প্রীতিকাহন পর্ব-০৬

0
607

#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_৬

❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌

নবাবের কথার প্রেক্ষিতে মিষ্টি কিছু বলতে চাইলো কিন্তু নবাবের মলিন মুখের মায়ায় মিষ্টি চুপটি করে রইলো। ওকে নিরব দেখে নবাব সময় ব্যয় করলো না৷ নত মাথায় রুম ত্যাগ করলো। নবাবের চলে যাওয়ার পথে তাকিয়ে ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে মিষ্টি আনমনে বললো, “যার জীবন অনেক আগেই পা পিছলে আগুনে পড়েছে, তার জীবন আর নতুন করে কী ধ্বংস হবে নবাব?”

মেঝেতে কয়েক মূহুর্ত তাকিয়ে মিষ্টি বিছানার কাছে এলো। নির্লিপ্ত চোখে শপিং ব্যাগটা দেখে হাতে নিলো। নাড়াচাড়া করে এতে একটা বোরকা, সালোয়ার কামিজের সাথে ওড়না আর একটা সাদা খাম পেল। বিছানায় বসে সবকিছু রেখে খাম হাতে মিষ্টি বলে উঠলো, “এতে আবার কী আছে?”

খাম খুলে দেখতে গিয়ে মিষ্টি কিছু টাকা আর একটা ছোট্ট চিরকুট পেল। টাকাসহ খাম বিছানার ওপর রেখে চিরকুট পড়তে শুরু করলো, “দেনমোহরের দুই হাজার একশো টাকা পরিশোধ করে দিলাম। ছোট্টবেলায় গুরুজনদের মুখে শুনেছিলাম, দেনমোহরের জোরে না-কি অনেক সংসার টিকে থাকে। এবার দেখি, এই দুই হাজার একশো টাকার জোর কতটুকু?”

চিরকুট পড়া শেষে একগাল হেসে উঠলো মিষ্টি আর তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠলো, “যার পোড়া কপালে একুশ লক্ষ টাকার সংসার নেই, তার কপালে কি একুশ শত টাকার সংসার স্থায়ী হবে?”

.

দুপুর পেরিয়ে গেছে অনেক আগে। এখন সূর্য ছুটছে পশ্চিম আকাশে। নবাব ভবনের বাইরে পায়চারি করছে। হঠাৎ নূপুরের শব্দ শুনতে পেয়ে নবাব স্থির হয়ে দাঁড়ালো। ভেসে আসা নূপুরের শব্দের খোঁজ করতে ডান দিকে ফিরে তাকালো। কালো রঙের বোরকায় আবৃত এক রমনীকে দেখে নবাবের চোখ সেই রমনীর ওপর স্থির হলো।

পায়ে পায়ে রমনী এসে নবাবের সম্মুখে দাঁড়ালো। কালো বোরকা বাইরে তার চোখ দু’টো ছাড়া মুখের অন্য অংশ দেখা যাচ্ছে না। ক্লান্ত এবং চোখের তলায় দাগ নিয়ে রমনী নবাবের মুখ পানে তাকিয়ে বললো, “চলো।”

নবাবের কাছে অতি ছোট্ট এই শব্দ পৌঁছাতে সময় লাগেনি কিন্তু জবাব দিতে সে সময় নিচ্ছে। কারণ বোরকারূপী এই নারী নবাবের হৃদয়ে ঈষৎ দোলা দিয়েছে। শব্দহীন নবাবকে সে ডাকলো, “নবাব?”

কিঞ্চিৎ আঁতকে উঠে নবাব বললো, “হুম।”

“চলো।”

“হ্যাঁ, চলো।”

নবাব হাঁটতে শুরু করলো আর মিষ্টি এবার পাশ থেকে নবাবকে পযর্বেক্ষণ করতে লাগলো। কালো টিশার্টের ওপর কালো রঙেরই শার্ট সাথে একই রঙের প্যান্ট পড়েছে নবাব। সাদা জুতো পরা পা তাল মিলিয়ে হাঁটছে মিষ্টির সাথে। মাথার চুলগুলো আড়াল হয়েছে সাদা ক্যাপের তলায় আর হাড় ভাসা মুখ ঢাকা পড়ছে কালো মাস্কের আড়ালে। ভবনের বাইরে পা রেখেই মিষ্টি নবাবকে লক্ষ্য করছিল কিন্তু এত কাছ থেকে দেখে সে নিজের ভেতরে অস্বস্তি অনুভব করছে।

বাড়ির বাইরে আগে থেকেই রিকশা দাঁড় করানো আছে। রিকশা দেখে মিষ্টি চমকে গিয়ে নবাবের কাছে জানতে চাইলো, “নবাব, রিকশা কেন?”

রিকশার কাছে এসে পিছন ফিরে তাকালো নবাব, “একতরফা গাড়ি ব্যবহার করা নিরাপদ নয়। তাছাড়া যেখানে যাবো, সেটা মোটেও কাছে নয়। এতটা পথ ড্রাইভিং করা আমার পক্ষে কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে।”

মিষ্টি চুপটি করে ভাবনায় মত্ত হলো। ওকে ভাবতে দেখে নবাব বললো, “দাঁড়িয়ে পড়লে কেন? চলো জলদি।”

নিঃশব্দে মিষ্টি রিকশায় চড়ে বসলো সাথে সাথে নবাবও নিজের জায়গাটা বুঝে নিয়ে বসে পড়লো। রিকশাওয়ালা মামার পিঠে হাত রেখে নবাব বললো, “মামা চলেন।”

রিকশা চলছে সাথে বইছে বিকালের মিঠেল হাওয়া। মিষ্টির বোরকা নাছোড়বান্দা হয়ে বাতাসের তালে বেসামাল হচ্ছে। নিজের বোরকা সামলাতে গিয়ে মিষ্টির নজর গেল নবাবের পায়ের কাছে থাকা ব্যাগের উপর, “কালকে তো হাতে একটা পলিথিনও দেখিনি আজকে এত বড় ব্যাগ কোথা থেকে এলো?” নিজের কৌতূহল চাপা রাখতে না পেরে মিষ্টি জিজ্ঞেস করে বসলো, “ব্যাগ? কালকে তো কোনও ব্যাগ দেখিনি।”

“এসবের ব্যবস্থা আগেই করা ছিল। আজকে নিলয় আর জিসান আসার সময় নিয়ে এলো নয়ত এখানে তোমার আমার পোশাক কোথায় খুঁজবো?”

“ওহ। তাহলে সবকিছু পরিকল্পনা মাফিক করা হচ্ছে?”

“হুম, কিছুটা।”

“কিছুটা? সম্পূর্ণ নয় কেন?” বুঝতে না পেরে।

“জীবন কি পরিকল্পনা মাফিক চলতে পারে?”

“কেন পারে না?”

“তোমার পরিকল্পনা অনুযায়ী এখন তো তোমার রিকশায় নয়, প্রাইভেট গাড়ি থাকা কথা কিন্তু সেটা কি হয়েছে?”

“কথা তো ভালোই বলতে জানো। এমন চিনি গুড় মেশানো কথা বলেই তো…” মিষ্টি বাক্য সম্পূর্ণ করলো না। কোথাও একটা বাঁধা অনুভব করে চুপ করে গেল। এতে নবাব বলে উঠলো, “থামলে কেন? বলো, এমন চিনি গুড় মেশানো কথা বলেই আমি কী করি?”

মিষ্টি এবারও বাক্য সম্পূর্ণ করলো না। অসম্পূর্ণ বাক্য তেমনই অসম্পূর্ণ রেখে মুখ ফিরিয়ে নিলো কিন্তু নবাব তাকিয়ে রইলো। বেশ কিছুক্ষণ পর মিষ্টি মুখ ঘোরালো আর নবাবকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সোজা হয়ে বসে জিজ্ঞেস করলো, “কী হয়েছে? আগে কি দেখোনি আমায়?”

“দেখবো না কেন? কিন্তু একটা মানুষের এত রূপ দেখা হয়নি।”

“সেটা আমারও দেখা হয়নি। দুইদিন ধরে যা দেখছি এতে আমার ত্রিশ বছরের চিন্তাভাবনা গুলিয়ে যাচ্ছে।”

মিষ্টির মুখের কথায় বরাবরের মতো মাথা নুইয়ে এলো নবাবের। ও প্রতিবার এবং প্রতিবাক্যে যেন নবাবকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, তুমি অপরাধী নবাব, অপরাধী। নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে নবাব বললো, “কত সুন্দর করে অপমান করছো আমায়। না আমার নাম নিচ্ছো আর না সরাসরি বাক্য প্রয়োগ করছো। এমন নির্লিপ্ত কন্ঠে আর নামহীন বাক্যে অপমানিত হওয়া যায় তা আমার অজানা ছিল। কষ্ট হচ্ছে কিন্তু হজম করবো শেষ নিশ্বাস অবধি।”

“সত্যি কথা বলাটা কি অন্যায়?”

“নাহ, তা কেন হবে? কিন্তু সবার সামনে সত্যি জাহির করার খুব বেশি প্রয়োজন ছিল না।”

মিষ্টি এসব কথার ভীড়ে ভুলেই গেছে সে এখন রিকশায় আছে আর রিকশাওয়ালা মামার সামনে এসব বলছে। নবাবের কথায় সেই ইঙ্গিত পেতে এবার তার নিজের কাছে সংকোচ লাগছে৷ মিষ্টি চুপ হয়ে গেল কিন্তু হঠাৎ কানের কাছে ফিসফিস শুনতে পেল, “এমন তিক্ত অপমান তোমার মুখে তোমার নামের মতোই মিষ্টি লাগে।”

চোখ গোল গোল করে মিষ্টি তাকালো নবাবের দিকে। মাস্ক পড়া মুখ দেখলে হয়ত বোঝার উপায় নেই নবাবের চেহারায় কী ভাসছে? কিন্তু ওর অপলক চোখে এখন খুশি ঝিলিক দিচ্ছে।

.

বাস স্ট্যান্ডে বসে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে নবাব আর মিষ্টি। পাশাপাশি একটা বেঞ্চে বসে থাকলেও ওদের মাঝে দেয়াল হয়ে আছে বড় সাইজের একটা ব্যাগ। রাস্তার চারপাশ মানুষে মুখর হয়ে আছে। দোকানপাটে জ্বলছে অজস্র কৃত্রিম আলো।

সন্ধ্যার পর আজকেই প্রথম মিষ্টি পরিবার ছাড়া অন্য কারোর সাথে বাইরে অবস্থান করছে। চোখ ঘুরিয়ে সবটা দেখে বোরকা ঠিক করে নিলো খানিকটা আর তখন মিষ্টির মনে পড়লো নবাবের একটা কথা, “বোরকা পড়ে বাইরে যাবে কারণ তোমাকে কেউ দেখলে আমার ভালো লাগে না।” সেদিন হেসে হেসে নবাবের কথার জবাব দিয়েছিল, “আমি তো কোথাও যাই না তাহলে অন্য কেউ কীভাবে দেখবে?”

“যাও না বলেই তো ভালো লাগে। তুমি অন্তর্মুখী হওয়াতে কিন্তু ভালো হয়েছে।”

“কীভাবে?”

“এই যে, সাজগোছ বা বাইরে গিয়ে সময় অপচয় না করে আমার সাথে আড্ডা দিচ্ছো।” সেদিন নবাবের কথা শুনে মিষ্টি শরীর দুলিয়ে হেসেছিল আর ভেবেছিল, তার খেয়াল রাখার জন্য কেউ একজন আছে। কিন্তু খেয়াল রাখার মানুষ তার জীবনকে নিজের করে নিবে, সেটা কখনও ভাবেনি মিষ্টি।

নবাব ফোন স্ক্রোল করতে মশগুল। মিষ্টির দিকে না তাকিয়েও ওর পুরো মনোযোগ মিষ্টির উপর। ফোন স্ক্রোল করার ফাঁকে নবাব মিষ্টিকে জিজ্ঞেস করলো, “মিষ্টি, এখন কি কিছু খাবে?”

“নাহ।” গম্ভীর গলায় মিষ্টির জবাব।

“দুপুরেও তো খাওনি।” এবার তাকলো মিষ্টি নবাবের দিকে আর কাঠ গলায় জবাব দিলো, “তোমার খাওয়ার ইচ্ছে হলে তুমি খাও। আমার পেট এমনিতেই ভরে আছে।”

ফোনে দৃষ্টি দিয়েই নবাব বললো, “পেট ভরে থাকার কথা তো আমার কারণ আমি তো কথা শুনছি বা শুনেছি, তাই না?”

“কথা শোনানোর মতো কাজ করলে কি মানুষ মুখে তালা এঁটে বসে থাকবে?”

পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে নবাব বললো, “মানুষ তখনই কথা শুনে, যখন সে তার প্রিয় মানুষের ভালো করতে গিয়ে তার চোখে অপরাধী হয়ে উঠে।”

…চলবে কি?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে