প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-৩৬+৩৭

0
563

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৩৬
________________
নিকষ কালো অন্ধকারে ঘেরা চারপাশ। ঘরের ভিতর ল্যাম জ্বলছে। বাহিরে ঝিরিঝিরি শব্দে বৃষ্টি হচ্ছে। রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ বসে আছে কুঁড়েঘরের সামনে মাটির সিঁড়ির ওপর পা রেখে। উপরে ছাউনি থাকায় বৃষ্টির পানি লাগছে না তাদের গায়ে। রাগান্বিতার পাশেই রয়েছে হেরিকেন। আলো দিচ্ছে তাদের। রাগান্বিতা আবদারের স্বরে বললো,
“শুনুন এবার বাড়ি ফিরে একটা টেলিফোন কিনবেন। বাবার সাথে কথা বলবো। কতদিন হয়ে গেল বাবার সাথে চিঠি বিলি হয় না।”

প্রতিউত্তরে শুধু এতটুকুই বলে ইমতিয়াজ,
“আচ্ছা।”
“জি। বাবাকেও বলতে হবে টেলিফোন কেনার কথা। বাবা বোধহয় আমায় ভুলেই গেছে না হলে চিঠি লেখে নি কেন?”
“এখন বোধহয় লিখেছে আমরা তো বাড়ি নেই ডাকপিয়ন নিশ্চয়ই রবিন চাচার কাছে চিঠি দিয়ে গেছে।”
“আপনি সত্যি বলছেন?”
“মনে হচ্ছে।”

রাগান্বিতা জোরে একটা নিশ্বাস ফেললো। বললো,
“দাদিমাকে আজ সকালে স্বপ্নে দেখেছিলাম আমায় বাড়ি যেতে বলছে।”
“আচ্ছা যাবো আনে।”

রাগান্বিতা খুশি হয়ে বললো,
“সত্যি যাবেন।”
“হুম।”

রাগান্বিতা ইমতিয়াজের ডান হাতখানা শক্ত করে চেপে ধরলো। কাঁধে মাথা দিয়ে বললো,
“আমি কি চাই জানেন?”

ইমতিয়াজ সামনের দিকে চোখ রেখেই বলে,
“কি বলো,”
“আমি চাই, আমাদের জীবনটা এভাবেই যেন সাদাসিধে ভাবে কেটে যাক। কখনো ঝড় না আসুক।”

আকাশে তখন প্রবলবেগে একটা বিদ্যুৎ চমকালো। মেঘটাও গর্জে উঠলো। ইমতিয়াজ মৃদু হাসলো। মনে মনে বললো,“প্রকৃতি বোধহয় এমনটা চায় না।”

ইমতিয়াজ রাগান্বিতার দিকে তাকালো। চোখ মুখ খুশিতে পুরো জ্বলজ্বল করছে। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার কপালে কাছে থাকা চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে দিলো। তারপর রাগান্বিতার হাতে থাকা কাঁচের চুড়িগুলোতে হাত বুলিয়ে বললো,
“আর আমি কি চাই জানো?”

রাগান্বিতা অতি আগ্রহ নিয়ে বললো,
“কি চান বলুন!”

ইমতিয়াজ বৃষ্টির পানে তাকালো। বললো,
“আমি চাই, আমি তোমার হাতের শখের ভাঙা চুড়ি হবো। না তুমি পড়তে পারবে, না তুমি ফেলতে পারবে বউ।”

রাগান্বিতা বিস্মিত নজরে তাকালো ইমতিয়াজের দিকে। বললো,“ভাঙা চুড়িই কেন?”

ইমতিয়াজ মৃদু হেসে রাগান্বিতাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো,“এমনি।”
——
সময়গুলো অতিদ্রুত চলতে থাকলো। দেখতে দেখতে কেটে গেল পুরো ছ’টা দিন। এই ছ’দিন যেন সময়গুলো কেটেছে পুরো স্বপ্নের মতো। রোজ নৌকা নিয়ে নদীর চারিপাশে ঘুরে বেড়ানো। মাছ ধরা, রান্না করা, একসাথে গোসল করা। বিকেল হলে পুরো দ্বীপের মাঝে ছোটাছুটি করা, দোলনায় দোলা, ইমতিয়াজের বাঁশির আওয়াজ শোনা সবই যেন অন্যরকম ছিল। গরু ছাগলকে নিয়ে আশেপাশে চড়ানো এটাও ছিল দারুণ। রাগান্বিতা যেন এ জীবনেই পুরো আনন্দিত ছিল। এর মধ্যে যেটা সবচেয়ে মিষ্টিমধুর ছিল তা হলো ভোর হলেই টিয়াপাখির ডেকে ওঠা, বউ স্বাগতম, বউ স্বাগতম, বউ স্বাগতম। জীবন যেন ভীষণ সুন্দর!
.
নতুন একটা সকাল! প্রকৃতি জুড়ে তখন হিমশীতল বাতাস বইছিল। মোরগ ডাকছিল। টিয়া পাখিটাও ডাকছিল। রাগান্বিতা প্রতি সকালের মতো আজও নামাজ সেরে কোরআন পাঠ করছিল। ইমতিয়াজ আজ আর ঘুমায় নি। সে চেয়ে চেয়ে শুধু দেখছিল রাগান্বিতাকে। মেয়েটা নিষ্পাপ কিন্তু সে পাপী কথাটা ভাবলেই কলিজাটা কেঁপে ওঠে ইমতিয়াজের। ভয় এসে গ্রাস করে তাকে। কি যে যন্ত্রণার, তা বলার মতো নয়। দিন যত এগোচ্ছে ইমতিয়াজের যন্ত্রনাও বুঝি একটু একটু করে বাড়ছে। সহ্য করা দিনে দিনে বুঝি দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আচ্ছা যদি এমনটা হতো, যে কিছুই হতো না। ইমতিয়াজ মাথা নাড়ালো। কিছু কি হয়েছে হয় নি তো তাহলে! খামোখাই আবোলতাবোল। দিনে দিনে কেমন একটা হয়ে যাচ্ছে ইমতিয়াজ! স্বপ্ন বুনছে, আবার ভাঙছে! হতাশ হচ্ছে আবার সামলে নিচ্ছে!’

….
রেশবপুরে নিজ কক্ষে বসে আছে রাগান্বিতার বাবা মোতালেব তালুকদার। কিছুদিন হলো রেজওয়ানের জন্য মেয়ে দেখছেন তিনি। কিন্তু মন মতো কোনো পাত্রীই পাচ্ছেন না। এর মধ্যে ঘটে গেল আরেকটা ঘটনা দাদিমা পুকুরপাড়ে নাইতে গিয়ে হোটচ খেয়ে পড়ে গেছিলেন পানিতে। কাছে পাশের বাড়ির মোর্শেদের মা থাকায় বেঁচে যান। কিন্তু ভয় যে একটা কঠিন পেয়েছেন তা বোঝা গেছে। সেই পড়ে যাওয়ার দিন থেকে মানুষটা বিছানায়, ঠিকভাবে উঠতেও পারে না। ডাক্তার ডাকা হয়েছিল। ডাক্তার আড়ালে নিয়ে বললেন দাদিমার গুরুতর অসুখ করেছে। শহুরে ডাক্তার দেখালে বোধহয় সুস্থ হতেন। দাদিমাকে শহরে নেয়া দুষ্কর ব্যাপার ছিল তাই রেজওয়ানকে বলে শহুরে ডাক্তারকে গ্রামের আনার ব্যবস্থার করেন। তাও লাভ হয় নি। অবস্থা তেমন ভালো নয়। বর্তমানে দুশ্চিন্তা গ্রস্ত মোতালেব তালুকদার। মা সমতুল্য মানুষটার জন্য বড্ড মন কাঁদে তার। রাগান্বিতাকে দেখতে চাচ্ছেন খুব। তাই বর্তমানে টেবিলে বসে চিঠি লিখছেন রাগান্বিতার জন্য যদি মেয়েটাকে একটা বার দাদিমার কাছে আনা যায়।

প্রিয় কন্যা,
কেমন আছো তুমি। আশা রাখি আল্লাহর রহমতে জামাইকে নিয়ে সুখেই আছো। বহুদিন পরে তোমার নামে চিঠি লিখতে বসেছি। কি লিখবো ভেবে পাচ্ছি না হুটহাট এমন সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে যে আমি নিজেই খুব হতাশাগ্রস্ত! রেজওয়ানের জন্য মেয়ে দেখছিলাম। কিন্তু এর মধ্যে ঘটে গেল দুষ্কর একটা ব্যাপার তোমার দাদিমা নাইতে গিয়ে পড়ে গেছিলেন পানিতে। সেই থেকেই অসুস্থ তোমার দাদিমা। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে কথাটা বলছি তোমায় দিনে দিনে তোমার দাদিমার অবস্থা খুবই গুরুতর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তোমায় খুব দেখতে চাচ্ছেন। যদি পারো তবে জামাইকে নিয়ে রেশবপুরে এসে দেখে যেও। পারলে কাল পরশুর মধ্যেই রওনা দিও আর কিছু লিখতে পাচ্ছি না। ভালো থেকো।’

ইতি,
তোমার বাবা।’

কথাগুলো লিখে কলম চালানো থামালেন রাগান্বিতার বাবা। এমন সময় তার কক্ষের দুয়ারের সামনে হাজির হলো কাশেম। হাল্কা কাশি দিয়ে বললো,
“আমু সাহেব?”

কাশেমের কণ্ঠটা কানে আসতেই দুয়ারের পানে তাকালেন মোতালেব তালুকদার। বললেন,
“হুম আয়।”

কাশেম ভিতরে ঢুকলো। বললো,“আমারে নাকি খুঁজতাছিলেন?”

মোতালেব তালুকদার নিরুত্তর চাহনি নিয়ে চাইলেন। যা দেখে কাশেম বললো,“চিন্তা কইরেন না দাদিমা ঠিক হইয়া যাইবো আনে।”

দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লেন মোতালেব তালুকদার। হাতে লেখা চিঠিটা ভাজ করে খামে ভরে ঠিকানা লিখে কাশেমের হাতে দিয়ে বললো,
“চিঠিডা পোস্ট অফিসে দিয়া আয়। সাবধানে যাইস।”
“আইচ্ছা সাহেব।”

চলে গেল কাশেম। আর মোতালেব তালুকদার আকাশ পানে চাইলেন। কিসের যেন খুব ভয় পাচ্ছেন তিনি। ইদানীং ঘুমালে খুব উল্টোপাল্টা স্বপ্ন দেখছেন। সেই সেদিনই দেখলেন, দাদিমা তাকে কিছু না বলে কোথায় যেন চলে যাচ্ছেন। কতবার ডাকলেন দাদিমাকে কিন্তু দাদিমা ঘুরেই তাকালেন না।”

বড় কষ্ট লাগছে মোতালেব তালুকদারের। এই স্বপ্নের অর্থ তো ভালো নয়। চিন্তা লাগছে খুব।
—–
পরন্ত বিকেলের মিষ্টিমধুর সুন্দর সময়। রাগান্বিতা ইমতিয়াজ শুয়ে আছে সবুজ ঘাসের বুকে। তাদের ঘিরে ছুটছে হাঁস, মুরগী আর ছাগলের একটা বাচ্চা।
ইমতিয়াজ আকাশ পানে তাকিয়ে শুধালো,
“কাল সকালে আমাদের নিতে ট্রলার আসবে সবকিছু গুছিয়ে রেখো কেমন!”

রাগান্বিতার মনটা কথাটা শুনেই খারাপ হয়ে গেল। মন খারাপ নিয়েই বললো,
“কালই চলে যাবো আর ক’টা দিন থাকলে হতো না।”
“না প্রেমনগরে বেশিদিন থাকতে নেই। মায়া পড়ে গেলে।”
“পড়লে পড়তো কি এমন ক্ষতি তাতে।”

ইমতিয়াজ গম্ভীর এক আওয়াজে বললো,
“একটা কথা সবসময় মাথায় রাখবে জীবনে কোনোকিছুর প্রতিই বেশি মায়া জন্মাতে দিবে না। এই মায়া বড্ড ভয়ংকর জিনিস। দুঃখ ছাড়া বেশি কিছু দেয় না।”
“মায়াতে ভালোবাসা থাকে।”
“যেদিন মায়া ছাড়াতে কষ্ট হবে সেদিন বুঝবে।”

রাগান্বিতা আর কিছু বলে না। চুপ হয়ে যায়। চোখে মুখে এক গম্ভীরতার ছোঁয়া ভেসে ওঠে। ইমতিয়াজ আবার বলে,“রাগ করলে?”

রাগান্বিতা জবাব দেয় না। ঠিক সেই মুহুর্তেই আকাশ পথ বেয়ে ছুটে গেল সাতটি রঙে আবদ্ধ হওয়া রংধনু। ইমতিয়াজ হাত দিয়ে তা দেখিয়ে বললো,
“তুমি আমার জীবনে আসা ঠিক ওইরকম সাতরঙা রংধনুর রঙ।”

রাগান্বিতা তাকালো। চট করেই অভিমানটা গায়েব হয়ে গেল। সে হাসলো। বললো,
“আর আপনি আমার জন্য এই সাতরঙার ভিড়ে থাকা বিশাল আকাশ।”

ইমতিয়াজ রাগান্বিতার থুতনিতে আলতো স্পর্শ করে বলে,
“হাসি ফুটলো তবে বউয়ের মুখে।”

আবারও হাসে রাগান্বিতা। বলে,
“হাসাতে জানানো মানুষটা গম্ভীর মুখে থাকতে দেয় কই।”
“তুমি কি জানো তুমি আমার জন্য স্নিগ্ধতার সকালে ফুটে ওঠা এক পদ্মফুল বউ যাকে যতই দেখি মন ভরে না।”

লাজুক হাসে রাগান্বিতা। কি মায়াময়ী লাগে সেই হাসি!’

#চলবে….

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৩৭
________________
আকাশ কেঁপে বাহিরে ঘন বর্ষণ হচ্ছে। বর্ষণের চাপে মাটিরা ভিজে চিপচিপে হচ্ছে। খড়ের ছাউনিতেও শব্দ শোনা যাচ্ছে। আকাশে বিদ্যুৎ চমকে কতক্ষণ কতক্ষণ পর বাহিরে আলো এসে পরিবেশটা দেখাচ্ছে। ইমতিয়াজ দাঁড়িয়ে আছে জানালার ধারে রাগান্বিতা ঘুমে বিভোর। ইমতিয়াজের মাথায় কিছু চলছে, তার দিনকাল ভালো যাচ্ছে না কেমন বিষণ্ণ বিষণ্ণ লাগে চারপাশ। জীবনে সে অনেক বড় ভুল করে বসেছে। অবশ্য ভুল বললেও ভুল হবে। সামনে কি করে ফেলবে তারও ঠিক নেই। কিছু তো করতেই হবে নয়তো শান্তি ছাড়া এভাবে বাঁচবে কিভাবে! মাঝে মাঝে ইমতিয়াজের মনে হয় এভাবে বাঁচার চেয়ে মরে যাওয়া সুন্দর। কিন্তু ইদানীং মরতেও ইচ্ছে হয় না, সারাক্ষণ ইচ্ছে করে রাগান্বিতার সাথে সংসার করতে। তাকে নিয়ে নতুন করে বাঁচতে– আচ্ছা এই চাওয়া কি খুব অন্যায়। নয় তো। ইমতিয়াজ জোরে নিশ্বাস ফেললো। চোখের কোণে পানি জমলো তার। আম্মার কথা আজ বড্ড মনে পড়ছে। ইমতিয়াজ চোখ বন্ধ করে বললো,“আম্মা কতদিন হয়ে গেল তোমায় দেখি না, কতগুলো বছর পার হলো। জীবনটা কি একটু ভিন্ন রকম হতে পারতো না। তুমি যদি একটু বুদ্ধিমান হইতা, কবিরাজরে বিশ্বাস না কইরা আব্বারে বিয়া না দিতা তবে আজ আমার গল্পটা ভিন্ন হইতো। কেন করলা এমন অবুঝের মতো ভুল। জীবন তো শেষ হয়ে যাচ্ছে, হৃদয়ে কষ্ট লাগে আম্মা। কি একখান অবস্থা! আমায় যারা ভালোবাসে তারাই খালি আমারে রাইখ্যা চইল্লা যায় কেন আম্মা। আমি কি শুরু থেকেই খারাপ আছিলাম কও। জানো আম্মা আমার এখন খালি বাঁচতে মন চায়। রাগান্বিতাকে নিয়া ছোট্ট সংসার করতে ইচ্ছা করে। মেয়েটা আমারে কত ভালোবাসে জানো। তুমি কি ওই আকাশে বইসা দেখো আম্মা। আমি এইবার বাড়ি গিয়া তোমার কাছে যাবো অনেকদিন হইয়া গেছে তোমারে দেখতে যাই না। আমার লগে কথা কইবা তো আম্মা একবারও কথা কও না আমিই শুধু একলা একলা কথা কই! আম্মা তোমার শরীরের ঘ্রাণ কতযুগ ধরে পাই না। আমারে শেষবার বুকে সেই কবে নিছিলা। তোমার আমারে একটুও মনে নাই তাই না। তোমার মনে নাই জমিনের বুকে তুমি একটা পোলা থুইয়্যা গেছো। কত নিষ্ঠুর হইয়া আমারে একা রাইখ্যা থুইয়া গেলা আম্মা। তোমারে আমি বাঁচাইতে পারলাম না। আমি কাউরেই বাঁচাইতে পারি না। খালি মারি।”

চোখ ভিজে আসলো ইমতিয়াজের। বুকে যন্ত্রণা উঠলো আচমকা। কতকিছু একা মনে বলে ফেললো ছেলেটা। প্রকৃতির ঝড়ের সাথে সাথে বুঝি ইমতিয়াজের বুকেও ঝড় উঠেছে। প্রবলবেগের ঝড়। কেউ তার যন্ত্রণা বুঝচ্ছে না, কেউ না। কাঁধে কারো শীতল স্পর্শ অনুভব করলো ইমতিয়াজ হকচকিয়ে উঠলো এতে। দ্রুত চোখ মুছতে নিলো সে। এরই মাঝে রাগান্বিতা শীতল সুরে শুধালো,“ভেজা চোখ আড়াল করতে চাইলেই কি সব আড়াল করা যায় প্রিয়। আমি আপনার সব কথা শুনে নিয়েছি।”

ইমতিয়াজ আর পারলো না নিজেকে সামলাতে সে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রাগান্বিতাকে। বললো,“আমার আম্মাডারে আইন্না দিবা বউ আমার না তারে খুব দেখতে মন চায়।”

রাগান্বিতা নিরুত্তর। এই কথার কোনো উত্তর কি এই জগতে আছে, নেই তো। রাগান্বিতা কেন পৃথিবীর কোনো মানুষই মৃত ব্যক্তিকে ফিরিয়ে আনতে পারে না। রাগান্বিতার চোখ বেয়ে পানি ঝড়লো। ইমতিয়াজ যেন এই প্রথম অবুঝের মতো তার কাছে একটা আবদার করে বসলো। যে আবদার পূরণ করার সাধ্য রাগান্বিতার নেই। রাগান্বিতা ইমতিয়াজের পিঠে হাত বুলালো বললো,“এভাবে ভেঙে পড়বেন না আমি তো আছি দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে।”

ইমতিয়াজ নীরব। তার মুখে কোনো কথা নেই। আকাশে বিদ্যুৎ চমকালো আবার। বৃষ্টি হচ্ছে প্রবল বেগে। ঘর জুড়ে অন্ধকার আর হৃদয় জুড়ে বিষণ্ণতা নিয়ে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ। রাতটা বুঝি বড্ড বেশিই যন্ত্রণার কাটলো।’

শীতল ছোঁয়ায় পঞ্চমুখ চারপাশ। চারপাশে ঠান্ডা বাতাস বইছে। সেই বাতাস ঘরে এসে ঠেকছে। বৃষ্টি থেমেছে ঘন্টাখানেক হবে। রাগান্বিতা বসে আছে ইমতিয়াজের মাথার কাছে। কাল সারারাত সে ঘুমায় নি তার কোলে মাথা দিয়ে ইমতিয়াজ ঘুমিয়ে ছিল আর রাগান্বিতা জেগে জেগে ইমতিয়াজের মাথায় বিলি কেটে দিয়েছে শুধু। মানুষটার কত যন্ত্রণা ভাবলেই কষ্ট লাগছে রাগান্বিতার। পালঙ্কের পাশে থাকা ইমতিয়াজের হাত ঘড়িটা দেখলো ভোর পাঁচটা বাজে নামাজ আদায়ের সময় হয়ে গেছে।’

রাগান্বিতা আরো কিছুক্ষণ বসে থেকে ডাকলো ইমতিয়াজকে। বললো,“শুনছেন, উঠুন জলদি। নামাজ পড়বেন না। আম্মার জন্য নামাজ পড়ে দোয়া করবেন। উঠুন তাড়াতাড়ি।”

ইমতিয়াজ নড়েচড়ে উঠলো। মাথাটা ভাড় ভাড় ঠেকছে তার। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার দিকে তাকালো। বললো,“নামাজ পড়বে?”

রাগান্বিতা মাথা নাড়িয়ে বললো,“জি উঠুন।”

ইমতিয়াজ বিনা বাক্যে উঠে বসলো। রাগান্বিতা পালঙ্ক থেকে নেমে হেরিকেনটা জ্বালালো। চারপাশ এখনো তেমন পরিষ্কার হয় নি। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে বললো,“নদীর ঘাটে যাওয়ার কোনো দরকার নেই তুমি এখানে বসো আমি বালতি ভরে পানি নিয়ে আসছি। বৃষ্টি পড়েছে চারপাশ কাঁদা হয়ে রয়েছে। পড়ে গেলে তাই তুমি বসো আমি পানি নিয়ে আসি।”

ইমতিয়াজ পালঙ্ক থেকে নেমে রন্ধন শালায় রাখা বালতিটা হাতে নিয়ে বাহিরে বের হলো। বাহিরে তখন আবছা আলো বইছে। দেখা যাচ্ছে অনেকটা। রাগান্বিতা টিয়াপাখির পাশ দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,“সাবধানে যাবেন।”

ইমতিয়াজ কথাটার জবাব না দিলেও শুনতে পেয়েছে ঠিকই। মিনিট পনের যেতেই ইমতিয়াজ বালতি ভরে পানি নিয়ে রাখলো পিড়ার ওপর(মাটির সিঁড়ি)। ইমতিয়াজ বালতিটা রেখে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,“আমি ওজু করে এসেছি তুমিও আসো। আমি অপেক্ষা করছি।”

রাগান্বিতা মাথা নাড়িয়ে মৃদুস্বরে বললো,“ঠিক আছে।”
——
ঘড়িতে তখন আটটার কাটায় ছুঁই ছুঁই। ইমতিয়াজ তাদের ব্যাগপত্র গুছাতে ব্যস্ত। আসবাবপত্রের কিছুই নিবে না এমনটা ভেবেছে ইমতিয়াজ। রাগান্বিতাও বারণ করে নি। মাঝে মাঝে এখানে আসবে এমন পরিকল্পনা তার। ট্রলারের আওয়াজ শোনা গেল। ট্রলারটা সোজা এসেছে নদীরঘাটপাড়ে যার দরুন এত নিকটে আওয়াজটা পাওয়া যাচ্ছে। ইমতিয়াজ রাগান্বিতাকে তাড়া দিল। বললো,“দ্রুত বোরকা হিজাব পড়ে নেও বউ, আমি বাকিদের গুছিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।”

রাগান্বিতা মাথা নুইয়ে হেঁসে বললো,“ঠিক আছে।”

….
“কি গো বন্ধুরা এই সাতদিন মজা পাইছো তো খালি ঘুরাঘুরি সঙ্গে খাওন আর খাওন।”

গরুর রশি খুলতে খুলতে কথাগুলো গরু-ছাগলকে উদ্দেশ্য করে বললো ইমতিয়াজ। তারা বুঝলো কি না বোঝা গেল না। তবে ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে থেকেছে ঠিকই। এই গরু’ছাগলগুলো এক লোকের কাছ থেকে ভাড়ায় এনেছিল ইমতিয়াজ, হাঁস-মুরগীও তেমন। খালি টিয়াটা নিজ টাকায় কিনে আনা। এরও একটা বিশেষ কারণ আছে। ইমতিয়াজ গরু-ছাগলগুলোকে সঙ্গে করে চলে গেল ট্রলারের উদ্দেশ্যে। এই সাতদিনে খেয়ে খেয়ে ভালোই মোটা হয়েছে গরুর ছাগলগুলো। কি অবস্থা। প্রেমনগর ছেড়ে যেতে চাচ্ছে না গরুছাগল, ইমতিয়াজ ঠেলে ঠেলে নিয়ে গেল ওগুলোকে। হাঁস-মুরগী খাঁচায় থাকায় বেশি সমস্যা হয় নি। খুব সহজেই নিয়ে রাখলো ট্রলারে। চারপাশ গুছিয়ে ইমতিয়াজ ঘরে ঢুকতেই দেখলো রাগান্বিতা বোরকা হিজাব পড়ে তৈরি। সে বললো,“হয়ে গেছে তোমার?”

রাগান্বিতাও তাদের কুটিরে থাকা ছোট্ট আয়নাটায় একবার নিজেকে দেখে বললো,“জি চলুন।”

ইমতিয়াজ রাগান্বিতার হাত ধরে বাহিরে আনলো। তখনই টিয়াপাখিটা বলে উঠল,“বউ স্বাগতম, বউ স্বাগতম, বউ স্বাগতম।”

রাগান্বিতা নিকাবের আড়ালে হাসলো। বললো,“একে ট্রলারে নিবেন না?”

ইমতিয়াজ খাঁচা থেকে পাখিটা বের করতে করতে বললো,“না।”

রাগান্বিতা অবাক হয়ে বললো,
“কেন?”
“কারণ একে মুক্ত করে দিবো ওই আকাশে।”
“আমাদের সঙ্গে কেন নিবেন না?”
“সবাইকে সঙ্গে নিতে নেই।”

এই বলে পাখিটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু কাটলো ইমতিয়াজ। সঙ্গে বললো,“তোকে বলেছিলাম না রোজ সকালে যদি নিয়ম করে তিনবার বলতে পারিস বউ স্বাগতম, বউ স্বাগতম তবে সাতদিন পর তোর মুক্তি। কি কথা রাখলাম তো। সবসময় ভালো থাকিস। আমাদের ভুলিস না কেমন। রোজ তিনবেলা খাইয়েছি মনে রাখিস কিন্তু।”

বলে আরো একবার টিয়ার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা এবার বুঝলো ইমতিয়াজ কেন পাখিটাকে ছেড়ে দিতে চাইছে। রাগান্বিতা আর মন খারাপ করলো না। নিকাবটা হাল্কা উঠিয়ে পাখির কপালে চুমু কেটে। শীতল সুরে বললো,“ভালো থাকিস সবসময়।”

অতঃপর ইমতিয়াজ রাগান্বিতা দুজনেই দু-হাতে টিয়াটাকে ধরে উড়িয়ে দিল আকাশে। সঙ্গে সঙ্গে টিয়া পাখিটি মুক্ত আকাশে ডানা ঝাপটাতে লাগলো। আবারও চেঁচিয়ে বলতে বলতে গেল,“বউ স্বাগতম, বউ স্বাগতম, বউ স্বাগতম।”

রাগান্বিতার চোখে পানি চলে এতো। কত সুন্দর সুন্দর মুহূর্ত কাটালো তারা। স্মৃতি হয়ে থাকবে সব।’

অবশেষে নদীরঘাটপাড়ে গিয়ে ট্রলারে উঠলো রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ। তারা উঠতেই ট্রলার চলতে শুরু করলো। একটু একটু করে তারা চলে আসতে লাগলো প্রেমনগর ছেড়ে। রাগান্বিতার চোখ ভেসে আসছে, কি সাধারণ জীবনযাপণ করলো এই কয়দিন। জীবন যে কি নিদারুণ সুন্দর ছিল গত সাতদিন। নৌকাটা নজরে আসলো, ঘাটপাড়ের বড় গাছটার সঙ্গে এখনো বাঁধা, ঢেউয়ের স্রোতে ভাসছে। মুক্ত আকাশে কিছু পাখি উঠছে, সেই দূরে দোলনাটা দেখা যাচ্ছে, ইমতিয়াজের বাঁশি বাজানোর সেই গাছটাও নজরে আসলো। ছোট্ট কুঁড়েঘরটা পড়ে রইলো একা, সামনেই ঝুলে রইলো শূন্য হওয়া সেই টিয়াপাখির খাঁচাটা। রাগান্বিতা যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণই তাকিয়ে রইলো প্রেমনগরের দিকে পাশেই ইমতিয়াজ দাঁড়ানো। হঠাৎই রাগান্বিতা কেমন এক বিষণ্ণ সুরে আওড়ালো,
“আমরা আবার কবে আসবো এখানে?”

ইমতিয়াজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“প্রকৃতি যেদিন আবার চাইবে।”

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]

#TanjiL_Mim♥️

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে