ভুল সত্য পর্ব-০৮

0
112

ভুল সত্য

দুপুরে কি খাবে তুলি?

টুকটুকি আমার বুকের মধ্যে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরেছিল। আমি ওর শরীরে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম
যা খাওয়াবেন তাই খাব
মুকুল ড্রাইভ করতে করতেই চকিতে একবার আমার দিকে তাকাল, তারপর বলল
ওর নাম কি রাখবে?
টুকটুকি
বাহ! খুব সুন্দর নাম। আর ও কোথায় থাকবে? জানো তো মা বিড়াল একেবারেই পছন্দ করে না
আমার ভেতরটা হঠাত করেই কেমন নিভে গেল। এত বছর পর মনে হয়েছিল আমি আবার আমার শৈশবে ফিরে গেছি এখন সবাই আবার ওকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবে? আমার অবস্থা দেখে মুকুল হেসে ফেলল।
– রিল্যাক্স। ও আমদের বারান্দায় থাকবে। শুধু খেয়াল রেখ যেন মায়ের ঘরে না যায়।
– কিচ্ছু চিন্তা করবেন না আমি ওর জন্য একটা হাউজ কিনে নেব। অনলাইনে অর্ডার দিয়ে দেব আজই। ও একটু ও বিরক্ত করবে না কাউকে। প্রমিজ।
– আর ওকে কি খেতে দেবে? ক্যট ফুড ও অর্ডার দিয়ে দিও
– না না। দোকানের এসব খাবার হেলদি না, আমি ওকে বাসার খাবার খাওয়াব
– ওর জন্য কি আলাদা রান্না হবে? তাহলে নাজনীন কে বলে দিও
আমি বুঝতে পারছি না মুকুল কি ইচ্ছে করেই এমন বোকা বোকা কথা বলছে? নাকি আমার সঙ্গে মজা নিচ্ছে? আমি বোঝার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। বিড়াল নিয়ে আরো অনেকক্ষণ টুকটাক কথা হল। কথা বলতে বলেন কখন যে আমরা শহরতলী ছেড়ে গ্রামের কাচা রাস্তায় উঠেছি টেরই পাইনি। মুকুল কাচা রাস্তার একপাশে গাড়ি পার্ক করে আমাকে নামতে বলল।

আমি সামনে তাকিয়ে দেখলাম একটা কাচা মাটির ঘর ওপরে খড় দেয়া। এমন ঘর আজকাল খুব একটা দেখা যায় না। আমার ছোট বেলায় আমি নানা বাড়িতে গেলে দেখেছি। নানাবাড়ি শহর ছেড়ে একটু ভিতরে। বাড়ির চারদিকে আম বাগানে, দক্ষিণ কোনে পুকুর ঘাট। তবে সবকিছুতে আধুনিকতার ছোয়া। আমার বরং বেশি ভালো লাগত নানা ভাইয়ের বাসায়। আগেও বলেছি নানা ভাই আমার মায়ের খালা। তার বিয়ে হয়েছিল গ্রামেই। শশুড় বাড়ি আর একটু ভেতরের দিকে। ছোটবেলায় নানাবাড়িতে এলে আমরা ওখানে ও যেতাম। ছোট্ট মাটির ঘর। উঠোন পেরুলে পুকুর ঘাট। নানা বাড়ি এলে আমি উন্মুখ হয়ে থাকতাম কখন ওখানে যাব। নানা ভাইয়ের একটাই মেয়ে সালেহা খালা ও আমাকে খুব ভালোবাসত। সালেহা খালার বিয়ে হয়ে যাবার এক বছরের মাথায় নানাভাই এর স্বামী মারা যায়। একা একা উনি এই অজ পাড়া গায়ে পরে থাকবেন তাই মা তাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল। প্রতি বছর গরমের ছুটিতে আমরা এখানে আসতাম। সালহা খালা ও সেসময় শশুর বাড়ি থেকে বেড়াতে আসত। ভারি মজা হত তখন। আমরা চড়ুইভাতি করতাম, সারা পুকুর দাপিয়ে সাতার কাটতাম।

আমার সাতারের হাতেখড়ি সালেহা খালার হাত ধরে। পরে অবশ্য বাবা আমাকে মহিলা কমপ্লেক্স থেকে সাতার শিখিয়েছে। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান বলে তাদের যত অপূর্ন ইচ্ছা সব আমাকে দিয়ে পুরন করতে চেয়েছিলেন। তাই ছোট বেলায় আমি নাচ, গান, ছবি আকা, সাতার সবই শিখেছি। যদিও তারা কেউ কখনো জানতে চায়নি আমার কোনটা ভালো লাগে। একবার অবশ্য বলতে গিয়ে এমন ধাতানি খেয়েছি যে পরবর্তীতে আর সাহস হয়নি। মা চোখ পাকিয়ে বলেছিল
রান্নাবান্না তো শশুর বাইতে গেলে সারা জীবনই করবি। এটা আবার শখ করে শেখার কি আছে।
বাবা বলেছিলেন
তুমি সুযোগ পেয়েছ তো তাই মর্ম বুঝতে পারছ না। তুমি যতটা পাচ্ছ তার জন্য কত ছেলেমেয়ে হাহাকার করে মরে।
আমি বুঝে গিয়েছিলাম আমার ইচ্ছে অনিচ্ছের কোন মুলা তাদের কাছে নেই। তাই নিজেই ইউটিউব দেখে বেকিং শিখতাম। নানাভাই মারা যাবার পর ইউটিউব আমার সবচেয়ে বড় সঙ্গি হয়ে উঠেছিল। দেশি কন্টিনেন্টাল চাইনিজ সবই শিখেছিলাম ইউটিউব দেখে। বাবা আমাকে কুকিং ক্লাসে ভরতি না করলেও যখন যা লাগবে এনে দিত। আমার বানানো ব্রাউনি পিজা মুজ কেক খেয়ে প্রয়াংশাও করত খুব। মা অবশ্য বিরক্ত হত। সবচেয়ে বেশি খুশি হত আশরাফ চাচা। আমার রান্নার সবচেয়ে বড় ভক্ত ছিলেন তিনি। এত প্রশংসা করতেন যে আমি মঝে মাঝে লজ্জাই পেয়ে যেতাম। আমার প্রথম বানানো মুজ কেক খেয়ে বললেন
যে হাতে এই কেক বানানো হয়েছে সেই হাতটাই তো চেটেপুটে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। প্রিন্সেস আরেক পিস পেতে পারি কি?
আমি প্লেটে তুলে দিতে গেলে বললেন
উঁহু খাইয়ে দাও।
এবং খাওয়ানোর সময় সত্যি সত্যিই আমার আংগুল চেটে খেতে লাগলেন। তখন আমার বয়সে এগারো। সেসময় তার অভিপ্রায় বুঝতে পারিনি। বুঝেছিলাম আরো এক বছর পরে।

তুলি ভেতর এস
আমি চমকে তাকালাম। ভাবনায় জাল ছিড়ে বেরিয়ে এলাম। মুকুল আমার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেল। আজ কেন জানি ওর হাত ধরাটা খারাপ লাগল না। আমি সামনে তাকিয়ে দেখলাম উঠানে বিশাল রান্নার আয়োজন। লাকড়ির চুলার সামনে যিনি বসে আছেন তার বয়স পঞ্চাশের উপর হলেও মুখে কেমনে একটা শিশু সুলভ লাবন্য। কোন এক অদ্ভুত কারনে তার মুখটা ভিষণ চেনা চেনা লাগছে। মনে হচ্ছে কোথায় যেন দেখেছি।

আমরা কাছে গেলে মুকুল পরিচয় করিয়ে দিল। এবার আমি তাকে চিনতে পারলাম। ওর নাম মরিয়ম বিবি। উনি একজন বিশিষ্ট ইউটিউবার। তার চ্যনেলের ফলোয়ার লক্ষধিক। ভিডিওগুলো বেশ সুন্দর গ্রাম্য পরিবেশে, মাটির হাড়িতে লাকড়ির চুলায় রান্না হয়। কখনো দেশি রান্না করতে হলে আমি তার ভিডিওই দেখি। কিছু দিন আগে তার চ্যানেলে দেখেছিলাম যে প্রতি শুক্রবার এই যায়গাটা ভাড়া নেয়া যায়। মুকুল আমাকে এখানে নিয়ে আসবে ভাবিনি।

মরিয়ম বিবিকে আমার খুব ভালো লাগল। ভিষন আন্তরিক। যদিও আমার উঠানে বসে তার রান্না দেখতে ইচ্ছা করছিল কিন্তু মুকুল বলল আগে যায়গাটা ঘুরে দেখতে। আমাদের জন্য একটা মাটির ঘরের ব্যবস্থা আছে। আমরা আমাদের ব্যগ পত্র আর টুকটুকিকে সেখানে রেখে চারপাশটা ঘুরে দেখলাম। যায়গাটা খুব বেশী বড় নয় তবে সব গোছানো আর খুব পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। মাটির ঘরের কোন ঘেষে সিমের গাছ লতিয়ে উঠেছে। বেগুনি ফুল ফুটে আছে। দুই একটা কচি সিম ও উকি দিচ্ছে। বাড়ির পেছনে দুটো কলা গাছ। একটা পেয়ারা আর কোনার দিকে একটা কামরাঙা গাছ ও দেখলাম। তবে আমার সব চাইতে ভালো লাগল পুকুর ঘাট। বাধাই করা ঘাট। একেবারে নির্জন। আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুকুল বলল
পানিতে নামবে?
এক্সট্রা ড্রেস আনলে নামতাম
আমি এনেছি তুমি চাইলে নামতে পারো
এবার আমি বুঝলাম মুকুলের এত বড় ব্যগের রহস্য। আমি আর সময় নষ্ট না করে তরতর করে সিড়ি বেয়ে নেমে পানিতে ঝাপিয়ে পরলাম। প্রথমে পানি ঠান্ডা মনে হলেও পুকুরের মাঝ বরাবর আসতে আসতে টের পেলাম নিচের দিকের পানি বেশ উষ্ণ। পুকুরের ঠিক মাঝখানে এসে আমি মাথা তুললাম। পানি একেবারেই অগভীর। আমার গলা পর্যন্ত হবে। আমি স্যামনে তাকিয়ে দেখলাম মুকুল সিঁড়ির শেষ ধাপে দড়িয়ে অপলক চেয়ে আছে। আমি ওখান থেকেই চেঁচিয়ে বললাম
আপনি ও নামেন
ও কিছু একটা বলল, এতদুর থেকে শোনা গেল না। আমি সাঁতরে আবার ঘাটে ফিরে গেলাম তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললাম
আসেন, আপনিও নামেন

মুকুল কেমন বিষন্ন চোখে তাকিয়ে রইল। আমার প্রথম একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। আমার পরনের শাড়ি ভেজা, শরীরের সঙ্গে লেপ্টে আছে। তাকিয়ে দেখলাম মুকুল আমাকে দেখছে না করুণ চোখে পানির দিকে তাকিয়ে আছে। আমি সিড়ির ধাপে উঠে বললাম
কি হয়েছে?
কিছু না, তুমি সাঁতার কাটো
আপনি আসছেন না কেন?
আমি পানিতে নামতে ভয় পাই। ছোটবেলায় একবার ডুবে গিয়েছিলাম তারপর আর কখনো নামিনি
আমি এগিয়ে এসে বললাম
কিছু হবে না, এইটুকু পানিতে আপনি ডুববেন না। আসেন তো
মুকুল আমার সঙ্গে পানিতে নেমে এলো। আমি ওর হাত ধরে মাঝ বরাবর নিয়ে এসে থামলাম। এখানে ওর বুক অবধি পানি।। আমি ওকে দাঁড় করিয়ে রেখে চারদিকে সাঁতার কাটতে লাগলাম। হঠাৎই মনে হল ও টাল সামলাতে পারছে না। ভারসাম্য হারিয়ে পড়েই যেত আমি দ্রুত এসে ওকে ধরে ফেললাম। ওর মুখের দিকে তাকাতে সাহস হচ্ছিল না। পানিতে একবার যার ভয় জন্মায় সেটা থেকে বেরিয়ে আসা এত সহজ নয়। আমি ওর বুকের মধ্যে মাথা রেখে টের পেলাম হৃদস্পন্দন অনেক দ্রুত। আমি ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম
ভয় নেই, সব ঠিক আছে। আমি আছি তো
মুকুল যে কাজটা কখনই করেনা আজ সেটাই করল; দুই হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করল আমি তার কি জবাব দেবো বুঝতে না পেরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।

চলবে……….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে