প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-২৪+২৫

0
526

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-২৪
________________
রৌদ্রময় সকাল! ফজরের নামাজ সেরে পুনরায় আরেকবার ঘুমিয়ে ছিল রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ ফজরের সময় বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর আর এসেছিল কি না জানে না রাগান্বিতা। হঠাৎই কিছু একটা ভেবে নড়েচড়ে উঠলো রাগান্বিতা। আশেপাশের কোথাও ইমতিয়াজকে না দেখে খানিকটা চিন্তিত হয়েই পালঙ্ক ছেড়ে নামলো সে। সিঁড়ি বেয়ে নামতেই দেখা মিললো দাদিমার সাথে। তাকে দেখেই দাদিমা মিষ্টি হেঁসে বললেন,
“তুমি উডছো রাগান্বিতা।”
“হুম বাবা কোথায় দাদিমা?”
“তোর আব্বা তো হকাল হকালই হাডে গেছে বাজার করনের লাইগ্যা।”
“ওহ আচ্ছা আর দাদাভাই?”
“ওয় তো চাষাবাদে গেছে জমির ফসল দেহার লাইগ্যা।”

দাদিমার কথা শুনে রাগান্বিতা অবাক স্বরে এদিক সেদিক তাকিয়ে বললো,
“দাদাভাই চাষাবাদ করে কবে থেকে?”
“মেলাদিন(বেশিদিন) হয় নাই হুনছি এহন থেইকা গ্রামেই থাকবো তোর আব্বায় আর শহরে যাইতে দিতে চায় না।”
“ওহ।”
“হয় তুমি এখন যাও চোহে মুহে পানি দিয়াও আমি খাওন বাড়তাছি।”
“ঠিক আছে।”

দাদিমা রন্ধনশালার দিকে এগিয়ে গেলেন আর রাগান্বিতা আশেপাশে তাকিয়েই বাড়ি থেকে বেরিয়ে উঠানের কলপাড়ের দিকে আসলো। এই ইমতিয়াজটা সকাল সকাল গেল কই! রাগান্বিতার মনটা বড় অস্থির লাগছে। রাগান্বিতা দিনে দিনে হারে হারে টের পাচ্ছে প্রেম বড্ড ভয়ংকর জিনিস। মানুষটাকে এক পলক না দেখলেই কেমন অস্থির অস্থির লাগে। রাগান্বিতা কলের গোঁড়ায় এসে দাঁড়াতেই আচমকাই এক বাঁশির সুর কানে ভেসে আসলো। রাগান্বিতা ধড়ফড়িয়ে উঠলো এ তো সেই মানুষটারই বাঁশির সুর। রাগান্বিতা যেন ঠাহর করতে পারলো ইমতিয়াজ কোথায় আছে রাগান্বিতা আর দেরি করলো না কলগোড়া ছেড়েই ছুট লাগালো বাহিরে।

ইমতিয়াজের সঙ্গে রাগান্বিতার প্রথম দেখা হওয়া প্রথম দিনের সেই জায়গা আর সেই বিশাল গাছটার নিচে বসে আজও বাঁশি বাজাচ্ছে ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা দূর থেকেই নিজের পায়ের গতি কমিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসতে ছিল ইমতিয়াজের দিকে। সেদিনকার সেই দিনটা আর আজকের দিনটার মধ্যে কত তফাৎ! রাগান্বিতা ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে আনমনা বসলো ইমতিয়াজের পাশ দিয়ে। ইমতিয়াজ তখনও নিজ মনে বাঁশি বাজাতে ছিল। কি মুগ্ধনীয় শব্দ তার রাগান্বিতা চোখ বন্ধ করে অনুভব করতে লাগলো তা। হঠাৎই বাঁশি বাজানো থামিয়ে দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়েই বললো ইমতিয়াজ,
“কারো অনুমতি ছাড়া তার পাশে বসে বাঁশির সুর শোনা কিন্তু ঘোর অন্যায় জমিদার কন্যা।”

রাগান্বিতা যেন ধড়ফড়িয়ে উঠলো এক মুহূর্তের জন্য হলেও চরমভাবে অবাক হয়েছে সে। রাগান্বিতা নিজেকে দমালো। বললো,
“বাঁশির সুর কানে আসাটা অন্যায় নয়।”
“ঘরে বসে শুনলে অন্যায় নেই ছুটে এসে শুনলে ঘোর অন্যায়।”

রাগান্বিতা কি বলবে বুঝতে পারছে না। পরমুহুর্তে কি ভেবে জবাব দিলো,
“যে বাঁশি বাজাচ্ছিল তার ওপর আমার অধিকার আছে।”

ঝটপট প্রশ্ন ইমতিয়াজের,
“কিসের অধিকার?”
“সে আমার একজন নিজস্ব মানুষ। আর নিজস্ব মানুষের ওপর কিসের অধিকার থাকতে পারে তা নিশ্চয়ই আপনায় বুঝিয়ে বলতে হবে না।”

ইমতিয়াজ হেঁসে ফেলে মেয়েটা কিভাবে বলে দিল “সে তার নিজস্ব মানুষ’’! ইমতিয়াজ শীতল সুরে বললো,
“তুমি এত সুন্দর করে কথা বলো না রাগান্বিতা, আমি যদি প্রেমে পড়ে যাই আমার তো ভয় লাগে।”

রাগান্বিতা শব্দ করে হাসে আয়েশ করে ইমতিয়াজের পাশে বসে বলে,
“বউকে ভালোবাসতে ভয় কিসের?”
“তুমি বুঝবে না।”
“বুঝিয়ে বললে কে বুঝবে না শুনি!”

অভিমানী স্বরে শুধালো রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার নাকের ডগায় হাল্কা স্পর্শ করে বললো,
“সবাই বুঝবে কিন্তু তুমি বুঝবে না।”

রাগান্বিতার রাগ হলো সে রাগ নিয়ে মুখ ভাড় করে বসে রইলো। আর ইমতিয়াজ তার কান্ডে হাসলো। শীতল সুরে বিড়বিড়িয়ে বললো,
“তুমি কি বিশ্বাস করবে বউ, খুন না করেও আজ আমি খুনি হয়েছি।
ভালোবাসবো না ভেবেও ভালোবাসতে শুরু করেছি!”

রাগান্বিতা ইমতিয়াজের দিকে কেমন এক চাহনী নিয়ে তাকালো। ভ্রু-জোড়া কুঁচকে বললো,
“কিছু কি বললেন আপনি?”

ইমতিয়াজ উদাসীন সুরে আবার শুধালো,
“আমি তোমায় অনেক কিছু বলি বউ, কিন্তু তুমি শুনো না। আমি আঘাতপ্রাপ্ত মানুষ বউ, তুমি আমার প্রতি এত অনুরাগী হও না।”
“ভালোবাসতে বারণ করছেন আমায়?”
“এত বড় সাধ্য আমার কই!”
“তবে নিজে ভালোবাসতে চাইছেন না কেন?”
“আমি ভালোবাসতে শুরু করলে তুমি সইতে পারবে না।”
“কেন পারবো না?”

ইমতিয়াজ জবাব দেয় না। উল্টো বলে,
“তুমি কি জানো বউ, আমি তোমার চোখে আমার মরণ দেখি!’

স্তব্ধ হয়ে গেলো রাগান্বিতা। চোখদুটো আচমকাই কেমন একটা করে উঠলো বুকটা থমকে উঠলো মুহূর্তেই। রাগান্বিতা তার ভেজা ভেজা আঁখি নিয়ে বলে,
“আপনি এভাবে কথা কেন বলেন, আমার যে খারাপ লাগে।”

ইমতিয়াজ বুকে জড়িয়ে ধরে রাগান্বিতাকে। মিষ্টি হেঁসে বলে,
“তুমি এভাবে কেঁদো না, আমি ব্যাথা পাই!”

রাগান্বিতা আর কিছু বলতে পারলো না চুপ হয়ে গেল ওখানেই। এই মানুষটা এমন কেন। অভিমানের ক্রোধে ভাসলো রাগান্বিতা! আর ইমতিয়াজ ভিতরে ভিতরে কি যে ভাবলো বোঝা গেল না।’
____________________________

“রামু! দ্রুত দরজা খোলো, তুমি এভাবে কাহিনির অর্ধেক বলে বাথরুমে যেতে পারো না। আমি কাল শেষ রাতে কখন ঘুমিয়ে গেলাম, তুমি ডাকবে না আমায়! রামু কি হলো! বের হও বলছি!”

লাগাতার রামুর বাথরুমের দরজা ধাক্কাচ্ছে আর কথাগুলো বলছে ইলিয়াস। তার মাথা ভন ভন করছে এই গল্পের শেষটা জানার জন্য মনটা অস্থিরতায় ধেয়ে আসছে তার। কালরাতে কাহিনি শুনতে শুনতে কখন যে চোখ দুটো বুজিয়ে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গিয়েছিল ইলিয়াস সেটা বুঝতে পারে নি। সকালে ঘুম ভাঙতেই রামুর বউকে ডেকে জানতে পারে রামু বাথরুমে গেছে। তাই তো ছুটে আসলো এখানে। ইলিয়াস আবারও দরজা ধাক্কালো। জোরে আওয়াজ করে বললো,
“তুমি কি বাহিরে আসবে রামু নাকি আমি দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকবো।”

এবার রামু পারুক কেঁদে ভাসিয়ে দিক। এই কোন পাগলকে সে রাগান্বিতার কাহিনি বলতে বসেছিল। তাকে শান্তি মতো বাথরুমও করতে দিবে না নাকি। রামু আরো দশমিনিটের মতো সময় নিয়ে বের হলো। একরাশ আক্রোশ নিয়ে বললো,
“আমারে কি আমনে শান্তি মতো একটু ইয়ে করবাও সময় দিবেন না ডাক্তার বাবু!’
“তোমার ইয়ে টিয়ে বাদ দেও আগে কাহিনি বলো। তোমার কাহিনির চক্করে আমার রাতে ঘুম হয়নি জানো তুমি। সকালেও তো ধড়ফড়িয়ে উঠলাম পুরো।”
“আমার কি দোষ আমনেই তো ঘুমাইয়া গেছিলেন।”

ইলিয়াস কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“ঠিক আছে ওসব বাদ দেও। এবার যদি পুরো কাহিনি না বলে কোথাও গিয়েছো তো ইনজেকশন দিয়ে আমিও তোমায় রাগান্বিতার মতো পাগল বানিয়ে দিবো।”

রামু অবাক হয়ে গেল ডাক্তার ইলিয়াসের কথা শুনে এগুলান কোনো ডাক্তারে কয়! রামু শুকনো ঢোক গিলে বললো,
“এমনে কেউ কয়?”
“তুমি বড্ড বকছো দ্রুত বলো, ইমতিয়াজ গেল কই! রাগান্বিতা কিভাবে পাগল হয়ে গেল! ওর বাবাও বা মারা গেলেন কি করে! তার থেকেও বড় কথা রাগান্বিতাকে চিঠিগুলো দিতো কে, ইমতিয়াজ নাকি অন্যকেউ! আর দাদিমার রাগান্বিতা শাপলার অলংকারের সাজ দেখে ভয় পাবার কারণটাও এখনও বলো নি তুমি! তার থেকেও বড় প্রশ্ন ইমতিয়াজ যদি কুহুকেই ভালোবাসতো তাহলে রাগান্বিতাকে বিয়ে করলো কেন?”

রামু বেশি না ভেবেই জবাব দিলো,
“কেন আবার মাহাদকে খুঁইজ্জা পাওন যাচ্ছিল না বইলা।”

চমকে আবার প্রশ্ন করলো ইলিয়াস,
“আরো একটা প্রশ্ন মাহাদকে মারলো কে? ইমতিয়াজ! যাতে রাগান্বিতাকে বিয়ে করতে পারে।”
“না। একখান কথা কি জানেন ডাক্তার বাবু এই মাহাদরে যে মারছিল হেও বাইচ্চা নাই আর!”

ইলিয়াসের মাথা ঘুরে উঠলো কথা শুনে। এত রহস্য কেন। ইলিয়াস তাড়া দিল। চেঁচিয়ে বললো,
“কাহিনি কও রামু!”

রামু ভয় পেয়ে গেল। দ্রুত হাত মুখ ধুয়ে তার ঘরের সামনের জায়গাটা দেখিয়ে বললো,
“আমনে ওইখানে যাইয়া বহেন আমি এক্ষুণি আইতাছি পুরা কাহিনি শেষ কইরাই এবার দম ফালামু আমি।”

ইলিয়াস নিজেকে শান্ত করলো। আর দেরি না করে চলে গেল রামুদের ঘরের দুয়ারের সামনে। বসলো পিড়িতে।’

রামুদের ঘর থেকে রাগান্বিতাদের সেই তালুকদার ভিলাটা দেখা যায় বছর পাচেক আগেই রামু এখানে ঘর বানিয়েছিল চাইলে জমিদার বাড়িতে থাকতে পারতো কিন্তু অজানা কোন ভয়ের কারণে থাকতে পারলো না। পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে আছে তালুকদার ভিলাটি। তালুকদার ভিলার সামনেই ছোট্ট কুঁড়েঘরে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে রাগান্বিতাকে। এটাও পাঁচবছর আগেরই তৈরি। রাগান্বিতাকে সবাই ছেড়ে ছুঁড়ে গেলেও রামু পারে নি যেতে। রাগান্বিতার জন্যই রামু তার নিজ গ্রাম ত্যাগ করে এখানেই বউ নিয়ে থাকছে। তবে একেবারে কাছে নয় একটু দূরে। ধুলোতে জর্জরিত নিজ বাড়িটাকে জানালা দিয়ে চেয়ে দেখলো রাগান্বিতা। চোখের নিচে কালো দাগ, এলেমেলো চুল, ময়লাযুক্ত ছিঁড়ে যাওয়া পোশাক আর পায়ে শিকল বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি। দৃষ্টি তার ওই বাড়িটার দিকে। রাগান্বিতা এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে বাড়িটার পানে। রাগান্বিতার কাজই ওই বাড়িটার দিকে কোনো কারণ ছাড়াই ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা। রাগান্বিতা বিড় বিড় করে বললো,
“তুমি কবে ফিরবে ইমতিয়াজ! আমি যে আজও তোমার অপেক্ষায় বসে। কতদিন হয়ে গেল তোমার মুখের সেই বউ বউ ডাকখানা আমি শুনি না।”

চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো রাগান্বিতার! তবে উত্তর আর মিললো না।
____________________________
১৯৮১ সালে! বড় সেই বিশাল গাছটায় এখনো পাশাপাশি বসে রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা এখনো মন খারাপ করে ইমতিয়াজের বুকে মাথা দিয়ে বসে আছে। ইমতিয়াজ নড়েচড়ে উঠলো। বললো,
“আর কত মন খারাপ করবে বউ, আমি তো তোমার পাশেই বসে!’

রাগান্বিতা ইমতিয়াজের বুক থেকে মাথাটা ওঠালো। বললো,
“আপনি একটা বদমাশ লোক!”

ইমতিয়াজ হেঁসে জবাব দেয়,
“জানি তো!”

আক্রোশে ফেটে বলে রাগান্বিতা,
“না জানেন না।”

আবারও হাসে ইমতিয়াজ। বলে,
“ঠিক আছে। এবার ওঠো জলদি সকাল থেকে কিছু খেয়েছো দেখে তো মনে হচ্ছে না। চলো দ্রুত কিছু খেয়ে নিবে,

উঠে দাঁড়ালো রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ। দুজনই চললো তালুকদার ভিলার উদ্দেশ্যে। ইমতিয়াজ যেতে যেতে বললো আবার,
“কথায় কথায় শুধু এভাবে রাগ দেখালে কিন্তু হবে না বউ। মাঝে মাঝে ভালোও বাসতে হবে।”
“মাঝে মাঝে কেন, আমি তো আপনায় রোজই ভালোবাসি।”

ইমতিয়াজ মিষ্টি একটা হাসি দিলো, রাগান্বিতার গাল টিপে বললো,
“তুমি একটা পাগল বউ,

কপাল কুঁচকে জবাব দিলো রাগান্বিতা,
“আপনি করেছেন, আমার কোনো দোষ নেই।”

ইমতিয়াজ চুপ হয়ে গেল। সে বুঝেছে আজ রাগান্বিতা বেশ ক্ষেপেছে তার একটা কথাও মাটিতে ফেলতে দিবে না। তার আগেই উত্তর হাজির!’

#চলবে…..

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-২৫
________________
কড়া রোদ্দুরে আচ্ছন্ন চারপাশ। ইমতিয়াজ বাড়ি নেই মোকলেসের সাথে দেখা করতে গেছে। রন্ধনশালায় রান্না করছে রাগান্বিতা আর দাদিমা। রাগান্বিতার মাথায় কিছু প্রশ্ন ঘুরছে সে চাইছে দাদিমাকে বলতে। সে কুহুর বিষয় নিয়েই কিছু বলবে কিন্তু দাদিমা আধও কিছু বলবে কি না জানে না রাগান্বিতা৷ দাদিমার সেদিনকার তার সাজ দেখে তার ওপর রেগে যাওয়া আর ভয় পাওয়ার বিষয়টা এখনো প্রায়সই মাথায় ঘোরে। রাগান্বিতার মনে হচ্ছে আজ দাদিমাকে জিজ্ঞেস করলে সে নিশ্চয়ই কিছু বলবে। অনেক ভেবে রাগান্বিতা সিদ্ধান্ত নিলো প্রশ্নটি সে করবেই। রাগান্বিতা প্রশ্নটি করবে এরই মাঝে দাদিমা বলে উঠলেন,
“জানো রাগান্বিতা তুমি যাওনের পর একখান ঘটনা ঘটছে।”

রাগান্বিতা নিজের প্রশ্নটি ধামাচাপা দিল। নরম কণ্ঠে বললো,
“কি ঘটনা?”
“মাহাদরে কেডা জানি মাইরা ফেলছে। তুমি যাওনের দিনই রাত্তির বেলা মুজিবর গো বাড়ির পিছনের ডোবায় মাহাদের লাশখানা ভাইসয়া উঠছিল। কি যে মায়া লাগজিল রাগান্বিতা তুমারে বুঝবার পারমু না। কে যে করলো! কে জানে!

রাগান্বিতা স্তব্ধ স্বরে বললো,
“পুলিশ আসে নি।”
“আইছিল মাহাদ নাকি হাতার(সাঁতার) জানতো না হের লাইগ্যা বেশি আগায় নায়।”
“কিন্তু মুজিবর চাচাদের ডোবায় তো পানি কম থাকে পড়লে মরে যাওয়ার কথা তো নয়।”
“ওইদিন নাকি বেশি আছিল।”

রাগান্বিতা চুপ রইলো তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে! মাহাদ নিখোঁজ হওয়ার পর তার সাথে ইমতিয়াজের বিয়ে হওয়াতে তার খুব আনন্দ হয়েছিল। কিন্তু মাহাদের মৃত্যু সে ভাবে নি। রাগান্বিতা নিশ্চুপে ‘আমি একটু আসছি’ বলে বাড়ি থেকে বের হলো। একটু হাঁটতেই দেখা মিললো ইমতিয়াজের তার দিকেই এগিয়ে আসছে। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার সামনে দাঁড়াতেই রাগান্বিতা থমথমে গলায় বললো,
“জানেন মাহাদ আর নেই কে যেন মেরে ফেলেছে।”

ইমতিয়াজ থতমত খেয়ে গেল। বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
“কে মারলো?”

রাগান্বিতা জবাব দেয় না তার মনে হচ্ছে তার জন্যই মাহাদকে কেউ মেরে দিয়েছে। রাগান্বিতা ছলছল দৃষ্টি নিয়ে ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমার জন্যই মারা গেছে মাহাদ।”

ইমতিয়াজ আশেপাশে তাকালো। না কেউ নেই। সে রাগান্বিতার হাত ধরলো। নিশ্চুপ স্বরে বললো,
“এসব তুমি কি বলছো?”

হঠাৎই কেঁদে উঠলো রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ চমকে উঠলো রাগান্বিতাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“আমার সাথে চলো।”
“আমি মাহাদের খুনি।”

রাগান্বিতার মুখ চেপে ধরলো ইমতিয়াজ। বললো,
“হুস,চুপ! একটাও কথা না।’

রাগান্বিতা চুপ হয়ে গেল তার মাথা ভনভন করছে বার বার নিজেকেই মাহাদের খুনি মনে হচ্ছে। তাকে যদি মাহাদ বিয়ে করতে না আসতো তাহলে হয়তো মাহাদ আজ বেঁচে থাকতো। তার জন্য মাহাদের জীবনটা এভাবে নষ্ট হয়ে গেল। ভাবলেই বুক চিঁড়ে কান্না আসছে রাগান্বিতার।’

নদীর ঘাটে ঢেউ চলছে প্রবল। ইমতিয়াজ রাগান্বিতাকে নিয়ে নদীর ঘাটে এসেছে। আশপাশে জনশূন্যহীন কেউ নেই। দূরদূরান্তে শুধু ট্রলার আর নৌকা যাওয়া দেখা যায়। নদীর ঘাটের ডানদিকটায় মাটির একটা সরু রাস্তা যায়। দুই পাশে সারি সারি তালগাছ। যার একপাশে নদী আর অন্যপাশে মাঠ। মাঠের ওপার মুন্না মিয়াদের বাড়ি। নদীর দিকের তালগাছের সারির আগে রয়েছে এক বিশাল বড় রেন্টিগাছ। সেই রেন্টি গাছের নিচে পাশাপাশি বসে আছে রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা এখনো ফোঁপাচ্ছে। ইমতিয়াজ এবার বিরক্ত নিয়ে ধমক দিলো। বললো,
“এভাবে কাঁদতে থাকলে মানুষ তো ভাববে আমি তোমায় মেরেছি। তারপর লোকে নারী নির্যাতনে আমাকে জেলে দিক।”

রাগান্বিতা তাও নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হলো। আরও কতক্ষণ ফোপালো। ধীরে ধীরে পরিবেশ হলো শান্ত। কারো মুখে কোনো কথা নেই। ইমতিয়াজ এবার পরিস্থিতি বুঝে নরম কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,“এবার বলো কি হয়েছে?”

রাগান্বিতা নির্জীব। চুপচাপ। মুখে কোনো কথা নেই। ইমতিয়াজ আবার প্রশ্ন করলো,“তুমি কি কিছু বলবে?”

রাগান্বিতা এবার মুখ খুললো। বললো,“আমার কাছে প্রায়সই কারো লেখা চিঠি আসে সে নিজেকে নিষ্ঠুর বলে দাবি। বিয়ের আগে আমি অনেকগুলো চিঠি পেয়েছি। চিঠির জন্যই সেদিন গ্রামের সব শিক্ষিত ছেলেদের ডাকি তাদের হাতের লেখা দেখি আপনাকেও তো ডাকা হয়েছিল।”

ইমতিয়াজ শুনলো,কিছু ভাবলো। বললো,
“তারপর।”
“কিন্তু কারো সাথে ওই চিঠির হাতের লেখা মিলে নি।”

ইমতিয়াজের মাঝে তেমন কোনো হেলদোল দেখা গেল না। সে স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞেস করলো,
“এতে মাহাদের খুনের কি সম্পর্ক?”
“আপনি বুঝতে পারছেন না আমার মনে হচ্ছে ওই চিঠি দাতাই মাহাদকে মেরেছে।”
“নাও হতে পারে।”

রাগান্বিতা নিজেকে ধাতস্থ করলো। চোখের পানিটুকু মুছে বললো,
“মানে?”
“মানেটা খুব সোজা হতেই পারে অন্যকেউ মেরেছে।”
“আপনি বুঝছেন না চিঠির লেখাগুলো খুব ধারালো ছিল।”
“আমার মনে হয় না চিঠিদাতা এমন কিছু করবে।”
“আপনি এতটা নিশ্চিত কি করে হচ্ছেন?”
“আমি নিশ্চিত নই মনে হলো তাই বললাম।”

রাগান্বিতা কিছু বলে না সে ভেবেছিল চিঠির কথাগুলো ইমতিয়াজকে বললে ইমতিয়াজ তাকে কটু কথা শোনাবে কিন্তু ইমতিয়াজ এমন কিছুই করলো না। কিন্তু কেন? রাগান্বিতার ভাবনাটা বুঝি ইমতিয়াজ বুঝলো। সে বললো,
“আমি সেদিনই আঁচ করতে পেরেছিলাম কেউ তোমার নামে প্রেমপত্র দিচ্ছে। আর তুমি তাকে খুজচ্ছো। এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। তুমি সুন্দরী, তোমাকে হাজার ছেলে চাইবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এখন তুমি বিবাহিত। আমার মনে হয় না তোমার নামে আর কোনো চিঠি আসবে আর যদি আসে আমায় বলবে আমি এর ব্যবস্থা নিবো।”

রাগান্বিতা নিখুঁত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ইমতিয়াজের মুখের দিকে। বিয়ের পর আর একটাই চিঠি এসেছিল রাগান্বিতার কাছে রাগান্বিতা কথাটি চেপে গেল কিন্তু ভাবলো পরে আর কোনো চিঠি আসলে সে চেপে যাবে না চিঠি সমেত দেখাবে। রাগান্বিতা আশেপাশে তাকালো। না কেউ নেই, সে আচমকাই ইমতিয়াজের গালে চুমু খেল। মিষ্টি হেঁসে বললো, “আপনি পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ স্বামী।”

ইমতিয়াজ আকস্মিক কান্ডে কিছুটা চমকে উঠলো। নিজেকে ধাতস্থ করলো, তবে কিছু বললো না। মেয়েটাকে যত দেখে তত অবাক হয় ইমতিয়াজ,“মেয়েটা তাকে এত ভালোবাসে কেন?”

কিছু সময় যেতেই মোকলেসের হাক শোনা গেল নদীর পাড়ে রঙিন নৌকা নিয়ে ঘুরছে। মোকলেস এগিয়ে আসলো ইমতিয়াজকে দেখে বললো,
“ভাই আমনে এহানে কি করেন?” রাগান্বিতা আপাও দি আছে।”

ইমতিয়াজ, রাগান্বিতা একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করলো মোকলেসকে কি বলবে উত্তর খুঁজে পায় না। ইমতিয়াজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“তোর জন্যই বসে ছিলাম।”

মোকলেস অবাক হলো। বললো,
“আমার জন্যে,
“হ তোর নৌকায় চড়বো।”

মোকলেস কথা বাড়ালো না নৌকাটাকে ইমতিয়াজদের অনেকটা কাছে নিয়ে এসে বললো,
“হাচা(সত্যি) উডবেন ভাই। এহন তো ঠাডা পড়া রোদ্দুর।”
“তাতে কি নদীতে হাওয়া নেই।”
“তা একটু আছে,
“তাইলে আবার কি চল। রাগান্বিতা উঠো!’

রাগান্বিতা বিনা বাক্যে উঠে দাঁড়ালো। ইমতিয়াজের হাত ধরেই সে নৌকায় চড়ে বসলো। দুজন একসাথে অনেকটা সময় পার করলো। মোকলেস নৌকা চালাতে চালাতে শাপলার বিলে চলে আসলো। তবে আজ শাপলা নেই। কিছু লতা ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না। ইমতিয়াজ বললো,
“আজ শাপলা থাকলে তোমায় আবার সাজাতাম বউ?”

রাগান্বিতার মুখটা খানিকটা কালো হয়ে গেল। সে খুশি হতে চেয়েও খুশি হতে পারলো না। ইমতিয়াজ প্রশ্ন করলো,“কি হলো?”

রাগান্বিতা মাথা নিচু করে জবাব দিলো,
“দাদিমা শাপলাফুল দিয়ে সাজতে বারণ করেছেন।”

ইমতিয়াজ খানিকটা ভড়কালো। প্রশ্ন ছুড়লো আবার,
“কেন?”
“জানি না। আপনি সেদিন যখন শাপলা দিয়ে সাজিয়েছিলেন দাদিমা তা দেখেন। খুব অদ্ভুত আচরণ করেন! কি নিয়ে যেন ভয় পেয়েছিলেন খুব। সাথে আমায় বারণ করেছেন আমি যেন আর শাপলা দিয়ে না সাজি।”

ইমতিয়াজ কিছু বললো কি যেন ভাবলো রাগান্বিতা প্রশ্ন করলো,“কি ভাবছেন।”

ইমতিয়াজ তাকালো নদীর দিকে শুঁকনো মুখে জবাব দিলো,
“ফুলের সাথে কিসের ভয়?”
“পোকামাকড়ের কথা বলেছিলেন।”

ইমতিয়াজ আর ভাবলো না এতটুকু বললো শুধু,“ওহ আচ্ছা।”
—-
রাতের খাবার সেরে দাদিমার কক্ষে ঢুকলো রাগান্বিতা। দাদিমা তখন পালঙ্কের চাদর ঠিক করছিলেন। রাগান্বিতার উপস্থিতি টের পেতেই দাদিমা প্রশ্ন করলেন,
“কিছু কইবা রাগান্বিতা?”

রাগান্বিতা এগিয়ে আসলো। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জোরালো কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,“আমি সব জানতে চাই দাদিমা।”

দাদিমা হতভম্ব হয়ে গেলেন। কাঁপা কাঁপা স্বরে বললেন,
“কি জানবার চাও?”
“এই যে তুমি সেদিন আমার শাপলার সাজ দেখে কেন ঘাবড়ে গিয়েছিলে?”

দাদিমা থমকে হাসলেন। বললেন,
“হেদিনই(সেদিনই) তো কই ছিলাম শাপলা ফুলে পোকামাকড় থাহে।”
“তুমি মিথ্যে বলো না। আমি কিন্তু সবটা জেনেই ছাড়বো। আমার মন বলছে তুমি কুহু আপার বিষয়েও কিছু জানো।”

এবার যেন আরো ঘাবড়ে গেলেন দাদিমা। কি বলবেন বুঝতে পারছেন না। রাগান্বিতা ক্ষিপ্ত মেজাজ। সে আজ জেনেই ছাড়বে। রাগান্বিতা দাদিমার দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমায় সব বলো।”

দাদিমা শাড়ির আঁচল চেপে কাঁদলেন। রাগান্বিতার বুকটা হঠাৎই কেঁপে উঠলো। সে দাদিমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“তুমি কাঁদছো কেন দাদিমা?”

দাদিমা চুপ রইলেন। রাগান্বিতা দাদিমাকে নিয়ে জানালার পাশে বসলো। জানালার কপাট খুলতেই ঘুটঘুটে অন্ধকার পরিবেশটা নজরে আসলো প্রথম। তারপর আকাশের চাঁদখানা দেখা গেল। রাগান্বিতা কিছু বললো না দাদিমা অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“কুহুরে কেউ মারে নাই রাগান্বিতা। কুহু তোর আব্বার মুখে চুনকালি মাখাইয়া মইরা গেছে। নিজেই নিজের পাপ ধুইতে বিষ খাইছে।”

রাগান্বিতার চোখ থমথমে, গলায় কণ্ঠস্বর গেল থেমে। আপা বাবার মুখে চুনকালি দিয়েছে। রাগান্বিতা থমথমে গলাতেই বললো,
“আপা কি করছিল?”

মুখে আঁচল চেপে বললো দাদিমা,
“কুহু পোয়াতি আছিল।”

থমকে গেল রাগান্বিতা। পায়ের মাটিটা বুঝি সরে যাচ্ছিল এক মুহূর্তের জন্য। কান দিয়ে যেন ধোঁয়া বের হলো। সে স্তব্ধ! তার আপা বিয়ের আগে, না না! রাগান্বিতার বিশ্বাস হলো না তার আপা কলঙ্কিত নয়! কিছুতেই এটা হতে পারে না। দাদিমা মিথ্যে বলছে। তার আপা পবিত্র ছিল। মৃত বলে কি যা খুশি তাই শুনে নিয়ে বিশ্বাস করে নিবে রাগান্বিতা!

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ!]

#TanjiL_Mim♥️

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে