বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-১০

0
1495

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_১০

–জুইঁফুল!

জায়েফ কেমন যেন এক কাতর কন্ঠে বলে উঠলো।

হ্যাঁ।জায়েফ ই কল করেছে।আমি আগে থেকেই ধারণা করে রেখেছিলাম সে আমাকে অবশ্যই বিরক্ত করবে।নিয়াজ ভাইয়ার রাতের কথাগুলো কেও ভালো করে মাথায় ঢুকিয়ে নিয়েছি। কোন প্রকার ভঙ্গিমা না করেই তাকে সোজাসাপ্টা উত্তর দিলাম,,,

–জ্বী বলুন।আমি শুনছি।

সে পূর্বের ন্যায় বলল,,,

–আই এম রিয়েলি সরি।

আমি তাকে কঠিন গলায় জবাব দিলাম

–কিসের জন্য?

–আমার করা অন্যায়ের জন্য।(জায়েফ)

–যেই আমি সামান্য আঘাতটুকু ভুলতে পারি না,সেই আমি কি করে একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষের দেয়া আঘাত ভুলে যাবো?(আমি)

— তুমি আমাকে তার বদলে আঘাত দাও, শাস্তি দাও। আমি হাসিমুখে সব মেনে নিব।(জায়েফ)

— একদমই না। আমাকে আপনার মত ভেবে থাকলে আপনি ভুল করছেন। খুনের বদলে কখনোই খুন হয় না, আমার মতে। আমাকে আঘাত দেয়ার কারণে আপনাকে আঘাত দিলে আপনার আর আমার মধ্যে পার্থক্য রইল কোথায়।(আমি)

— ঠিক আছে। তাহলে অন্যায়ের তো শাস্তি হয় তুমি আমাকে না হয় শাস্তিই দাও।(জায়েফ)

— এত করে যখন আপনি শাস্তি চাচ্ছেন তাহলে শুনে রাখুন – আমি আপনাকে কখনো ক্ষমা করতে চাইনা। হয়তোবা কখনো ক্ষমা করতে পারবও না। আর এটাই হবে আপনার শাস্তি।(আমি)

— জুঁইফুল তুমি এটা বলতে পারলে? (জায়েফ)

–হ্যাঁ পারলাম। কারণ আপনি যদি জেনে শুনে অন্যায় করে বলতে পারেন আপনি অন্যায় করেছেন এখন আপনি ক্ষমা চাচ্ছেন তাহলে আমিও বলতে পারি। শুনে রাখুন আপনি আমার অতীত। অতীত কে আমি অতীতই রাখতে চাই। আর আমি বলে দিয়েছি আপনার শাস্তি কি তাই দয়া করে আমাকে আর বিরক্ত করবেন না।(আমি)

আর এক মুহূর্তের জন্যেও কথা না বাড়িয়ে ফোনটা কেটে দিলাম। মোবাইলটা বালিশের উপর রেখে বিছানায় নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলাম। আজ মনে হচ্ছে আমারও আম্মু থাকলে বুঝি এরকম টা হত না। আজ আমারও আম্মু থাকলে তার কোলে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে তাকে আমার সব দুঃখ, কষ্ট,বেদনার অংশ ভাগ করতাম। আজ আমারও আম্মু থাকলে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে প্রতিরাতে এক নিশ্চিন্তময় ঘুমের রাজ্যে পাঠিয়ে দিত।

আজ মনে হচ্ছে এই এক শব্দের মা নামক ব্যক্তি টা থাকলে বুঝি সব অসম্ভবই সম্ভব হয়ে যেত। মা নামক ছোট্ট শব্দের মহান ব্যক্তির মাঝে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা’ নিহিত থাকে। যে ভালোবাসা মা ছাড়া পৃথিবীর আর অন্য কোনো ব্যক্তির কাছেই থাকে না। এখন মনে হচ্ছে চিৎকার করে বলি আমারও কেন একটা মা নেই। হাটুর উপর বালিশ রেখে মুখ গুঁজে অঝোর ধারায় কান্না করে যাচ্ছি।

অনেকটা সময় পর নিজেকে একটু স্বাভাবিক করে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসলাম। ওয়াশ রুম থেকে বের হয়েই বিছানার উপর সেই বক্সটা চোখে পড়ল। বক্সের পাশে গোলাপ ফুলটা পড়ে রয়েছে। বিছানার উপর আরাম করে বসে বক্সটি খুলতে লাগলাম। মনের মাঝে হাজারো প্রশ্নের পাহাড় জমে গিয়েছে। বক্সটা কে রাখল? বারান্দায় কে দিল বক্স টা? সত্যিই কি আমার জন্য? নাকি অন্য কারো? ধুর! অন্য কারো হবে কেন? আমার বারান্দায় রেখেছে অবশ্যই আমার জন্য হবে।

বক্সটা খোলার সাথে সাথে বেলি ফুলের মাতাল করা ঘ্রাণ আমার নাকে এসে ধাক্কা দিল। দেখালাম বক্সের ভিতরে একটা বেলি ফুলের মালা। মালাটার নিচে কাগজে লেখা কিছু একটা গুঁজে দেওয়া হয়েছে। বেলীফুল দেখে মনটা আনন্দে একেবারে বাকবাকুম হয়ে গেল। বেলি ফুল আর তার ঘ্রাণ আমার সবচেয়ে প্রিয়। আমার বারান্দায় অবশ্য বেলি ফুলের গাছও রয়েছে। ফুল টার নিচে একটা হালকা আকাশী রঙের শাড়ি ও দেখা যাচ্ছে। শাড়ীটায় হাল্কা আকাশী রঙের সাথে হালকা গোলাপি রঙের পাড় রয়েছে। শাড়িটার ভেতরের অংশে ও হালকা গোলাপী রঙের স্টেপ রয়েছে। সাথে আরও দেখতে পেলাম একটা এন্টিকের কোমর বন্ধনী। এটাকে হয়তোবা কোমর বিছাও বলে থাকে। এতক্ষণে আমার চোখ পড়ল কাগজ টার দিকে। যেখানে গোটা গোটা অক্ষরে কিছু একটা লেখা রয়েছে। কাগজটা নিয়ে পড়তে শুরু করলাম।

“আমার #বর্ষণ_সঙ্গিনী,

তুমি কি জানো তুমি যে নিজের অজান্তেই কত বড় একটা ভুল করে বসে আছো? তুমি কি জানো তুমি যে তোমার নিজের অজান্তেই আমার হয়ে গেছো? তুমি কি জানো তোমার সুবাস যে শুধু আমার জন্যই? তুমি কি জানো তোমার ওষ্ঠদ্বয় এর নিচের ঈষৎ গর্তে কতটা মাদকতা জড়িত? তুমি কি জানো তোমার হরিণী আঁখিদ্বয় কতটা বিমোহিত করে আমায়? জানো না তুমি। তুমি এর কোন কিছুই জানোনা।জেনে রাখ, তোমার বেদনাসিক্ত চেহারা আমায় জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। তোমার চোখের এক এক ফোটা অশ্রু বিন্দু আমার বুকের বা পাশে লাভার ন্যায় গড়িয়ে পড়ে। সব শেষে শুধু এতোটুকুই জেনে রাখ যে, আমার জীবনের #বর্ষণ_সঙ্গিনী শুধু তুমিই হবে। অপেক্ষা শুধু সঠিক সময়ের।

তোমার বর্ষণ সঙ্গি”।

লেখাটা পড়ে মনে হচ্ছে আমার চারপাশ ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে। হায়! হায়! এমন পাগল আবার কোথা থেকে উদয় হল? আমি তো বাঁচি না আমার দুশ্চিন্তায়। তার উপর নতুন পাগলের আমদানি। উফফ কি যে হচ্ছে আমার সাথে। ভার্সিটির ও সময় হয়ে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে সাদু কে বলতে হবে এগুলো।

হালকা-পাতলা কিছু নাস্তা করে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হলাম। সাদু আর আমার একটা নির্দিষ্ট জায়গা আছে। ওখানেই দুজনে একত্রিত হই তারপর একসাথে ভারসিটি যাই। দূরে থেকেই দেখতে পাচ্ছি সাদু দাঁড়িয়ে রয়েছে। মুখে বিরক্তির ভাব একেবারে স্পষ্ট। ওর কাছে যেতেই ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠলো,,,

–কোন বিমান দিয়া আইছোস তুই?এই জায়গার থেইকা এই জাগায় আইতে এতো সময় লাগে?

–আমি না হয় দেরি কইরা আসলাম। তুই কোন বিমান দিয় এতো তাড়াতাড়ি আইছোস?কি কেসটা কি বাবু?কার লগে দেখা করতে এতো তাড়াতাড়ি বেড় হইছোস?(আমি)

–তোর শশুর এর লগে দেখা করতে আইছি।(সাদু)

–নাউজুবিল্লাহ! ছিঃ!ছিঃ!ছিঃ!আর মানুষ পাছ নাই? শেষ পর্যন্ত বুড়া বেডার লগে দেখা করতে আইলি। বাসায় জানে?(আমি)

সাধু আমার দিকে কটমট করে কতক্ষণ তাকিয়ে হাটা ধরল। ওর পিছন পিছন আমিও হাঁটা ধরলাম। এরপর আমরা দুজন রিক্সা দিয়ে ভার্সিটির সামনে এসে নামলাম। ক্লাসের ফাকে ফাকেই সাদুকে সকালের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বললাম।সাথে জায়েফ এর কথাও বললাম। যে কাগজটায় লেখা ছিল সে কাগজ টা ভার্সিটি আসার সময় সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম।সাদুকে সেটাও দেখালাম।

— বাহ! তোর জীবনে তাহলে নতুন দিওয়ানার এন্ট্রি হইলো। ভেরি ইন্টারেস্টিং। আই লাইক ইট।(সাদু)

— বাট আই ডোন্ট লাইক ইট। এইসব দেখলে এখন আমার গা চুলকায়। যাই হোক, আজকের পরে যদি এমন কোন কান্ড আবার ঘটেরে তাইলে দেখিছ সোজা ভাইয়ারে বইলা দিব।(আমি)

— তোর মধ্যে কি কোন রস কস দেয় নাই আল্লাহ। দেখ তোরে কত সুন্দর সুন্দর গিফট দিছে। সামনে আরো দিলে আরো ভালো হইবো। মজা হইবো রে! আমারেও দিছ একটু ভাগ(সাদু)

— আয় তোরা ভাগ দেই।

কথাটা বলেই সাদুর চুল ধরে টানাটানি শুরু করে দিলাম।সাদুও আমার হিজাব ধরে টানাটানি শুরু করে দিলো। মারামারি করতে করতে আমরা যে যার বাসায় চলে আসলাম।

বাসার সামনে এসে আরেকদফা ঝাটকা খেলাম। আমাদের বাসার গেটের সামনে এসে দেখি আলআবি ভাইয়া দাঁড়ানো। মুখমন্ডল তার গম্ভীরতায় ছেয়ে গিয়েছে। তাকে কিছু বলার আগেই সে আমার হাত ধরে গেটের ভিতরে নিয়ে এলো। এরপর এক বাজখাঁই গলায় চিৎকার করে বলে উঠলো,,,

–রাস্তায় কিভাবে চলতে হয় সেই ম্যানার্স টুকুও নেই?

তার এরূপ ব্যবহার দেখে অনেকটা ভড়কে গিয়েছি আবার একটু ভয়ও লাগছে। আমি মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে আবারো জোর গলায় বলে উঠলো,,,

–ভার্সিটিতে কি যাও ঝগড়া করার জন্য?

তার এমন আচরণ আর এমন কথাবার্তার কোন কিছুই আমার কাছে বোধগম্য হচ্ছে না মাথা তুলে তার দিকে কিছুটা প্রশ্নসূচক ভাবে তাকালাম। তার কপালে বিন্দুবিন্দু ঘামের ছোঁয়া রয়েছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে ক্লান্ত অথবা খুব দ্রুততার সঙ্গে কোন কাজ করেছে যার জন্য সে হাঁপিয়ে উঠছে বারবার। আমি তাকে কিছু বলার আগেই সে হন হন করে গেট দিয়ে বের হয়ে বাইকে করে চলে গেল। আজকে আমার সাথে ঘটা আজব আজব কান্ড দেখে মনে হচ্ছে নিজেই পাবনায় টিকিট কেটে চলে যাই।

বাসায় এসে দেখি কমলা আন্টি রান্না করছে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম,,,

–আজকে তুমি হঠাৎ রান্না করছো যে? (আমি)

–মনে চাইলো তোমারে একটু রাইন্দা খাওয়াই। ডেইলি তুমিই তো রান্দো।( কমলা আন্টি)

দুপুরে ভাইয়া বাসায় লাঞ্চ করে না। আমি আর বাবাই লাঞ্চ করে থাকি। মাঝে মাঝে কমলা আন্টিও থাকে আমাদের সাথে। দুপুরে খাচ্ছিলাম আমরা। আজকে কমলা আন্টিও আমাদের সাথে খাচ্ছে। তখন বাবা বলে উঠলো,,,

— জুই তোদের সব শপিং শেষ হয়েছে?

— হ্যাঁ হয়েছে তো সব।

এরপর আমাদের মধ্যে আর কোন কথা হল না। ভাইয়া এখনো বাবার সাথে কথা বলে না। ভাইয়াকে অনেক বলেছি যা হওয়ার তা তো হবেই। এখন কথা না বলে লাভ কি? বাবা ও তো এখন কষ্ট পাচ্ছে। সে তো বুঝতে পেরেছে। তখন ভাইয়া আমার প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। এড়িয়ে চলে গিয়েছিল।

বিকেলের দিকে সেই বক্সটা আর চিঠিটা সুন্দর করে গুছিয়ে আলমারিতে রেখে দিলাম। ফুল গুলো বাইরেই রাখলাম। রাতে ভাইয়া আসার পরে ডিনার করে একটু বই-খাতায় চোখ বুলিয়ে ভাইয়ার সাথে কিছু সময় গল্প করে ঘুমিয়ে পড়লাম।

এভাবেই রুটিনমাফিক তিন চার দিন চলে গেল। একদিন বিকেলবেলা বারান্দায় বসে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী গল্পটা পড়েছিলাম। হঠাৎ করে ফোনে একটা মেসেজ আসলো। মেসেজটা চেক করতে গিয়েই চমকে উঠলাম। কারণ মেসেজটায় লেখা ছিল,,,

“প্লিজ চুলগুলো একটু বেঁধে নাও। না হলে আমি আর পারছিনা। তোমার খোলা এলোমেলো চুলগুলো ছুঁয়ে দিতে এতটা ইচ্ছে করছে যা তোমাকে বলে বুঝাতে পারব না।”

চলবে……………..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে