#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৩৪
________________
শিশির ভেজা একটা সকাল। বাতাসের ধ্বনি ধ্বনিতে ভেসে বেড়াচ্ছে একটা মিষ্টিমধুর সুরেলা কণ্ঠ। পুরো নির্জন মাখা সকালের প্রকৃতিরা সেই ধ্বনি শুনছে মন দিয়ে। বাড়তি কোনো শব্দ নেই, নেই কোনো কোলাহল। আছে শুধু এক রূপবতী রমণীর কণ্ঠে ভাসা কোরআনের সুর। রাগান্বিতা কোরআন শরীফ পাঠ করছে। অনেক আগেই সে আর ইমতিয়াজ উঠে একসাথে ফজরের নামাজ পড়ে। ইমতিয়াজ নামাজ আদায় করেই ঘুমিয়ে যায় কিন্তু রাগান্বিতা ঘুমায় নি। সে বাড়ি থেকে আসার সময় সঙ্গে করে কোরআন শরিফ নিয়ে আসে। রাগান্বিতা প্রায়শই নামাজ আদায় করে কোরআন পাঠ করে। আজও করছে। চারপাশ চুপচাপ আর নিরিবিলি। মাঝে দু’ একবার খোপের ভিতর থাকা মোরগের ডাক শোনা গেলেও পরে আর যায় নি তেমন। রাগান্বিতা জানালার ধারে মুখ করে চৌকির উপর বসে কোরআন পাঠ করছে। বাহিরেই খাঁচায় বন্দী করা তাদের সঙ্গে থাকা টিয়া পাখিটি চোখ বুজে ঝিমাচ্ছে। ধীরে ধীরে সময় গড়ালো। রাগান্বিতা তার কোরআন পাঠ শেষ করে মনে মনে কিছু দোয়া দরুদপাঠ করে ইমতিয়াজের কপালে ফুঁ দিয়ে দিলো। ইমতিয়াজ ঘুমে মগ্ন থাকায় তেমন টের পায় নি আর। রাগান্বিতা কোরআন শরিফ বন্ধ করে চুমু কাটলো দু’বার। তারপর এগিয়ে যায় সামনেই উচু তাকের কাছে সেখানে কোরআন শরীফ রেখে আবার এগিয়ে আসে ইমতিয়াজের দিকে। সকালের নাস্তা বানাতে হবে। কিন্তু তার আগে ঘর ঝাড়ু দিতে হবে। রাগান্বিতা ঘর ঝাড়ু দিয়ে, ঝাড়ু হাতে বের হলো বাহিরে সঙ্গে সঙ্গে শীতল ভেজা সকালের বাতাসেরা তাকে ছুঁয়ে দিলো। রাগান্বিতা চোখ বন্ধ করে ফেললো। সকালের এই মুহূর্তটা তার দারুণ লাগলো। রাগান্বিতা বেশিক্ষণ না দাঁড়িয়ে কোমড়ে আচল বেঁধে তাদের কুঁড়েঘরের সম্পূর্ণ আঙিনাটা একবার ঝাড়ু দিলো। তারপর রান্নাঘরের দিকে গেল। কুঁড়েঘরের ভিতরে ঢুকে হাতের ডানদিকে একটা দুয়ার আছে সেই দুয়ারের পরেই মাটির উনুন পেতে রন্ধনশালা বানানো। চুলার পাশেই জ্বালানোর জন্য ছিল শুঁকনো কিছু ডালপালা। রাগান্বিতা দেশলাই দিয়ে মাটির চুলা বা উনুন জ্বালালো। সর্বপ্রথম ছোট্ট পাতিল পেতে পানি দিলো গরম করার জন্য। রাগান্বিতা গরম গরম পরাটা আর দুধ চা বানাতে চাচ্ছে সকালের নাস্তা হিসেবে।
—-
“তুমি আমায় ভুলে গেছো তাই না”
“আমায় এভাবে ভুলে কি করে গেলে দা..”
সঙ্গে সঙ্গে হকচকিয়ে উঠলো ইমতিয়াজ। ঘুমটা ভেঙে গেল আচমকা। ইমতিয়াজ আশেপাশে তাকালো। জোরে একটা নিশ্বাস ফেললো। তখনই জানালার ফাঁক দিয়ে দেখতে পাওয়া টিয়াটা বলে উঠল,“বউ স্বাগতম, বউ স্বাগতম, বউ স্বাগতম!” রাগান্বিতাও শুনতে পেল টিয়ার কথাটা লজ্জায় নুইয়ে গেল। টিয়ার মুখে কথাটা শুনলেই তার কেমন লজ্জা লজ্জা লাগে। ইস্! ইমতিয়াজ এ কি শিখালো টিয়াটাকে। আনমনেই হেঁসে ফেললো রাগান্বিতা।
এদিকে, ইমতিয়াজ সেও তাকিয়ে রইলো টিয়াটার দিকে। অনেক্ক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে ধীরে ধীরে নিজেকে করলো শান্ত। তারপরই গলা খাগাড়ি দিয়ে ডাকলো,
“বউ, এই বউ, কোথায় তুমি?”
রাগান্বিতা তক্ষৎনাৎ তার কাজ রেখে দৌড়ে আসলো। এক হাতে আঠা মাখানো। রাগান্বিতা চিন্তিত স্বরে বললো,“কি হলো, কি হলো?”
রাগান্বিতার কণ্ঠ শুনেই ইমতিয়াজ তাকালো রাগান্বিতার দিকে। কাঁচা হলুদ রঙের শাড়ি (গ্রামীণ স্টাইলে পড়া),হাতে অল্প কিছু কাঁচের চুড়ি, মাথায় একপাশে সিঁথি কেটে চুলগুলো খোঁপা করা, দু’কানে ছোট্ট পুঁতির দুল, গলায় ছোট্ট একটা চেন সঙ্গে লাল রঙা ঠোঁটে রাগান্বিতাকে পুরো ভিন্নরকম লাগছে। ভাড়ি গহনাগাঁটি ছাড়াও এই সাধারণ শাড়িতেও কত মায়াবী দেখাচ্ছে রাগান্বিতাকে। ইমতিয়াজ পলকবিহীন তাকিয়ে রইলো রাগান্বিতার দিকে।
ইমতিয়াজকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবার প্রশ্ন করলো রাগান্বিতা,“কি হলো কিছু বলছেন না কেন! কি হয়েছে? এভাবে ডাকছিলেন যে।”
ইমতিয়াজ রাগান্বিতার চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। বললো,“কি হবে কিছুই হয় নি। কোথায় ছিলে তুমি?”
রাগান্বিতা কিছুটা এগিয়ে এসে বললো,
“সকালের নাস্তা করছিলাম তো।”
”তুমি জানো তোমায় না দেখে আমার কত খালি খালি লাগছিল?”
রাগান্বিতা হাসে। বলে,“আপনিও না তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে আসুন আমি খাবার তৈরি করছি।”
রাগান্বিতা চলে গেল। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে শুধালো,
“আজ তোমায় খুব সুন্দর দেখাচ্ছে বউ!”
রাগান্বিতা কথাটা শুনতে পেলেও বিনিময়ে কিছু বললো না। মুচকি হেঁসে চলে গেল চুলার পিটে।’
ইমতিয়াজ আরো কিছুক্ষণ চৌকিতে বসে থেকে বের হয় কুঁড়েঘর থেকে। জোরে নিশ্বাস ফেলে প্রকৃতির বুকে। তারপর হেঁটে যায় হাঁস-মুরগী আর গরু-ছাগলের কাছে। গরুর ছাগলদের ঘাস দিয়ে। হাঁস-মুরগীর খোপ খুলে দিলো, সঙ্গে সঙ্গে হাঁস-মুরগী বেরিয়ে এসে তাদের ছোট্ট ছোট্ট পা নিয়ে চলতে শুরু করলো। হাঁস দু’টো আর তাদের এক বাচ্চাটা দৌড়ে ছুটে গেল পানির কাছে। মুরগীর জন্য চাল এনে খেতে দিলো ইমতিয়াজ। সঙ্গে বললো,
“তোদের এখানে এনেছি কেন জানিস যাতে মনে হয় এই ছোট্ট দ্বীপে আমি রাগান্বিতা শুধু নই। তোদের মতো আরো কিছু প্রাণী আছে যারা গুনগুন করে আমাদের এই ছোট্ট সংসারে ঘোরাফেরা করবে। সঙ্গে মনে হবে এই প্রকৃতির সবটা নির্জীব নয়। সতেজও আছে।”
রাগান্বিতার হাঁক শোনা গেল। সে একটু উচ্চস্বরেই বললো,“আপনার কি হয়েছে? আমার কিন্তু রান্না প্রায় শেষ।”
ইমতিয়াজ উঠে দাঁড়ালো। রাগান্বিতাকে বললো,“এই তো হয়ে গেছে আমি ঘাটপাড় থেকে এক্ষুণি মুখ ধুয়ে আসছি।”
রাগান্বিতা শুনলো। বললো,“আচ্ছা জলদি আসবেন।”
—–
ইমতিয়াজ হাতমুখ ধুয়ে ঘরে পা রাখতেই রাগান্বিতা হাসি মুখে তার দিকে গামছা এগিয়ে দিলো ইমতিয়াজও নিলো। বললো,“ধন্যবাদ বউ।”
রাগান্বিতা বিনিময়ে হাল্কা হাসে। বলে,“পাটি কি ঘরের ভিতর বিছাবো নাকি বাহিরে?”
উত্তরে নিজের মুখখানা গামছা দিয়ে মুছে বললো ইমতিয়াজ,“বাহিরে।”
কুঁড়েঘরের সামনেই দুয়ারের একটু কিনার দিয়ে মাটির মেজেতে পাটি বিছিয়ে পাশাপাশি বসে আছে রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ তাদের সামনেই রয়েছে দু’কাপ দুধ চা আর একটা প্লেটে কিছু গরম গরম তৈলাক্ত পরাটা। ইমতিয়াজ একটা পরাটা হাতে নিয়ে গোল করে ভাজ করে দুধ চায়ের সাথে ভিজিয়ে খেতে শুরু করলো। রাগান্বিতাও খেতে লাগলো। তবে তার আগে জিজ্ঞেস করলো,“কেমন হয়েছে?”
ইমতিয়াজ রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে বললো,“দারুণ!”
রাগান্বিতা অবাক স্বরে বললো,
“কিন্তু আপনি তো এখনও খান নি?”
“তুমি রান্না করেছো মানেই সেটা দারুণ হবে।”
“মানুষকে কিভাবে কথার জালে ফাঁসানো যায় তার উপর পড়াশোনা করেছিলেন বুঝি।”
হাসে ইমতিয়াজ। বলে,
“তুমি ফাঁসলে না তো?”
“কে বলেছে ফাঁসি নি, আমি তো সেই কবেই ফেঁসে বসে আছি। আজও জানলেন না আপনি?”
চায়ের কাপে চুমুক দিলো ইমতিয়াজ। বললো,
“জানি তো তাও তোমার মুখে শুনতে ভালো লাগে।”
“আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন আমি প্রতিবার বিভোর হয়ে যাই।”
“তোমাকে বিভোর বানানোর জন্যই বোধহয় আমার জন্ম।”
“আপনি কি জানেন প্রিয় আমার প্রায় মনে হয় আমার সৃষ্টি আপনার জন্যই। আপনি ছাড়া বোধহয় আমি অসম্পূর্ণ।”
ইমতিয়াজ বিনিময়ে কিছু বলে না। ইচ্ছে করে চুপ করে রয়। তবে তার বলতে খুব মন চাচ্ছে,
“আমার তো মনে হয় আমার বিনাশের অস্ত্র বুঝি তোমার হাতে।”
কিন্তু ইমতিয়াজ বললো না। রাগান্বিতার ঠোঁটে থাকা হাসিটাকে এই মুহূর্তে কোনোভাবেই মিলিয়ে দিতে চায় না ইমতিয়াজ। সে একটা সিদ্ধান্ত নিলো, রাগান্বিতার সাথে উল্টোপাল্টা আর কোনো কথাই সে বলবে না। ইমতিয়াজ এ ক’দিনে হারে হারে টের পেয়েছে, রাগান্বিতাকে দুঃখ দেয়া ইমতিয়াজের কম্ম নয়!”
——
সময়টা প্রকৃতি মেপে বোধহয় সকাল দশটা। রাগান্বিতা ইমতিয়াজ নৌকায় চড়ে কোথায় যেন এসেছে। বর্তমানে নদীর মাঝে বইঠা রেখে পানিতে ভাসছে। ইমতিয়াজের হাতে মাছ ধরা জাল। রাগান্বিতা কিছুটা অবাক স্বরেই বললো,
“আপনি কি মাছ ধরতে চাচ্ছেন?”
ইমতিয়াজ নদীর এদিকে সেদিক তাকিয়ে বললো,“হুম।”
কথাটা শেষ করেই হাতের জালটাকে বিছিয়ে ছুঁড়ে মারলো নদীর পানিতে। রাগান্বিতা একটু চমকে উঠলো এতে। মনে মনে বললো,“আপনি মাছ ধরতেও জানেন?”
ইমতিয়াজ রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বললো,“একটু আকটু।”
খানিকটা কম্পন সৃষ্টি হয় রাগান্বিতার মাঝে। ধীরে স্বরে বলে,“মানুষটা তার মনে মনে বলা কথাগুলোও বুঝতে পারে কি করে?”
ইমতিয়াজ হাল্কা হাসে। ধীরে ধীরে উঠাতে শুরু করে নদীতে বিছিয়ে দেওয়া মৎস্য আটকানো তার জালটাকে।
#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]
#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৩৫
________________
দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে চুলাতে। রাগান্বিতা মাছ ভাজছে, তার পাশেই বসে আছে ইমতিয়াজ। দৃষ্টি তার রাগান্বিতার দিকেই। কতক্ষণ আগেই ইমতিয়াজের প্রথম জালেই একটা বড় মাছ আর কিছু ছোট ছোট মাছ ধরা পড়েছে। দু’জন মানুষের জন্য যা ছিল যথেষ্ট। ইমতিয়াজ পরর্বতীতে আর জাল ফেলে নি নদীতে। চারপাশটা একটু ঘুরে চলে আসে তাদের ছোট্ট কুটিরে। রাগান্বিতা ফিরেই দ্রুত মাছ কেটে রাঁধতে বসে। ইমতিয়াজ পাশে বসে শুধু দেখছে রাধুনী রাগান্বিতাকে কথা বলছে না কোনো চুপচাপ শুধু দেখেই যাচ্ছে।
….
রাগান্বিতার রান্না শেষ হলো। ভাত,মাছ ভাজা, ডাল, সঙ্গে ইমতিয়াজের কোথা থেকে যেন নিয়ে আসা লাউশাক রান্না করেছে রাগান্বিতা। দারুণ ঘ্রাণ বেরিয়েছে রান্না থেকে।’
রাগান্বিতা তার ঘেমে যাওয়া মুখটাকে মুছলো। কাজ তার প্রায় শেষ এবার শুধু ঘরটা একবার ঝাড়ু দিলেই হয়ে যাবে। রাগান্বিতা চুলার চারপাশটা গুছিয়ে পরিপাটি করলো, রান্নার আসবাবপত্রগুলো ঘরের ভিতর নিয়ে সাজিয়ে রাখলো তাকে। তারপর ঝাড়ু নিয়ে পুরো ঘর ঝাড়ু দিল। মাটির সিঁড়িতে ময়লা নিয়ে বাহিরে বের হতেই ইমতিয়াজ এগিয়ে আসলো হাতে গরু ছাগলকে খাওয়ানোর জন্য ঘাস নিয়ে। সে ঘাস নিয়ে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলো,“তোমার কি হয়ে গেছে বউ?”
রাগান্বিতা মাথা উঁচু করে কপালের ঘামটুকু পুনরায় মুছে বললো,“এই তো শেষ। আপনার হলো?”
ইমতিয়াজ দাঁড়িয়ে বললো,“হুম। আমি এগুলো রেখে আসছি আজ দুজন একসাথে গোসল করবো।”
রাগান্বিতা মৃদু হেসে জবাব দিলো,“ঠিক আছে।”
সময় গড়ালো। ইমতিয়াজ আর রাগান্বিতা হাতে করে গামছা আর জামাকাপড় নিয়ে হেঁটে গেল নদীরঘাটে। দুজনের হাতে নিমপাতার ডাল। দুজনেই ডাল দিয়ে দাঁত মাজছে। রাগান্বিতা তার তিতা তিতা মুখখানা নিয়ে বললো,
“এগুলো দিয়ে আপনি কি করে দাঁত মাজেন কি তিতা?”
“তিতা কই? আমার তো লাগে না।”
চোখ মুখ কুঁচকে তাকালো রাগান্বিতা যা দেখে ইমতিয়াজ হাসলো। জামাকাপড় ঘাটের পাশে উঁচু বেঞ্চিটাতে রেখে ঘাটপাড়ে নামলো দুজন। ইমতিয়াজ আগে এরপর রাগান্বিতা। বাঁশের তৈরি সুন্দর ঘাট। রাগান্বিতা ঘাটে বসলো। হাত দিয়ে পানি স্পর্শ করে কুলি করলো। এরপর সামনের দিকে তাকালো। দূরদূরান্তে শুধু নদীতে থাকা পানি আর পানি।
কাছেই নদীর ঢেউয়ে নৌকাটা বড় গাছের পিঠে ভাসছে। ইমতিয়াজ আর রাগান্বিতা মিষ্টি আলাপে হাসাহাসি করছে আর নাইছে। পানিও ছিটাচ্ছে একে অপরের গায়ে। রাগান্বিতা বললো,“আপনি একটা পাগল।”
ইমতিয়াজ হাসতে হাসতে জবাব দিলো,
“জানি তো তুমি করেছো।”
“উম, আমার বয়েই গেছে আপনাকে পাগল বানাতে উল্টো আপনি পাগল বানিয়েছেন।”
“এক ষোড়শী কন্যার মাঝে এত প্রেম আমি এর আগে দেখেনি।”
“আমি কিন্তু বেশ সাহসী।”
“মানুষ খুন করতে পারবে?”
রাগান্বিতা ফট করেই বলে দিল,“আপনি বললে ঠিক পারবো।”
উচ্চ শব্দে হেঁসে দিলো ইমতিয়াজ। রাগান্বিতাও হাসলো। কি মিষ্টি মধুর সময় কাটলো দুজনের এই নিরিবিলি প্রকৃতিতে। পাখি ছুটছিল ধবধবে সাদা রঙের বিশাল আকাশে।’
যোহরের নামাজ আদায় করে দুজনেই সকালের ন্যায় খেতে বসলো কুঁড়েঘরের দুয়ারের কাছে। রাগান্বিতা হাতে হাতপাখা দিয়ে ইমতিয়াজকে বাতাস করছে,ইমতিয়াজ বারণ করেছিল বটে কিন্তু রাগান্বিতা শোনে নি। ইমতিয়াজ তৃপ্তি পেয়ে খাচ্ছে মাছ, ডাল, ভাত আর শাক। রাগান্বিতার রান্নার হাত চমৎকার। ইমতিয়াজের অনেক পছন্দের।’
খাবার সেরে বিছানায় শুয়ে দুজন গল্প করলো কিছুক্ষণ এরপর বিকেল হতেই নামাজ পড়ে হাঁটতে বের হলো দুজন। আকাশটা সুন্দর। চারপাশ শুঁকনো। কাল সেই বৃষ্টিটার পরে কড়া রোদ পড়ায় সব শুকিয়ে গেছে। রাগান্বিতা ইমতিয়াজের হাত ধরলো। আহ্লাদী স্বরে বললো,
“এই জায়গাটার নামটা তো জানা হয় নি।”
“এত জেনে কি করবে থাকুক না কিছু অজানা।”
“কেন থাকবে?”
“থাকলে কি খুব ক্ষতি হবে?”
“না। তবে বললে আমি খুশি হবো।”
“তবে বোধহয় আজ তোমায় খুশি করা হলো না আমার।”
খানিকটা অভিমান জমলো রাগান্বিতার। সে মুখ কালো করে বললো,“নামটা বললে কি হতো?”
“তুমি যে আমায় ফেলে আসতে তখন।”
“আসবো না আমি আপনি হীনা এদিকে কখনো আসবো না।”
ইমতিয়াজ এবার ভাবলো। বললো,
“নাম কি দেয়া যায় বলো তো?”
ইমতিয়াজের কথা শুনে অবাক হয়ে বললো রাগান্বিতা,
“কেন, নাম দিবেন কেন, এই জায়গার নাম নেই।”
“আছে তো প্রেমনগর। এই জায়গার নাম প্রেমনগর।”
রাগান্বিতা হেঁসে ফেলে। বলে,
“যা খুশি জায়গার নাম কখনো এমন হয়। প্রেমনগর।”
“কেন হয় না আচ্ছা বাদ দেও ওদিকে চলো।”
বলেই এগিয়ে চললো ইমতিয়াজ আর রাগান্বিতা। কতদূর হাঁটতেই কিছু গাছপালার মধ্যে ঢুকে পড়লো রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ। মাঝখানের গাছ দুটোতে কাঠের সঙ্গে দড়ি বেঁধে দোলনা বানানো। রাগান্বিতা জিনিসটা দেখেই বললো,“বসি?”
ইমতিয়াজ মৃদু হেসে বললো,“হুম বসো তোমার জন্যই বানানো।”
রাগান্বিতা দৌড়ে গিয়ে বসলো। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার পিছনে দাঁড়িয়ে হাল্কা ধাক্কা দিলো। সঙ্গে সঙ্গে রাগান্বিতা সামনে পিছনে দুলতে লাগলো। অদ্ভুত এক ভালোলাগা গ্রাস করলো রাগান্বিতাকে। সে হাসলো উচ্চ শব্দে হাসলো। সেই হাসি যেন ইমতিয়াজের হৃদয় নাড়িয়ে দেয়ার মতো কাজ করলো। ইমতিয়াজ দেখে গেল রাগান্বিতাকে। হাল্কা স্বরে আওড়ালো,“কি নিদারুণ হাসি তোমার। এই হাসিতেই আমি নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি বারংবার। অন্তর পুরে ছারখার হচ্ছে যে কতবার তা যদি তুমি জানতে।”
ইমতিয়াজ কয়েকমুহুর্ত রাগান্বিতার পিছনে দাঁড়িয়ে থেকে কথাগুলো ভেবে হঠাৎই সরে গেল। গিয়ে বসলো নদীর ধারের একটা বড় গাছের সাথে হেলান দিয়ে। তবে রাগান্বিতার কাছ দিয়েই ছিল। ইমতিয়াজের পড়নে ফতুয়া আর লুঙ্গি। মাথায় গামছা পেঁচানো। ইমতিয়াজ একপলক রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে কোমড়ের কাছে ফতুয়ার আড়ালে লুকিয়ে রাখা বাঁশিটা বের করলো। তারপর পূর্বাংশের আকাশটার পানে চেয়ে ঠোঁট ছোঁয়ালো বাঁশির ফাঁকে দু’হাতের আঙুলও ছোঁয়ালো বাঁশির শেষ প্রান্তের দিকের ফাঁকে ফাঁকে। ধীরে ধীরে সুর আনলো। প্রকৃতি জুড়িয়ে কি মুগ্ধনীয় আওয়াজ হলো চারিপাশে। নিস্তব্ধ প্রকৃতিটা বুঝি হঠাৎ করেই সতেজ হয়ে উঠলো। পাখিরা ছুটে এসে বসলো গাছের ডালে। তাদেরও মন কাড়লো বুঝি ইমতিয়াজের বাঁশির সুর। মনে মনে বোধহয় বলছিল,“এত সুন্দর কেন!”
রাগান্বিতা তার দোলনা দুলানো বন্ধ করলো আচমকা। সেই ভরসন্ধ্যাবেলার প্রথম আলাপের বাঁশির সুর ঝনঝন করে যেন বেজে উঠলো রাগান্বিতার কানে। রাগান্বিতা মুগ্ধ হলো, মনটা প্রবল স্রোতের মতো প্রেমদুয়ারের কাছে ছিটকে গেল। কি প্রবল ধাক্কা লাগলো হৃদয়ে। রাগান্বিতা বুকে হাত দিল। সে আবার প্রেমে পড়লো বুঝি ইমতিয়াজের। দোলনার দড়িতে কপাল ছুঁয়ে মনে মনে আওড়ালো, “ছেলেটা এত মুগ্ধনীয় কেন! আমি বার বার হারিয়ে যাই।”
অনেকক্ষণ সময় চললো ওমন। রাগান্বিতা দোলনায় বসে বাঁশির সুর শুনলো আর ইমতিয়াজ গাছের পিঠে হেলান দিয়ে বাঁশি বাজাতে থাকলো। তবে তারা কিন্তু পুরোপুরি একা ছিল না তাদের সঙ্গে ছিল গাছের ডালে বসে থাকা কিছু নাম না জানা পাখি। তারাও মগ্ন ছিল বাঁশির সুরে।
রাগান্বিতা উঠে দাঁড়ালো, অনেক তো হলো দূরে বসা এবার না হয় কাছে যাওয়া যাক। রাগান্বিতা নীরবে গিয়ে বসলো ইমতিয়াজের পাশ দিয়ে। নদীতে তখন প্রবল স্রোতের শব্দ শোনা গেল। ইমতিয়াজ চোখ বন্ধ করে বাঁশি বাজাতে থাকলো মন দিয়ে। যেন আজ পুরো মনটাই আঁকড়ে ছিল বাঁশির ভিড়ে। রাগান্বিতা গালে হাত দিয়ে এক ধ্যানের তাকিয়ে রইলো ইমতিয়াজের মুখশ্রীর দিকে। কি নিষ্পাপ লাগছে ওই মুখখানা। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে রাগান্বিতার ইচ্ছে হচ্ছে,“এই সময়টা যদি এখানেই থেমে যেত, ওই পাখিগুলোও ওখানে বসে থাকতো, এই মুগ্ধনীয় পরিবেশটার যদি কোনো পরিসমাপ্তি না ঘটতো তবে না কতই ভালো হতো। রাগান্বিতা প্রাণ ভরে শুধু ইমতিয়াজকেই দেখে যেত। এই দেখা বুঝি জনম জনমেও শেষ হবে না রাগান্বিতার। একটা মানুষ দেখার এত তৃপ্তি রাগান্বিতা এর আগে কখনো অনুভব করে নি। ক্ষণে ক্ষণে সে টের পাচ্ছে সে মরছে, ইমতিয়াজের প্রতি গভীর আসক্তিতায় সে দিনে দিনে মারা পড়ছে।”
ইমতিয়াজের কণ্ঠ শোনা গেল। সে বাঁশি বাজানো থামিয়ে নরম স্বরে বললো,“এভাবে তাকিয়ে থেকো না গো, আমি যে পুরোই সর্বহারা হয়ে যাবো বউ।”
রাগান্বিতার টনক নড়লো। গালের হাত সরিয়ে ধ্যানময়ী গলায় বললো,
“আমিও যে হচ্ছি তার বেলা।”
জবাব দেয় না কেউই কারো কথার। ধীরে ধীরে সময়ের সাথে সাথে প্রকৃতিও রঙ বদলালো। রাগান্বিতা ইমতিয়াজ পাশাপাশি, কাছাকাছি বসা। দৃষ্টি তাদের নদীর ভিড়ে আকাশের মাঝে থাকা লাল রঙা সূর্যটার দিকে। চারপাশ পুরো রক্তিম আগুনের আলোর মতো চকচকা। বোঝাই যাচ্ছে সন্ধ্যা নামছে। একটা ধমকানো বাতাস ছুইলো ইমতিয়াজ আর রাগান্বিতাকে। ইমতিয়াজ আচমকা বলে উঠল,
“জানো তো রাগান্বিতা, প্রেম মানে হলো এক আসমান যন্ত্রণা তাও দেখো মানুষ বেছে বেছে সেই প্রেমে পড়বেই যেমন আমি পড়েছি।”
রাগান্বিতার দৃষ্টি প্রকৃতির দিকে থাকলেও ইমতিয়াজের কথাটা খুব ভালোভাবেই শুনেছে। মুচকি হেসে ইমতিয়াজের কাঁধে মাথা দিয়ে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে স্বল্প স্বরে আওড়ালো,
“আমিও।”
#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]
#TanjiL_Mim♥️