তুলে বলল
মা অনেক ঝামেলা করে দারোয়ানকে বলে ওকে যোগাড় করেছি। একটু শিখিয়ে টিখিয়ে নেন। অন্তত যতদিন রেবা না আসছে।
আমার শাশুড়ি চকিতে একবার আমার দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়ে বললেন
না আইলে নাই। আমারা তিনটা মোটে মানুষ। কি এমুন কাম?
এত বড় বাড়ি। পরিষ্কার করার জন্য তো একজন লাগে।
ধোয়া মোছা করুক। রান্দনের দরকার নাই। ওই গুয়ের খাওন খাইতে চাই না
মুকুল গম্ভীর গলায় বলল
দরকার আছে। এখন নিশ্চই আপনি রান্না করতে বসবেন না
কেন তর বউয়ের হাতে কি মেন্দি লাগসে?
আমি আর তুলি বাইরে যাব। ফিরতে রাত হবে। আপনি কি খেতে চান খালা কে বলে দিন। কি করে করতে হবে বুঝিয়ে দিন।
একদিন আমি কষ্ট মস্ট কইরা চালায়া লমু। এরে বিদাই কর।
না মা। রেবা না আসা পর্যন্ত ওই থাকবে। তুলি এসব করতে পারবে না। আগামী সপ্তাহ থেকে ওর মাস্টার্সের ক্লাশ শুরু হবে।
আমি চট করে কিছু বলতে পারলাম না। মুকুল এত খবর কোথা থেকে পেল? নিশ্চই তিথি বলেছে। বাবা অবশ্য বিয়ের আগে ওর মা আর ফুপুদের বলেছিল যেন আমাকে মাস্টার্স করার সুযোগ দেয়। এরপর পাশ করে চাকরি বাকরি করব কিনা তা পরে ঠিক করা যাবে। মা অবশ্য এ নিয়ে কথা বাড়াতে চেয়েছিল কিন্তু বাবা দেয়নি। আমিও গাঁ করিনি। কি লাভ ঝামেলা করে। সবাই এক। উনিশ আর বিশ। মুকুল না হয়ে মকবুল হলেও এই হত। ব্যটা ছেলে সবাই এক। যদিও মুকুল সব রকম চেস্টাই করছে যেন আমি এখানে ভালো থাকতে পারি কিন্তু এ আর কয় দিন? আমার সঙ্গে এখনো সুবিধা করতে পারেনি তাই ভালো মানুষের ভঙ্গ ধরে আছে। দুদিন পরে আসল চেহারা বেরিয়ে আসবে। তবে এত কিছুর পরেও মুকুলের প্রতি আমার ঋণ ক্রমেই বাড়ছে। আজ ও যেটা করল, আমি আশা করিনি। ওর মা হয়ত ধরেই নেবেন আমি ওকে বলে এসব করিয়েছি। যাক ওদের ব্যপার, ওরা বুঝুক।
আমি আনমনা হয়ে এসব ভাবছিলাম, খাওয়ায় মনযোগ নেই। মুকুল বোধহয় সেটা লক্ষ্য করেই বলল
তুলি খেতে ইচ্ছা না হলে খেও না।
আমার শাশুড়ি বাকা হেসে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, আমি তার আগেই বললাম
না খাচ্ছি তো। হালুয়া অসাধারন হয়েছে খালা। রুটিটাও নরম তুলতুলে। সিদ্ধ আটা তাই না?
হ ভাবী। খালাম্মার যে কেন পছন্দ হইল না। বুজলাম না।
ওই বেটি, কথা কম ক। যা ফ্রিজ থেকা মুরগি বাইর কইরা ভিজা। আর পেপেটা চিকন কইরা কাট।
খালা গজগজ করতে করতে রান্নাঘরে চলে গেল।
মুকুল উপরে যাওয়ার আগে বলল
তুলি খাওয়া হলে রেডি হয়ে নাও।
আমি কথা বাড়ালাম না। চা খেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু পরিস্থিতি অনুকুলে না। এখন চায়ের কথা বললে আবার কি ঝড় শুরু হয়। বাইরে বের হলে বরং মুকুল কে বলব। মালাই চা কিনে দিতে। একটু অবাক লাগল। আমি কি ওর প্রতি একটু বেশিই নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছি। নিজের প্রতি নিজেরই একটু বিরক্ত লাগল। ওর সঙ্গে কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না কিন্তু বাসায় থাকার কথা ভাবতেও পারছি না।
আজ রিক্সা না নিয়ে আমরা গাড়ি নিয়ে বেড় হলাম। মুকুল কেমন গম্ভীর হয়ে আছে। আমরা কোনদিকে যাচ্ছি বুঝতে পারছি না। জিজ্ঞেস করতে ও ইচ্ছা করছে না।
চা খাবে তুলি?
খাওয়া যায়
আজও আমরা রবীন্দ্র সরোবরে দাড়িয়ে চা খেলাম। মুকুল সেদিনের মতো আমার সঙ্গে গল্প করল না। দূরে দাড়িয়ে ফোনে কথা বলতে লাগল। কি নিয়ে কথা হচ্ছিল জানি না গাড়িতে বসার পরে ও কেমন চুপ করে রইল, তারপর আচমকা বলল
আমার উপহারটা কি তোমার পছন্দ হয়নি তুলি?
হয়েছে তো, হবে না কেন?
বলতে বলতে আমি নাকের উপর হাত রেখে চমকে উঠলাম। আমার নাকফুলটা নেই।এমন তো হবার কথা নয়। নানু ভাই বলতো সোনার গয়না হারানো অশুভ লক্ষন। আমি ভয় পাওয়া গলায় বললাম
সেকি! আমার নোসপিন। কোথায় গেল? হায় আল্লাহ! কোথায় হারালাম আমি।
আমার অবস্থা দেখে মুকুল হেসে ফেলল তারপর আমার হাতটা টেনে নিয়ে পকেট থেকে নোসপিনটা বের করে আমার হাতে রাখল। আমি অবাক হয়ে বললাম
কোথায় ছিল এটা?
বিছানার পাশে মেঝেতে পরে ছিল।
আমি ওটা পরতে পরতে বললাম
আগে বললেন না কেন?
এমনি
স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে ওর মন খারাপ হয়েছে। আমার কিছু বলা উচিত। হয়ত কোমল কিছু কথা কিন্তু বলতে ইচ্ছা করছে না। আমি খুব ধৈর্যে ধরে অপেক্ষা করছি ওর মুখোশটা কখন খসে পরে সেটা দেখার জন্য। ও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে গাড়ি স্টার্ট দিল। আমরা যখন শহর ছেড়ে অনেকটা দূরে চলে এসেছি তখন আমি আস্তে আস্তে বললাম
আমার কোথায় যাচ্ছি?
তোমার জন্য কিছু অর্ডার করেছিলাম, সেটা আনতে।
আমি আর কিছু জানতে চাইলাম না, তবে এই রকম শহরতলীতে ও আমার জন্য কি অর্ডার করতে পারে সেটা জানতে ভীষণ কৌতূহল হচ্ছিল। আর যখন জানতে পারলাম তখন আমি এত বেশী খুশী হলাম যে স্থান কাল পাত্র ভুলে মাঝ রাস্তায় আমি, এই কঠিন হৃদয় তমালিকা কায়সার ওকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।
চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে