প্রেমরাঙা জলছবি পর্ব-১১

0
234

#প্রেমরাঙা_জলছবি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_১১

সুরাইয়া বিছানা ঠিক করছিল। আশরাফ বাহিরে দাঁড়িয়ে উমেদের সাথে ফোনে কথা বলছিল। উমেদ ঢাকা চলে গিয়েছে দুইদিন ধরে। ভাইয়ের সাথে কথা বলা হয়ে ওঠেনি সেভাবে তাই রাতে কলে কথা বলছিল। ময়না বেগম বোনের বাড়িতেই আছেন তিনি এখনো বাড়ি ফেরার কথা জানাননি।

উমেদের সাথে কথা শেষ করে আশরাফ রুমে চলে আসে। সুরাইয়া মাত্রই কাজ শেষ করে খাটে হেলান দিয়ে বসেছে।
আশরাফকে রুমে ঢুকতে দেখে সুরাইয়া বলে ওঠে,“চা করে দেব?”

আশরাফ চুলগুলো নেড়ে পিছনের দিকে দিয়ে বলে,“চলো বের হই।”

সুরাইয়া ভ্রু কুচকে বলে,“এখন? কেন?”
“বউকে নিয়ে ঘুরতে ইচ্ছে করছে তাই। গন্তব্য কোথাও না শুধু বাইক নিয়ে দুজনে রাস্তায় ঘুরব। খোলা আকাশ, চারদিক অন্ধকার আর মাঝেমাঝে আলোর ছটা, দারুণ না?”

সুরাইয়া মুচকি হাসে৷ তৎক্ষণাতই আবার মুখটা কালো হয়ে যায়। আশরাফ পাশে এসে বসে সুরাইয়ার চিবুক স্পর্শ করে মুখটা তুলে জিজ্ঞেস করে,“কী হয়েছে? শরীর খারাপ? যাবে না?”

সুরাইয়া মাথানিচু করে নরমস্বরে বলে,“আমাদের কত টাকা হয়েছে?”

আশরাফ কপালের ভাজ বিস্তৃত করে বলে,“কেন? হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?”
“তুমি তো আমাকে সেরকম কিছু বলো না। আমি জানিও না কত টাকা হয়েছে জমানো৷ আচ্ছা যে টাকা হয়েছে সেই টাকা দিয়ে এখানে কিছু করে সংসার চলবে না? তোমার সাথে সংসার করার ইচ্ছে আমার কবে পূরণ হবে? দুই, তিন বছর পর দুই আড়াইমাস করে না আমি বছরের প্রতিটা দিন তোমার সাথে কাটাতে চাই। বিশ্বাস করো আমি সব পরিবেশে মানিয়ে নেব নিজেকে। আমি ভাত ডালে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখব কিন্তু তোমার অনুপস্থিতি ভালো লাগে না। তুমি চলে গেলে তোমার সাথে কাটানো সময়গুলো আমার গলা চেপে ধরবে। আমি শ্বাস নিতে পারব না। ”

আশরাফ একহাত দিয়ে সুরাইয়াকে বুকে জড়িয়ে নেয়। মাথায় চুমু দিয়ে বলে,“তুমি বললে আমি আর যাব না। বলো তুমি কী চাও?”
“এখানেই থেকে যাও। সারাদিনের ব্যস্ততা কাটিয়ে অন্তত রাতে এই বুকটায় মাথা রাখতে চাই।”
“ঠিক আছে। আমি দেখছি কী করা যায়।”
“হুম।”

সুরাইয়াকে ছেড়ে তার দুইগালে হাত রেখে আশরাফ বলে,“যাও এখন তৈরি হও আমরা বের হব। রাত হয়ে গেছে।”
“ দশ মিনিটে রেডি হয়ে নিচ্ছি।”
“তুমি তাড়াতাড়ি রেডি হও আমি বাহিরে অপেক্ষা করছি।”

সুরাইয়া মৃদু হেসে বলে,“ঠিক আছে।”
______

আবরারের জ্ঞান ফিরতে ফিরতে তিনদিন গত হয়। হৃদিতা এই তিনদিন গোসল, খাওয়ার সময় আর খুব প্রয়োজন ছাড়া সবসময় আবরারের কেবিনেই ছিল।
হৃদিতা মাত্রই একটু বাহিরে দাঁড়িয়ে আজহার রেজার সাথে কথা বলছিল। তখনই নার্স কেবিন থেকে হৃদিতাকে ডাক দেয়।

হৃদিতা আজহার সাহেবকে দাঁড়াতে বলে ভেতরে চলে যায়। কেবিনে আসতেই নার্স বলে,“উনার হাতের আঙুল নড়ছে। এখনই হয়তো তাকাবে। জ্ঞান ফিরেছে উনার।”

হৃদিতা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। নার্সটা আবার বলে ওঠে,“আপনি কে হন উনার? সারাক্ষণ এখানে পড়ে আছেন। উনার বাড়ির আর কেউ নেই?”

হৃদিতা আমতা আমতা করে বলে,“উনার বাড়িতে একাই থাকতে দেখেছি। হয়তো উনার বাবা-মা গ্রামে থাকেন। খবর দেয়া হয়নি হয়তো।”
“আচ্ছা৷ আপনি তাহলে এখানেই থাকুন৷ আমি গিয়ে ডাক্তারকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

নার্স যেতে শুরু করলে হৃদিতা পিছন থেকে ডাক দিয়ে নার্সকে থামিয়ে দেয়। নার্স জিজ্ঞাসু চোখে হৃদিতার দিকে তাকালে হৃদিতা বলে ওঠে,“এশা ম্যামের কী অবস্থা? উন্নতি দেখা দিয়েছে কি?”

নার্স একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে মুখে অন্ধকার নামিয়ে বলে,“উনার অবস্থা একদম ভালো না। দূর্ঘটনা যখন ঘটে তখন হয়তো উনি সিটবেল্ট বাঁধেননি তাই ছিটকে পড়েছিলেন। মুখের অবস্থা খুবই খারাপ। বেঁচে গেলেও প্লাস্টিক সার্জারি করা ছাড়া উপায় নেই। তবে…”

নার্স থেমে যেতে হৃদিতা আবার প্রশ্ন করে ওঠে,“তবে কী?”
নার্স কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে ওঠে,“ উনি হয়তো আর কাম ব্যাক করবেন না। কোমায় আছেন এখন।কোনো৷ আশা দেখতে পাচ্ছি না।”
হৃদিতা চোখ বন্ধ করে একটা প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বলে,“আচ্ছা। ঠিক আছে আপনি আসুন। ডাক্তারকে নিয়ে আসবেন বললেন তো।”

“ জি।” বলেই নার্স সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। হৃদিতা আজহার সাহেবের দিকে তাকালে তিনি ইশারায় হৃদিতাকে সেখানেই থাকতে বলেই বড়ো বড়ো ধাপ ফেলে চলে যান।

হৃদিতা পিছন ফিরে তাকাতেই দেখে আবরার ছোটো ছোটো চোখে তার দিকেই দেখছে আর তাকিয়ে থাকতে না পেরে বারবার চোখের পলক ফেলছে। বেডের পাশে রাখা চেয়ারটা টেনে বসে হৃদিতা।

আবরার তখনো হৃদিতার দিকেই তাকিয়ে আছে। তিনদিনে শরীরের বেশ অবনতি দেখা যাচ্ছে আবরারের। সুশ্রী চেহারার মানুষটার মুখটায় কালসিটে দাগে ভর্তি। তার সামনে আয়না নিয়ে আসলে হয়তো আরেক প্রকার দূর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবে সে।

হৃদিতা আবরারের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলে,“কেমন আছেন এখন? ভালো লাগছে কি?”

আবরার মলিনমুখে নির্জীবকণ্ঠে বলে ওঠে,“ আ আপনি এখানে কেন?”

“উনি তো খুব প্রয়োজন ছাড়া আপনার কেবিন থেকে বের হয়নি। তিনটা দিন আমাদের চেয়ে উনিই আপনার দেখাশোনা বেশি করেছে।” কথাগুলো বলতে বলতে নার্স ভেতরে প্রবেশ করে।

নার্সের সাথে এবারডাক্তার এসেছেন। তিনি অনেকটা সময় নিয়ে চেকআপ করে হাসিমুখে বলেন,“ সব তো এখন আলহামদুলিল্লাহ ভালোই দেখছি, কেমন অনুভব করছেন আবরার সাহেব?”

আবরার নার্সের বলা কথা শোনার পর থেকেই পলকহীন দৃষ্টিতে হৃদিতার দিকে তাকিয়ে আছে। ডাক্তারের কথা কানে পৌঁছতেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বলে ওঠে,“একটু ভালো লাগছে। কারো পরিশ্রম তো বৃথা যেতে দিতে পারি না। তাই হয়তো এবারের মতো ফিরে এলাম মৃত্যুর দুয়ার থেকে।”

ডাক্তার সাহেব স্টেথোস্কোপ হাতে জড়িয়ে নিয়ে বলেন,“যা বলেছেন। হৃদিতা ম্যামের জন্য হসপিটালের নার্সগুলো অন্তত এখান থেকে ছুটি পেয়েছিল। তিনটা দিন উনি খুব পরিশ্রম করেছেন। সে যাই হোক, আমি ওষুধ লিখে দিচ্ছি। কাউকে দিয়ে আনিয়ে নিবেন। রাত থেকেই খাওয়া শুরু করুন। আপাতত বেশ কিছুদিন আপনাকে হসপিটালের বাসিন্দা হয়েই থাকতে হবে।”

ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লিখে হৃদিতার হাতে দিয়ে চলে যায়। নার্স প্রেসক্রিপশনটা নিয়ে ভালোভাবে বুঝিয়ে দেয় কখন কোনটা খেতে হবে।
নার্স বেরিয়ে যেতেই হৃদিতা আবরারের উদ্দেশ্যে বলে,“আপনি কি মিনিট পাঁচেক একা থাকতে পারবেন? আমি ওষুধগুলো সামনের ফার্মেসি থেকে নিয়ে আসতাম।”

আবরার দরজার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,“কেন আছেন এখানে?”

হৃদিতা এদিক ওদিক দেখে আমতা আমতা করে বলে,“ ক কেন আছি মানে? আপনি অসুস্থ তাই।”
“দুনিয়ার সবাই অসুস্থ থাকলে নিশ্চয়ই তাদের সাথে থাকেন না।”

হৃদিতা মাথা নিচু করে মেঝেতে দৃষ্টি ফেলে বলে,“সবাই নিশ্চয়ই আমার বেকারত্ব ঘোচাতে আমার জন্য ভাবেনি। ”
“ওহ আচ্ছে পরিশোধ করছেন?”
“টাকার ঋণ পরিশোধ করা যায়, সাহায্যের না। আপনি আমার জন্য কিছু করতে চেয়েছিলেন সেখানে আমি নাহয় আপনার জন্য কিছু করলাম।”
“সত্যি করে বলুন এটাই শুধু কারণ এখানে থাকার?”
“আর কী কারণ থাকবে? আমি এখানে আছি জন্য আপনার অসুবিধা হচ্ছে?”
“এখন থেকে নারীকে বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হবে। মানুষকেই আর বিশ্বাস করতে চাই না আর সেখানে তো মেয়ে মানুষ। ”

হৃদিতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে,“আপনি একবার এশার কথা জিজ্ঞেস করলেন না কেন? উনাকে তো আপনি খুব ভালোবাসেন। সেদিন বললেনও যে আপনার শেষ..”

হৃদিতাকে থামিয়ে দিয়ে আবরার বলে ওঠে,”প্লিজ, ওর কথা আর আমাকে বলবেন না। ওর নামটাও আমি শুনতে চাই না।”

হৃদিতা ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে,“কেন?”
“এত প্রশ্ন ভালো লাগছে না আমার। প্লিজ চুপ থাকুন।”
“আমাকে অসহ্য লাগছে? লাগলে বলতে পারেন আমি চলে যাব। নার্স তো আছেই।”
“আমি বললেই আপনি শুনবেন?”
“হ্যাঁ শুনতে তো হবেই। আপনার সঙ্গ প্রয়োজন না হলে, আমাকে সহ্য না হলে শুধু শুধু বিরক্ত করব কেন?”

আবরার হৃদিতার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে অন্যদিকে তাকায়। নির্জীব গলায় বলে,“আর থেকে যেতে বললে?”

#চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে