প্রীতিকাহন পর্ব-৩০+৩১

0
446

#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_৩০

❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌

চোখ তুলে তাকালো নবাব, “আমার কাছে মিষ্টি মানে সুখের একটা ছোট্ট পুঁটলি আর আমি সেই পুঁটলি থেকে যখন-তখন সুখ বের করে নিতে পারি। তাহলে দুঃখের কথা আসবে কেন?”

মুগ্ধ নয়নে মিষ্টি নবাবকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, “তোমার কথার ভিড়ে সর্বদা আমি হারিয়ে যাই নয়ত হেরে যাই। কখনওই তেমন করে জবাব দিতে পারি না।”

“হয়ত আমার কথায় তোমার মন ভুলে যায়।”

স্মিত হেসে মিষ্টি বললো, “হ্যাঁ, তুমি তো আবার কথার জাদু দিয়ে মানুষের মন ভুলিয়ে দিতে পারো। যাক, এখন ঘুমিয়ে পড়ো। রাত তো আর বেশি বাকি নেই।” এই বলে মিষ্টি নবাবের হাত ছেড়ে দিলো।

“যখন বাকি নেই তবে ঘুমিয়ে কী করবো?”

অবাক হলো মিষ্টি, “তাহলে কী করবে?”

মিষ্টির হাত পরম যত্নে আগলে নিয়ে নবাব বললো, “এই যে, হাত ধরে বসে বসে তোমার রাগ দেখবো।”

“বাজে না বকে ঘুমাও। আমি যাচ্ছি।” বলেই মিষ্টি উঠতে নিলে নবাব হাত টেনে বসিয়ে দেয় মিষ্টিকে আর গম্ভীর গলায় বলে উঠে, “পিস্তল কিন্তু গুলিতে একদম ঠাসা। একটাই গুলি খরচ করেছিলাম সেদিন। দ্বিতীয় গুলি কি আজকে খরচ করাতে চাও?”

মিষ্টি মাথা নুইয়ে রেখেছে কিন্তু যখন চোখ তুলে তাকালো, তখন দু’টো মুক্তোর দানা গড়িয়ে পড়লো। নবাব আঁতকে উঠলো তবে কিছু বলার সুযোগ পেল না, “নবাব, বিদেশে গিয়ে আমাকে ভুলে যাবে না তো?” মিষ্টির অশ্রু সিক্ত নয়ন আর আবেগ জড়ানো প্রশ্নে নবাব অবাক-খুশি হলো। কারণ তার মিষ্টি তাকে নিয়ে ভাবছে, তার মিষ্টি তাকে হারানোর ভয়ে চোখে শ্রাবণ ধারা নামিয়েছে। কিন্তু সে বুঝেও স্বাভাবিক রইলো আর মিষ্টির হাত ছেড়ে দিয়ে বললো, “তোমার ঘুম হয়নি মিষ্টি। যাও, গিয়ে একটু ঘুমিয়ে নাও।”

“বলো না নবাব, বলো না আমায় ভুলে যাবে কি না?” মিষ্টির খুব ইচ্ছে করছিল নবাবকে এই প্রশ্ন করতে কিন্তু কোনও একটা অদৃশ্য বাঁধনে আবদ্ধ হয়ে সে নিজেকে সংযত করলো।

.

সারি সারি ঝাউগাছ, চিকচিকে বালির নরম বিছানা আর সামনে নীল জলরাশি এবং শোঁ শোঁ গর্জনের মনোমুগ্ধকর সমুদ্র সৈকত। দুপুরের রোদ্দুরে গরম হওয়া বালিতে একজোড়া নূপুর পড়া পা অন্য জোড়া পায়ের সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটছে। আকাশের নীল আর সমুদ্রের নীল এখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। ঢেউয়ের ছন্দে মৃদু পবনের কোমল স্পর্শে রোমাঞ্চিত মিষ্টির মন ক্ষণে ক্ষণে বলে উঠছে, “আল্লাহর অপূর্ব সৃষ্টি। দুই চোখ দিয়ে দেখেও মন ভরে না।”

হাঁটাহাঁটি করে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। মিষ্টি আর নবাব একই চেয়ারে বসে আছে কিন্তু নিশ্চুপ হয়ে। কক্সবাজারের বালুচরে যখন প্রথম পা রাখে সেই থেকে দু’জনে চুপ করে আছে। তবে এখন পাশাপাশি বসে মিষ্টির নিরব থাকতে অস্বস্তি লাগছে। চারপাশে সমুদ্র, বাতাস আর মানুষের হৈ-হুল্লোড়ে প্রকৃতি চঞ্চল কিন্তু তার পাশের মানুষটাই কেমন স্থবির হয়ে আছে। কালকে রাত থেকেই নবাব চুপ হয়ে গেছে, অনেকটা হঠাৎ করে। নবাবের এমন নীরবতা মিষ্টির হা-হুতাশ বাড়িয়ে তুলছে।

“নবাব?” চারপাশের অজস্র আওয়াজ ভেদ করে মিষ্টির নরম ডাক নবাবের কান অবধি পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। তাই বাধ্য হয়ে মিষ্টি দ্বিতীয়বার নবাব নাম মুখে আনে, “নবাব?”

“হুম।” জবাব দিয়ে নবাব ফিরে তাকালো। মিষ্টি স্পষ্টত বুঝতে পারলো নবাব কোনো ভাবনায় ডুবে আছে। কিন্তু সেটা প্রকাশ না করে জিজ্ঞেস করলো, “কক্সবাজার নিয়ে কিছু বলবে না?”

নবাবের সাথে বিয়েতে আবদ্ধ হওয়ার পর থেকেই বাইরে বের হলে মিষ্টিকে বোরকা হিজাব পড়তে হয়। মূলত পালিয়ে বেড়ানোর জন্য হলেও নবাব ছোট্টবেলা থেকে চাইতো মিষ্টি যেন বোরকা পড়ে। সব দিক বিবেচনা করে মিষ্টি কোনও আপত্তি করেনি। তবে সমুদ্রের হাওয়া লাগাতে মুখের হিজাব তুলে দিয়েছে সে অনেক আগেই। এখনও দুপুর হয়নি তবে রোদের তেজে এই সমুদ্রে তাকানো দায়। মাথার উপর মস্ত বড়ো ছাতা থাকা সত্ত্বেও রোদ্দুরে তাকাতে মিষ্টির সমস্যা হচ্ছে। চোখ ছোট করে সে নবাবের দিকে তাকিয়ে আছে।

“কী হয়েছে তোমার? হঠাৎ এমন চুপ হয়ে গেলে কেন?” নবাব জবাব দিচ্ছে না বিধায় মিষ্টি বাধ্য হয়ে কারণ জানতে চাইলো।

একটু হাসলো নবাব, “বিছানাকান্দি সম্পর্কে জানাতে কত জোর করেছিলাম অথচ তুমি শুনবে না বলে জানিয়ে ছিল। কিন্তু আজকে নিজে থেকে জানতে চাইছো বলে অবাক লাগছে।”

“অবাক হওয়ার কী আছে? আমি কি জানতে পারি না?”

“হুম, পারো।”

“তাহলে বলো। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে।”

“কক্সবাজার সম্পর্কে তো তোমার জানা আছে। বই বা অন্য কোথাও হতে হয়ত জেনে থাকবে।”

একটু লজ্জা পেল যেন মিষ্টি এমন ভঙ্গিতে মাথা নামিয়ে বললো, “জানার তো শেষ নেই। একটু-আধটু হয়ত জেনেছিলাম কিন্তু আমার ইচ্ছে আমি তোমার মুখ থেকে শুনবো।”

“এই মিষ্টি, তুমি কি সত্যিই আমার মিষ্টি?” এই বাক্যে নবাবের কন্ঠস্বর বদলে গেল। মিষ্টি আবারও সেই চিরাচরিত নবাবকে দেখতে পেয়ে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। মুখ ভরে হেসে জবাব দিলো, “জানি না।”

মিষ্টির সাথে তাল মিলিয়ে হেসে নবাব জানতে চাইলো, “কী হয়েছে তোমার বলো তো? আজকে নিজে থেকে আমাকে কেন লাগামহীন হতে বলছো?”

অবাক চোখে তাকালো মিষ্টি, “তোমাকে আমি কক্সবাজার সম্পর্কে বলতে বলেছি। তুমি এখানে অন্য মানে খুঁজে বেড়াচ্ছো কেন?”

কাঁধ নাচালো নবাব, “না, না, অন্য মানে তো নিশ্চয়ই আছে কিন্তু আপাতত না হয় বন্ধ রাখলাম খোঁজাখুঁজি। এখন কক্সবাজারের ইতিহাস শোনো।” এই বলে নবাব মিষ্টির দিকে মুখ করে বসলো আর মিষ্টি একটু রেগেও শান্ত হয়ে রইলো।

“কক্সবাজারের প্রাচীন নাম পালংকী । একসময় এটি প্যানোয়া নামে পরিচিত ছিল। প্যানোয়া শব্দটির অর্থ হলো হলুদ ফুল। অতীতে কক্সবাজারের আশপাশের এলাকাগুলো এই হলুদ ফুলে ঝকমক করত। ইংরেজ অফিসার ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স ১৭৯৯ খ্রিঃ এখানে একটি বাজার স্থাপন করেন। উনার নামানুসারে সেটা কক্স সাহেবের বাজার বলে পরিচিত হয় যা পরবর্তীতে কক্সবাজার নামে সম্যক পরিচিত পায়।” এই বলে থামলো নবাব কারণ সে দেখলো মিষ্টি অন্যমনস্ক হয়ে কাকে যেন দেখছে। মিষ্টির মনোযোগ ফেরাতে নবাব বলে উঠলো, “বুঝলে মিষ্টি?”

মিষ্টির চৈতন্য ফিরলো কিন্তু নজর এক জায়গাতেই আটকে রইলো আর এতে নবাবের কপাল কুঁচকালো। মিষ্টিকে সে কিছু বলবার চিন্তা করতেই মিষ্টি হাত দেখিয়ে নবাবকে বললো, “সোহেল।” মিষ্টির মুখে নামটা শুনে পিছনে ঘুরে তাকালো নবাব আর নিজেও চমকে গেল।

কোঁকড়া চুল এবং ভরাট দেহের অধিকারী এক পুরুষ তার সঙ্গিনীর সাথে হাসিতে মত্ত। দু’জন দু’জনের হাত জড়িয়ে দিব্যি হাঁটছে কক্সবাজারের বালুচরে। এদের দেখে হুট করেই নবাব হাঁটতে শুরু করলো আর এটা লক্ষ্য করে মিষ্টি দ্বিগুণ চমকে গেল।

“নবাব…” মিষ্টি নবাবকে ডাকলো কিন্তু নবাব হনহন করে ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো। সোহেলের সাথে হাত মিলিয়ে বেশ হাসিখুশিতে কথা বলতে লাগলো। দূর থেকে এসব দেখে মিষ্টি অবাকের মাত্রা ছাড়িয়ে গেল এবং সে বিড়বিড় করলো, “যার সাথে আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল তার সাথে নবাবের এত ভাব কীভাবে হলো?”

“এই মিষ্টি?” দূর থেকে নবাব হাত উঁচিয়ে মিষ্টিকে ডাকতেই তার মনের প্রশ্নপত্র যেন হাওয়ার তোড়ে উড়ে গেল। কত-শত ভয়, বিস্ময় আর রাগকে পুঁজি করে মিষ্টি যখন উঠে দাঁড়ালো, তখন দ্বিগুণ গতিতে হাত নেড়ে নবাব মিষ্টিকে কাছে ডাকলো। অগত্যা হাঁটতে লাগলো মিষ্টি। নবাবের একদম পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো মিষ্টি মুখে একরাশ বিরক্তি টেনে।

“উনারা এখানে বেড়াতে এসেছেন মিষ্টি।” নবাব বলে উঠলো আর সোহেলের পাশা থাকা মেয়েটাকে দেখিয়ে বললো, “উনি সোনিয়া, আমাদের ভাবী। সোহেল ভাই না-কি ইদানীং বিয়ে করেছেন।” নবাবের নির্লিপ্ত কণ্ঠ নিসৃত বাক্য শুনে অবাক চোখে তাকালো মিষ্টি। ওর অবাক চোখে তাকিয়ে নবাব মৃদু হেসে নিয়ে সোহেলকে জিজ্ঞাসা করলো, “কতদিন আছেন আপনারা?”

“সপ্তাহখানেক আরও আছি। কারণ বাড়ির পরিস্থিতি এখনও বোধহয় শিথিল হয়নি।” নবাবকে জবাব দিয়ে সোহেল মিষ্টির দিকে তাকালো। লোকটার মুখে একটা গম্ভীর ভাব স্পষ্ট দেখতে পেল মিষ্টি আর এতেই ধারণা করলো সোহেল রসকষহীন মানুষ।

“নিজের প্রেমিকাকে রেখে একটা বিধবা মেয়েকে বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে ছিল না আমার। পরিবারের জন্য যদিও বা রাজি হয়েছিলাম কিন্তু বিয়ে হলে হয়ত ডিভোর্স দিতে দেরি করতাম না। আমার কথায় কিছু মনে করবেন না৷ তবে আপনি অনেক ভাগ্যবতী। নবাবের মতো কাউকে স্বামী হিসেবে পেয়েছেন যে কিনা আপনাকে যে-কোনও মূল্যে পেতে রাজি অবশ্য এখানে মূল্যের পাল্লায় টাকা নয়, জীবন রেখেছে নবাব।” এমন কাটকাট কথা শুনে মিষ্টিসহ সবাই অবাক হয়ে গেল। সবার মুখের অবস্থা বদলে যেতে দেখে সোনিয়া বললো, “আপনারা ওর কথায় কিছু মনে করবেন না। ও এমনই সোজাসাপটা কথা বলে দেয়। এতে কেউ কিছু মনে করলো কিনা বিবেচনা করে না।”

মিষ্টি একটু হাসার চেষ্টা করলেও নবাবের বেশ রাগ লাগছিল কিন্তু সে-ও মিষ্টির মতো চুপ থাকার চেষ্টা করলো। এদিকে সোহেল কাঁধ নাচিয়ে বললো, “আমার কথাবার্তা অন্যরকম হলেও এটা কিন্তু ঠিক যে নবাবের জন্য অসম্ভব কিছু সম্ভব হয়েছে।” কথাগুলো সোহেল সোনিয়াকে বললেও ভরদুপুরে নবাবের এসব শুনতে ইচ্ছে করছে না। তাই সোহেলের কাঁধে হাত রেখে নবাব বললো, “অনেক বেলা হয়ে গেছে। আমরা এখন আসি। বেঁচে থাকলে হয়ত দেখা হবে।” এই বলে নবাব মিষ্টির হাত ধরে হাঁটতে শুরু করলো। নবাবের বাচনভঙ্গি স্বাভাবিক থাকলেও চেহারায় রাগ জমে ছিল আর তাই সোহেল কোনও কথা খুঁজে পায়নি। এদিকে মিষ্টি এখনও বুঝতে পারছে না এতক্ষণ ধরে তার চোখ কী দেখলো আর কান কী শুনলো? তবে যেই শব্দ আজ অবধি নবাব কখনও মুখে আনেনি, সেই ‘বিধবা’ শব্দ শুনে মিষ্টির ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে গেল। হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই স্মৃতি যা মিষ্টির জীবনকে দুঃখের সম্মুখীন করতে বাঁক নিয়েছিল।

“মিষ্টি? নবাব এসেছে?” মায়ের কন্ঠ শুনতে পেল মিষ্টি ওয়াশরুম থেকে। জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে কেবলই ঢুকেছিল মিষ্টি কিন্তু নবাবের নাম শুনে কাপড়চোপড় হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়লো। রুমের বাইরে যাওয়ার চিন্তা ছিল মিষ্টির মাথায় কিন্তু নিজের ঘরেই নবাবকে দেখে খানিকটা চমকে উঠলো, “কখন এলে?”

নবাব উল্টো দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিল। মিষ্টির কন্ঠ শুনে ফিরে তাকিয়ে সে নিজেও চমকে গেল। কালো পেড়ে হলুদ শাড়িতে মিষ্টিকে অন্যরকম লাগছে। কিন্তু এই অন্যরকম লাগার ভিড়ে নবাব তার হৃদয়ে যন্ত্রণা অনুভব করছে। কষ্টের ওজন ভারী হতেই তার গলা ধরে আসছে। নিজেকে সামলানো বড্ড দায় হয়ে পড়ছে তবুও নবাব বললো, “এই মাত্র।”

…চলবে

#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_৩১

❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌

নবাবের এলোমেলো চুল আর মলিন মুখ দেখে মিষ্টি বিচলিত হলো, “নবাব, কী হয়েছে তোমার? চেহারা এমন লাগছে কেন?”

মিথ্যা কথাটা বলতে যদিও মুখে বিঁধছে তবুও বলতে হলো নবাবকে, “তেমন কিছু না। মাথাটা একটু ধরেছে। তুমি আমার মাথাটা একটু টিপে দিবে মিষ্টি?”

“এখন?” চমকে উঠলো মিষ্টি।

“হ্যাঁ।”

মিষ্টি জানে নবাবকে বারণ করলেও সে শুনবে না। তাই অগত্যা সে রাজি হলো কিন্তু বাসা ভর্তি মেহমানের কথা মনে পড়তেই বললো, “ছাদে গিয়ে দেই? বাসায় তো…” মিষ্টির কথার মাঝে নবাবের একটু রাগ হলো, “ইট’স ওকে মিষ্টি। লাগবে না। আমি গেলাম।” এই বলে নবাব চলে যেতে নিলে মিষ্টি নবাবের হাত ধরে আদুরে গলায় বললো, “সবসময় ভুল বুঝো কেন আমায়? তোমাকেও তো আমি বুঝতে পারি না। কালকে কত করে বললাম আজকে আমার বাগদানের অনুষ্ঠানে তুমি এসো কিন্তু তুমি রাজি হলে না। এখন অনুষ্ঠান শেষ হতে চলে এলে আবার তিনসন্ধ্যায় মাথা টিপে দিতে বলছো। আমি তো বারণ করিনি কিন্তু বাসা ভর্তি মেহমান তাই ভাবলাম…”

ফিরে তাকালো নবাব এবং স্থির দৃষ্টিতে অনর্গল বলে গেল, “তোমাকে আমি কখনও ভুল বুঝিনি মিষ্টি হয়ত তুমিই আমাকে কোনও দিন বুঝবে না। আমি সপ্তাহ খানেক পরে বিদেশ চলে যাবো। তাই আজকে শেষবারের মতো দেখা করতে এসেছি।”

“কী বলছো তুমি এসব?” আঁতকে উঠলো মিষ্টি।

নবাবের নির্বিকায় উত্তর, “হ্যাঁ।”

“কিন্তু এর জন্য তো অনেক দেরি আছে, তাই না? আমাকে তো ফুপ্পি বললো…” মিষ্টির চোখে অসীম বিস্ময় বলে সে কথা হারিয়ে ফেলছে৷ এদিকে নবাবও চাপা কষ্টে যেন বোবা হয়ে আছে প্রায়৷ গলায় আঁটকে থাকা কষ্টকে গিলে সে বললো, “আমি ছাদে যাচ্ছি। তুমি এসো।” বলেই নবাব চলো গেল৷ কিন্তু ‘তুমি এসো’ বাক্যে দুনিয়ার সমস্ত কষ্ট যেন সে বুঝিয়ে দিয়ে গেল মিষ্টিকে। আর সেই ভাবনায় মত্ত হয়ে শাড়ির আঁচলে মুখ চেপে বলে উঠলো, “কী হচ্ছে এসব?”

“মিষ্টি আপু?” হঠাৎ লামিয়ার কন্ঠ শুনে সম্বিত ফিরলো মিষ্টির।

“কী?”

“বড় চাচী ডাকছে তোমাকে।”

“কেন?”

“জানি না।”

“হঠাৎ আবার মা কেন ডাকছে? এদিকে দেরি করলে নবাব হয়ত রাগ করবে।” এমন ভাবনায় মিষ্টি লামিয়াকে বললো, “তুই যা। আমি যাচ্ছি।”

“ঠিক আছে।”

লামিয়া চলে যেতেই মিষ্টি নিজের মায়ের খোঁজ করতে লাগলো। মেহমানদের নজর এড়িয়ে ডাইনিং রুমে মাকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আমায় ডেকেছো?”

“হ্যাঁ।” জবাব দিয়ে মেয়েকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “এ কি! তুই এখনও কাপড় বদল করিসনি?”

“না মানে…” মিষ্টি ইতস্তত করতেই মিষ্টির মা কিছু একটা খাবারের বাটি এগিয়ে দিলেন। মিষ্টি দেখলো এতে পায়েস রয়েছে। খানিকটা বিস্মিত হলেও জিজ্ঞেস করার আগে শুনতে পেল, “হুট করে ছেলেটা এলো। ভাগ্যিস পায়েসটা আছে। এটা ওকে দিয়ে দিস আর তুই তো বললি নবাব আসবে না। আপাও বলেছিলেন। যাক, তুই নিয়ে যা।” মিষ্টি ভেবেছিল তার মা হয়ত তাকে অন্য কাজে ডেকেছে। সে বুঝতে পারেনি তার মা নিজেও নবাবকে নিয়ে এতটা ভাবে।

পিঠ ঘুরিয়ে শাড়ির আঁচল টেনে এক হাতের মুঠোয় রেখে অন্য হাতে পায়েসের বাটি নিলো মিষ্টি। ধীর পায়ে যখন ছাদে পৌঁছালো, তখন আকাশ কৃষ্ণ বর্ণের হয়ে গেছে। কৃত্রিম আলোয় ছাদ ঝলমল করছে আর সেই আলোকে ধার করে মিষ্টি দেখতে পেল নবাবকে। পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আকাশের হাজারো তারা দিকে তাকিয়ে।

নিঃশব্দে মিষ্টি এসে দাঁড়িয়ে ডাকলো নবাবকে, “নবাব?”

একটু সময় নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো নবাব। ক্লান্ত মুখে তার মলিনতার ছড়াছড়ি। চাপা দিতে গিয়েও কষ্ট ভাসছে দিনের আলোর মতো। কিন্তু সব সরিয়ে সে মিষ্টিকে জিজ্ঞেস করলো, “তোমাকে সমস্যায় ফেললাম, না?”

“তোমার আর আমার কথা সবাই জানে নবাব৷ আমরা কত ভালো বন্ধু তা কাউকে আলাদা করে বলা লাগে না। তাই সমস্যা হওয়ার মতো কারণ দেখছি না।”

“তাহলে মেহমানদের কথা বললে যে।”

মিষ্টি কী উত্তর দিবে ভেবে পাচ্ছে না তবুও নবাবকে বুঝাতে চেষ্টা করলো, “জানি না কেন বলেছি? হয়ত না ভেবেই বলেছি।”

“আমি কিছু খাবো না মিষ্টি।” হঠাৎ নবাব খাওয়ার কথা বলতে মিষ্টির খেয়াল হলো সে নবাবের জন্য পায়েস নিয়ে এসেছে। এখন সেটা মনে পড়তেই বললো, “মা পাঠিয়েছেন। না খেলে নিশ্চয়ই রাগ করবেন।”

ছাদে বসার সুন্দর ব্যবস্থা আছে। সিমেন্টের তৈরি চেয়ার দেখিয়ে মিষ্টি বললো, “ওখানে আগে বসো। এরপর লক্ষী ছেলের মতো খাবে তারপর তোমার সব কথা শুনবো।”

“মাথা ব্যথা নিয়ে এসব খেতে ইচ্ছে করছে না।”

“না খেলে নিশ্চয়ই সেরে যাবে না।… চলো।”

নিমরাজি হয়ে নবাব মিষ্টিকে অনুসরণ করলো। পাশাপাশি দু’জনে বসতেই মিষ্টি পায়েসের বাটি এগিয়ে দিয়ে বললো, “খাও। পায়েস তো তোমার খুব পছন্দ, তাই না?”

পায়েসের বাটি হাতে নবাব বললো, “ভালোই তো আমার পছন্দ অপছন্দের খবর রাখো।”

হালকা হাসলো মিষ্টি, “হয়ত।”

বেশ কিছুক্ষণ আর ওদের মাঝে কথা হলো না। নবাব চুপচাপ খেয়ে গেল আর মিষ্টি আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। নবাবের খাওয়া শেষ হতেই বাটিটা মিষ্টিকে ফিরিয়ে দিয়ে বললো, “একটু বেশিই মিষ্টি।”

আনমনে ম্লান হাসলো মিষ্টি, “খাবার হোক বা অন্য কিছু। নামটা শুনলেই মনে হয় যেন আমাকে নিয়ে বলা হচ্ছে।”

মিষ্টিকে চুপ থাকতে দেখে নবাব বললো, “দেরি হওয়ার কথা ছিল কিন্তু সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। তাই আমিও দেরি করতে চাই না।” মিষ্টির মুখ মলিন হলো নবাবের কথা শুনে।

“কিন্তু দুইমাস পরে আমার…” চাপা লজ্জায় মিষ্টি পুরো বাক্য শেষ করতে পারলো না। কিন্তু নবাবের বুঝতে অসুবিধা হয়নি মিষ্টি নিজের বিয়ের কথা বলছে।

“সবাই তো থাকছেই মিষ্টি। তাছাড়া আমার কোনও ভূমিকা নেই তোমার বিয়েতে।” গম্ভীর গলায় কথাগুলো বললো নবাব আকাশের দিকে মুখ করে।

“এটা তুমি বলতে পারলে নবাব? মা বাবার পর আমার জীবনে যদি কারোর ভূমিকা থেকে থাকে তবে সেটা তুমি নবাব, তুমি।”

“আমার ক্ষেত্রেই কিন্তু তাই মিষ্টি আর তোমাকে আঘাত করতে আমি কথাটা বলিনি। বিদেশে গেলে দুই মাস পরেই আমার পক্ষে দেশে ফেরা সম্ভব নয়। তাছাড়া এখন যেতে না পারলে এতগুলো টাকা নষ্ট হয়ে যাবে।”

মিষ্টির খুব কষ্ট লাগছে। ওর কেবলই মনে হচ্ছে টাকার ভিড়ে সে নবাবের কাছে ফিকে হয়ে গেছে। কষ্ট লুকাতে মানুষ গম্ভীর হয়ে উঠে আর অসীম রাগের চাদর চাপা কান্নাকে আড়াল করে। মিষ্টিও তাই করে বললো, “ঠিক আছে, যাও। সাবধানে থাকবে আর নিজের যত্ন করবে।” নবাব কোনো জবাব দিলো না।

আকাশে ঝলমল করা একটা নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো, “পৃথিবীর আকাশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রের নাম কী জানো মিষ্টি?” মিষ্টির এখন এসব শুনতে ভালো লাগছে না বিধায় থমথমে গলায় জবাব দিলো, “নাহ।”

নবাব তেমনই আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, “লুব্ধক, যাকে ইংরেজিতে বলে Sirius.” এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে মিষ্টির দিকে তাকালো নবাব। শীতল কন্ঠে বললো, “এর আরেকটা নামও আছে, স্বাতী নক্ষত্র। আমার কাছে তুমিও ঐ লুব্ধক নক্ষত্রের মতো। হাজারও নক্ষত্রের ভিড়ে সবচেয়ে উজ্জ্বলতম একটা নক্ষত্র, স্বাতী নক্ষত্র।”

নবাব প্রায়শই এমন নতুন নতুন তথ্য জানিয়ে মিষ্টিকে অবাক করে দিতো। আজকেও ব্যতিক্রম হয়নি কিন্তু নবাবের কাছে স্বাতী নক্ষত্র হওয়ার মানে সম্পূর্ণরূপে বুঝতে পারছে না মিষ্টি। তাই এই সম্পর্কিত আলোচনা না করে বললো, “এসো তোমার মাথা টিপে দেই।”

“নাহ, এখন আমাকে যেতে হবে মিষ্টি।”

“আর একটু থাকো না নবাব। রাত তো এখনও তেমন করে হয়নি।” অনুনয়-বিনয় করলো মিষ্টি কিন্তু সেটা প্রত্যাখান করতে হালকা হাসলো নবাব, “চাইলেও থাকা সম্ভব নয় মিষ্টি। অনেক দেরি যে হয়ে গেল।… ভালো থেকো। বেঁচে থাকলে দেখা হবে একদিন।” এই বলে নবাব দ্রুত পায়ে ছাদ ত্যাগ করলো।

…চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে