ভুল সত্য পর্ব-০৫

0
105

ভুল সত্য

যতটা বিনোদন হবে আশা করেছিলাম বিষয়টা ততটা বিনোদনমূলক হলো না। মুকুল ওর লম্বা লম্বা পা গুলো নিয়ে আমার সামনে এসে দাড়াল। আমি অবাক হবার ভান করে বললাম
আরে আপনি? এসে গেছেন। তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে আসুন। খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই। টেবিলে খাবার দিয়ে দিয়েছি।
মুকুক টেবিলের দিকে তাকিয়ে আরেক দফা হতভম্ব হল।
আমি নিজের প্রতিভায় নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এই ধরনের নাটকীয় ডায়লগ যে আমি কোনদিন দিতে পারব আশাই করিনি। অবশ্য আমাকে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। এই ধরনের ডায়লগ পঞ্চাশটা চ্যানেলের অন্তত ত্রিশটা নায়িকা প্রতিদিন বলছে। যদিও এসব ডায়লগ এর পরেও নায়িকাকে প্রতিনিয়তই চর থাপ্পড় খেতে হয়। যে নাটকের নায়িকা যত বেশি নির্যাতিত সেই নাটকের জনপ্রিয়তা ততই বেশী। প্রেম ভালোবাসা দেখতে দেখতে মানুষের চোখ পচে গেছে। এখন সবাই দেখতে চায় নায়ক, নায়িকাকে একটু পর পর থাপ্পর মারছে আর তারপর ঘুমিয়ে পরলে চোখে জল নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সবাই এই টাইপ ভালোবাসা দেখতে পছন্দ করে। মুকুল অবশ্য সিরিয়ালের নায়কদের মতন কিছুই করলো না

থমথমে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল
এতসব রান্না তুমি করছো?
ওই আর কি, তেমন কিছু না। আসলে কদিন ধরে রিচ ফুড খাওয়া হচ্ছিল তো তাই মা বললেন……
ঘর মুছতে ও কি মা তোমাকে বলেছে?
না না, ছি! উনি কেন বলবেন? আসলে রেবা ছুটিতে তো তাই………
রেবা ছুটিতে নাকি?
হ্য, কেন আপনি জানতেন না?
মুকুল জবাব দিল না। ধুপধাপ করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল

নিচে থেকেই শাশুড়ির ঘরের দরজায় টোকা দেয়ার শব্দ শোনা গেল। কিন্তু ভেতরে কোন উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় এর শব্দ পাওয়া গেল না।। এই বাড়ির এই ব্যাপারটা বেশ মজার সবকিছুই ঘটে কেমন নিরবে।

আমার কাজ শেষ। আমি ন্যকড়া বালতি রেখে ঘরে গিয়ে হাত্মুখ ধুয়ে নিলাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আচড়াচ্ছি তখনই মুকুল ঘরে ঢুকল। আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে সোজা ওরাশরুমে ঢুকে গেল।

সমীক্ষায় দেখা গেছে নারীদের গোসলের সময় পুরুষদের চেয়ে দুই মিনিট হলেও বেশী। পুরুষদের যদি সময় লাগে ৬.৩ মিনিট সেখানে নারীদের দরকার হয় ৭.২ মিনিটের। মুকুল নারী পুরুষ সবার মুখে কলঙ্ক লেপে দিয়ে তেত্রিশ মিনিট পর বেল হল। আমি তেপোর ভয়ে মানে তেলাপোকা শাশুড়ির ভয়ে নিচে নামলাম না। মুকুল কতটা কি বলেছে জানি না। এর পুরো প্রভাবটাই আমার উপর এসে পরবে। ডলা ব্যপারটা পুরোটাই নিম্নগামী। এমডি ম্যনেজারকে ডলা দেয়, ম্যনেজার অফিসারকে, অফিসার পিওনকে, পিওন বাড়ি গিয়ে তার বউকে, বউ ছেলেকে ইত্যদি ইত্যাদি। ভেবেছিলাম মুকুল বের হলে একসঙ্গে নামব। কিন্তু সেই আশা মনে হচ্ছে সুদুর চীনে । সময় কাটানোর জন্য আমি একটু সাজগোজ করে নিলাম। সিরিয়ালের নায়িকেদের মত শাড়ি চুড়ি টিপ পরে ফেললাম। মুকুল বেরিয়ে এসে আমাকে দেখে রীতিমত ধাক্কা খেল। প্রথম দিনের মত খানিকক্ষণ হা করে তাকিয়েই রইল। আমি মিস্টি করে হেসে বললাম
চলেন খেতে যাই

খাবার টেবিলে তেমন কিছুই হল না। আমি ভেবেছিলাম উনি হয়তো খেতেই নামবেন না। কিন্তু আমার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে উনি আমাদের সঙ্গে খেতে বসলেন; এমনকি পটলের খোসা দিয়ে চিংড়ি মাছের ভর্তার প্রশংসাও করলেন। মুকুল অবশ্য কয়েকবারই রান্নার প্রশংসা করেছে।

খাওয়া শেষ করে করে মুকুল উপরে চলে গেল। আমি টেবিল গুছিয়ে উপরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তখনই আমার শাশুড়ি পেছন থেকে ডেকে বললেন
শুনো, সব কথা জামাইয়ের গলা ধইরা কইতে হয় না। কিছু কথা নিজেগো মধ্যেও রাখোন লাগে। বুঝতে পারসো?
আমি আস্তে করে বললাম
গলা ধরিনি তো, তবে আপনি বললে………
এই বলে আর দাড়ালাম না, একরকম দৌড়ে উপরে চলে এলাম। পেছন থেকে বলতে শুনলাম
বেয়াদ্দব মাইয়া! ফাজিলের ঘরের ফাজিল

আমাকে হাসিমুখে ঘরে ঢুকতে দেখে মুকুল চোখ তুলে তাকালো। তারপর বলল
বাইরে যাবে তুলি?
আমার মুখ শুকিয়ে গেল। এই রে! এই বুঝি আমাকে কোন সিনেমা হলের কোনার সিটে বসিয়ে দেবার তাল করছে। তারপর সিনেমা দেখার চাইতে সিনেমা করাতে ব্যস্ত হয়ে যাবে। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম
বাইরে কোথায়?
এমনি চল, একটু রিক্সা করে ঘুরে আসি
রিকশার কথা শুনে আমি একটু আশ্বস্ত হলাম, যাক অন্তত সিএনজি তে উঠাতে চায় নি। আমি বললাম
তাহলে চেইঞ্জ করে নেই
চেইঞ্জ করতে হবে না। এমনই সুন্দর লাগছে।

আমরা অনেকক্ষণ রিক্সা করে ধানমন্ডির লেকের এদিক ওদিক ঘুরলাম। রবীন্দ্র সরোবর থেকে চা ও নিলাম। মুকুলের ব্যপার-স্যাপার আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ মনে হচ্ছে। তিনদিন হয়ে গেল মুকুল একবারের জন্য আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করেনি। এমনকি রিক্সায় বসেছে আমার হাত পর্যন্ত ধরার চেষ্টা করেনি। কেমন বন্ধুর মতন আচরণ করছে। এদিক-ওদিককার গল্প করছে। আমার অবশ্য খারাপ লাগল না। তিথির সঙ্গে ওর ভাইয়ের অনেকটাই মিল। কেমন একটা সহজ সাবলীল ব্যাপার আছে দুজনের মধ্যেই।

অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরির পর মুকুল জিজ্ঞেস করল
আর কোথাও যাবে তুলি?
আর কোথায়?
চলো তিথিদের বাসায় যাই
আমার মনটা খুশিতে নেচে উঠল। আমি ভাবতেই পারিনি মুকুল এই কথাটা বলবে।

তিথিদের বাসায় আজ অনেক লোকের ভিড়। মেঝ চাচার অফিসের কলিগেরা দাওয়াতে এসেছেন। ওদের ফ্ল্যাটে জায়গা হচ্ছে না তাই তিথিদের বাসায় মহিলাদের বসানো হয়েছে। রেহানা আন্টি ভীষণ ব্যস্ত। তবু আমাদের দেখে খুশি হলেন ভীষণ। তিথি সব কাজ ফেলে আমাকে নিয়ে ছাদে চলে গেল।মুকুলকে মেঝচাচা ধরে নিয়ে গেলেন কলিগদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন বলে।

তিথিদের ছাদটা এমনিতেই সুন্দর। রাতের বেলা আরও সুন্দর লাগে। হাসনাহেনার সুগন্ধে মন ভরে যায়। বেশিক্ষণ গল্প করা গেল না, নিচে থেকে ডাক এল। সিড়ি দিয়ে নামার সময় শাড়িতে পা বেঁধে শাড়ি টাড়ি খুলে একাকার অবস্থা হলো। এমনিতে হলে আমি সামলে নিতাম কিন্তু মুকুল তখন সিঁড়ি দিয়ে উঠছিল। ওর সামনে এই অবস্থা হওয়াতে অস্বস্তিতে পড়তে হলো খুব। মুকুল হয় বোধ হয় সেটা বুঝতে পেরেই চট করে ভেতরে ঢুকে গেল। তিথি আমাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল
কিরে তুই ভাইকে দেখে অমন লজ্জা পেয়ে গেলি কেন?
আমি শাড়ির কুচি ঠিক করতে করতে বললাম
লজ্জা না পাওয়ার কি আছে?
বরের সামনে আবার এত লজ্জা কিসের? তোদের মধ্যে সব ঠিক আছে তো? দেখিস আমার ভাইটাকে ঠকাস না। তোকে কিন্তু অসম্ভব ভালোবাসে।
পরের কথাটা আমার কানে গেল না কিন্তু প্রথম কথাটা কেমন মাথার মধ্যে গেঁথে গেল। আমি কি সত্যিই কাউকে ঠকাচ্ছি? এই জীবনে আমি কারো পাওনা বাকী রাখিনি। তা সে আমার সঙ্গে ভালো আচরন করুক কিংবা খারাপ।

ফেরার সময় পুরোটা পথ আমি কেমন আনমনা হয়ে রইলাম। তিথির কথাটা মাথা থেকে সরাতেই পারছিলাম না। রাতের বেলা যখন মুকুল ল্যপটপ নিয়ে অন্য ঘরে যেতে উদ্যত হল, আমি ওকে ডেকে বললাম
কোথায় যাচ্ছেন?
একটু কাজ আছে। তুমি ঘুমিয়ে পর
একটু দাড়ান, আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা আছে।
হ্য বল।
আপনি এখানে থাকতে পারেন। আমি কারো প্রাপ্য থেকে তাকে বঞ্চিত করি না।

মুকুল প্রথমে আমার কথাটা বুঝতে পারল না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর হো হো করে হেসে উঠলো।

আমি একটু বিরক্ত হয়ে বললাম
হাসছেন কেন?
হাসির কথা বললে তো হাসবই

আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, মুকুল আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল

আমিও আমার পাওনা ছেড়ে দেই না।তবে আমি বিজনেসের স্টুডেন্ট তো, আপাতত ইনভেস্ট করছি সময়মতো সুদে আসলে উসুল করে নেব।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে