প্রীতিকাহন পর্ব-২৬+২৭

0
473

#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_২৬

❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌

নিঃশব্দে দাঁড়ালো মিষ্টি কারণ সে বুঝতে পারছে না নবাব এখন কী বলতে চাইছে। এদিকে তার মনের ঘর ঝড়ে নড়বড়ে হচ্ছে। একটা অস্বস্তি তাকে যেন গ্রাস করছে।

শ্লথ পায়ে নবাব এসে দাঁড়লো মিষ্টির কাছে। মাথা নামানো আর মুখ মলিন হয়ে আছে যা মিষ্টি এক ঝলকে দেখে নিলো। চোখেমুখে মলিনতার ছায়া টেনেই কন্ঠ নরম করলো নবাব, “কালকে আমার ওইভাবে বলা ঠিক হয়নি। দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় আমি যদি এমন না করতাম তাহলে হয়ত রাতে তোমাকে এতটা…”

মিষ্টি ভাবেনি নবাব এখন কালকের প্রসঙ্গ টেনে কথা বলবে। তবে এমনটা হওয়াতে সে স্বস্তি ফিরে পেল এবং নিজেকে অতি দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় এনে বললো, “নবাব, কালকের কথা কেন টানছো? কালকের বিষয় সূর্যের সাথে সাথে অস্তমিত হয়েছে। আজকে যেমন আকাশ নতুন করে উজ্জ্বল হয়েছে, তেমন নতুন প্রসঙ্গেই কথা হোক। কালকের বিষয় মনে রেখো না।”

“তুমি কষ্ট পাওনি?” নবাবের চোখে কিঞ্চিৎ বিস্ময় দেখতে পেল মিষ্টি। এতে ম্লান হেসে জবাব দিলো, “আমি কষ্ট পেতে পারি– এটা যে বুঝতে পেরেছো এতেই খুশি হয়েছি। তবে সবচেয়ে বেশি খুশি হতাম তুমি বিদেশে ফিরে গেলে।”

“আমার সঙ্গ পীড়াদায়ক, তাই তো?” হঠাৎ নবাবের মুখের মলিনতা গাম্ভীর্যের আড়ালে ঢাকা পড়লো। অতি সহজে সেটা ধরতে পেরে মিষ্টি জিজ্ঞেস করলো, “বিদেশে গেল খুশি হওয়ার কথা বলেছি তাই এমনটা বলছো?”

“নাহ, এমনিতেও তো আমাকে তোমার সহ্য হয় না। এতে কাছে থেকেও তোমার মুখে হাসি ফুটাতে ব্যর্থ আমি। লোকমুখে শুনেছি আপন মানুষের মুখদর্শন করলেও প্রশান্তি আসে মনে কিন্তু আমার মুখ দেখে তো তোমার হৃদয় ফাটে কষ্টে।” নবাব যেন ইচ্ছে করেই মিষ্টিকে ব্যথিত করতে চাইছে।

“নবাব, এসব কী বলছো তুমি?” ধমকে উঠলো মিষ্টি আর আচমকা নবাব পিছন ফিরে দুই কদম সামনে চলে গেল। মিষ্টি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রাগে যেন কাঁপছে কিঞ্চিৎ। কয়েক মূহুর্ত নবাব কী যেন ভেবে আবার মুখোমুখি হলো মিষ্টির কিন্তু এবার ভিন্ন সুরে জানতে চাইলো, “এই মিষ্টি, আমাকে গ্রহণ করা কি খুব কঠিন?”

নবাবের এমন কন্ঠ মিষ্টির কাছে অপরিচিত নয়। নবাব নিজেকে সর্বদা মিষ্টির চেয়ে বড় এবং দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ মনে করলেও মাঝে মাঝে সেই ছোট্ট নবাব হয়ে যায়; যেই নবাব বড্ড ভালোবাসা কাতুরে, যেই নবাব মিষ্টি কাতুরে।

“এটা নিজেকেই না হয় জিজ্ঞেস করো।” একটু শক্ত গলায় উত্তর দিলো মিষ্টি।

“করেছি।” হালকা হাসলো নবাব।

“কী জবাব পেলে?” তোয়ালে সুদ্ধ হাত ভাঁজ করে দাঁড়ালো মিষ্টি।

“অনেক আগেই আমায় গ্রহণ করে ফেলেছো।” কথা বলে নবাব যেন মজা পেল এমন ভঙ্গিতে মিটিমিটি হাসতে লাগলো। এদিকে একটু লজ্জা নিয়ে রাগ এসে ঘাড়ে চেপে বসলো মিষ্টির। সেটাকে পাত্তা না দিয়ে মিষ্টি বললো, “দিনকে দিন অনেক পরিবর্তন হচ্ছে তোমার।”

“হবেই তো সম্পর্ক যে গভীর থেকে গভীরতম হচ্ছে। বন্ধু থেকে প্রীতি…” হাত দেখিয়ে মিষ্টি জিজ্ঞেস করলো, “দুপুরে নিশ্চয়ই মার খেয়ে পেট ভরাতে চাও না।”

“আমার কিন্তু খেতে আপত্তি নেই।” টাউজারের পকেটে হাত গলিয়ে ঠোঁট টিপে হাসতে লাগলো নবাব। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বড় হওয়া চুলগুলো ঝড়ের বেগে পল্লবের মতো যেন নেচে চলেছে। এমন সৌন্দর্যে নবাবকে কি ভালো লাগছে? নাহ, মিষ্টির মনে হলো এমন সৌন্দর্যে বেমানান লাগছে নবাবকে। তবে মুখের হাসিতে সে তৃপ্তি খুঁজে পাচ্ছে।

“নিজের মাঝে কষ্ট চেপে এভাবে আমাকে হাসতে শেখাবে? আমি তোমার মতো হৃদয়ে কষ্ট চেপে হাসতে চাই।” আচমকা মিষ্টির এমন কথায় নবাবের হাসি যেন মাঝদরিয়ায় ডুব দিলো। বিস্মিত চোখে সে মিষ্টিকে দেখে চোখ নামিয়ে নিলো। মিষ্টি বুঝতে পারলো নবাব কোনও উত্তরের সন্ধান পাচ্ছে না। তাই পিছনে ঘুরে দাঁড়িয়ে নরম সুরে বললো, “নবাব, অতি অল্প কথায় বলছি আমি, একটু কষ্ট করে বুঝে নিও তুমি। যার জীবন থেকে হাসি বিলীন হয়ে গিয়েছিল তাকে তুমি সেই হাসি ফিরিয়ে দিয়েছো। যার কাছে তুমি তার হাসির কারণ; এটা কি বলা লাগবে যে সে হতে চায় না তোমার মৃত্যুর কারণ?”

.

“এই মিষ্টি, গান গাও তো।” অন্যমনস্ক হয়ে মিষ্টি বিকালকে দেখছিল কিন্তু নবাবের কন্ঠে তার চেতনা ফিরে এলো। স্নিগ্ধ বিকালের সুমিষ্ট হাওয়ায় এলোমেলো হচ্ছে মিষ্টির কালো হিজাব। সেটা ডান হাতে সামলে নিয়ে তাকালো মিষ্টি নবাবের দিকে। নিষ্পলক চোখে তার বিস্ময়ের ছড়াছড়ি। মিষ্টির চোখের তারা শত প্রশ্নেরা করছে ভিড় কিন্তু সব উপেক্ষা করে নবাব বললো, “চুপ করে না থেকে গান শুরু করো।”

দুপুরের আহার শেষে নবাব মিষ্টিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল ফয়েজ লেকের অপার সৌন্দর্যে হারিয়ে যেতে। এই অঞ্চলের চারদিকে পাহাড় আর মাঝখানে রয়েছে অরুনাময়ী, গোধূলী, আকাশমনি, মন্দাকিনী, দক্ষিনী, অলকানন্দা নামের হৃদ। হৃদের পাড়ে যেতেই দেখা মিললো সারি সারি নৌকা। সেই সারি সারি নৌকার ভিড়ে নবাব খুঁজে নিলো ছোট্ট একটা নৌকা কেবল দু’জনার জন্য। নৌকায় বসে কিছু দূর যেতেই চোখে পড়লো দুই দিকের সবুজ পাহাড়, মাঝে মধ্যে দু-একটি বক এবং নাম না জানা হরেক রকম পাখি। এতোসব মুগ্ধতার ভিড়ে ডুবে ছিল মিষ্টি আর নবাবও ছিল নিশ্চুপ। কিন্তু হঠাৎ এমন আবদারে যেন সকল নিশ্চুপের ছুটি হয়ে গেল।

“কী হয়েছে তোমার?” পানির শব্দের মাঝে মিষ্টির কন্ঠের স্নিগ্ধতায় মৃদু হাসলো নবাব, “গান গাইতে বললাম এখানে কিছু হওয়ার কী আছে?”

“চট্টগ্রামে কোনও কালোজাদু হয়?”

“কেন?” জানতে চাইলো নবাব।

“সেদিন জিপে জ্ঞান ফেরার পর যেই নবাবকে দেখেছি, এখানে এসে তার কোনও মিল খুঁজে পাচ্ছি না।” মিষ্টির কথায় নবাব শুধু হাসলো আর যেন একটু লজ্জায় চোখ নামালো। সে নিজেকে স্বাভাবিক রাখলেও মিষ্টি ধরতে পেরেছে, নবাব হয়ত লজ্জা পেয়েছে। কিন্তু পরক্ষণেই নিজের মনকে জিজ্ঞেস করেছে, “ছেলেরা লজ্জা পায়?” ঠিকঠাক উত্তর পেল না মিষ্টি।

“আচ্ছা, চট্টগ্রামে ট্রেন ছাড়া আসা যায় না?” খুব দ্রুততার সাথে মিষ্টি প্রসঙ্গ বদলে দিলো আর সেটা নবাব ধরতে না পেরে মিষ্টির কথার স্রোতেই ভাসতে লাগলো, “কেন যাবে না? বাসেও আসা যায়।”

“তাহলে বাসে না এসে হঠাৎ ট্রেনে করে কেন এলো?”

“তোমার জন্য।”

“আমার জন্য?” অবাক হলো যেন মিষ্টি।

“হ্যাঁ।”

“কিন্তু কেন? আমি তো তোমায় বলিনি ট্রেনে করে আসতে।”

“ট্রেনে আসতে বলোনি কিন্তু ট্রেনে উঠতে বলছো।”

একটু বিরক্ত হলো মিষ্টি, “নবাব, ভণিতা করো না তো। আমি কবে তোমাকে বলেছি ট্রেনে উঠতে? তুমি কিন্তু মিছিমিছি এসব বলছো।”

নিজের কোমরে দুই হাত রেখে একটু কপট রাগ দেখাতে নবাব বললো, “এই মিষ্টি, নৌকায় বসে কিন্তু তুমি আমায় মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছো। জানো না, পানির মাঝে দাঁড়িয়ে কেউ মিথ্যা বলে না।” নবাবের ভাবভঙ্গিতে শব্দ করে হেসে উঠলো মিষ্টি, “নবাব তোমাকে না ঝগড়ুটে মহিলাদের মতো লাগছে। ঐ যে, যারা এমন কোমড় বেঁধে ঝগড়া করে আর আমরা মোটেও পানির মাঝে দাঁড়িয়ে নই, বসে আছি তাও নৌকায়।”

“সবসময় আমার কথায় ভুল ধরে এসেছো।” সোজা হয়ে বসে নবাব বললো।

নবাবের দিকে তাকিয়ে ঘাড় কাত করলো মিষ্টি এবং সেই অবস্থায় জিজ্ঞেস করলো, “ভুল করলে সেটা ধরবো না?”

“তোমার কাছে ধরা পড়তে চাই বলেই তো বারংবার এই ভুল করা।”

হঠাৎ দু’জনার চোখ স্থির হয়ে গেল। মুখের বিপরীতে এবার যেন চক্ষুদ্বয় কথোপকথন চালালো। শব্দহীন এই কথোপকথনে মিষ্টি কিছু খুঁজে না পেলেও অনুভব করলো, “ঐ চক্ষুদ্বয় প্রণয়ের নেশায় এত বুঁদ হয়ে আছে, যাকে ছাপিয়ে কখনও খুনের নেশার সৃষ্টি হতে পারে না। কিন্তু কোনওদিন যদি খুনের নেশার সৃষ্টি হয় তবে সেটা কেবলই ব্যর্থ প্রণয়ের আহাজারি হবে।”

নবাবের চোখের কোটরে চোখ রেখে মিষ্টি জানতে চাইলো, “বললে না তো কেন ট্রেনে করে চট্টগ্রামে এলে?”

নবাব একটু নড়ে-চড়ে বসলো। কিছু সময় নিশ্চুপ থেকে বললো, “একদিন তুমি বলেছিলে তোমার ট্রেনে উঠবার অনেক শখ।”

“সেই কবেকার কথা তুমি এখনও মনে রেখেছো?”

হালকা হেসে নবাব ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়ালো। নবাব সোজা হয়ে বসে চোখ নামিয়ে রেখেছে আর তার পাশে বসা মিষ্টি নবাবের দিকে মুখ করে রেখেছে। চট্টগ্রামে এসে মিষ্টি নবাবকে যতই দেখছে, ততই অবাক হচ্ছে। এমনকি কবুল শব্দ উচ্চারণ যবে থেকে করেছে, সেই থেকে মিষ্টির জীবন অন্য দিকে বাঁক নিচ্ছে। তার জীবনে কিছু মিষ্টি অতীতের কথা সে ধীরে ধীরে ভুলতে বসেছিল বর্তমানের ছুরিকাঘাতে। কিন্তু এই নবাব একটু একটু করে তাকে তার অতীত ফিরিয়ে দিয়ে বর্তমানকে রাঙিয়ে তুলছে।

নদীতে ভাসমান নৌকায় বসে মিষ্টি এমন নবাবকে কল্পনা করেনি৷ ছাব্বিশ বছরের এই যুবকের মাঝে এতটা লজ্জা লুকিয়ে থাকতে পারে তা মিষ্টির অজানা ছিল। এই যুবক তাকে ভালোবাসে, জোর করে হলেও বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করেছে তাকে কিন্তু এক মূহুর্তের জন্যও অসম্মান করেনি। এমন জীবনসঙ্গী কয়জনের ভাগ্যে জুটে? যতবার মিষ্টি এসব ভাবতে নেয়, ততবারই তার মনে হয়, “আমার জন্য নবাবের ক্ষতি হলে আমি পাগল হয়ে যাবো। এই মানুষটা আমাকে যতটা চেনে আর বুঝে, আমার মা-বাবাও হয়ত এরচেয়ে বেশি বুঝে না। সবাই তো চায় বাবা-মায়ের মতো আগলে রাখার মানুষটাই জীবনে আসুক। নবাব আমার পরিবারের চেয়েও আমার জন্য বেশি চিন্তিত কিন্তু ওর যে জীবনের নিশ্চয়তা নেই তাও আমার জন্য।”

একটা কষ্ট হৃদয়কে দুমড়ে মুচড়ে দিতেই নিজের অজান্তে মিষ্টি নবাবের হাত ধরলো। নবাব এতে বিস্মিত হয়ে যখন মিষ্টিকে দেখলো, তখন ছলছল নয়নে মিষ্টি বললো, “অনেককিছু বলতে ইচ্ছে করে কিন্তু আমি পারি না নবাব। বলতে নিলে নিজেকে স্বার্থপর মনে হয় আর…” মিষ্টি থেমে যেতেই নবাব দুই হাতে মিষ্টির হাত মিলিয়ে নিয়ে বললো, “আমি তো কিছু শুনতে চাই না মিষ্টি আর না ভাবতে চাই। আমায় শুধু অনুভব করতে দাও। এতেই খুশি আমি।”

“এত উদার কেন ভাবো নিজেকে? হ্যাঁ? সবকিছুই কেন তোমাকে মেনে নিতে হবে?”

…চলবে

#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_২৭

❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌

হালকা হাসলো নবাব, “মেনে কোথায় নিলাম? সবকিছুই তো জোর করে করলাম কিন্তু এখন বাকিটা শুধু অনুভব করতে চাই।”

নবাবের কাছে হাত বন্দি রেখে মিষ্টি মাথা নুইয়ে নিলো। মাঝিরা নৌকা চালাতে ব্যস্ত হলেও সেসব নজর করার হুঁশ নেই নবাব আর মিষ্টির। সন্তপর্ণে নবাব মিষ্টির কানের কাছে এসে ফিসফিস করলো, “ভালোবাসাও অনুভবেই রাখবো। তোমার প্রগাঢ় ভালোবাসায় খুন হয়েও শুনতে চাইবো না ভালোবাসো কি না? তবে আমি জানি, তুমি আমাকে ভালোবাসো। হয়ত সেদিনই ভালোবাসার প্রথম অনুভূতি তোমার হৃদয়ে স্থান পেয়েছে, যেদিন…” নবাবের বলার মাঝে লজ্জায় চঞ্চল হওয়া চোখ আর কাঁপা কন্ঠে মিষ্টি বললো, “থামো। তুমি বড্ড বেশি বলছো। নৌকায় আমরা একা নই।”

হাসতে হাসতে সোজা হয়ে বসলো নবাব কিন্তু মিষ্টির হাত ছাড়লো না। এরপর বললো, “কথার রেলগাড়ী চলতে শুরু করলে আশেপাশের হুঁশ থাকে না।”

তেমনই নত মাথা আর লজ্জায় জড়ানো কন্ঠে মিষ্টি বললো, “এটা নতুন আর কী? তোমার মুখ তো সবসময়ই লাগামহীন।”

“এত চুপ থাকার পরেও এমন অপবাদ দিলে?” অবাক হওয়ার ভঙ্গি করলো নবাব।

মিষ্টি জবাব না দিয়ে বললো, “হাত ছাড়ো আমার।” অথচ হাত একটু ছাড়ানোর চেষ্টা করলেই সরে যেতো। কোনওরূপ চেষ্টা না করেই মিষ্টি হাত ছেড়ে দেওয়ার কথা বলতে নবাব আরও শক্ত করে চেপে ধরলো।

“এই হাত ধরেই তো ভবিষ্যতের পথে হাঁটবো আমি তাহলে ছাড়ার কথা বলছো কীভাবে?” মিষ্টি জবাব দিলো না কিন্তু নবাব ওর মুখপানে তাকিয়ে অপেক্ষা করলো। এই অপেক্ষার অবসান ঘটলো নৌকা থামার ফলে। পাড়ে এসে নৌকা থেমেছে বলে নবাব মিষ্টির হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো৷

“চলো। এবার আমাদের নামতে হবে।” এই বলে নবাব পায়ে পায়ে নৌকা থেকে নেমে দাঁড়ালো শুকনো মাটিতে। তবে নামার পূর্বে মাঝিদের সাথে একটু সময় ব্যয় হলো ভাড়া মিটাতে গিয়ে। মিষ্টি নৌকার শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়ালো কিন্তু নামতে গিয়ে ওর মাঝে একটু ভয় কাজ করলো, “এই বোরকা যদি পায়ে পেঁচিয়ে যায় আর আমি যদি পড়ে যাই?” অতি অল্প সময়ে মিষ্টি ভাবনায় ডুব দিলো। এদিকে নবাব অস্থির হয়ে হাত বাড়ালো, “দাঁড়িয়ে পড়লে কেন? হাত দাও জলদি।” যেই হাত এতক্ষণ নবাবের মুঠোয় বন্দী ছিল, সেই হাত আবার বাড়িয়ে দিতে গিয়ে মিষ্টির মাঝে অস্বস্তির সৃষ্টি হলো। কিন্তু নবাবের হাতের স্পর্শ পেতেই চোখের পলকে একটা অবাক কাণ্ড হয়ে গেল।

“এই, কী করলে তুমি? নামাও শিগগির।” পাজাকোলে থেকে মিষ্টি আঁতকে উঠলো কিন্তু নবাব ভ্রুক্ষেপহীন হেসে উঠলো, “আমিই তো কোলে নিলাম। তাহলে এত চটছো কেন?”

“চটছি মানে? এমন কাণ্ডের পর কি তোমার তপস্যা করবো? তুমি ইচ্ছে করে আমার হাত ধরে নাড়ালে যেন আমি বেসামাল হয়ে যাই আর তারপর তুমি…” মিষ্টি রাগে মুখ ফিরিয়ে নিতে নবাব বললো, “বাহ! বুঝে গেছো দেখছি।”

“নামাও বলছি। সবাই তাকিয়ে আছে নবাব।”

নবাব হাঁটতে শুরু করলো আর সামনে তাকিয়ে বললো, “পরিচিতের ভিড়ে আমাদের চক্ষুলজ্জা প্রখর থাকে কিন্তু অপরিচিতের ভিড়ে সেটা ক্রমশই সংকীর্ণ হয়ে পড়ে।”

“তোমাকে এত যুক্তি উত্থাপন করতে বলিনি। আমাকে নামিয়ে দিতে বলছি।” খানিকটা খেঁকিয়ে উঠলো মিষ্টি, “নামাও শিগগির।”

“মিস টিউন, এখন নিশ্চয়ই কোমড় ভাঙতে চাও না। আর একবার যদি ঐ দু’টো শব্দ আমার কানে আসে তো এমন ভাবে নামাও যে সারাজীবন আফসোস করবে।” মুখে যতই বলে বদলে গেছে নবাব কিন্তু মনে মনে এখনও পিস্তলের কথা চিন্তা করলেই আঁতকে উঠে মিষ্টি। তাই তো নবাব দায়সারা ভাব নিয়ে কথা বললেও এখন মিষ্টি খানিকটা ভয় পেয়ে গেল। কোনও জবাব তো দিলোই না উল্টো নবাবের গলা জড়িয়ে নিলো দু’হাতে যেন পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে আসে। আর এতেই নিজ মনে হেসে নিলো নবাব।

“দেখতে তো রোগা, পাটকাঠি কিন্তু ওজন তো দেখছি কম নয় তোমার।” হালকা হেসে ব্যঙ্গ করলো নবাব। স্বভাবতই মিষ্টির রাগ হলো কিন্তু জবাবের বিপরীতে নিরবতাকে আগলে নিলো। তবে আনমনে ফুঁসে উঠলো, “পরিকল্পনা করে এমনটা করেছে আবার আমাকেই খুঁচিয়ে মারছে। হুহ।”

.

রাত দশটা। ফয়েজ লেকে আজকে শেষ দিন পার করতে হয়েছে বিশ্রাম নিয়ে। কারণ নবাব আজকে সকালে মিষ্টিকে জানিয়ে ছিল, “মিষ্টি, সন্ধ্যার পর ব্যাগ গুছিয়ে নিও।”

“কেন?”

“আজকে চট্টগ্রাম ছেড়ে দিচ্ছি।”

“কালকেই এলে আর আজকেই চলে যাবে?”

“হ্যাঁ, এখানে বেশি থাকার পরিকল্পনা নেই।”

“ওহ।” মিষ্টি আর কথা বাড়ায়নি কিন্তু নবাব জিজ্ঞেস করেছিল, “জানতে চাইবে না এবার কোথায় যাবো?”

জবাব দিতে গিয়ে মিষ্টি হালকা হেসেছিল, “যেই প্রশ্নের উত্তর পাবো না, সেই প্রশ্ন করে তোমার অস্বস্তি বাড়াতে চাই না।” নবাব মিষ্টির উত্তরে অবাক হয়েছিল আর সঠিক জবাব পেয়ে মাথা নুইয়ে নিয়েছিল। কারণ নবাব অনুভব করেছিল তার হয়ত মিষ্টিকে বলা উচিত কিন্তু সে কোনও ঝুঁকি নিতে রাজি নয়।

রেস্টুরেন্টে বসে রাতের খাবার শেষ করলো নবাব আর মিষ্টি। নবাব লক্ষ্য করছে খাওয়া শেষ হতেই মিষ্টি অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে। ওর মনোযোগ নিজের দিকে টানতে নবাব জানতে চাইলো, “এই মিষ্টি, চা খাবে? সিলেটের চা কিন্তু বাংলাদেশের বাইরেও সুনাম কুড়িয়েছে।”

নবাবের কথা শুনে মিষ্টি অবাক হলো কিন্তু সেটা চোখেমুখে ভাসলেও কন্ঠে ধরা দিলো না, “চট্টগ্রামে বসে সিলেটের চায়ের কথা কেন বলছো? তোমার মাথা কি ঠিক আছে?”

“হ্যাঁ, মাথা ঠিকই আছে। আসলে সিলেটে তো চা খাওয়া হয়নি। সিলেটে এসে সিলেটের বিখ্যাত চা-ই খাওয়া হলো না। এরচেয়ে বড় অন্যায় আর হতে পারে?”

“জানি না।” মিষ্টি কথা বাড়াতে চাইলো না আর নবাব সেটা টের পেল। কিন্তু সে-ও কথা না বাড়িয়ে ওয়েটারকে এক কাপ চা দিতে বললো।

বেশ কিছুক্ষণ পর ওয়েটার এসে এক কাপ দুধ চা দিয়ে গেল। ধোঁয়া উঠানো গাঢ় চায়ে যেন চিরাচরিত প্রেম জমে আছে। চায়ের দিকে একঝলক দেখে হাসলো নবাব এরপর মিষ্টিকে বললো, “এই মিষ্টি, একটু খেয়ে দেখো তো চিনি ঠিকঠাক আছে কি না?”

মিষ্টি এবার বিরক্ত হলো, “কী হয়েছে তোমার? হঠাৎ চা নিয়ে কেন পড়লে? আর তুমি জানো না আমি চা খাই না?”

দায়সারা ভাব নিয়ে নবাব বললো, “চা খাওয়ার জিনিস নয়, পান করার। আর তোমাকে তো পুরোটা খেতে বলিনি এই একটু খেয়ে শুধু চিনির পরিমাণ যাচাই করবে।”

“এটা তো তুমি নিজেই করতে পারো।”

“তা পারি কিন্তু মিষ্টি যদি দেখে চায়ে কতটা মিষ্টি হলো তাহলে ভালো হয় না?” বলেই হাসলো নবাব আর মিষ্টি বুঝতে পারলো ওকে চা না পান করিয়ে নবাব ছাড়বে না। তাই অগত্যা চায়ের কাপ নিয়ে এক চুমুক দিয়ে মিষ্টি কাপটা পেয়ালার ওপর রেখে দিলো আর গম্ভীর গলায় জবাব দিলো, “সব ঠিক আছে।”

নবাব নিঃশব্দে চায়ের কাপ হাতে নিলো। টেবিলের উপর কনুইয়ের ভর দিয়ে কাপ মুখের সামনে ধরে রহস্যময় হাসি দিয়ে চায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। এরপর মিষ্টির দিকে তাকিয়ে চায়ে চুমুক দিলো। মিষ্টি পুরো বিষয়টা বাঁকা চোখে দেখলো। ওর মনে কিঞ্চিৎ খটকা লাগলেও স্বাভাবিক বিষয় ভেবে উড়িয়ে দিলো। কিন্তু নবাব একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি করায় মিষ্টির চোখে অবাকের আলো এসে হাতছানি দিলো। নবাব এবার মিষ্টির দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের হাসি দ্বিগুণ করলো আর ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, “কী?”

মিষ্টি দাঁতে দাঁত চেপে চোখ নামিয়ে নিলো আর আনমনে বলে উঠলো, “কত্ত চালাক! আমার এঁটো চা খাওয়ার জন্য এসব করেছে আবার আমি বুঝতে পারিনি বলে সেটা বোঝাতে এমন নির্লজ্জের মতো হাসছে।”

“মনে মনে আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ না হয়ে সরাসরি বলো না। আর হ্যাঁ, চা কিন্তু মারাত্মক মিষ্টি হয়েছে।” বলেই ঠোঁট টিপে হাসলো নবাব। চায়ের কাপে আরেক দফা চুমুক দিতেই শুনতে পেল মিষ্টির মুখ বিরক্তিতে বলছে, “ফাজিল কোথাকার।”

“সেই ছোট্টবেলা থেকে ফাজিল শব্দটা বলে আসছো। এখন তো বড় হয়েছি কিন্তু শব্দটা এক জায়গাতেই তুমি রেখে দিলে।”

“এই, তোমার কী হয়েছে বলো তো? হঠাৎ এমন উদ্ভট আচরণ করছো কেন?” নবাব জবাব না দিয়ে চা শেষ করলো। প্যান্টের পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে টাকা নিতে শুরু করলো আর মুখে বিস্তর হাসি।

“হাসছো কেন?” নবাবের হাসি দেখে মিষ্টি জানতে চাইলো।

কপাল কুঁচকে নবাব তাকালো মিষ্টির দিকে, “হাসিতে কি কারফিউ জারি করেছো?”

“যদি সম্ভব হতো তবে তোমার ওপরই জারি করতাম।”

নবাব চট করে উঠে দাঁড়ালো। ওয়ালেট প্যান্টের পকেটে গুঁজে হাঁটতে শুরু করলো। বিল পে করতে যাবে কিন্তু মিষ্টির চেয়ারের পাশে এসে থেমে গেল নবাব। সামনে তাকিয়েই নিচু গলায় মিষ্টিকে বললো, “মনের ওপর কারফিউ জারি করার পর আর কি প্রয়োজন আছে এর? এতগুলো বছর ধরে কারফিউ চলছে আমার মনের ওপর কিন্তু তুমি এই কারফিউ আর শিথিল করলে না।” এই বলে নবাব চলে গেল আর মিষ্টি তেমনই বসে রইলো নিশ্চুপ হয়ে কিন্তু চোখ গোল গোল হয়ে আছে অতি বিস্ময়ে।

সাড়ে এগারোটা নাগাদ নবাব আর মিষ্টি পৌঁছে গেল সিনেমা প্যালেসের সামনে। এখান থেকে সৌদিয়া বাস সার্ভিসের সুবাদে নবাব কক্সবাজার যাওয়ার পরিকল্পনায় আছে। বাসের টিকিটের ব্যবস্থা আগে থেকেই করা আছে। ফয়েজ লেক থেকে আসার পথেই মিষ্টিকে নবাব কক্সবাজারের কথা জানিয়ে ছিল। তাই কোথায় যাচ্ছে– এমন ভাবনায় মিষ্টি এখন আর চিন্তিত নয়।

সিলেটে ফোন ফেলে এসেছে বিধায় মিষ্টি নবাবকে জিজ্ঞেস করে ছিল, “এতে তোমার সমস্যা হবে না?”

“আশা করছি হবে না। এখান থেকে সেখান থেকে কল করে খবর নিচ্ছি।”

“বাসার অবস্থা কি জানতে পেরেছো? তোমার আমার বাসায় এখন কী চলছে?” মিষ্টি খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেও নবাব জবাব দেয়নি আর মিষ্টিও জোর করার মতো সাহস পায়নি।

…চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে