বউ পর্ব – ০২

0
1860

#বউ
#তাহরীমা
#পর্ব-০২
___________________________

মেঘ গ্রামের পথ ধরে হেটে চলেছে।রিয়ার বলায় ঠিকানাটা সে বেশ মুখস্থ করেছে।গ্রামের কয়েকজনকে দেখলে মেঘ দাঁড়িয়ে পড়ে।আর ঠিকানাটা বলে।যেহেতু মেহুর বাবাকে সবাই চিনে সেহেতু ঠিকানাটা এক দেখায় তারা দেখিয়ে দেয় বাড়িটা।

চারদিকে সবুজ আর সবুজ গ্রামের প্রকৃতি এমন ই।কিছু বিলে ধানের ও চাষ করা হয়েছিল।কিন্তু তখন ধান পাকা হয়ে যাওয়ায় কেটে ফেলা হয়েছে।মেঘ শহরে থাকে ছোট থেকেই।তাই এসবের অভিজ্ঞতা একদম ই নতুন।

মেঘ ঠিকানা বরাবর বাড়ির সামনে দাঁড়ায় আর ভাবে প্রাক্তনের সাথে তার কথা বলতে ই হবে।এত লুকোচুরি কিসের?কেন এত অচেনা লাগার ভান?
আবার ভাবে–“হয়ত অতীত ভেবে সে এখনো অভিমান করে আছে।”

মেঘ মেহুদের বাড়ির সামনে দাঁড়ায়।

বাড়ির সামনে বড় উঠান।
মেহুর বাবা উঠানের একপাশে অনেক কিছু রোপন করেছে।যেমন–বিভিন্ন শাক,টমেটো,বেগুন,ধনেপাতা ইত্যাদি।

মেহু বসে বসে শাক তুলছিলো।মেহুকে দেখে মেঘের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।সে অগত্যা মেহুর সামনে দাঁড়িয়ে গলার স্বর দিলো।

মেহু মুখ তুলে পুরুষ মানুষ দেখে উড়নাটা আরেকটু টেনে সালাম দিলো।মেঘ সালাম নিলো।

-কেমন আছো?
-আলহামদুলিল্লাহ।কিন্তু কে আপনি?

মেহু মেঘকে বিয়েতে দেখেছিল ঠিক।কিন্তু এক দেখায় মানুষের চেহারা মনে রাখতে পারে না মেহু।তাই মেঘকে চিনতে অসুবিধা হলো।

আবারো এ প্রশ্নটা শুনে মেঘের মন খারাপ হয়ে গেলো।
–“কেন এভাবে অচেনা করে দিচ্ছো?আচ্ছা মানলাম আগের কথা ভুলে গেছো।কিন্তু তোমার বান্ধবীর বিয়েতে না দেখা হলো?”

মেহু তখন কিছুক্ষন ভেবে ধাক্কা খাওয়ার কথা মনে পড়লো।কিন্তু লোকটা কে সেটা তো সে জানেনা।মেহু কোমল কন্ঠে বলল–“সত্যি ই আপনি কে আমি জানি না।”

মেঘ মনে মনে ভাবলো অভিমান থেকেই হয়ত এমন বলছে।একবার বিয়েটা হয়ে যাক তারপর দেখাবে মজা।তাকে না চেনার ফল।

মেঘ তখন বলে-
–“আসলে আমি তোমার আব্বুর সাথে দেখা করতে এসেছি।’

মেহু তখন হাসিমুখে মেঘকে বারান্দায় বসতে বলে তার বাবাকে ডাকতে যায়।রুম থেকে মেঘতা বের হয়ে মেঘের সামনে যায়।

মেঘ মেঘতাকে দেখে হাসিমুখে হাত বাড়ায় মেঘতা ও চট করে উঠে পরে।

বাড়িতে একটা অচেনা পুরুষ এসেছে সেটা নিয়ে আশেপাশে মানুষের কৌতুহলের শেষ নেই।

মেহুর মা আসে।মেঘ সালাম করে,মেহু এসে শরবত দেয়।মেহুর বাবা উনার রুম থেকে বের হয়ে মেঘকে দেখে বলে–” কে তুমি?”

মেঘ নিজের পরিচয় দেয়।
মেহুর বাবা একটা চেয়ার টেনে বসে বলেন–“কি দরকারে এখানে আসা?”

মেঘ ভণিতা না করে ই বলে–“আমি আপনার মেয়েকে ভালবাসি।অনেক আগে থেকেই ভালবাসি।আপনাদের ভয়ে সে জানায়নি।আমি তাকে বিয়ে করতে চাই?”

মেঘের সুজাসুজি কথায় মেহুর বাবা অবাক ই হন।কিন্তু পাত্রকে বেশ পছন্দ হয়েছে।কিন্তু মেহু খুবই অবাক হয়।সে এতে বাধ সাজে।

মেহু বলে–“কি সব বলছেন আপনাকে আমি চিনি ই না।”

মেঘ তখন মনে মনে বলে–“না চেনার ভান বিয়ের পর দেখিয়ে দিবো।”

মেহু রাগ করে সেখান থেকে চলে গেলে।
মেঘ মেহুর বাবা মাকে অনেক বিনয়ের সাথে বুঝায় যে তাদের মেয়েকে সে কতটুকু ভালবাসে।আর কখন থেকে ভালবাসে।

মেহুর বাবা মা ও বুঝেছে।তখন মেহুর বাবা ভাবে-” হয় মেহু মেঘতার জন্য বিয়ে করবেনা বলে ভালবাসাকে অস্বিকার করছে নয়ত বাবা মার ভয়ে মিথ্যা বলছে।”

মেহুর বাবা বলে–“তোমার বাবা মাকে নিয়ে আসিও।উনাদের মত থাকলে আমার আপত্তি নেই।”

মেহু তখন আবারো আসে রাগ দেখিয়ে বলে–“বউ হবো।কিন্তু আমার মেয়েকে ও আমার সঙ্গে নিয়ে যাব?”

মেঘ মুচকি হাসে।মেঘতার দিকে চেয়ে কপালে চুমু দেয়।আর বলে–“হ্যা আমি ই ওর বাবাই হবো।”

মেহুর বাবা মা হাসে।তখন মেহুর বাবা বলে–“যা তো মেহু ছেলেটার জন্য ভাতের ব্যবস্থা কর।শহর থেকে এসেছে।যেতে যেতে ক্ষুধা লাগবে।তাছাড়া মেহমানদারী করা ভালো।”

মেঘ তখন একটু অবাক হয় মেহু নামটা শুনে।আবার কি ভেবে মুচকি হাসে।

মেঘতা কোল থেকে নেমে পড়ে।
মেঘ মেহুর বাবার সাথে গ্রামে হাটতে বের হয়।পথে অনেকের সাথে দেখা হয়।তবে মেহুর বাবা বিচক্ষণ মানুষ।এই মুহুর্তে পাত্রের ব্যপার বলা ঠিক হবেনা।তাই তিনি মেঘের পরিচয় দেন,সে তার এক নিকট বোনের ছেলে।

এদিকে মেহুর কান্নার শেষ নেই।সে বিয়ে করতে চায় না।মেঘতাকে নিয়ে তো ভালই আছে।মেহুর মা হাসে।বয়সে বড় হলেও মেয়েটার স্বভাব পাল্টালো না।
.

রান্নাবান্না শেষ করে মেহু প্লেটে সব সাজিয়ে নেয়।মেহমানদের আপ্যায়ন এর জন্য তার আব্বু ছোট একটা টেবিল তৈরি করেছিল।মেহু টেবিলে নিয়ে গিয়ে সাজিয়ে দেয়।মেহুর বাবা মেঘকে খুব আদর সমাদর করেন।
.

মেহুদের বাড়ির পিছনে পুকুরপাড় রয়েছে।সেখানে পাড়ে গিয়ে মেহু বসে পড়ে।অতীত মনে পড়ে তার খুব কান্না আসছে।আজ কত খুশির দিন হতে পারতো কিন্তু আজ তাকে কাদতে হচ্ছে।

মেঘ মেহুর বাবাকে বলে–“আপনি কিছু মনে না করলে আমি একটু আপনার মেয়ের সাথে কথা বলতে পারি?”

মেহুর বাবা অনুমতি দেয়।আর বলে দেয় মেহু কোথায় আছে।

মেঘ মেঘতাকে নিয়েই হাটা ধরে।

দূর থেকে মেঘ মেহুকে দেখছে।সে মা কে কল দেয়।আর সব বলে মেঘের মা মেহুর বাবার কথা শুনে খুশি ই হন।কথা বলতে বলতে মেঘ মেহুর পাশে দাঁড়ায়।
–“এই দেখো আম্মু তোমার বউমার পাশে দাঁড়িয়ে আছি।”

মেহু নেড়েচড়ে উঠে দাঁড়ায়।লোকটার লাজলজ্জা নেই নাকি।বিয়েই হয়নি আসছে বউ বলতে।

মেঘের মা হেসে কল কেটে দেয়।অনেকদিন পর আবারো ছেলেটা পাগলামি করছে।হাসছে এর চেয়ে খুশি একজন মায়ের জন্য কিছুই হতে পারেনা।

মেহু মেঘকে রাগিচোখে তাকিয়ে চলে যেতে নিলে মেঘ বলে উঠে-“বউ”।

এই একটা শব্দ কত ছোট্ট।কিন্তু গুরুত্ববিশাল।মেহু থমকে দাঁড়ায়।

–“কাল আম্মুকে নিয়ে আবারো আসবো বিয়ের ডেট ফাইনাল করবো।তুমি এ বিয়েতে রাজি নও?”

মেহু মেঘের দিকে না তাকিয়ে ই বলে–“আল্লাহ যা চান তাই হবে।”

____________________

মেঘ শহরে চলে যায়।

পরেরদিন মেঘ আবারো গ্রামে আসে।মেঘের বাবা মা দুজনকেই নিয়ে আসে।মেঘ বহুবছর আগেই মা কে তার প্রাক্তনের ফটো দেখিয়েছিলো।
মেহুদের জন্য অনেক মিষ্টি নিয়ে আসে নতুন আসছে বলে কথা।

গ্রামে কথাটা দ্রুত ছড়িয়ে যায়।মেহুর বিয়ে হতে যাচ্ছে।অনেকেই খবরটা শুনে খুশি হয়।অবশেষে মেহু বিয়েতে মত দিয়েছে।গ্রামের মানুষ দের এটাই সমস্যা,কার বিয়ে হচ্ছে না হচ্ছে সেগুলো নিয়ে একদফা কানাঘুষা করবে।

মেঘের বাবা মাকে মেহুর বাবা মা অনেক শ্রদ্ধা করে কথা বলেন।বিশেষ করে মেঘের বাবা আর মেহুর বাবা পুরানো বন্ধুর মতো ই কথা বলে।
তারা এমন মানুষদের সাথে আত্মীয়তা করতে পারছেন বলে খুব খুশি হয়।

মেহু একটা ত্রিপিস পড়ে,সাথে স্কার্ফ করে নেয়।মেঘের বাবা মাকে সালাম দিয়েই মেঘের মায়ের পাশে বসে।

মেঘের মা জিজ্ঞেস করে–“কেমন আছো মা?
–“জ্বি আলহামদুলিল্লাহ।আপনি কেমন আছেন?”
–“আমি ও আলহামদুলিল্লাহ।”

মেহুর মা নাস্তা পানি নিয়ে আসে। ফটোতে যেমন দেখছিল বাস্তবে মেহু আরো সুন্দর বেশি।মেঘের মা খুশি হয়।মেঘতা এসে মায়ের সাথে দাঁড়ায়।মেঘের মা হাল্কা হেসে মেঘতার আঙ্গুল ধরে।আর বলে–“বলোতো আমি কে?

মেঘতা তখন মেহুর মুখের দিকে তাকায়।সব তো মায়ের কাছ থেকে সে শিখে।তাই তাকিয়ে আছে।মেহু হাল্কা স্বরে বলে–“তোমার দাদু!”

দাদু শব্দটা মেঘতা এই প্রথম শুনেছে।তাই সে অবাক চোখে চেয়ে থাকে।মেঘের মা মেঘতাকে কোলে নিয়ে বসে।
আর বলে–“মেয়েটা অনেক শান্ত হয়েছে।কার মতো হয়েছে?মেহুর মতো নাকি?”

সকলেই চুপ করে আছে।মেহুর চোখ জলে ভরে গেলো।কিসের এত দুঃখ তার?আজকের দিনটা যে খুশির দিন তবে?

বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়।যাবার আগে মেঘের খুশিমুখ দেখে মেহু হাল্কা হাসে।বিয়ে নিয়েও মানুষ এত খুশি হয়?
কিন্তু সে কিছুতেই মেঘকে মনে করতে পারছে না।মেঘ কেন মিথ্যা বলছে?যেখানে মেঘকে সে চিনে ই না!

.
পথে যেতে যেতে মেঘের বাবা বলে–“পরিবার টা আমার খুব পছন্দ হয়েছে।বিশেষ করে মেয়ের বাবাকে।মেয়ে ও মাশাল্লাহ! আশা করি সব ভাল ই হবে।”
মেঘের মা বলে–“আমারো বেশ ভাল লেগেছে।”
মেঘ তখন হেসে বলে–“কার পছন্দ দেখতে হবে না?”

তিনজনি হেসে উঠে।
______________

বিয়ের আয়োজন শুরু হয়ে যায়।মেঘতাকে ছেড়ে মেহুর বাবা মা কিভাবে থাকবে?সে নিয়ে সবার মন খারাপ হয়।তবে মেঘতা খুব খুশি।তার বাবাই আকাশ থেকে এসেছে।এটা তার নানা ই বলেছে।

মেঘতা নানার সাথে হাটে যায়।তার কি সৌভাগ্য মায়ের বিয়ে দেখবে?যদিও সে ছোট মাথায় বিয়ে কি বুঝছেনা।তারপর ও তার মা বউ হবে।বউ মানে হয়তো সুন্দর কিছু!কি জানি তার মাথায় কি আসছে।মেঘতার মুচকি হাসি দেখে মেহুর বাবা ও হাসে।মেঘতাকে বুকে জড়িয়ে নেয়।নাত্নির মায়া বড্ড ভালবাসার মায়া।


মেহু রুমে বসে আছে।মেহুর রুমে একটা জানালা রয়েছে।বাইরে সে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে।চোখে বিন্দু বিন্দু অশ্রু!
মেহুর মা ঘরে আসে।
–“মেহু?”

মেহু তাকায় না।
মেহুর মা পাশে বসে বলে–“এখন তুই মেয়ে।কয়েকদিন পর তুই হবি বউ।বউ শব্দটা ছোট হলেও দায়িত্ব কিন্তু অনেক।তোকে অনেক পরিস্থিতি সামলাতে হবে ভেঙ্গে পড়া চলবে না।আমার মনে হয় মেঘ ভাল ছেলেই।নাহলে তোকে এত ভালবাস………”

মেহু ফুফিয়ে কাদে।তার কিছুই মাথায় ডুকছে না।সে যে সত্যি ই মেঘকে চিনতেছে না।
–“আমার খুব করে অতীত মনে পড়ছে আম্মু।”

মেহুর চোখের জল মুছে মেহুর মা মেহুকে বুকে জড়িয়ে রাখে।তার ও চোখে জল।
মেহুর মা বলে–“আল্লাহ যা করেন আর যা করবেন সব ভালর জন্য ই।ধর্য্য ধরতে কখনো ভুলবি না।অবশ্যই আল্লাহ ধর্য্যধারণকারীদের ভালবাসেন………

চলবে………..?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে