প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-২২+২৩

0
532

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-২২
________________
হাসিমাখা মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছে রাগান্বিতা ইমতিয়াজের মুখের দিকে। তার যেন বিশ্বাসই হলো না কাল তারা রেশবপুরে যাবে শুনে। রাগান্বিতা ছলছল দৃষ্টি নিয়ে ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আপনি সত্যি বলছেন আমরা কাল রেশবপুরে যাবো?”

ইমতিয়াজ রাগান্বিতার মাথায় হাত বুলালো শীতল সুরে সুধালো,
“হুম। বউয়ের কষ্টে বুক ফাঁটে বউ!’’

রাগান্বিতা যেন খুশি হলো টুক করে ইমতিয়াজের গালে ঠোঁট ছুঁয়ে বললো,
“আপনি খুব ভালো ইমতিয়াজ।”

ইমতিয়াজ মিষ্টি হেঁসে জবাব দেয়,
“আর তুমি মায়াবী!’
“আপনি আমার ঠোঁটের হাসি।”
“তুমি তো নিষ্ঠুর নও কি করে বলবো তোমায় ভালোবাসি।”
“চোখের পলকে, হাসির ঝলকে অথবা চিঠির ভীড়ে আপনি বলে দিয়েন আমি বুঝে নেবো।”
“তুমি চিঠি ভালোবাসো বউ?”
“উম! চিঠি নয় প্রেমপত্র!’

লাজুক স্বরে বললো রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ হাসলো বুকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“কোনো একদিন তোমার নামের বিশাল প্রেমপত্র পাঠাবো বউ তুমি পড়ে নিও।”
“কত শব্দের দিবেন?”
“তুমি কত শব্দের চাও বলো,
“কথা যেন না ফুড়ায় শেষ হয়েও যেন শেষ না হয় এমন প্রেমপত্র দিয়েন। শব্দ আপনি গুছিয়ে নিয়েন।”
“ঠিক আছে। এখন ঘুমাও রাত কিন্তু কম হয় নি।”

চোখ বুঝে ফেলে রাগান্বিতা। বলে,
“আপনিও ঘুমান।”
“হুম ঘুমাচ্ছি তুমি আগে ঘুমাও,

রাগান্বিতা শুনলো চোখ বুজে ঘুমানোর চেষ্টা করলো মুহুর্তেই। ইমতিয়াজ মাথায় হাত বুলাতে লাগলো তার। রাগান্বিতা সুখের সাগরে যেন ভাসলো। লোকটা বড্ড বেশিই যত্ন নেয় তার।

রাতের আকাশে পাড়ি জমানো চাঁদটা তখন উঁকি মারছিল ঘরে। ইমতিয়াজ তাকালো রাগান্বিতার মুখশ্রীর দিকে। বিড়বিড় করে বললো,
“এমন মায়াবী মুখখানার ধ্বংস করি কেমন করে!”

অনেকক্ষণ যেতেই, রাগান্বিতা তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ইমতিয়াজ আস্তে আস্তে শোয়া থেকে উঠে বসলো। বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে রইলো আরো কতক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে নিজের কক্ষ থেকে বের হলো লম্বা কপাটটা দিল আস্তে করে বন্ধ করে। ইমতিয়াজ নিজ কক্ষ থেকে বেরিয়ে এগিয়ে যায় তালাবদ্ধ সেই রুমটার দিকে। চাবিটা পাশেই পায়ের কাছে থাকা একটা বড় টবের নিচে রাখা ছিল। ইমতিয়াজ তালা খুলে ভিতরে ঢুকলো। ঘুটঘুটে অন্ধকার বিরাজ করছিল কক্ষটাতে। ইমতিয়াজ তালাবদ্ধ কক্ষটা ভিতর থেকে আঁটকে চললো একদম সোজা। সাঁতরে দেশলাই বের করে ল্যাম জ্বালালো। ল্যামটা রাখলো সামনের টেবিলটার কাছে। চেয়ার পেতে বসলো সামনে। রুমটা ঘুটঘুটে অন্ধকারে আবদ্ধ থাকায় তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। চারপাশ অন্ধকার মাঝখানে শুধু একটা টেবিলের উপর ছোট্ট ল্যাম জ্বালানো। ইমতিয়াজ নিজের দু’গাল চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে বসে রইলো অনেকক্ষণ। নিশ্বাস ফেললো জোরে। চোখ খুলে একটা খাতার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে চিরকুট বানালো। হাতের বলপেন নিয়ে লিখতে শুরু করলো কিছু। সে লিখলো,
“আমি ধ্বংস, কিন্তু সে আমাতেই মুগ্ধ!
“আমি ভয়ংকর, সে শীতল।”
“আমি খুনি, সে নিরপরাধ।”
“আমি যে প্রতিহিংসার আগুনে গড়া এক নিষ্ঠুর পাপী, সে কেন বুঝচ্ছে না এমন পাপী মানুষদের কখনো ভালোবাসতে নেই, কখনোই না।”

কথাগুলো লিখেই চিরকুট ভাজ করলো। সযত্নে রাখলো টেবিলের পাশেই থাকা ছোট্ট একটা ঝুলির মধ্যে। সেখানে আরো কতগুলো এমন চিরকুট লেখা ছিল। ইমতিয়াজ সেই চিরকুটগুলোতে হাত বুলিয়ে আবার কিছু লিখতে শুরু করলো। লেখা শেষ হতেই ল্যাম হাতে এগিয়ে যায় রুমের ডানদিকটায় যেখানে বিশাল একটা জানালা আছে। ইমতিয়াজ জানালাটা খুলে দিতেই বাহিরের বাতাস এসে ছুঁয়ে দিল তারে, নিভিয়ে দিতে নিলো তার হাতের ল্যামটাকে। কিন্তু নিভলো না ইমতিয়াজ হাত দিয়ে আটকালো তাহারে। কতক্ষণ পের হতেই হঠাৎ কোথা থেকে যেন উড়ে আসলো ইমতিয়াজের সেই কবুতরটা। ইমতিয়াজ খাবার খাওয়ালো তাকে। তারপর সেকেন্ড চিরকুটটা বেঁধে দিলো কবুতরের পায়ে। বিড়বিড়িয়ে কি যেন বললো! কবুতর চলে গেল। ইমতিয়াজ তার পানে চেয়ে রইলো বহুক্ষণ!’
—-
পরেরদিন,
বেশ সকাল সকালই রাগান্বিতার বাবা জানতে পারলেন আজ নাকি তার মেয়ে জামাইরা আসবে। কথাটা শোনা মাত্রই তিনি ছুটে যান দাদিমার ঘরে। মানুষটা রাগান্বিতার শোকে অনেকটা অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন। রাগান্বিতা আসবে শুনেই সে যেন সতেজ হলেন, রান্নাবান্নার কাজে হাত ছোঁয়ালেন। খবরটা দিয়ে গেছে মোকলেস,, বলেছে সকালে নাকি তার কাছে একটা কবুতর এসে একটা চিঠি দিয়ে গেছে। রাগান্বিতার বাবার হাতেই চিঠিটা দিয়েছিল মোকলেস। সেখানে ইমতিয়াজ লিখেছিলো,
আসসালামু আলাইকুম জমিদার সাহেব। আশা করি আল্লাহর রহমতে ভালো আছেন। আমরা আগামীকাল বৃহঃস্পতিবার আসছি, দাদিমাকে আমার সালাম জানাবেন সঙ্গে বলবেন ভালো ভালো রান্না করে রাখতে তার রাগান্বিতা আসছে।

ইতি
ইমতিয়াজ!’

রাগান্বিতার বাবা প্রচন্ড খুশি হয়েছেন অবশেষে তার প্রাণপ্রিয় কন্যা তার দুয়ারে পা রাখবে। চিঠিতে আগামীকাল থাকলেও বৃহস্পতিবার আজকে। তবে চিঠি লেখার তারিখ অনুয়ায়ী হয় কালকে।”

‘বাবা’ হঠাৎই রেজওয়ানের ডাক শুনে পিছন ঘুরলেন মোতালেব তালুকদার। তাকে ঘুরতে দেখেই রেজওয়ান প্রশ্ন করলো,
“বাড়িতে হঠাৎ কিসের তোড়জোড় শুরু হলো বাবা?”
“রাগান্বিতা আসবে আজকে!’

বাবার কথা শুনে চোখে মুখে হাসির রেখা ফুটলো রেজওয়ানের। উত্তেজিত কণ্ঠে বললো,
“সত্যি বাবা।”
“হুম ইমতিয়াজ বার্তা পাঠিয়ে ছিল।”
“আমি তবে বাজার থেকে ওর জন্য ভালো ভালো খাবার, ফলমূল নিয়ে আসি বাবা?”
“হুম যাও সঙ্গে করে মিষ্টি আনতে ভুলো না কিন্তু।”
“আচ্ছা বাবা।”

বলেই বেরিয়ে পড়লো রেজওয়ান। রেজওয়ান শহরে গিয়ে নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে সব নিয়ে চলে এসেছে। আজ চারদিন হয়েছে এসেছে। একবার ভেবেছিল বোনের কাছে যাবে একবার কিন্তু পরে আবার কি ভেবে যেন যায় নি।
—–
এবারের যাত্রাপথের মাধ্যম হিসেবে ইমতিয়াজ ট্রেনটাকে বেছে নিয়েছে। তার ইচ্ছে সন্ধ্যার মধ্যেই রেশবপুরে পৌঁছানো। তাই সকাল সকালই বেরিয়ে পড়েছে। এদিকটা থেকে বের হতেই বড় বিপাকে পড়তে হয় ওদের যেমন লেগেছে সময় তেমন ক্লান্তিকর পরিশ্রম। ঢাকার শহরের যাত্রাপথ বড্ডই কঠিন লাগে রাগান্বিতার। এত মানুষ আশেপাশে থাকে। গ্রামের যাত্রাপথ যেন এর চেয়ে সোজা। বগির সিটে বোরকা পরিধিত বসে আছে রাগান্বিতা। আর তার পাশেই ইমতিয়াজ। প্রকৃতির মুগ্ধ করা বাতাস তাদের ছুঁয়ে দিচ্ছে বারংবার। রাগান্বিতা চেয়ে চেয়ে শুধু পথগুলো দেখলো কি সুন্দর এই দেশখানা। মাঠে মাঠে গরু -মহিষ, উঁচু উঁচু গাছ সঙ্গে নীল আকাশ।

সময় গড়ালো ওরা ট্রেন ছেড়ে নৌকায় উঠলো। নদীতে জোয়ার ভাটার উপদ্রব থাকায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা লাগলো। বেশ কয়েকঘন্টা নদীতেও কাটানো হলো তাদের আসার পথে দু’দিনের খাবার নিয়ে এসেছিল তারা যদি কোনোভাবে নৌকার বেড়া জ্বালে আঁটকে পড়ে তখন। প্রথম জোয়ার ভাটার তান্ডব দেখে রাগান্বিতা তাই ভেবেছিল আজ তারা বাড়ি যেতে পারবে না। কিন্তু পারলো! ওরা যখন রেশবপুরের নদীর ঘাটে এসে পৌঁছালো তখন বিকেল প্রায়। ইমতিয়াজ দ্রুত মাঝির পাওনা মিটিয়ে চললো এগিয়ে। এবার লাস্ট বাহন তাদের গরুর বা মহিষের গাড়ি। যেটা সরাসরি রাগান্বিতাদের বাড়ির সামনে নিয়ে যাবে। ইমতিয়াজ অনেক খুঁজে একটা বড়সড় মহিষের গাড়ি ভাড়া করলো। রাগান্বিতাও উঠে বসলো। চোখ বেয়ে যেন তার অশ্রু গড়ালো কতদিন পর নিজ জন্মস্থানের হাওয়ার গন্ধ পেল। রাগান্বিতা চুপটি করে বসে রইলো, আর গাড়ির পিছন দিকটার এদিকটাতেই ইমতিয়াজ বসা। গ্রামের প্রকৃতির দিকে চোখ বুলাচ্ছিল সে। সঙ্গে হঠাৎই বিড়বিড় করে বললো,

এ সেই গ্রাম, যে গ্রাম আমায় নিঃস্ব করেছে,
শেষ সর্বস্ব হারিয়ে করে দিয়েছে ফকির।”

পরমুহূর্তেই রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে আবারো ধীর স্বরে বললো ইমতিয়াজ,

আবার এই গ্রামই সঙ্গে দিয়েছে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসার এক রমনী, সে রমনী পাষাণ মন গলাতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। একটু একটু করে ভরিয়ে দিচ্ছে সব। তবুও কভু কি পারবে পুরোপুরি সবটা ঘোচাতে, খামতি কমিয়ে নতুন প্রেমের সূচনায় মোড়াতে!’
—-

সদর দরজার সামনে পায়চারি করছে রাগান্বিতার বাবা। মন, চোখ-মুখে যেন বড্ড অস্থিরতার ভাব। মেয়েটাকে একটুখানি দেখার জন্য বড্ড ব্যাকুল বাবা। কখন যে আসবে কে জানে!” হঠাৎই বাড়ির সামনে এসে একটা মহিষ গাড়ি থামলো। রাগান্বিতার বাবা ছুট্টে এগিয়ে গেলেন,,

#চলবে…..

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-২৩
________________
বাবাকে দেখেই মহিষের গাড়ি থেকে নেমে ছুট্টে এগিয়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো রাগান্বিতা। রাগান্বিতার বাবা মৃদু হাসলেন। চোখের পানি আসলেও মুছে নিলেন নিমিষেই। মিষ্টি সুরে সুধালেন,
“কেমন আছো মা? কতদিন পর তোমারে দেখলাম।”

রাগান্বিতা চোখে পানি রেখেই বললো,
“ভালো বাবা। তুমি কেমন আছো?”
“আমিও ভালো আছি।”

রাগান্বিতা তার বাবাকে ছাড়লেন। ইমতিয়াজ এগিয়ে এসে মোতালেব তালুকদারের পা ছুঁতে নিলেই হাত দুটো ধরে উঠিয়ে নিলেন। ইমতিয়াজকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“পায়ের হাত দেয়ার দরকার নেই ইমতিয়াজ, তুমি তো শুধু আমার মেয়ের জামাই নও আমার ছেলেও।”

রাগান্বিতার বাবার কথা শুনে তেমন কোনো রিয়েকশন দিলো না ইমতিয়াজ। শুঁকনো হেঁসে বললো,
“ভালো আছেন তো আগের চেয়ে শুঁকনো দেখাচ্ছে।”

রাগান্বিতার বাবা মুখে হাসি রেখেই উত্তর দিলেন। বললেন,
“ওসব কিছু না। বয়স বাড়ছে আর কত তরতাজা থাকবো। চলো ভিতরে চলো,

এই বলে রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজকে ভিতরে নিয়ে গেলেন রাগান্বিতার বাবা। সর্বপ্রথমই দেখা মিললো রেজওয়ানের সাথে রাগান্বিতা তার ভাইকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“কেমন আছো দাদাভাই কতদিন পর তোমায় দেখলাম?”

রেজওয়ান হাসলো,খুশি মনে রাগান্বিতাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
“ভালোই আছি। তুই কেমন আছিস?”
“ভালো দাদাভাই।”

রাগান্বিতার উত্তর শুনে রেজওয়ান তাকালো ইমতিয়াজের দিকে। বললো,
“কেমন আছো আমার বোনটা তোমায় জ্বালাচ্ছে না তো?”

ইমতিয়াজ হেঁসে জবাব দিলো,
“না আপনার বোন খুবই ভালো। আমার বড্ড খেয়াল রাখে।”

ইমতিয়াজের কথা শুনে শুধু হাসে রেজওয়ান আর কিছু বলে না। ওরা ভিতরে চলে যায়।
——
রাগান্বিতার কক্ষে দাঁড়িয়ে আছে ইমতিয়াজ। পুরো কক্ষটায় চোখ বুলাচ্ছে সে। রাগান্বিতা নিচে আছে, দাদিমার কাছে গেছে। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার কক্ষের আয়নার দিকে তাকালো বার কয়েক নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে পলক ফেলে বিড় বিড় করে বললো শুধু,
“কুহু কি এই আয়নাতেই নিজের মুখশ্রী দেখতো! হবে হয়তো!”

ইমতিয়াজ আয়না থেকে সরলো চলে গেল সামনের জানালাটার দিকে। পর্দাটা সরালো আগে সঙ্গে সঙ্গে শেষ বিকেলের শীতল বাতাস এসে ছুয়ে দিলো তাকে। বাতাসের ছোঁয়ায় চোখ বন্ধ করলো ইমতিয়াজ। হঠাৎই চোখের সামনে ভেসে উঠলো তার,
“একটা নিথর দেহ, তার পানে ছলছল চোখ নিয়ে অপরাধী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইমতিয়াজ স্তব্ধ হয়ে ছুট্টে এসে লুটিয়ে পড়লো নিথর দেহটার সামনে। চারপাশটা যেন এক নিমিষেই ধ্বংস হয়ে গেল। ভিতর থেকে ধ্বংস হলো ইমতিয়াজ। তখনই কে যেন যেন কানের পাশে ঝনঝন শব্দে বললো,
“প্রতিশোধ চাই, প্রতিশোধ চাই ইমতিয়াজ। এক ধ্বংসে সবটার ধ্বংস চাই।”

“এই যে শুনছেন?”

আচমকাই রাগান্বিতার ভয়েসটা কানে বাজতেই হকচকিয়ে উঠলো ইমতিয়াজ। তার চোখ দুটো তখন ধারণ করেছিল লাল বর্ণ, প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলে উঠছিল শরীর। দু’হাতের মুঠো করছিল শক্ত। নিজেকে সামলাতে সে হচ্ছিল ব্যর্থ।

রাগান্বিতা এগিয়ে আসলো পিছন থেকে কাঁধে হাত রাখলো ইমতিয়াজের। রাগান্বিতার হাতের স্পর্শ পেতেই পুনরায় চোখ বন্ধ করে নিলো ইমতিয়াজ। জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলতে লাগলো মুহূর্তেই। রাগান্বিতা কি যেন ভাবলো হুট করেই পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো ইমতিয়াজকে। শীতল সুরে বললো,
“আর কতক্ষণ পিছন ঘুরে থাকবেন, এবার তো আমার পানে তাকান আমি যে অধিক আগ্রহে আপনার অপেক্ষায় বসে।”

জবাব আসলো না। ধীরে ধীরে ইমতিয়াজ শান্ত হলো। মুঠো করে থাকা হাতটা ঢিলে হয়ে গেল। সে চাইলো, মুচকি হেঁসে পিছন ঘুরলো। জড়িয়ে বুকে আনলো রাগান্বিতাকে। অভিমানী সুরে বললো,
“তুমি আমার অভিমান বুঝো না বউ?”

রাগান্বিতার অবাক স্বরে বললো,
“মানে।”
“ইমতিয়াজ কি কোনোদিন তোমার মানের জবাব দিয়েছে যে আজ দিবে।”
“কিন্তু না বললে বুঝবো কেমন করে?”

রাগান্বিতার থুতনী ধরে মাথাটা উঁচু করলো ইমতিয়াজ। চোখে রাখলো চোখ, ঠোঁটের অতি নিকটে এসে শীতল সুরে সুধালো,
“আমার চোখের ভাষা না বুঝলে তুমি আমায় কি করে বুঝবে বউ?”

দ্রুততার সঙ্গেই রাগান্বিতার জবাব,
“আমি আপনায় বুঝি! এই যে মাত্র আপনি জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছিলেন কোনো কথা ভেবে দুঃখ পাচ্ছিলেন, আপনার রাগ হচ্ছিল,হাতের মুঠো শক্ত করে নিজের রাগ দমালেন এগুলোর সবটাই আমি বুঝি ইমতিয়াজ।”

মুহূর্তের মধ্যে ইমতিয়াজ থমকে গেল ছিটকে পিছন সরে আসলো দু’কদম। বললো,
“তুমি মিথ্যে বলছো!”

রাগান্বিতা উচ্চস্বরে হেঁসে ফেলে। নিরদ্বিধায় বলে,
“জানি তো। ওটা তো আপনায় চমকানোর জন্য বলেছিলাম।”

ইমতিয়াজের বিশ্বাস হলো না সে আবার প্রশ্ন করলো। বললো,
“তুমি সত্যি বলছো?”
“তা নয় তো কি! আর তাছাড়া আচমকাই আপনার রাগ আসবে কেন?”
“রাগ তো আমার আসছিল।”
“কেন?”

ইমতিয়াজের শীতল চাহনী!
“তুমি কক্ষে আসতে এত দেরি কেন করছিলে বউ?”

রাগান্বিতা লাজুক হাসলো। এতক্ষণে বুঝলো ইমতিয়াজ কেন তার ওপর অভিমান আর রাগ করছিল। রাগান্বিতা মিষ্টি হেঁসে বললো,
“আমাকে খুব ভালোবাসেন ইমতিয়াজ সাহেব?”

বুকের কোথাও এসে যেন কথাটা বারি খেল ইমতিয়াজের। সে উত্তর দিতে পারলো না। আবার চুপও থাকলো না। রাগ নিয়ে বললো,
“তোমায় বলবো না।”

আবার হাসে রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে বলে,
“একদম হাসবে না বউ,তুমি হাসলে আমার অসুখ অসুখ লাগে।”

রাগান্বিতা হাসি থামিয়ে দেয়। বলে,
“অনেক হয়েছে এবার চলুন আমি শরবত আর কিছু শুঁকনো খাবার নিয়ে এসেছি।”

বলেই ইমতিয়াজের হাত ধরে পালঙ্কের কাছে নিয়ে গেল রাগান্বিতা। খাবার দেখিয়ে বললো,
“দাদিমা পাঠালেন খেয়ে নিন।”

ইমতিয়াজ একবার রাগান্বিতার মুখশ্রী আর আরেকবার খাবারের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তুমি খেয়েছো?”
“না আপনি আগে খান তারপর আমি খাবো।”

ইমতিয়াজ শুনলো না রাগান্বিতার হাত ধরে পালঙ্কে বসিয়ে বললো,
“চলো একসাথে খাই।”

রাগান্বিতা মিষ্টি হাসলো। যেন সে জানতো বিষয়টা। রাগান্বিতা আশ্বাস দিয়ে বললো,
“আপনি খান আমার তেমন খিদে নেই নৌকায় বসে তখন খেয়েছিলাম না।”
“সে তো সেই কখন খেয়েছো এখন আবার খাও।”

ইমতিয়াজ শরবতের গ্লাসটা হাতে নিলো রাগান্বিতার মুখের কাছে ধরে বললো,
“খাও,

রাগান্বিতা আর বারণ করতে পারলো না একটুখানি খেয়ে নিলো। বললো,
“এবার আপনি খান।”

ইমতিয়াজ অনেকক্ষণ গ্লাসটার দিকে তাকিয়ে রইলো তার মোটেও খেতে ইচ্ছে করছে না। কেমন গলাটা আঁটকে আঁটকে আসছে। ইমতিয়াজকে খেতে না দেখে আবারও বললো রাগান্বিতা,
“কি হলো আপনি খাচ্ছেন না কেন?”

এবার খেল ইমতিয়াজ। একটুখানি খেয়ে বললো,
“তোমায় একটা প্রশ্ন করবো বউ?”

রাগান্বিতা নিরদ্বিধায় বললো,
“জি বলুন!’
“আমি শুনেছিলাম তোমার নাকি আর একটা বড় বোন ছিল কিন্তু তাকে তো দেখি নি এখনো। কোথায় সে?”

নিমিষেই রাগান্বিতার হাসি মাখা মুখটা চুপসে যায় স্তব্ধ স্বরে বলে,
“নেই সে।”

অবাক স্বরে বলে ইমতিয়াজ,
“নেই মানে কোথায় গেছে?”

ইমতিয়াজের প্রশ্নে হুট করেই উঠে দাঁড়ালো রাগান্বিতা, আচমকাই ইমতিয়াজের হাত ধরে বললো,
“চলুন আমার সাথে দেখাচ্ছি।”

ইমতিয়াজও উঠে দাঁড়ালো। বিনা বাক্যে এগিয়ে চললো সে রাগান্বিতার পিছন পিছন। যেন সে ভেবেছিল রাগান্বিতা এমন কিছুই করবে।”

—–
গাছের পাতাতে ভরপুর পরিবেশ। কেমন যেন নিস্তব্ধ সব। গত দিনগুলোতে বৃষ্টি না হওয়ায় মাটিগুলো পুরোই শুকনো আর ফেটে ফেটে গেছে এমন। রাগান্বিতাদের বাড়ির রন্ধনশালা পেরিয়ে হাতের ডান দিকটা ছুট্টে যাচ্ছিল রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ। শেষ বিকেলের জন্য সব কেমন যেন ছমছমে লাগছে। রাগান্বিতা অনেকটা পথ হেঁটে এসে বাঁশ দিয়ে বেড়া দেয়া একটা কবরস্থানের সামনে দাঁড়ালো। ইমতিয়াজের পা ওখানেই থেমে গেল। রাগান্বিতা ইমতিয়াজের হাতটা ছেড়ে পায়ের চটি খুলে কবরের দোয়া পাঠ করে ভিতরে ঢুকলো। নিশ্চুপ স্বরে বললো,
“এই যে মাটির নিচটা দেখছেন, এখানেই আমার বোন কুহু শুয়ে আছে। আমাদের মায়া ত্যাগ করে চলে গেছে দূরে যেখান থেকে আর কখনো ফিরে আসবে না আপা। কখনোই আসবে না।”

বলেই কবরের পাশে লুটিয়ে পড়লো রাগান্বিতা। বোনের মৃত্যুর পর আজ প্রথম তার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়লো। তার বুকটা কেঁদে উঠলো আচমকা। বোনের সাথে কাটানো কিছু খুনশুঁটির মুহূর্ত ভেসে আসলো চোখের সামনে।”

রাগান্বিতার কান্না দেখে আরো দু’পা পিছিয়ে গেল ইমতিয়াজ। বুকে ব্যাথা অনুভব করছে সে। রাগান্বিতার চোখের অশ্রু সে কেন সহ্য করতে পারছে না! কেন!’

ইমতিয়াজ কুহুর কবরের পানে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
“তুমি কি দেখছো কুহেলিকা আমি এসেছি! তোমার অসমাপ্ত সেই প্রেমের গল্পের বিষাক্ত প্রেমিক ফিরে এসেছে তুমি কি দেখতে পাচ্ছো তাকে! আচ্ছা তোমার কি রাগ হচ্ছে না আমার উপর! মনে হচ্ছে না এই পাষাণ মানুষটাকে ভালোবেসে তুমি ভুল করেছিলে! এক ভয়ংকর চরম ভুল! আচ্ছা তোমার বোনকে বললে কি সে বিশ্বাস করবে,
“আমি তোমার দূরে থেকেও কাছের কেউ ছিলাম!”

ইমতিয়াজ রাগান্বিতার পানে তাকালো মেয়েটা এখনো কাঁদছে। হঠাৎই সেদিকে এগিয়ে আসলো রেজওয়ান বোনকে কাঁদতে দেখে ছুটে আসলো সে। দৌড়ে গিয়ে ধরলো বোনকে। চোখে পানি তারও জমলো। ইমতিয়াজ শুধু দেখে গেল দুই ভাইবোনকে মুখ ফুটে কিছু বললো না আর।’

#চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে