বৃষ্টি এসো সাঁঝের বেলা ১২তম এবং শেষ পর্ব

0
1917

#বৃষ্টি_এসো_সাঁঝের_বেলা
#১২তম_এবং_শেষ_পর্ব
#অনন্য_শফিক


আমি জিজ্ঞেস করলাম,’বিন্দু কে মা?’
মা বললেন,’বিন্দু নিতুলের বোন।আপন বোনের চেয়েও বেশি। নিতুল যখন ক্লাস সিক্সে পড়ে তখন ওর একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল। পিকনিকে যে গাড়ি দিয়ে গিয়েছিল সেই গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছিল। এক্সিডেন্টের পর নিতুলের অবস্থা ছিল ভয়াবহ। তখন তার ব্লাডের প্রয়োজন হলো।ব্লাড কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না কারণ নিতুলের ব্লাডের সাথে মিলছিলো না কারোর ব্লাড গ্রুপ।বিন্দু তখন জানালো তার মায়ের সাথে নিতুলের ব্লাড গ্রুপের মিল আছে।আর সে নিজে আহত হওয়া সত্ত্বেও আমায় নিয়ে তাদের বাসায় ছুটে গেল।আর তার মাকে গিয়ে বললো আমার সাথে এক্ষুনি হসপিটালে চলো মা। আমার ভাইটা মরে যাচ্ছে।তার মা তখন জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলেন না কে তোমার ভাই! তার পরনে যে কাপড় ছিল সেই কাপড় পরেই তিনি আমাদের সাথে হসপিটালে গিয়ে নিতুলকে ব্লাড দিয়েছিলেন।আর সেদিন থেকেই তারা রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল।নিতুল আর বিন্দুর মধ্যে গড়ে উঠেছিল ভাই-বোনের এক সুন্দর সম্পর্ক।’
আমি মার কথা শুনে চুপ হয়ে রইলাম। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে কোথাও একটা বড় ধরনের ভুল করে ফেলেছি আমি। কিন্তু এই ভুল শুধরানোর উপায় কী?

শুভ্র ফিরছে না।বাবা শক্ত সামর্থ্য মানুষ।
তাকে কোনদিন আমি কাঁদতে দেখিনি। কিন্তু তিনি আজ হসপিটালের বারান্দায় ধুলোবালির উপর বসে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদছেন।তার সাথে বসে কান্নায় গলা মিলিয়েছে মা,আর নিতুলের ছোট বোন রুম্পা। এই মুহূর্তে কী করবো আমি বুঝতে পারছি না। মন প্রাণ দিয়ে আল্লাহকে ডেকে যাচ্ছি আমি। হঠাৎ নিতুলের এক বন্ধু বললো,’ব্লাড ম‍্যানেজড হয়েছে।’
বাবা বসা থেকে লাফিয়ে উঠে বললেন,’কীভাবে হয়েছে?’
‘শুভ্র পাঠিয়েছে।বিন্দু প্র‍্যাগনেন্ট।তাই তার ব্লাড এখানকার ডাক্তাররা নিবে না। ঝামেলা হবে।বিন্দু তাই ছোট খাটো একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে গিয়ে তার ব্লাড প‍্যাক করে পাঠিয়েছে।’
বাবা বললেন,’আদহামদুলিল্লাহ।’
কিন্তু মা কেমন যেন মনমরা হয়ে উঠলেন। তিনি নিতুলের বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলেন,’বিন্দুর কী বিয়ে হয়ে গিয়েছে?’
‘আন্টি সেসব কথা পরে বলা যাবে।’
‘না এক্ষুনি বলো। আমি এখন শুনতে চাই!’
নিতুলের বন্ধু বললো,’বিন্দু একটি ছেলেকে ভালো বাসতো।কিন্তু তার বাবা মা এটা কিছুতেই মেনে নেননি।তাই সে গোপনে তার বাবা মাকে না জানিয়ে এই ছেলেটিকে বিয়ে করেছিল। সেই ছেলে তার সাথে পাঁচ মাস বৈবাহিক সম্পর্ক রেখে হঠাৎ উধাও হয়ে গেছে।পরে খবর নিয়ে জানা গেছে এই ছেলে ঠগ ছিল।সে আরো অনেক মেয়ের সাথেই এমন করেছে।এখন এই ছেলে আছে ইংল‍্যান্ডে।’
কথাটা শুনে মায়ের চোখ থেকে টুপ করে দু ফোঁটা জল এসে গড়িয়ে পড়লো তার গালের উপর।আর আমার চোখ থেকেও। আহারে!এমন একটা দুঃখী মেয়ের ব‍্যাপারে আমি কী নোংরা ধারণা পোষণ করেছিলাম মনে মনে!আর তাকে কী অপমান টাই না আমি করেছিলাম।
মা নিতুলের বন্ধুটিকে জিজ্ঞেস করলেন,’বিন্দুর বাবা মা কী এই ব‍্যাপারে কিছু জেনে গেছে?’
নিতুলের বন্ধু বললো,’জেনে গেছে।জেনে গেছে বলেই তো তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। বিন্দু এতো দিন নিতুলের আশ্রয়েই ছিল।’
মা তখন আফশোস করে বলে উঠলেন,’আহারে দুঃখী মেয়ে আমার!’
আমি ঝাঁপসা চোখে তখন তাকিয়ে রইলাম হসপিটালের গেটের উপর। কেন জানি আমার মন বলছে বিন্দু এক্ষুনি আসবে।আর সে যদি আসে সর্ব প্রথম আমি তার পা ছুঁয়ে মাফ চাইবো।

নিতুলের অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে।ওকে এখন আলাদা কেবিন দেয়া হয়েছে। সেই কেবিনে মা বাবা সহ সবাই প্রবেশ করেছে। মা নিতুলের কপালে চুমু খেয়ে বললেন,’আমার বাবা। আমার কলিজার টুকরা!’
নিতুল কেঁদে ফেললো। কেঁদে কেঁদে সে বললো,’মা,আমি বড় ভুল করে ফেলেছি মা। আমার উচিৎ ছিল তোমাদের জানানো!আর পৃথুর কোন দোষ নেই।ও রাজিই ছিল না। ওকে আমি জোর করে বিয়ে করেছি।’
মা নিতুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,’আমরা তোর উপর নারাজ না বাবা। তুই যাকে নিয়ে ভালো থাকবি তাকেই আমরা মেনে নিবো। তাছাড়া পৃথুতো আমাদের ঘরেরই মেয়ে।ঘরের মেয়ে ঘরে থাকবে তাতে সমস্যা কী!
কিন্তু সমস্যা হলো এখানে যে তুই একটা মেয়েকে জোর করে বিয়ে করেছিস।জোর করে বিয়ে করা বর্বর সমাজের নিয়ম। আমাদের সভ‍্য সমাজ কিছুতেই এটা মেনে নিতে পারে না।’
নিতুল বললো,’মা ও মনে মনে রাজিই ছিল আমার প্রতি। কিন্তু আমি সত‍্যিই এটা বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। আমি তোমাদের সবার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী!’
মা বললেন,’ঠিক আছে। এখন আর বাহানা করে লাভ নাই।বউমার কাছে তুই মাফ চেয়ে নিস।যার কাছে অপরাধ করেছিস তার কাছে মাফ চাইবি।’
মার মুখে বউমা ডাক শুনে লজ্জায় আমার মাথা ঝুঁকে আসছিলো। ঠিক তখন আমায় জাপটে ধরে মার কাছে টেনে নিলো রুম্পা।মার কাছে নিয়ে বললো,’তোমার বউমাকে বরণ করো।’
মা মিষ্টি করে হেসে বললেন,’বউমা এখন পুরোনো হয়ে গেছেন। তাকে আর নতুন করে বরণ করার কোন প্রয়োজন নেই।’
মার কথা শুনে কেবিনের সবাই হেসে ভেঙে পড়লো। এমনকি যে বাবা সারাটা জীবন শুকনো মুখে থেকে তার জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন সেই বাবাও হা হা করে হেসে উঠেছেন।তার হাসি দেখে মা বললেন,’এইভাবে হা করে হাসলে তো তোমার মুখে মশা মাছি ঢুকে যাবে!’
মার কথা শুনে বাবা রাগে মুখ বন্ধ করে দিলেন।
কিন্তু মা যখন আবার বললেন,’দ‍্যাখো দ‍্যাখো পুত্রবধূকে পছন্দ হয়নি বলে শশুর তার মুখকে ব‍্যাঙের মুখের মতো ফুলিয়ে রেখেছেন!’
এই কথা শুনে বাবা এমন জোরে হাসলেন যে এক নার্স এসে ধমকে দিলো পর্যন্ত বাবাকে। নার্স এসে বললো,’এটা কী বিয়ে বাড়ি নাকি যে এখানে গলা ছেড়ে হাসবেন?’
বাবা তখন রঙ্গ করে বললেন,’আপনি দেখি ভীষণ বোকা মানুষ!বিয়ে বাড়ি না হলে কী আমরা এভাবে গলা ছেড়ে হাসতাম।’
নার্স বেটি বাবার এমন মসকরা শুনে মুখ ঝাড়ি দিয়ে কেবিন থেকে পা নাচিয়ে দ্রুত হেঁটে বের হয়ে চলে গেল।মা তখন বললেন,আসো আমরাও সবাই বের হয়ে যাই। এখন স্ত্রী তার স্বামীর সেবা করুক।’
একে একে সবাই বের হয়ে গেলে আমি নিতুলের পাশে এসে বসলাম।নিতুল তখন আমার একটা হাত তার দু হাতের মুঠোয় টেনে নিয়ে বললো,’তুমি আমার প্রতি ক্রোদ্ধ তাই না?’
আমার চোখে কেন জানি হঠাৎ জল এসে গেছে। আমি সেই জল খুব কষ্টে গোপন করে বললাম,’না আমার কোন রাগ নেই।’
‘আমি যে তোমার সাথে বিয়ের আগে অসভ‍্যতা করেছি এই জন্য তো রাগ আছে?’
‘ছিল। কিন্তু এখন আর নেই। স্বামীর উপর রাগ রাখা ঠিক নয়।’
‘তুমি কী আমায় খুশি মনে তোমার স্বামী হিসেবে মেনে নিয়েছো?’
‘হ‍্যা নিয়েছি।’
‘কেন নিয়েছো? আমি তো খারাপ মানুষ। খারাপ মানুষ ছাড়া কী কেউ একটা মেয়ের সাথে বিয়ের আগে এসব অসভ‍্য‌‌ কাজ করে ,আর জোর করে বিয়ে করে?’
‘তুমি খারাপ মানুষ নও। মানুষ তার ভুল বুঝতে পারলে সে আর খারাপ মানুষ থাকে না। ভালো মানুষ হয়ে যায়।’
নিতুল আমার হাতটা আরো শক্ত করে ধরে বললো,’ভালো মানুষকে তবে কী ভালোবাসা যায়?’
আমি ওকে জড়িয়ে ধরে ওর কানের কাছে আমার ঠোঁট নিয়ে ফিসফিস করে বললাম,’একশোবার বাসা যায়। আমি তোমায় ভালোবাসি।আই লাভ ইউ।’
নিতুল মিষ্টি করে হেসে আমার কপালে আলতো চুমু এঁকে দিয়ে বললো,’আই লাভ ইউ টু পৃথু।’
তারপর আমরা দুজন চোখাচোখি হলাম।নিতুলের চোখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো এটাই আমার প্রথম প্রেম এবং এটাই আমার শেষ প্রেম।
এর মধ্যেই কেবিনে এসে ঢুকলো শুভ্র।সে এলো একা। শুভ্র এসেই বললো,’নিতুল,বিন্দুকে ধরে রাখতে পারলাম না রে!’
নিতুল চমকে উঠে বললো,’মানে?’
শুভ্র বললো,’বিন্দু ছাড়া আর কারোর সাথে তোর ব্লাড গ্রুপ মিলছিলো না।তাই আমি তোর ভাড়া করে রাখা বাসায় গিয়েছিলাম বিন্দুর কাছে। কিন্তু সে বললো সরাসরি এখানে এসে ব্লাড দিতে চাইলে ডাক্তার তার প্র‍্যাগনেন্সির জন্য ব্লাড নিতে চাইবে না।তাই সে একটা ছোট্ট প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে যায় আমায়।আর ওখানে ব্লাড দিয়ে সে হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। আমি সেই ব্লাড একজনের মাধ্যমে এখানে পাঠিয়ে সারারাত ভর তাকে খুঁজেছি কিন্তু কোথাও তাকে পাইনি। অবশ্য আমরা যখন ক্লিনিকে যাচ্ছিলাম তখন বিন্দু বলেছিল,আমি কোনদিন নিতুল কিংবা পৃথুর সামনে যাবো না। কোনদিন না।সে মনে হয় তার সংকল্প রাখার জন্যই আড়ালে চলে গেছে!’
নিতুল ওর কাছ থেকে এইসব কিছু শুনে দরদর করে চোখের কোল ছাপিয়ে জল ফেলে দিলো। আমার চোখ থেকেও নেমে এলো জল।এর জন্য তো আমিই দায়ী। কেন আমি সেদিন এমন আচরণ করেছিলাম ওর সাথে? আমার তো সবকিছু আগে জেনে নেয়া উচিৎ ছিল!
আমি ভুল করে ফেলেছি। মস্ত বড় ভুল।
তারপর নিতুল সুস্থ হয়ে গেলে সেও সারাটা দেশ তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে বিন্দুকে। কিন্তু কোথাও তার ছায়াটুকু পর্যন্ত মিলেনি।

——
সাত বছর পর–


আমাদের এক কন‍্যা সন্তান হয়েছে।কন‍্যার বয়স দের বছর।নিতুল তার কন‍্যার নাম রেখেছে বিন্দু।বিন্দুর স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্যই এই নাম দেয়া।আর আশ্চর্য বিষয় হলো আমাদের কন‍্যার চেহারায়ও বিন্দুর চেহারার স্পষ্ট ছাপ আছে।কী অদ্ভুত বিষয়!
কদিন আগে আমরা সিলেট গিয়েছিলাম শাহজালাল (রহঃ) এর মাজার জিয়ারত করতে। ওখানে গিয়ে একটা পাগলি মেয়ে দেখে থমকে উঠলাম। পাগলি মেয়েটার কাছে বসে পুতুলের মতো সুন্দর একটা ছেলে খেলছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে নিতুলকে বললাম,’এই নিতুল, দেখতো এটা কে? পাগলি টাকে বিন্দুর মতো লাগছে না?’
বিন্দুর চোখের নীচে একটা কাঁটা দাগ আছে। এই পাগলীটার চোখের নীচেও আছে।নিতুল আমায় রেখে দৌড়ে গেল পাগলিটার কাছে। গিয়ে বললো,’বিন্দু। এই বিন্দু?’
বিন্দু ফিরেও তাকালো না।
নিতুল ওর ছেলেটাকে কাছে টেনে নিয়ে বললো,’নাম কী তোমার বাবা?’
ছেলেটা মিষ্টি করে বললো,’আমার নাম নিতুল।’
নিতুল ওর নামটা শুনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।সে কেঁদে কেঁদে ছেলেটার কপালে চুমু এঁকে দিয়ে বললো,’নিতুল সোনা, আমার সাথে যাবে?’
ছেলেটা বললো,’মাকে ছাড়া আমি কোথাও যাই না।’
তারপর নিতুল ছেলেটাকে অনেক কিছু কিনে দিতে চেয়েছে। কিন্তু ছেলেটি জানালো মায়ের নিষেধ আছে তাই সে কিছুই নিতে পারবে না।
আমার তখন খুব কান্না পাচ্ছিল। আমার জন‍্যই তো এসব হয়েছে।তাই আমি বিন্দুর পায়ে পড়ে গেলাম। পায়ে পড়ে বড় অনুনয় করে ক্ষমা চাইলাম তার কাছে। কিন্তু বিন্দু আমার দিকে তাকিয়েও দেখলো না পর্যন্ত।
অবশেষে আমরা ফিরে এসেছি। ফিরে এসেছি মনভরা কষ্ট নিয়ে। আর শুধু বারবার এই কথা ভেবেছি যে, পৃথিবী এমন কেন? ভীষণ রকম অদ্ভুত এবং রহস্যময়!

——(সমাপ্ত)——

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে