#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৩২
________________
ফজরের ধ্বনি কানে আসতেই ঘুমটা ভেঙে গেল রাগান্বিতার সে আধশোয়া হয়ে উঠে বসলো। আশেপাশে তাকালো কিছুক্ষণ। চোখের ঘুমটা পুরোপুরি যেতেই রাগান্বিতা তাকালো ইমতিয়াজের ঘুমন্ত মুখের দিকে। কি মায়া ভরা ওই মুখখানায়! রাগান্বিতা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ইমতিয়াজের মুখের দিকে। ধীর স্বরে বললো,“আপনায় ভীষণ ভালোবাসি প্রিয় কখনো ছেড়ে যাবেন না তবে যে আমি পাগল হয়ে যাবো। আপনায় যে কেন এতো ভালোবাসি আমি নিজেও জানি না। আপনার চোখ দুটোতেই আমি বড্ড মায়া দেখি, আপনার কণ্ঠস্বর প্রতিবার যেন আমার কানে মধুর সুরেলা হয়ে ভাসে আর আপনার বিশ্বস্ত বুকখানা ইস! আমি যতবার ওই বুুকখানায় মাথা রাখি কি যে শান্তি অনুভব হয় আপনায় বোঝানো যাবে না। আপনার একটুখানি অবহেলায় আমি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাই আমায় কখনো অবহেলা কইরেন না। তবে যে আমি জীবিত থেকেও মৃত ঘোষিত হবো।”
একা মনে অনেককিছু বললো রাগান্বিতা। চট করেই তার হুস আসলো তাকে নামাজ আদায় করতে হবে। রাগান্বিতা ইমতিয়াজকে ডাকলো। বললো,“শুনছেন, উঠুন জলদি নামাজ পড়তে যাবেন না।”
কয়েকবার ডাকতেই ইমতিয়াজের হুস আসে। যে দ্রুত উঠে বসে। বলে,“কি হয়েছে বউ?”
রাগান্বিতা হাল্কা হেঁসে বলে,“কিছু না দ্রুত উঠুন নামাজ পড়তে হবে।”
ইমতিয়াজ শুনলো সে দ্রুত বিছানা থেকে নেমে চলে যায় বাথরুমে। কতক্ষণ পেরিয়ে দ্রুত টুপি আর পাঞ্জাবি পড়ে বেরিয়ে যায়। ইমতিয়াজ যেতেই রাগান্বিতা ঢুকে বাথরুমে।
—–
ফজরের নামাজ আদায় করে জানালার ধারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে রাগান্বিতা। ধীরে ধীরে আধারে মেশা প্রকৃতিটা হলো আলোকিত। পাখিরা ডানা ঝাপটাচ্ছে দূর আকাশে। গাছের পাতা নড়ছে। রাগান্বিতার মন চাইলো এই প্রকৃতির মাঝে উঠানটায় একটু হাঁটতে। রাগান্বিতা আর দেরি করলো না সে বেরিয়ে গেল কক্ষ থেকে। কক্ষ থেকে বের হতেই রাগান্বিতার নজরে আসলো সেই তালাবদ্ধ করা কক্ষটার দিকে। যেটা বর্তমানে আর তালাবদ্ধ থাকে না। প্রায় মাসখানেক আগে যখন রাগান্বিতা তাদের বাড়ি থেকে এসেছিল তখনই দেখে তালাবদ্ধ করা কক্ষটা খোলা। অন্যান্য কক্ষগুলোর মতই এটাও পরিপাটি ছিল। তবে রাগান্বিতা বুঝেছিল তারা আসার আগেই কেউ কক্ষটা পরিষ্কার করে ছিল। রাগান্বিতা জিজ্ঞেস করেছিল এই কক্ষটায় আগে কি ছিল। ইমতিয়াজ বলে, ‘ময়লা সয়লা থাকতো। যা এখন সরিয়ে ফেলা হয়েছে।’ রাগান্বিতাও আর ঘাটে নি। রাগান্বিতা আলতো পায়ে নানা কিছু ভাবতে ভাবতে বাড়ির ভিতর থেকে বের হলো। মুক্ত খোলামেলা পরিবেশটায় প্রাণ খোলা নিশ্বাস নিয়ে হাঁটতে লাগলো। হঠাৎই রাগান্বিতার নজরে আসলো রবিনকে। লোকটা হাতে কি নিয়ে যেন বাড়ির পিছনের দিকটায় যাচ্ছে। রাগান্বিতা কৌতুহলী পিছু নিলো রবিনের কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো ডালপালা মিশ্রিত জায়গাটার কাছে আসতেই রবিনকে আর দেখতে পেল না রাগান্বিতা। রাগান্বিতা আশেপাশে তাকালো কিন্তু না কেউ নেই। তবে লাস্টবার ওই জমানো ডালপালা একটু নড়তে দেখেছিল।’
রাগান্বিতা আর একটু এগোবে এরই মাঝে পিছন থেকে বলে উঠল ইমতিয়াজ,“বউ।”
রাগান্বিতা আর এগোতে পারলো না। সে পিছন ফিরে তাকালো। বললো,“জি, আপনি চলে এসেছেন।”
ইমতিয়াজ দু’কদম এগিয়ে এসে বললো,“হুম। তুমি ওখানে কি করছো?”
রাগান্বিতা কথাটা চেপে গেল। বললো,
“কিছু করছিলাম না তো সকালের প্রকৃতিতে একটু হাঁটতে ইচ্ছে হলো তাই হাঁটছিলাম।”
“ওহ আচ্ছা এদিকে আসো।”
রাগান্বিতা এগিয়ে গেল। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার কাঁধ ধরে বললো,“চলো আমার সাথে আমরা একটু পর বের হবো।”
বলেই রাগান্বিতার হাত ধরে নিয়ে যেতে লাগলো ইমতিয়াজ। রাগান্বিতাও আর কিছু বলতে পারলো না তবে কৌতুহল একটা রয়েই গেল। এই রবিনকেও মাঝে মধ্যে কেমন যেন লাগে রাগান্বিতার। সেদিন রাতের ঘটনাটা হুট করে মনে পড়লো তার।
বাড়ির ভিতর ঢুকতেই সর্বপ্রথম নজরে আসলো রবিনকে। রবিন রন্ধনশালা থেকে বেরিয়ে এসেছে। রাগান্বিতা তাকে দেখেই তড়িৎ চমকে উঠলো। মাত্রই না রবিনকে সে বাহিরে দেখলো এরই মাঝে বাড়ির ভিতর আসলো কি করে! রাগান্বিতা আশপাশ না ভেবেই রবিনকে প্রশ্ন করলো,“আপনি কি এই মাত্র বাহিরে গিয়েছিলেন চাচা?”
রাগান্বিতার আচমকা প্রশ্নে রবিন অপ্রস্তুত অনুভব করলো। সে দ্রুত জবাব দিলো,“কই না তো আমি তো এহনই আইলাম।”
রাগান্বিতা আর কিছু বলতে পারলো না তবে কি সে ভুল দেখেছিল তখন। কিন্তু তার স্পষ্ট মনে পড়ছে রবিন হাতে করে কি নিয়ে যেন বাড়ির পিছনে যাচ্ছিল। রাগান্বিতাকে চিন্তিত দেখে ইমতিয়াজ প্রশ্ন করলো,“কিছু কি হয়েছে?”
রাগান্বিতা নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,“না কিছু হয় নি।”
ইমতিয়াজও আর কোনো প্রশ্ন করলো না।’
—-
সকালের নাস্তা সেরে নিজ কক্ষে তৈরি হচ্ছিল রাগান্বিতা। কালো রঙের জামদানী শাড়ি, হাতে সোনার চুড়ি, গলায় ভাড়ি অলংকার, চুলগুলো খোঁপা করা, চোখে গাঁড়ো কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিক।
ইমতিয়াজ কক্ষে ঢুকলো। রাগান্বিতা খানিকটা চমকে তাকালো তার দিকে। ইমতিয়াজ দাঁড়িয়ে পড়লো দুয়ারের সামনে। এক অদ্ভুত গভীর চাহনী নিয়ে তাকিয়ে রইলো রাগান্বিতার দিকে। একটা মানুষকে কালো রঙের শাড়িতে এত বেশি চমৎকার দেখাতে পারে জানা ছিল না বুঝি ইমতিয়াজের। ইমতিয়াজ কেমন ঘোর লাগানো দৃষ্টি নিয়ে এগিয়ে গেল রাগান্বিতার দিকে। রাগান্বিতা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। ইমতিয়াজ এগিয়ে এলো। রাগান্বিতার চোখের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ সুরে শুধালো,
“এত সেজো না বউ আমি যে পাগল হয়ে যাবো।”
রাগান্বিতা লজ্জায় মাথা নুইয়ে বললো,
“আপনার চোখে এমন প্রেম দেখার জন্য হলেও আমি বার বার সাজতে প্রস্তুত।”
“আমি বুঝেছি তুমি ভালো থাকতে দিবে না আমায়?”
“সাজলে বুঝি মানুষ ভালো থাকে না।”
“কেউ থাকে কি না জানি না তবে আমি থাকি না। এই যে এখন মাতাল মাতাল লাগছে, মস্তিষ্কের শব্দভান্ডারে শয়তান হানা দিচ্ছে এর দায় কে নিবে?”
“আমি তো আপনার বিয়ে করা বউ আমাতে ভয় কিসের!”
“মনের গহীনে হাজারো শব্দ, হাজারো কথা,লক্ষ কটি ভয় অথচ তোমায় বলতে গেলেই কোনো শব্দ খুঁজে পাই না। ফাঁকা ফাঁকা লাগে সবটা। এমনটা কেন হয় বউ?”
“আমি জানি না।”
হেঁসে ফেলে ইমতিয়াজ। আস্তে করে রাগান্বিতা গায়ে জড়ানো সকল অলংকার খুলে ফেলে। রাগান্বিতা অবাক হয়ে বলে,
“এগুলো খুলছেন যে,
“তোমায় কাল বলেছিলাম না আমরা বিলাসবহুল নয় সাধারণ ভাবে কিছুদিন সংসার করবো।”
রাগান্বিতা কিছু বললো না। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার গায়ের অলংকার খুলে গলায় চিকন একটা লকেট সমৃদ্ধ চেইন, দু হাতে দুটো চিকন চুড়ি আর কানে ছোট দুটো দুল পড়িয়ে দিল। তারপর ব্যাগে রাখা একটা সাদামাটা শাড়ি বের করলো। কিন্তু পরক্ষণেই রাগান্বিতাকে একপলক দেখে বললো, “আজ থাক কাল পড়ো। এতটুকু যন্ত্রণা আমি সইতেই পারি।”
শেষ কথাটার অর্থটা ঠিক বুঝলো না রাগান্বিতা। তবে কিছু জিজ্ঞেস করে নি আর। মুখ থেকে আপনাআপনি বেরিয়ে আসলো তার,“অদ্ভুত একটা লোক।”
রাগান্বিতাকে হাল্কা ভাবে সাজিয়ে ইমতিয়াজ করুণ চোখে তাকিয়ে রয় ওর মুখের দিকে। মনে মনে বলে, “তোমার কি মনে হয় না তুমি আমার শহরে এসে ভুল করেছো?” উত্তর এলো না। তবে ইমতিয়াজ এও জানে এই কথাটা রাগান্বিতাকে বললে রাগান্বিতা জবাবে বলতো, “কেন বলুন তো”। ঠিক তখনই ইমতিয়াজ রাগান্বিতাকে উত্তর দিতো,-
“তোমার শহর ভীষণ সুন্দর,
নয়নে জুড়ায় আঁখি।
আমার শহর বেজায় তীক্ষ্ণ,
বিষণ্ণতায় মাখা মাখি!”
সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা থমকে যেত। কেমন বিষণ্ণ মাখা চাহনী নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতো। আর সেই চাহনী দেখে ইমতিয়াজ ক্ষত বিক্ষত হতো। কি এক দারুণ অবস্থা।
—-
ঢাকার নদীর ঘাটে দাঁড়িয়ে আছে রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ। রবিনকে জানানো হয়েছে তারা কিছুদিনের জন্য দূরে কোথাও যাচ্ছে সে চাইলে তার বউ বাচ্চাকে নিয়ে ইমতিয়াজদের বাড়িতে থাকতে পারে। রবিনও মেনে নেয়। বার বার বাড়ি যাওয়া আবার ফিরে আসা বড্ড ঝামেলার লাগে রবিনের।’
রাগান্বিতা নদীর এপার থেকে ওপারে তাকালো। আশেপাশেও তাকালো। মানুষ খুব কম। বেলা বেশি না সকাল আটটা বাজে। চারপাশ পুরো নিরিবিলি। রাগান্বিতা প্রশ্ন করলো,“আমার কিসে চড়ে যাবো?”
উত্তরে ইমতিয়াজ জবাব দিলো,“ট্রলারে।”
কিছুক্ষণের মাঝেই একটা ট্রলার আসলো রাগান্বিতাদের সামনে। ইমতিয়াজ তাকে নিয়ে সেই ট্রলারে উঠলো। রাগান্বিতা পুরো ট্রলারে চোখ বুলাতেই অবাক হলো। কারণ পুরো ট্রলারে মানুষ হিসেবে ছিল তারা তিনজন। ইমতিয়াজ, সে আর ট্রলার চালক। আর বাকি যারা ছিল তারা কেউই মানুষ না।
#চলবে….
#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৩৩
________________
হা হয়ে তাকিয়ে আছে রাগান্বিতা পুরো ট্রলারের দিকে। কারণ তার সামনে রয়েছে দুটো গরু একটা বাছুর, তিনটে ছোট ছোট ছাগল,দুটো মোরগ, দুটো মুরগী সঙ্গে তাদের ছানা পোনা, দুটো বড় বড় হাঁস তাদের একটা ছাও(বাচ্চা), সঙ্গে একটা টিয়াপাখি, গরু আর ছাগল বাদে বাকি সবগুলোই খাঁচায় বন্দী। গরু ছাগল দড়ি দিয়ে বাধা। ট্রলারে জায়গা নেই তেমন। অথচ মানুষ হিসেবে আছে তারা তিনজন বাকি যারা আছে তাদের একজনও মানুষ না। রাগান্বিতার এই মুহূর্তে ঠিক কেমন প্রতিক্রিয়া দেয়া উচিত বুঝতে পারছে না। ইমতিয়াজ স্বাভাবিক। যেন এটা খুব স্বাভাবিক একটা বিষয়। নিত্যদিনের ব্যাপার। ট্রলারের কর্নারের দিকটায় চেয়ার পেতে পাশাপাশি বসে আছে ইমতিয়াজ আর রাগান্বিতা। ট্রলার চলছে তার আপন গতিতে। কোথায় যাচ্ছে রাগান্বিতা জানে না। রাগান্বিতা নদীর পানির দিকে তাকালো। ঢেউয়েরা ছুটছে তুমুল বেগে। রাগান্বিতা ইমতিয়াজের মুখের দিকে তাকালো। খুব অদ্ভুত কণ্ঠে বললো,“আমরা কি আর ফিরবো না?”
ইমতিয়াজ একপলক রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে বললো,“যদি বলি না ভয় পাবে খুব।”
রাগান্বিতা নিজেকে ধাতস্থ করলো। অবাক হয়েই বললো,
“ভয় পাবার কি আছে?”
“সত্যিই নেই?”
“আমি তো দেখি না।”
“তুমি দেখো না,নাকি দেখতে চাও না।”
“আপনি ঠিক কি বলতে চাইছেন বলুন তো।”
“তোমায় আমি খুন করবো বউ।”
সঙ্গে সঙ্গে উচ্চ শব্দে হেঁসে ফেললো রাগান্বিতা। শব্দটা এতটাই জোরে ছিল যে নিকাবের আর ট্রলারের শব্দের ভিড়েও ইমতিয়াজ খুব ভালো ভাবে টের পেল। ইমতিয়াজ বিস্মিত কণ্ঠে বললো,“তুমি ভয় পাচ্ছো না?”
রাগান্বিতা আরো কিছুক্ষণ হাসলো। মিনিট দুই যেতেই থেমে বললো,“আপনার কথায় আমি কখনোই ভয় পাই না। উল্টো আপনার কথা শুনলেই আমি নতুন করে প্রেমে পড়ে যাই।”
ইমতিয়াজ তাজ্জব বনে গেল। কি সাংঘাতিক কথা! মেয়েটা তার খুন শব্দের মধ্যেও ভালোবাসার ছোঁয়া পায়। ইমতিয়াজ নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,
“আমায় এত বিশ্বাস কেন করো বউ? জানো না মানুষকে বেশি বিশ্বাস করতে নেই।”
“দুনিয়ার সবাইকেই অবিশ্বাস করলে জীবনটা রঙিন হবে কি করে বলুন।”
“তুমি রঙিন জীবন চাইছো ওদিকে আমার নিজের জীবনই অন্ধকারে টইটম্বুর।”
“আগে ছিল মানছি। কিন্তু এখন আর থাকবে না আমি আছি তো রঙিন করার দায়িত্ব আমার।”
মৃদু হাসে ইমতিয়াজ। বলে,
“তুমি কি জানো দিনে দিনে আমি বড্ড ভীতু হচ্ছি?”
“আমি মেয়ে হয়ে ভীতু হই না আর আপনি ছেলে হয়ে ভীতু হচ্ছেন। এত ভয় কিসের আপনার?”
“তোমায় বলবো না বলে দিলেই আমি ধ্বংস।”
রাগান্বিতা এবার কি বলবে বুঝতে পারছে না। প্রায়শই ইমতিয়াজের এমন শেষ কথায় আঁটকে যায় রাগান্বিতা। প্রতিউত্তরে কিছুই বলতে পারে না।আজও তার ব্যতিক্রম কিছু হলো না। রাগান্বিতা চুপ হয়ে গেল। হঠাৎই আবার বলে উঠলো ইমতিয়াজ,
“তুমি কি মানবে একদিন তুমি আমায় খুন করতে চাইবে?”
সঙ্গে সঙ্গে চোখে মুখে বিস্ময়ের ছায়া ফুটে উঠলো রাগান্বিতার। যদিও রাগান্বিতার নিকাবের কারণে চোখ দুটো ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না ইমতিয়াজ। তবুও ওই চোখ দেখেই ইমতিয়াজ অনেককিছু বুঝলো। রাগান্বিতা কেমন এক দৃষ্টি নিয়ে থমথমে কণ্ঠে বললো,“আমি আপনায় কেন খুন করতে চাইবো। আপনায় খুন করার আগে যেন আমি ঝলসে যাই।”
বিনিময়ে ইমতিয়াজ আর কিছু বলে না। উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। বুকচাপা এক দীর্ঘশ্বাস বের হয়। ইমতিয়াজ আকাশ পানে তাকিয়ে বলে,- শুরু যেমন হয় শেষও তেমনি ঘটে। সৃষ্টি যখন হয়েছে ধ্বংস তখন অনিবার্য! শুধু দেখার পালা ধ্বংসের পথটা কতদূর। খুব দূরে নাকি অতি নিকটে!’
নিজ ভাবনার মাঝে কাঁধে কারো স্পর্শ অনুভব করলো ইমতিয়াজ। সে তাকালো। রাগান্বিতা তার কাঁধে মাথা দিয়েছে। ইমতিয়াজ কি ভেবে যেন বলে উঠলো,“আমি চাইবো বউ তোমার আমার পথটা যেন বহুকালের দীর্ঘ হয়।”
রাগান্বিতা নিকাবের আড়ালে মুচকি হাসলো। এতক্ষণ পর মানুষটা দারুণ কিছু বললো। রাগান্বিতা ঠোঁটে হাসি রেখেই বললো,“তা তো হবেই। এই রাগান্বিতা এত দ্রুত আপনার পিছু ছাড়বে না।”
—-
চারঘন্টার পথ অতিক্রম করে ইমতিয়াজদের ট্রলার এসে থামলো একটা ছোট্ট দ্বীপের মতো জায়গাতে। রাগান্বিতা পুরো জায়গাতেই চোখ বুলালো। একটা গোলাকার বৃত্তের মতো জমি। যার পুরোটায় সবুজ ঘাসে ভর্তি। সামনের দূরের দিকের একাংশে রয়েছে অসংখ্য বড় বড় গাছ। মাঝখানে ফাঁকা। আর গোলাকার বৃত্তের চারপাশে নদীর। দূরদূরান্তে কিছু দেখা যাচ্ছে না। এক কথায় বিশাল নদীর মাঝে একটা ছোট্ট গোলাকার দ্বীপ। রাগান্বিতা ইমতিয়াজ ট্রলার ছেড়ে নামলো। রাগান্বিতা আবারও আশপাশটা দেখলো। এখানে তারা থাকবে কই তাই বুঝচ্ছে না রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার হাত ধরলো। ট্রলার চালককে বললো,“আপনি এখানে থাকুন আমি একটু আসছি।”
এই বলে রাগান্বিতাকে নিয়ে চললো ইমতিয়াজ। হেঁটে আসলো একদম ওইমাথায়। অনেকখানি এগোতেই রাগান্বিতা দেখলো। চারপাশে গোল করে বেড়া দিয়ে রয়েছে নারকেল, সুপারি আর কলা গাছের শুকনো পাতা। বেড়ার কারনে ওপাশে কি আছে দেখা যাচ্ছে না। ইমতিয়াজ হেঁটে এসে মাঝ বরাবর দাঁড়ালো। তারপর হাত দিয়ে দুদিকের মাঝখান বরাবর বেড়া ফাঁক করে দিলো সঙ্গে সঙ্গে রাগান্বিতা দেখতে পেল। ফকফকা মাটির উঠান। উঠানের সামনেই একটু দূরে একটা ছোট্ট কুঁড়েঘর। খড়ের তৈরি ছাউনী তার। চারপাশে দেয়াল হিসেবে রয়েছে মাটি। ঘরে ঢোকার আগে উপরে খড়ের চাউনী থাকলেও চারপাশে বেড়া নেই। জমিনের মাটি থেকে একটু উঁচুতে ঘরটা। সামনে দুটো মাটির তৈরি সিঁড়িও আছে। রাগান্বিতা সামনে যত আগাচ্ছে তত মুগ্ধ হচ্ছে। চারপাশ এত সুন্দর কেন! তাদের সামরাজ্যের ওই জমিদার ভিটার চেয়েও কি নিদারুণ সুন্দর দেখাচ্ছে এই কুঁড়েঘরটা। রাগান্বিতা “বিসমিল্লাহ” বলে ঘরে প্রবেশ করলো। চারপাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়তো বৃষ্টি হবে। বাতাস বইছে পুরো প্রকৃতি জুড়ে। রাগান্বিতাকে ঘরের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে ইমতিয়াজ বললো,“তুমি এখানে চুপটি করে দাঁড়াও আমি বাকিদের থাকার ব্যবস্থা করছি। এই বলে চলে গেল ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা চেয়ে রইলো। চারপাশ দেখলো, তাদের ঘরে কর্নারের হাতের বামদিকের মাথাতেই আছে একটা বিশাল পেয়ারার গাছ। ডানদিকের কয়েককদম পেরিয়েই নদীর পাড়। যেখানে ঘাটলা আছে। ঘাটলার পাশে বিশাল রেন্টিগাছ। রেন্টি গাছের সাথে রয়েছে একটা কালো কুচকুচে রঙের নৌকা বাঁধা। ঢেউয়ে সেটা ভাসছে। তবে বর্তমানে রাগান্বিতা তা দেখতে পায় নি। ঘাটের অন্যপাশে বসার জন্য তক্কা দিয়ে বানানো উঁচু বেঞ্চ। তাদের ঘরটা দ্বীপের মাঝে নয় কর্নারে। যার কারনের নদীর ঘাট একটু নিকটে। কম করে হলেও বিশ পা এগোতে হবে। ইমতিয়াজ এগিয়ে আসলো সঙ্গে করে নিয়ে আসলো তিনটে গরু আর তিনটে ছাগল। তাদের রাখার জন্য বামদিকের পেয়ারা গাছের পরে অনেকখানি জায়গা ফাকা রেখে লম্বা ঘর বানানো। সেটার ছাউনীও খড় দিয়ে বানানো। ইমতিয়াজ তাদের সেই ঘরে বেঁধে রাখলো। কোথা থেকে যেন ঘাস এনে রাখলো সামনে তাঁরাও আনন্দে খেতে থাকলো। ইমতিয়াজ আবার গেল ট্রলারের কাছে এবার ফিরে এলো হাঁস মুরগী নিয়ে। সেগুলোর জন্য তৈরি আছে সুন্দর মাটির খোঁপ। হাঁসমুরগীকে ট্রলারে বসে খাওয়ানো হয়েছিল তাই আজ আর বার না করে সোজা খোঁপে ঢুকিয়ে দিয়ে সামনে থেকে মাটির দরজা আঁটকে দিল তক্কা দিয়ে। ঘরের সামনেই বাঁশের সাথে বেঁধে খাঁচায় ভরে ঝুলিয়ে রাখা হলো টিয়াপাখি। ইমতিয়াজ শিখিয়ে দিলো। বললো,“সবুজপাখি আমার বিবিকে বলো,“বউ স্বাগতম”!”
পাখিটি শুনলো মিনিট দুই যেতেই বলে উঠলো,“বউ স্বাগতম, বউ স্বাগতম, বউ স্বাগতম।”
রাগান্বিতা আপনাআপনি হেঁসে ফেললো। পুরোটা যেন স্বপ্ন লাগছে মনে হচ্ছে চোখ খুলতেই এই দারুণ স্বপ্নটা ভেঙে যাবে। যা এই মুহূর্তে রাগান্বিতা মোটেও চাচ্ছে না। রাগান্বিতা কতক্ষণ আগেই তার বোরকা হিজাব খুলে ফেলেছে যার দারুণ ইমতিয়াজ রাগান্বিতার শেষের হাসিটা দেখতে পেল। মনে মনে আওড়ালো, “তোমার এই হাসি যেন কোনো হাসি নয় বউ, এ আমার বিস্মিত বুকটা ঠান্ডা করার এক অদ্ভুত মায়াজাল। যা আমায় বার বার ভেঙে গুঁড়িয়ে আবার শক্তপক্ত করে।”
বুকে হাত দিয়ে মৃদু হাসলো ইমতিয়াজ।’
—-
ইমতিয়াজ রাগান্বিতা ঘরের ভিতর প্রবেশ করলো। রাগান্বিতা দেখতে পেল একটা ছোট চৌকি। সঙ্গে কিছু আসবাবপত্রও আছে বোঝাই যাচ্ছে তারা আসার আগে ইমতিয়াজ এখানে এসে অনেককিছু গোছগাছ করে গেছে। তারজন্যই চারপাশ এত পরিপাটি। ধীরে ধীরে প্রকৃতি আরো রঙ বদলালো, মেঘাচ্ছন্ন আকাশটা হলো আরো গাড়ো। ধীরে ধীরে ধরনী জুড়ে বর্ষণ শুরু হলো। এই যেন অন্যরকম বর্ষণ, বোধহয় প্রেম বর্ষণ।
~ ধরণী জুড়ে হচ্ছে নির্জীব এক খেলা
দুপুর হয়েও যেন দেখাচ্ছে সন্ধ্যাবেলা
মাটি নদী মিশে হচ্ছে ঘর্ষণ
প্রকৃতি জুড়ে যেন নেমেছে এক অদ্ভুত প্রেমবর্ষণ!
#চলবে…..