প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-৩০+৩১

0
554

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৩০
________________
সময়ের স্রোতে ভাসমান প্রকৃতি। দিনগুলো যেন কেমন কাটছে বিষণ্ণতায়। চারপাশ কেমন আবছা আবছা। দিনরাত বুঝি অন্ধকারে ডুবে থাকে এমন। রাগান্বিতা প্রায়শই খেয়াল করছে কোনো এক বিষয় নিয়ে ইমতিয়াজ চিন্তিত থাকে। আগের চেয়ে কথাও কম বলে। কেমন যেন এড়িয়ে এড়িয়ে চলে তাকে। প্রথম প্রথম বিষয়টা রাগান্বিতার নজরের না আসলেও ইদানীং আসছে। মানুষটার কি হয়েছে জানার জন্য রাগান্বিতার প্রতিদিনই অস্থিরতা কাজ করে। রাগান্বিতা প্রায় সময়ই দেখে ইমতিয়াজ গভীর রাতে না ঘুমিয়ে পালঙ্কের পাশে নিচে বসে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। কেমন বিষণ্ণমাখা চাহনী! মনে হয় হাজার বছর যেন তাকে দেখেনি ইমতিয়াজ। অথচ তারা রোজই একেঅপরের মুখোমুখি হয়। এই তো দু’দিন আগে। রজনীর শেষ প্রহর চলছিল। আচমকাই রাগান্বিতার ঘুম ভেঙে যায় সে চোখ খুলেই দেখতে পায় ইমতিয়াজ তার দিকে তাকিয়ে আছে। বিষয়টা দেখেই চট করে শোয়া থেকে উঠে বসে রাগান্বিতা দ্রুত নিচে নেমে আসে। ইমতিয়াজ নীরব, চুপচাপ। কোনো ভাবাক্রান্ত নেই। সে পালঙ্কের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বসে রয় চুপচাপ। কেমন নির্বিকার, বিষণ্ণ দেখাচ্ছে তাকে। রাগান্বিতা পালঙ্ক থেকে নেমেই পাশে বসে ইমতিয়াজের খানিকটা নিস্তব্ধ স্বরেই বলে,
“আপনার কি কিছু হয়েছে?”

ইমতিয়াজ নির্বিকার হয়ে জবাব দেয়,
“কি হবে!”
“আপনাকে প্রায় দেখি আপনি গভীর রাতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন।”
“তোমার কি অসস্থি লাগে? তাহলে কাল থেকে আর তাকাবো না।”

রাগান্বিতা হতাশ হলো সে ওইভাবে কথাটা বলতে চায় নি। রাগান্বিতা হতাশ হয়েই ইমতিয়াজের হাতটা নিজের হাতের মুঠোতে নিলো। নরম কণ্ঠে বলে,
“আপনার কি হয়েছে বলুন আমায়? ইদানীং আপনায় খুব চিন্তিত দেখায়।”
“আমার কিছু ভালে লাগে না বউ।”
“কেন?”

ইমতিয়াজ চুপ। রাগান্বিতা আবার প্রশ্ন করে,
“ব্যবসায় কি কোনো সমস্যা হয়েছে?”
“হয়েছিল অনেকদিন আগে একজনের পণ্য মানে শাড়ি আমার এক সহকারী ভুল করে আরেকজনকে দিয়ে দেয়। যা এখন ঠিক হয়ে গেছে।”
“তাহলে এখনও চিন্তিত কেন থাকেন?”

কেমন একটা হয়ে যায় ইমতিয়াজ। সে নিস্তব্ধ হয়ে ঠলে পড়ে রাগান্বিতার বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাগান্বিতাকে। রাগান্বিতা প্রথমে একটু ঘাবড়ালেও সামলে নেয় নিজেকে। ইমতিয়াজের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে নীরব সুরে শুধালো,
“আপনার কি হয়েছে বলুন না আমায়?”

ইমতিয়াজ কেমন একটু করে যেন বললো,“আমার যন্ত্রণা হয় বউ। চারপাশ ছারখার হয়। আমি কেমন বিষের জ্বালায় জ্বলছি। দাউদাউ করে অন্তর পুড়ছে প্রতিনিয়ত।”

রাগান্বিতা থমকে যায় ইমতিয়াজের এমন কোথায়! কান্না আসতে চায় ভিতর থেকে। মানুষটা এত কি নিয়ে কষ্ট পাচ্ছে। রাগান্বিতা ছলছল দৃষ্টিতেই বলে,
“এমনটা কেন হচ্ছে বলুন আমায়?”

ইমতিয়াজ বলে না। তবে মনে মনে ঠিকই আওড়ায়,“আমার যন্ত্রণার কথা যদি তোমায় বলা যেত তবে বোধহয় আমার চেয়ে সুখী আর কেউ হতো না। আমি বিতৃষ্ণায় আবদ্ধ বউ।”

সেদিন ইমতিয়াজ আর কিছু বলে না। রাগান্বিতাও আর প্রশ্ন করে না। তবে রজনীর শেষ হওয়ার পুরোটা সময় ইমতিয়াজ জড়িয়ে ধরে থাকে রাগান্বিতাকে। যেন ছেড়ে দিলেই রাগান্বিতা বুঝি পালিয়ে যাবে।

সেদিনের পর টানা দু’দিন ইমতিয়াজ আর রাগান্বিতার তেমন সংস্পর্শে আসি নি। এমন কি তাদের দেখাও হতো কম। ইমতিয়াজ গত দু’দিন খুব বেশি দেরি করে বাড়িতে আসতো। রাগান্বিতা অপেক্ষা করতো কিন্তু ইমতিয়াজ আসতো না। ইমতিয়াজের জন্য অপেক্ষা করতে করতে রাগান্বিতা ঘুমিয়ে যেত। সকালে উঠেও রাগান্বিতা ইমতিয়াজকে দেখতো না তবে ইমতিয়াজ যে রাতে তার পাশে এসে শুতো এটা বেশ বুঝতো কারণ ইমতিয়াজ প্রতিদিন তার পরিধিত পোশাক পালঙ্কের কর্নারে রেখে চলে যেত। ইমতিয়াজের দু’দিনের অবহেলাতেই রাগান্বিতা খুব কষ্ট পাচ্ছে। তবে রাগান্বিতা জানে ইমতিয়াজও তার মতো কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু দিনে দিনে এমন অবহেলা কেন করছে এইটুকুই বুঝচ্ছে না রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ রাগান্বিতাকে পড়াশোনার কথা বলেছিল অনেকদিন আগে। কিন্তু রাগান্বিতা বলেছে সে আর পড়াশোনা করতে চায় না। ইমতিয়াজও জোর করে নি আর। তবে পড়াশোনা যে একেবারে বাদ দিয়েছে এটা বললেও ভুল হবে। ইমতিয়াজ অনেকগুলো বই এনেছিল রাগান্বিতার জন্য। সেগুলো প্রায়শই পড়ে রাগান্বিতা। ইমতিয়াজের টেবিলেও অসংখ্য বই আছে। ইমতিয়াজ উপন্যাস পড়তে খুব পছন্দ করে। রাগান্বিতা আগে এসব পড়তো না কিন্তু এখন পড়ে বেশ লাগে তার। তবে দিন শেষে ইমতিয়াজের অবহেলা বেশ পোড়ায় তাকে।

জোরে নিশ্বাস ফেলে নিজের গত কয়েকমাসের দিনগুলোর কথা ভাবলো রাগান্বিতা। আচমকা ইমতিয়াজের অবহেলায় সে যেন তিলে তিলে শেষ হচ্ছে। হঠাৎই সাইকেলের বেল বাজার আওয়াজ আসলো। রাগান্বিতা বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে ছিল কিন্তু তাও তাকালো না। আবারও শব্দ হলো রাগান্বিতা তাকালো না এরপর বেশ কয়েকবারই আওয়াজ আসলো এবার বিরক্ত নিয়ে তাকাতেই সামনে ইমতিয়াজকে দেখে বিস্মিত হলো রাগান্বিতা। এইসময় ইমতিয়াজ এখানে। ইমতিয়াজ হাতের ইশারায় রাগান্বিতাকে নিচে নামতে বললো। রাগান্বিতা ইমতিয়াজের একটুখানি ইশারাতেই বুঝি প্রাণ ফিরে পেল। সে দৌড়ে ছুটে গেল নিচে। রবিন তখন ঘরের ভিতর কাজ করছিল। রবিনের বউয়ের ছেলে হয়েছে। সে এখন দ্রুত দ্রুতই কাজ সেরে বাড়ি চলে যায়।’

রাগান্বিতা ছুট্টে এসে সামনে দাঁড়ালো ইমতিয়াজের। ইমতিয়াজ তখন তাকিয়ে থাকে রাগান্বিতার দিকে। রাগান্বিতাও তাকায়। দুজনেই চুপচাপ। কথা দুজনেই বলতে চাচ্ছে কিন্তু দু’দিনের অধিক দুরত্বেই কোথায় যেন সংকোচতা কাজ করছে। কিছু সময় পার হওয়ার পরও যখন ইমতিয়াজ কিছু বলছিল না ধীরে ধীরে রাগান্বিতার ঠোঁটে জড়ানো হাসিটা মিলিয়ে গেল। সে মন খারাপের দৌলতেই প্রশ্ন করলো,
“কিছু কি বলবেন আমায়?”

উত্তরে ইমতিয়াজ বলে,“বলতে তো অনেক কিছুই চাই তোমায় কিন্তু সংকোচতার জ্বালায় বলতে আর পারছি কই।”

রাগান্বিতা ছলছল দৃষ্টিতে তাকায় ইমতিয়াজের দিকে। একটু কাছে এগিয়ে চোখে চোখ রেখে বলে,“আমি তো আপনার কাছের মানুষ আমাতে কথা বলতেও আপনার এত সংকোচতা কেন প্রিয়।”

ইমতিয়াজ কিছু বলতে পারে না। সে অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলে,“সাইকেলে বসবে বউ, চলো একটু কাছাকাছি হয়ে আশপাশটা ঘুরি।”

রাগান্বিতা বিনা সংকোচে সাইকেলের সামনে বসে। মনে মনে খুব খুশি হয়। ইমতিয়াজও খুশি হয়। সে সাইকেল চালিয়ে তাদের পুরো বাংলো বাড়িটির চারপাশটা ঘোরে। বাড়ি চারপাশটায় বনজঙ্গল আর গাছপালা ছাড়া তেমন কিছুই নেই। তবে বাড়ির পিছনের দেয়ালের একটা অংশে অনেকগুলো জমানো গাছের ডালপালা দেখছিল রাগান্বিতা। এদিকটায় তেমন একটা আসে না রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ বলে ছিল বাড়ির বাহিরে খুব একটা না যেতে। একই তো সুন্দরী বউ তারওপর বনজঙ্গল কখন কি ঘটে বলা যায়। রাগান্বিতা ইমতিয়াজের কথায় সেদিন খুব হেঁসেছিল। তবে কথা রেখেছিল ইমতিয়াজের। সে বার হয় নি খুব একটা বাহিরে।

সারাবিকালটা দু’জনে কাছাকাছি থাকলেও কোথাও যেন দূরত্বতা, ছিল কথা না বলতে পারার সংকোচতা। এমনটা কেন হচ্ছিল বুঝচ্ছিল না রাগান্বিতা। সে তো কথা বলতে চায় কিন্তু কোথাও গিয়ে যেন আটকাচ্ছিল খুব। ইমতিয়াজেরও বুঝি এমনই হচ্ছিল।
—-
সময় চললো বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল। পুরো প্রকৃতি হচ্ছিল লালচে। ইমতিয়াজ বাড়ির সদর দরজার সামনে এসে সাইকেল থামালো। রাগান্বিতা নামলো, গিয়ে বসলো বাড়ির সদর দরজার সামনে থাকা ছোট ছোট সিঁড়িগুলোর ওপর। তার যে কি পরিমাণ কষ্ট হচ্ছে বোঝানো যাবে না। ইমতিয়াজ বুঝলো রাগান্বিতার বিষয়টা সে সাইকেলটাকে এক কর্নারে রেখে বসলো রাগান্বিতার পাশ দিয়ে একটু দূরত্ব নিয়ে। এবার তার সংকোচতা বুঝি কমলো। সে প্রশ্ন করলো,
“মন খারাপ হচ্ছে?”

রাগান্বিতা চুপ। ইমতিয়াজ বলে,
“অভিমান করেছো খুব তাই না।”

রাগান্বিতা এবারও চুপ। ইমতিয়াজ খানিকটা অস্থিরতা নিয়ে বলে,
“আমার সাথে কথা বলবে না বউ?”

রাগান্বিতা এবার ঘুরে থাকালো ইমতিয়াজের দিকে। আচমকাই কেঁদে উঠলো। ইমতিয়াজ বুঝলো। মাথা নিচু করে বললো,
“এভাবে কেঁদো না গো বউ,তোমার কান্নায় যে আমার অন্তর পুঁড়ে ছারখার হয়ে যায়।”

তাও থামে না রাগান্বিতা। কিছুটা সময় পার হওয়ার পর রাগান্বিতা বলে,
“আমার ভুলটা কোথায় বলুন না আমায় এমন অবহেলা কেন করছেন?”

বলতে বলতে আবার কাঁদলো রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ এবার গা ঘেঁষে বসলো রাগান্বিতার৷ নিজের হাতের মুঠোতে রাগান্বিতার ডান হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে বললো,“তোমার কোনো ভুল নেই, সব ভুল আমার।”

ছলছল আঁখিতে ইমতিয়াজের দিকে তাকালো রাগান্বিতা। বললো,“কেন করছেন এমনটা?”

উত্তর দেয় না ইমতিয়াজ। অন্যদিকে সদর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা রবিন ইমতিয়াজ আর রাগান্বিতার বিষয়টা লক্ষ্য করলো সে বোধহয় খানিকটা হলেও আন্দাজ করতে পারলো ইমতিয়াজের বিষয়টা। গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। রাগান্বিতা মেয়েটা খুবই ভালো মনের একটা মেয়ে। যেমন রূপ তেমনই মিষ্টি স্বভাবের অধিকারি। এমন মেয়েকে যেকোনো পুরুষই হৃদয় দিতে বাধ্য। ইমতিয়াজও দিয়ে ফেলেছে। যেটা তাকে ক্ষণে ক্ষণে দুঃখ দিচ্ছে। রবিন চলে গেল। ইমতিয়াজ হঠাৎই বললো,
“কিছুদিনের জন্য দূরে কোথাও পালিয়ে যাবে বউ?”

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৩১
________________
মাগরিবের নামাজ সেরে জায়নামাজটাকে জায়গা মতো রেখে সবেমাত্র পালঙ্কে বসলো রাগান্বিতা।মাথায় তখনও তার কাপড় মুড়ানো। রাগান্বিতা কিছুক্ষণ জানালার বাহিরে তাকিয়ে রইলো। একটু একটু করে সন্ধ্যা নামার নিঝুম হওয়া প্রকৃতিটা দেখলো। এক শীতল হাওয়া বয়ে গেল তার শরীর ছুঁয়ে। রাগান্বিতা চোখ বন্ধ করে জোরে এক নিশ্বাস ফেললো। মাথায় মোড়ানো কাপড়টা সরিয়ে সে পশ্চিমা আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,“হে আল্লাহ্ আমার মানুষটাকে আপনি সবসময় ভালো রাইখেন। তার সকল দুঃখ কষ্ট আমারে দিয়েন আর আমার জীবনের সকল সুখ তারে দিয়েন।”

কথাগুলো বলে একা মনে অনেকক্ষণ আকাশ পানে তাকিয়ে রইলো রাগান্বিতা। ধীরে ধীরে সময় এগোলো। রাগান্বিতা এগিয়ে গেল তার কক্ষের আলমারির দিকে। বোরকা, হিজাব, নিকাব বের করলো তাকের ওপর থেকে। ইমতিয়াজ নামাজ আদায় করতে গেছে। যাওয়ার আগে রাগান্বিতাকে বলে গেছে, “তুমি নামাজ পড়ে তৈরি থেকো বউ আমরা বের হবো। তোমার আমার জন্য কিছু পোশাক কিনবো। তারপর নিরুদ্দেশ হবো কিছুদিনের জন্য। যেখানে তুমি আমি ছাড়া আর কেউ থাকবে না।”

রাগান্বিতাও মেনে নেয়। রাগান্বিতা তার খোঁপা করা ঘনকালো লম্বা চুলগুলো আবার শক্ত করে বেঁধে নিলো। বোরকা, হিজাব, নিকাব পড়ে নিজেকে বাহিরের যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করলো। শহরে আসার পর রাগান্বিতা তেমন কোথাও যায় নি। ঢাকাশহর ঘুরে দেখারো ইচ্ছে জাগে নি কখনো। কিন্তু আজ যখন ইমতিয়াজ ঘুরতে নিয়ে যাবে বললো তার খুব আনন্দ হয়েছে। মনে মনে ভেবে নিয়েছে তার প্রতি ইমতিয়াজের অবহেলা বুঝি কমলো।’

কক্ষের দুয়ারে কড়া নাড়ার আওয়াজ আসলো। কেউ মিষ্টি সুরে শুধালো,“তোমার হয়েছে বউ?”

রাগান্বিতা মৃদু হাসলো। বললো,“জি।”
কারন সে বুঝেছে ইমতিয়াজ চলে এসেছে।
—–
রাতের প্রকৃতি তখন থমথমে। নিঝুম প্রকৃতির ভিড়ে বড় মোটরগাড়িতে চড়ে এগোচ্ছে ইমতিয়াজ আর রাগান্বিতা। দুজনেই চুপচাপ। রাগান্বিতা বাহিরের প্রকৃতি দেখছে সে জানে না ইমতিয়াজ তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। রাতের মুগ্ধনীয় বাতাস তাদের বারংবার ছুঁয়ে দিচ্ছে। ধীরে ধীরে পথ পেরিয়ে বাজারের ভেতর দিয়ে ছুটলো গাড়ি। মানুষের ভিড় দু’দিকে। রাগান্বিতা নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে বসলো গাড়িতে। কতদূর গিয়েই গাড়ি থামানো হলো। ইমতিয়াজ রাগান্বিতা দুজনেই বেরিয়ে আসলো বাহিরে। সামনেই বিশাল এক মেলা বসেছে। শহুরে মেলা। গ্রামে থাকতে রাগান্বিতা একবার তার সহপাঠীদের সাথে মেলায় গিয়েছিল তাও তেমন কিছু না দেখে ফিরে এসেছে। বাবার বারণ ছিল কি না। ইমতিয়াজ মোটরগাড়ি থেকে নেমে রাগান্বিতার হাত ধরলো। বললো,“মেলার ভিতর ভিড় থাকবে আমার হাত কোনোভাবেই ছাড়বে না কিন্তু।”

রাগান্বিতা শুনলো মাথা নাড়িয়ে সমর্থনও করলো। অতঃপর রাগান্বিতা ইমতিয়াজ আস্তে আস্তে প্রবেশ করলো শহুরে মেলার ভিতর। নানান রঙের দোকানপাট আর মানুষের ভিড়। এত মানুষের মজলিসে রাগান্বিতা তেমনভাবে কখনোই আসে নি। চারপাশে মানুষ গিনগিন করছে। রাগান্বিতার গায়ে কোনো পরপুরুষের স্পর্শ না লাগে তাই ইমতিয়াজ খুব সযত্নে রাগান্বিতাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। রাগান্বিতা চারপাশটায় চোখ বুলালো নাগরদোলা, মাটির তৈরি খেলনা, শাড়ি চুড়িসহ অনেকগুলো খাবারের দোকান দেখলো। সেই দূরে দেখা মিললো বায়োস্কোপের। রাগান্বিতা কখনো বায়োস্কোপে চোখ দিয়ে ছবি দেখে নি। সে উত্তেজিত হয়ে ইমতিয়াজকে আবদার করলো,
“চলুন না বায়োস্কোপ দেখি।”

ইমতিয়াজ তাকালো বায়োস্কোপের দিকে। বেশি না ভেবেই বললো,“তোমার বায়োস্কোপ ভাল লাগে?”

রাগান্বিতা তার উজ্জ্বল মাখা কাজলকালো চোখদুটো নাড়িয়ে বললো,“হুম খুব। চলুন না যাই।”

ইমতিয়াজ রাজি হলো। বললো,“ঠিক আছে চলো।”

রাগান্বিতা প্রচন্ডরকম খুশি হলো। ইমতিয়াজ প্রাণ ভরে তা দেখলো। রাগান্বিতা ছুট্টে গিয়ে বায়োস্কোপওয়ালে বললো,“বায়োস্কোপ দেখবো চাচা।”

লোকটি খুশি হলো। ইশারায় বায়োস্কোপের সামনে থাকা গোলআকৃত্তির জিনিসটাকে দেখিয়ে ওখানে চোখ দিতে বললো। রাগান্বিতাও ইমতিয়াজকে নিয়ে বসলো নিচে। বললো,“আসুন একসাথে দেখি।”

এক ষোড়শী নারীর বায়োস্কোপ দেখার এত উত্তেজনা, এত আগ্রহ দেখে ইমতিয়াজ আর কিছু বলতে পারলো না। রাগান্বিতা চোখ রাখলো বায়োস্কোপের ভিতর। ইমতিয়াজও রাখলো। এরই মাঝে বায়োস্কোপওয়ালাও তার সুরেলা কণ্ঠ নিয়ে বললো, এ এক রাজা-রানির গল্প। রাগান্বিতা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে এবং শুনতে লাগলো।বায়োস্কোপওয়ালা বলে উঠল,

‘কী চমৎকার দেখা গেল এইবারেতে আইসা গেল, রাজার রাজ্য দেখেন ভালো। কী চমৎকার দেখা গেল।’- এ সুর আর ছন্দের তালে তালে ধারা বিবরণী দিতে লাগলেন বায়োস্কোপওয়ালা। কাঠের বাক্সে চোখ লাগিয়ে গানের তালে ছবি দেখার দৃশ্যকেই বায়োস্কোপ বলে। খঞ্জনি আর গানের তালে তালে বাক্সের ভেতর পাল্টে যায় ছবি। এক রাজা আর এক রানীর গল্প। রানী ছিল এক গরীব ঘরের মেয়ে। রানীর নাম মেহেরুন্নিসা। রাজা নবাব উদ্দিন। রানীর জন্ম গরীব ঘরে হলেও সে ছিল অত্যাধিক সুন্দরী এক যুবতী কন্যা।’

হঠাৎই একদিন রাজা শিকার করতে গিয়ে দেখা হয় রানীর সাথে। প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে যায় রাজা। রানীও মুগ্ধ হয় রাজাকে দেখে। এখান থেকেই শুরু হয় এদের প্রেম কাহিনি। এক রাজা, এক রানী, তাদের বনজঙ্গল, পশুপাখি,রাজকীয় বাড়ি এমন নানা রঙের ছবি দেখিয়ে সুরে সুরে কাহিনী বলতে লাগলো বায়োস্কোপওয়ালা। ধীরে ধীরে সেই কাহিনীর গল্পের জগতেই হারিয়ে যায় রাগান্বিতা ইমতিয়াজ। গল্পের এক পর্যায়ে দেখায় রাজার মা ষড়যন্ত্র করে মেহেরুন্নিসার সাথে। ছেলেকে ভুল বুঝিয়ে নিজের কাছে আনতে চায় কিন্তু পারে না। অনেক বাঁধা পেরিয়ে শেষে মিলন ঘটে রাজা-রানীর। আর এখানেই বায়োস্কোপের কাহিনী শেষ হয়।”

পুরো দৃশ্য দেখে রাগান্বিতা কখনো মুগ্ধ হয়েছে, কখনো হেঁসেছে, কখনো রাগ করেছে, তো কখনো কেঁদেছে। গোটা একটা সিনেমা দেখলো এমন। পুরো দৃশ্য শেষ হতে বায়োস্কোপ থেকে চোখ সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো রাগান্বিতা ইমতিয়াজ। গল্পের শেষে মিলন ঘটায় রাগান্বিতা বেজায় খুশি। ইমতিয়াজ বায়োস্কোপওয়ালাকে কিছু কড়ি দিলো। সে খুশি হলো।

ইমতিয়াজ রাগান্বিতাকে নিয়ে ছুটে যায় অন্যদিকটায়। রাগান্বিতাও যায়। যেতে যেতে বলে,“কাহিনীটা দারুণ ছিল তাই না?”

ইমতিয়াজও মৃদু হেঁসে বলে,“হুম। তোমার ভালো লেগেছে?”

রাগান্বিতা খুশি মাখা মুখে ইমতিয়াজের হাতটা আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে বললো,“হুম প্রচুর।”

ইমতিয়াজ খুশি হলো। রাগান্বিতার চোখ দু’টো আর কণ্ঠস্বর শুনেই বুঝতে পেরেছে ইমতিয়াজ। মেয়েটা আজ দারুণ খুশি।’

সময় চললো। রাগান্বিতা ইমতিয়াজ মুগ্ধনীয় মুহুর্ত কাটালো। রাগান্বিতাকে নিয়ে কিছু পোশাকের দোকানে ঢুকলো ইমতিয়াজ। খুবই সাদামাটা টাইপের শাড়ি কিনলো, চোখে দেয়ার জন্য কাজল, একটা লিপস্টিক, লাল টুকটুকে রঙের আলতা আর রঙ বেরঙের কিছু রেশমী চুড়ি। এক পাতা টিপ কেনার ইচ্ছে থাকলেও পরে কেন যেন কিনলো না। রাগান্বিতা শুধু দেখেই গেল ইমতিয়াজের কান্ড। ইমতিয়াজ নিজের জন্য কিনেছে কিছু লুঙ্গি, সাদা মাটা ফতুয়া, দুটো গামছা আর গায়ে মাখানো আতর। রাগান্বিতা বুঝে না এসব কেন কিনলো ইমতিয়াজ। সে তো এগুলো পরে না। শেষবার তার বাড়িতে বসে ওই প্রথম শাপলা দিয়ে সাজানোর দিন নৌকায় বসে ইমতিয়াজকে লুঙ্গি ফতুয়ায় দেখেছিল রাগান্বিতা এরপর আর দেখে নি। ইমতিয়াজ এখন আর চশমা পড়ে না। এতে অবশ্য রাগান্বিতার কোনো দ্বিধা নেই কারণ ইমতিয়াজকে চশমা ছাড়াই চমৎকার দেখায়।’

অনেকটা সময় একসাথে কাটালো। ঝালমুড়িও খেল দুজন। নাগরদোলাতেও চড়েছিল। রাগান্বিতার সে সময় কি ভয়! বুক ধড়ফড় করার বিষয়টা এখনো যায় নি মনের ভিতর থেকে। রাগান্বিতাদের বাড়ি ফিরতে প্রায় অনেকটা রাত হলো। তারা খুব আনন্দ করলো একসাথে। রাগান্বিতা ভুলেই গেল দু’দিন ধরে তার আর ইমতিয়াজের মাঝে দূরত্বের অবহেলা চলছিল। রাতে বাড়ি এসে দুজন একসাথে রাতের ভোজন করলো। রবিন ছিল না। খেতে বসেও রাগান্বিতার সে কি কথা! সারা সন্ধ্যার ঘটে যাওয়া তার ভালো লাগা, বুক ধড়ফড় করা, বায়োস্কোপের কাহিনী সব একের পর এক বলতে লাগলো। ইমতিয়াজও তার তালে তাল দিলো। খুশি মনে এটা ওটা বললো। সময়টা যেন দারুণ গেল দুজনের।’
—–
রজনীর তখন মধ্যভাগ চলছিল। রাগান্বিতা ইমতিয়াজের বুকে মাথা দিয়ে শুয়ে ছিল কথা তার তখনো শেষ হয় নি। ইমতিয়াজ তার মাথায় হাত বুলাতে লাগলো আর মন দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাগান্বিতার কথা শুনছিল। হঠাৎই রাগান্বিতা বললো,
“একটা কথা বলবো?”

চট করেই ইমতিয়াজ তার চোখ খুললো। বললো,“এতক্ষণ ধরে কি বলছিলে?”

রাগান্বিতা তার ঠোঁটে কামড় দিলো। মাথা উঁচকিয়ে হেঁসে জবাব দিলো,
“এতক্ষণ অনেকগুলো কথা বলছিলাম। এখন একটা কথা বলবো।”

ইমতিয়াজ হেঁসে দেয় রাগান্বিতার কথা শুনে। বলে,
“জি বলুন মহারানী আপনার একটা কথা কি?”

রাগান্বিতা খানিকটা লজ্জা পায়। মিষ্টিভাবে বলে,
“কাল আমরা কোথায় যাবো?”
“হুম,নিরুদ্দেশ হবো।”
“জায়গার নাম নেই।”
“গিয়ে বলবো।”
“এখন বললে কি হবে?”
“কিছুই না।”
“তাহলে বলুন।”
“বললাম তো গিয়ে বলবো।”

রাগান্বিতা আর ঘাটলো না। মেনে নিয়ে বললো,
“ঠিক আছে। আচ্ছা, আজ যে আমরা পোশাক কিনলাম আমরা কি ওগুলো ওখানে গিয়েই পড়বো।”
“হুম। শোনো কোনো গহনা নিবে না।”

রাগান্বিতা অবাক হয়ে বলে,
“কেন?”
“আমরা বিলাসিতা নয় বউ সাধারণভাবে কয়দিন সংসার করবো।”
“আপনি ঠিক কি চাইছেন বলুন তো?”

ইমতিয়াজ জোরে নিশ্বাস ফেলে দুইহাতে রাগান্বিতাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বললো,
“বলবো না বলে দিলে মজা আছে নাকি।”

রাগান্বিতা চুপ করে মাথা দিয়ে রইলো ইমতিয়াজের বুকে বিনিময়ে আর কিছু বলে না। অনেক্ক্ষণ পর চোখ বুঝে বলে,“আপনি হয়তো জানেন না প্রিয়,আপনায় মাঝে মাঝে আমার বড্ড রহস্যময় লাগে।”

ইমতিয়াজ বুঝি শুনলো রাগান্বিতার কথা। অনেকক্ষণ নীরব থেকে একা মনে আওড়ালো,“আমি যে কে, জানতে হলে ধূসর রঙের সেই পাতাটা তোমায় পড়তে হবে বউ, যে পাতাটা আমি লুকিয়ে রেখেছি গহীন অন্ধকারের এক পাতাল কক্ষে।”

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]

#TanjiL_Mim♥️

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে