প্রেমরাঙা জলছবি পর্ব-০৩

0
248

#প্রেমরাঙা_জলছবি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_০৩

মুখ্য মঞ্চের পাশেই শিক্ষার্থীদের গান, নৃত্য বা বক্তৃতার জন্য আলাদা মঞ্চ করা হয়েছে। তার পাশেই সবার বসার জায়গা। সবাইকে পার করে হৃদিতা নিজের জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায়। একজন এসে একটা চেয়ার আর মাইক্রোফোন এনে ঠিক করে সামনে রেখে দেয়।

হৃদিতা গলা ঠিক করে গিটারে আওয়াজ তুলতে শুরু করে। সামনে সবাই ধীরেধীরে চুপ হয়ে যেতে শুরু করে। হৃদিতা আশেপাশে তাকিয়ে মৃদু হেসে নিজের অতি পছন্দের গানটা শুরু করে৷

আমার ভিনদেশি তারা
একা রাতেরই আকাশে
তুমি বাজালে একতারা
আমার চিলেকোঠার পাশে
ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে
তোমার নাম ধরে কেউ ডাকে
মুখ লুকিয়ে কার বুকে
তোমার গল্প বলো কাকে?
আমার রাত জাগা তারা (রাত জাগা তারা)
তোমার অন্য পাড়ায় বাড়ি (অন্য পাড়ায় বাড়ি)
আমার ভয় পাওয়া চেহারা (ভয় পাওয়া চেহারা)
আমি আদতে আনাড়ি (আদতে আনাড়ি)
আমার আকাশ দেখা ঘুড়ি
কিছু মিথ্যে বাহাদুরি
আমার আকাশ দেখা ঘুড়ি
কিছু মিথ্যে বাহাদুরি
আমার চোখ বেঁধে দাও আলো
দাও শান্ত শীতল পাটি
তুমি মায়ের মতোই ভালো
আমি একলাটি পথ হাঁটি
আমার বিচ্ছিরি এক তারা (বিচ্ছিরি এক তারা)
তুমি নাও না কথা কানে (নাও না কথা কানে)
তোমার কীসের এত তাড়া? (কীসের এত তাড়া?)
রাস্তা পার হবে সাবধানে (পার হবে সাবধানে)
তোমার গায় লাগে না ধুলো
আমার দু’মুঠো চাল-চুলো
তোমার গায়ে লাগে না ধুলো
আমার দু’মুঠো চাল-চুলো
রাখো শরীরে হাত যদি
আর জল মাখো দুই হাতে
Please ঘুম হয়ে যাও চোখে
আমার মন খারাপের রাতে
আমার রাত জাগা তারা
তোমার আকাশ ছোঁয়া বাড়ি
আমি পাই না ছুঁতে তোমায়
আমার একলা লাগে ভারী
আমার রাত জাগা তারা
তোমার আকাশ ছোঁয়া বাড়ি
আমি পাই না ছুঁতে তোমায়
আমার একলা লাগে ভারী
আমার রাত জাগা তারা
তোমার আকাশ ছোঁয়া বাড়ি
আমি পাই না ছুঁতে তোমায়
আমার একলা লাগে ভারী।।

হৃদিতার গান শেষ হতেই চারপাশে হাতে তালি আর গানের গলার প্রশংসার ধুম পড়ে যায়৷ জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে। গান গাওয়ার সময় অন্যসবার সাথে অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথির নজরেও নজর মিলিয়েছে হৃদিতা। সুদর্শন পুরুষের নজরে অহংকার থাকে, তারা মেয়েদের দিকে না তাকিয়ে মেয়েদের মন জিতে নিতে চায়। এজন্যই হয়তো হৃদিতা যখন কিছুক্ষণের জন্য আবরার ফাইয়াজের দিকে তাকিয়ে গান গাইছিল তখন সে নিজের ফোনের স্ক্রিনে ব্যস্ত ছিল।

হৃদিতা সিঁড়ি দিয়ে নামবে তখনই বিভাগীয় প্রধান শরীফ আহমেদ তাকে কাছে ডাকে। হৃদিতা এসে পাশে দাঁড়িয়ে সালাম দেয়৷ শরীফ আহমেদের পাশেই বসে ফোনের স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে আবরার।

শরীফ সাহেব সালামের জবাব দিয়ে বলেন,” আছ কোথায় এখন? কেমন চলছে, কী করছ? আর বিয়ে! বিয়ে হয়েছে তোমার?”

হৃদিতা মৃদু হেসে বলে,” না স্যার। বিয়ে করিনি এখনো৷ জব খুঁজছি, একটা ভালো জব প্রয়োজন। বিয়ে নিয়ে এখনো কোনো ভাবনা নেই৷ ”
” তোমার সিভিটা ড্রপ কোরো তো আমার ইমেইলে। আমি তোমার জন্য কথা বলব৷ কত ভালো স্টুডেন্ট ছিলে তুমি আর তোমার কি না জবের জন্য ঘুরতে হচ্ছে!”
” কৃতজ্ঞতা, স্যার।”

হৃদিতা গিটারটা রেখে ফোন হাতে নিতেই দেখে উমেদের নম্বর থেকে চারবার কল এসেছে। হৃদিতা ফোনটা হাতে নিয়ে ইশিতাকে বলে,” তোরা এখানেই থাকিস আমি একটু কথা বলে আসছি, কল এসেছিল।”
” কে কল করেছে?”
” উমেদ ভাই, আমাদের শেখ সাহেব।”
____

” এতো মানুষের সামনে গান শুনে মজা আছে নাকি সুন্দরী? ফোন নম্বরটা দাও, রাতে কল দিয়ে তোমার এই সুমধুর সুরে গান শুনব।”

হৃদিতা উমেদের সাথে কথা শেষ করে নিজের জায়গার উদ্দেশ্যে ফিরছিল এমন সময় বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন ছেলে হৃদিতাকে উদ্দেশ্য করে কথাটি বলে।

হৃদিতা পিছনে না তাকিয়েই দুই তিনপা পিছিয়ে এসে ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,” কার কার নম্বর লাগবে?”

বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একজন হাত দিয়ে সবাইকে পিছিয়ে দিয়ে বলে,” শুধু আমার।”

হৃদিতা আরেকটু কাছে গিয়ে বলে,” কী চাই?”
ছেলেটাও বেহায়ার মতো মুখ এগিয়ে বলে,” আপাতত নম্বর, তারপর কী কী চাই সেটা চেয়ে নেব।”
” ছোঁয়া চাই না?”
” চাই তো!”

হৃদিতা গায়ের সব শক্তি দিয়ে প্রবল বেগে একটা চড় বসিয়ে দেয় ছেলেটার গালে। তার দুইপাশ থেকে দুইজন এগিয়ে আসতে লাগলে গালে চড় পড়া ছেলেটা তাদের থামিয়ে দেয়। আঙুল দিয়ে দাঁতের গোড়ায় হাত দিয়ে বের করে দেখতেই চোখ বড়ো বড়ো হয়ে যায়। র*ক্ত ঝরছে!

হৃদিতা আঙুল উঁচিয়ে বলে,” সব মেয়েকে এক ভেবে ভুল করবি না। সব মেয়ে মাথানিচু করে সব সহ্য করে নিতে জানে না। একটা আ*ঘা*তের পরিবর্তে কেউ কেউ জানটাও নিয়ে নিতে পারে। নেক্সট টাইম আমার সামনে তোদের কাউকে যদি অন্যকোনো মেয়েকে টিজ করতে দেখেছি চোখ একদম উপড়ে নেব। ”

হৃদিতা মেইন গেইটের দিকে তাকিয়ে দুজন পুলিশকে দেখেই শয়তানি হাসি হেসে বলে,” ওই যে দুজন ভূত দেখতে পাচ্ছি। বলব নাকি ঘাড় মটকে দিতে?”

ছেলেগুলো পিছনে তাকিয়ে লাঠি হাতে দুজন পুলিশকে দেখে শুকনো ঢোক গিলে নেয়৷ তাদের মধ্যে একজন বলে ওঠে,” স্যরি ম্যাম। এরকম ভুল আর হবে না।”

হৃদিতা তাকে হাত দিয়ে ইশারায় কাছে ডেকে বলে,” আমার বাবা উকিল। রাসেল শেখকে চেনা আছে? একটা করে ধরবে, জেলে ভরবে আর টিপে টিপে মা*রবে।”

ছেলেগুলো অনুনয় বিনয় শুরু করে দেয়। তারা বয়সে ছোটো হওয়ায় তাদের ভয় দেখাতে হৃদিতার মজাই লাগছিল তবে আফসোসও হচ্ছিল এটা ভেবে যে এতটুকু ছেলেগুলো ভদ্রতার প্রকাশের বয়সে কী অভদ্রতাটাই না করছে!

হৃদিতা নিজের আসনের দিকে যেতে থাকে। মোড় ঘুরতেই ধাক্কা লাগতে লাগতে বেঁচে যায় সে। কিছু বলবে ওমনি সামনে তাকিয়ে কানে ফোন সমেত আবরার ফাইয়াজকে দেখে থমকে যায় সে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার চোখের দিকে তাকাতেই দমে যায় সে।

আবরার ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তিটাকে বলে,” ফোন রাখো, আমি পরে কলব্যাক করছি।”

হৃদিতা পাশ কাটিয়ে চলে যাবে এমন সময় ফোনটা পাঞ্জাবির পকেটে রেখে আবরার হৃদিতাকে ডেকে বলে,” দাঁড়ান।”

হৃদিতা দাঁড়িয়ে যায়। মাথানিচু করে বলে ,” জি বলুন।”
” আপনিই তো গান গাইলেন তাই না?”
” জি আমি।”
” সুন্দর গান করেন। গান নিয়ে এগুনোর ইচ্ছে আছে?”
” উহু৷ শখে গাই। ”
” শখ তো প্রফেশনও হতে পারে।”
” না, শখকে প্রতিটা মানুষ ভালোবাসে, শখ হচ্ছে একেকটা আবেগ। সবাই নিজের প্রফেশনকে পছন্দ করে না।”
” বাহ! ভালো বলেছেন কিন্তু। গানের সাথে ভালো কথাও বলতে পারেন দেখছি।”
” শুকরিয়া।”
” বাসায় কোথায় আপনার?”
” সামনেই বাসা ভাড়ায় থাকি, টার্মিনালের মেইন রাস্তায় ওঠার ঠিক আগে হাতের বাম সাইডে গোলাপি রঙের বাসা। দুজন রুমমেটের সাথে থাকতে হয়।”
” আচ্ছা৷ জব খুঁজছেন হয়তো। এটা আমার কার্ড, প্রয়োজন মনে হলে কল দিতে পারেন। ” বলেই হৃদিতার হাতে একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়ে চলে যায় আবরার।

হৃদিতা আবরারের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে, ” আপনাকে ভালো লেগে গেছে, নেতা সাহেব। আমার যেটা পছন্দ সেটাকে প্রয়োজন নয় প্রিয়জন বানিয়ে নিতে অভ্যস্ত আমি। ”
______

উমেদ বাড়ি ফিরেছে অনেকক্ষণ। আসার পর থেকেই বিছানায় উল্টাসিধা হয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ময়না বেগম কয়েকবার এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন উমেদ কিছু খাবে কি না। উমেদ সব খাবারের কথায় নাকচ করে দিয়েছে।
বাড়ি আসার পর একটাবারের জন্যও সে সুরাইয়াকে দেখেনি। তার কাছে এটা আর নতুন কী? আশরাফ আর সুরাইয়ার বিয়ে হয়েছে চার বছর। আশরাফ আগে থেকেই বাহিরে থাকতো। দুই বছর আগে যখন বাসায় আসলো বিয়ে করতে তখন প্রথমেই উমেদকে ডেকে বলেছিল সুরাইয়ার কথা। জানিয়েছিল সে সুরাইয়াকে বিয়ে করতে চায়। এই যে বিয়ে হলো তারপর থেকেই যেন সবকিছুর নতুন সূচনা হলো। আশরাফের বিয়ের পরই মূলত বুঝতে শিখেছিল সে সুরাইয়াকে ভালোবাসে। বিয়ের আগের সেই দিনটার কথা মনে পড়লেই বুক ভারি হয়ে আসে মনে হয় কেউ বুকের ওপর বসে আছে এখনই গলা টিপে ধরবে। নিজের দোষে হারিয়ে ফেলা ভালোবাসার সম্মুখীন হওয়ার ভয়ে, যন্ত্রণায় সে বাড়ি ফেরার পথ ভুলে গিয়েছে। চার বছরে যতটা কম আসা সম্ভব সে এসেছে।

রুমের বাহিরে থেকে মেয়েলী গলায় কেউ বলে,” চা পাঠিয়ে দিব আপনার জন্য?”

গলাটা কানে পৌঁছতেই বুকটা কেঁপে ওঠে উমেদের। ভাঙা ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করে,” কেমন আছিস?”
” ভালো আছি৷ চা খেলে বলেন পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
” তোর হাতের চা হলে খাওয়া যায়।”
” ক’ চামচ চিনি দিতে হবে?”
” ভুলে গেছিস সব?”
” ক’ চামচ?”
” এক।”

উমেদ আবার বলে ওঠে,” আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা একদমই গোল্লায় গেছে তাই না?”

” সম্পর্ক ভিন্ন করেছিলেন আপনি, যার বউ হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম, আশায় বাঁচতে শুরু করেছিলাম তার ভাইয়ের বউ হয়ে বসে আছি, দারুণ না! আজ আপনি আমার নিষিদ্ধ পুরুষ, আপনার সামনে যাওয়া তো দূর আপনার দিকে তাকানোও অন্যা*য়। সব পুরুষ তো বোকা হয় না, শখের নারীকে ছাড়ে না আপনি ছাড়লেন কেন? ওহ স্যরি আমি আপনার বন্ধু ছিলাম, শখের নারী নই। ”

উমেদ কিছু বলে না৷ এক বিশ্রী যন্ত্রণা তাকে চেপে ধরে। গলা আটকে যায় শব্দ বেরোয় না, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে তার।

বাহিরে থেকে সুরাইয়ার গলা ভেসে আসে,” অতীত ভুলে বর্তমানে ফিরে আসুন। আমি আপনার বড়ো ভাইয়ের বউ৷ সম্পর্কে বড়ো ভাবি। আপনি অযথা এরকম কথাবার্তা তুলবেন না। একাকী কোনো সময় সামনে আসবেন না, অনুরোধ। ভালো চেয়েছিলেন আমার, ভালো থাকতে দিন। ”

#চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে