#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-১৮
________________
থমথমে চেহারা নিয়ে তাকিয়ে আছে রাগান্বিতা সামনের কবতুরটার দিকে। তার মাথায় ঢুকছে না এখানে কে চিঠি পাঠাবে। রাগান্বিতা এগিয়ে গেল কবুতরটার দিকে ছুঁতে চাইলো বার বার কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো রাগান্বিতার হাতে কবুতরটা ধরা দিচ্ছে না এবার। সে এদিক সেদিক চোখ বুলাচ্ছে শুধু। রাগান্বিতা কবুতরটার হাবভাব ঠিক বুঝচ্ছে না চিঠি নিয়ে যখন এসেছে তখন তাকে নিতে দিচ্ছে না কেন! কবুতর টা বেশ কিছুক্ষণ এক স্থানে দাঁড়িয়ে ছিল রাগান্বিতা ছুঁতে গেলেই ছুটে যাচ্ছিল অন্যদিকে। শেষমেশ রাগান্বিতা কবুতর ধরার হাল ছেড়ে দিল বোধহয় কবুতরটা তার রাস্তা গুলিয়েছে। রাগান্বিতা পালঙ্কে বসে রইলো চুপচাপ। কবুতরটা অনেকক্ষণ বসে থেকে আবার ছুটে চলে গেল। রাগান্বিতা জাস্ট হা হয়ে তাকিয়ে রইলো কবুতরটার যাওয়ার পানে।
“কান্ডটা ঠিক কি হলো তাই যেন বুঝলো না! কবুতর এলো চিঠি নিয়ে অথচ চিঠি না দিয়েই চলে গেল। অদ্ভুত তো!’
কবুতর যাওয়ার তিন সেকেন্ডের মাথাতেই রুমে প্রবেশ করলো ইমতিয়াজ। শান্ত স্বরে বললো,
“খাবার তৈরি নিচে চলো রাগান্বিতা।”
রাগান্বিতা খানিকটা চমকে উঠলো কারণ সে তখনো কবুতরটার কথা ভাবছিল। রাগান্বিতা ইমতিয়াজের দিকে তাকালো ভাবলো ইমতিয়াজকে কবতুরের কথাটা বলা উচিত। তাই করলো। সে চিন্তিত স্বরে বললো,
“জানেন তো এই মাত্র একটা ঘটনা ঘটেছে।”
ইমতিয়াজ রাগান্বিতার দিকে এগিয়ে আসলো। খানিকটা অবাক স্বরে বললো,
“কি ঘটনা?”
“মাত্র একটা কবুতর এসেছিল কোনো এক বার্তা নিয়ে কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো আমি তাকে ছুঁতে পারি নি যতবার ধরতে গেছি ততবারই পালিয়ে গেছে। এমনটা কেন করলো?”
ইমতিয়াজ হাসলো। বললো,
“এই সামান্য একটা বিষয় নিয়ে তুমি চিন্তা করছো।”
ইমতিয়াজের কথা শুনে আহ্লাদী স্বরে বললো রাগান্বিতা,
“বারে করবো না বার্তা নিয়ে আসলো অথচ না দিয়েই চলে গেল এমনটা কেন হলো এর আগে তো এমন হয় নি।”
ইমতিয়াজ রাগান্বিতার পাশে বসে ওর হাত ধরে মৃদুস্বরে বললো,
“মানুষ তো প্রায়সই তার গন্তব্য ভুলে যায় ওটা তো মাত্র পাখি ছিল।”
ইমতিয়াজের কথায় এক শীতল ভরা চাহনী নিয়ে তাকালো রাগান্বিতা ইমতিয়াজের চোখের দিকে। বললো,
“তার মানে আপনি বলছেন পাখিটা তার ঠিকানা ভুলে গিয়েছিল।”
“হুম। ভুলে যাওয়া কি অস্বাভাবিক কিছু?”
“তাও ঠিক।”
“তুমি কি ঘাবড়ে গিয়েছিলে?”
টনক নড়লো রাগান্বিতার। নিজেকে স্বাভাবিক রেখেই বললো,
“না তবে একটু অবাক হয়েছি তাই ভাবছিলাম।”
“বুঝেছি আর ভাবাভাবির প্রয়োজন নেই চলো নিচে খাবে।”
রাগান্বিতা শুনলো নিজের মাথায় ঘোমটা দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বললো,
“ঠিক আছে। চলুন,
“হুম তুমি হাঁটো আমি আমার জামাটা বদলে আসছি। ভয় নেই নিচে চাচা আছে,
রাগান্বিতা আর কিছু বললো না। হেঁটে যেতে যেতে বললো শুধু,
“ঠিক আছে। দ্রুত আসুন।”
“হুম যাও তুমি। আমি আসছি।”
রাগান্বিতা চলে গেল। রাগান্বিতা যেতেই ইমতিয়াজ তার রুমের দুয়ারটা আঁটকে দিয়ে জানালার দিকে এগিয়ে গেল। চুপ করে দাঁড়ালো কিছুসময় এরই মাঝে উড়ে যাওয়া সেই কবতুরটা আবার ফিরে এসে বসলো ইমতিয়াজের কাঁধে। কারণ সেটা যায় নি এতক্ষণ বাড়িরই আশেপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। ইমতিয়াজ কাঁধ থেকে পাখিটা হাতে নিয়ে আস্তে করে পায়ে থাকা চিঠিটা নিলো। চিঠিটা নিতেই পাখিটা পুনরায় ইমতিয়াজের কাঁধে চড়ে বসলো। ইমতিয়াজ চিঠিটা খুললো। অনেক্ক্ষণ তাকিয়ে রইলো চিঠিটার দিকে। পড়লো কিছু। তার দৃষ্টি ছিল স্থির ইমতিয়াজ চিঠিটা পুনরায় ভাজ করে মুঠোয় চেপে রাখলো। মনে মনে বললো,
“ভাবনাটাই তবে সত্যি হলো!’
ইমতিয়াজ এগিয়ে গেল তার টেবিলটার ড্রয়ার থেকে একটা ঠোংগা বের করে কবুতরের খাবার গম বের করলো। গম দেখেই কবুতর ডানা ঝাপটালো ইমতিয়াজ ঠোংগা থেকে গম বের করে টেবিলের উপর একটা ছোট্ট বাটিতে রাখলো। সঙ্গে সঙ্গে কবুতর টা ইমতিয়াজের কাঁধ ছেড়ে উড়ে বসলো টেবিলের উপর। তারপর নিজের ঠোঁট দিয়ে ঠুকরিয়ে ঠুকরিয়ে খেতে শুরু করলো গম। ইমতিয়াজের কবুতর খুব পছন্দ। ছোট বেলা থেকেই এই কবুতরটা আসতো ইমতিয়াজের ঘরে ইমতিয়াজ তাকে গম খাওয়াতো। খাওয়া শেষ হলেই আবার উড়ে যেত। এভাবে করতে করতে একটা বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক গড়েছে ইমতিয়াজের সাথে কবুতরটার। এখন তো খিদে পেলেই ছুটে আসে। খুব উপকারী কবুতর। ইমতিয়াজও অনেক যত্ন করে কবুতরটাকে।
—–
আসন পেতে খাবার নিয়ে নিচে বসে আছে রাগান্বিতা। সচরাচর নিচে বসে তেমন একটা খাবার খাওয়ার অভ্যাস নেই রাগান্বিতার। বাড়িতে বসে টেবিল চেয়ারে বসেই খাওয়া হতো। রাগান্বিতার বাবা ছিলেন একটু বিদেশি টাইপের, রাগান্বিতা শুনেছিল একসময় নাকি বিদেশিনীদেরে সাথে তার বাবার বেশ ভাব ছিল কিন্তু সময়ের সাথে সেই ভাব বিনিময় সব ঘুচে যায়। তবে কিছু অভ্যাস আজও বদলাতে পারে নি রাগান্বিতার বাবা। গ্রামের আর সব ছেলেমেয়েরা তাদের বাবা মা’দের আব্বা আম্মা বলে ডাকে কিন্তু রাগান্বিতার বাবা শিখিয়েছেন আব্বাকে বাবা বলা আর আম্মাকে মা। রাগান্বিতার বাবা বেশ কিছু দেশের ভাষা জানতেন পড়াশোনাতেও বেশ পটুছিলেন। কিন্তু রাগান্বিতার মা ছিল একটু সাধারণ পড়াশোনা খুব বেশি জানতেন না। উনি সবসময় অশুদ্ধ ভাষাতেই কথা বলতেন। রাগান্বিতার বাবাও তার বউয়ের সাথে তার মতো করেই কথা বলতেন যেমনটা দাদিমার আর গ্রামের অশিক্ষিত মানুষদের সাথে করেন। তবে রাগান্বিতা আর রেজওয়ানকে সবসময় শুদ্ধ ভাষাই শিখিয়েছেন। মায়ের আদর রেজওয়ান আর কুহু কিছুটা পেলেও রাগান্বিতা তেমন পায় নি। জোরে নিশ্বাস ছাড়লো রাগান্বিতা। তার কাছে ভাষা বলতে বাবার মুখের ভাষাই সেরা।”
“এখনও খাওয়া শুরু করো নি কেন?”
হঠাৎই ইমতিয়াজের ভয়েসটা কানে বাজতেই নিজের ভাবনা থেকে বের হলো রাগান্বিতা। স্থির দৃষ্টি নিয়ে তাকালো ইমতিয়াজের দিকে। ইমতিয়াজের চোখে চশমা নেই গায়ের সাদা রঙের ফতুয়া আর সাদা পায়জামা পড়া খুবই সাধারণ তবে অসাধারণ লাগছে রাগান্বিতার কাছে। রাগান্বিতা দৃষ্টি সরালো। বললো,
“আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”
ইমতিয়াজ হাল্কা হাসলো। বসলো রাগান্বিতার পাশ দিয়ে। বললো,
“খিদে পেলে খেয়ে নিবে আমার জন্য অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই।”
রাগান্বিতা হাল্কা মাথা নোয়ালো লাজুক কণ্ঠে বললো,
“দাদিআপা মানে দাদিমা বলেছিলেন বিয়ের পর নাকি জামাই বউকে একসাথে খেতে হয়। জামাই না খেলে বউকে তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়।”
ইমতিয়াজ নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলো রাগান্বিতার দিকে। মেয়েটাকে বড্ড বেশিই লাজুকতায় ধরেছে তবে খারাপ লাগছে না। ইমতিয়াজ মৃদু হেসে বললো,
“চলো খাই।”
“জি।”
রাগান্বিতা ইমতিয়াজকে খাবার এগিয়ে দিল। ইমতিয়াজও নিলো। তারপর দুজন একসাথে করে খেতে শুরু করলো খাবার ।’
——
নিঝুম বিকেল! প্রকৃতি খুব বিষণ্ণ, নিরিবিলি আর চুপচাপ। রাগান্বিতা বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির জন্য বড্ড মন খারাপ হচ্ছে বাবা, দাদাভাই, দাদিমা সবাইকে তার খুব মনে পড়ছে। ইচ্ছে করছে ছুট্টে চলে যাই তাদের কাছে। রাগান্বিতার খারাপ লাগলো। ঘরে ইমতিয়াজ ঘুমাচ্ছে। বোধহয় রাতে মোটেও ঘুম হয় নি তার। বাড়ির পরিবেশটা একটু বেশিই ছমছমে কেমন যেন। রাগান্বিতা ভিতু নয় বেশ সাহসী তারপরও এমন একটা জায়গায় ইমতিয়াজ একা থাকতো ঠিক কেমন যেন লাগলো। আচমকা আকাশের মেঘ বদলালো, এমনিতেও হাল্কা কালো ছিল এখন পুরো দমেই কালো হয়ে গেল। মেঘে ঢেকে গেল পুরো আসমানটা। আশপাশের পুরো গাছপালা নড়েচড়ে উঠলো বাতাস বইতে লাগতো তীব্র গতিতে। বালি আসছিল পুরো ঘরভরে। রাগান্বিতা চোখ বন্ধ করে ফেললো তার অবাধ্য ঘন কালো লম্বা চুলগুলো উড়তে লাগলো আপনাআপনি। ঘোমটা পড়ে যাচ্ছিল বারংবার। বিরক্ত লাগলেও তার বাতাসটা ভালো লাগছিল। ইমতিয়াজ হঠাৎই ছুটে আসলো ‘রাগান্বিতা, রাগান্বিতা’ বলতে বলতে চলে আসলো দ্রুত। ঘুমটা তার মাত্রই ভাঙলো। প্রকৃতির থমকানোর খানিকটা ঘাবড়ে ছিল সে। ইমতিয়াজ ছুট্টে এসে থেমে গেল বারান্দার দুয়ার পর্যন্ত এসেই রাগান্বিতার সেই মোহনীয় সৌন্দর্য দেখেই চোখ আঁটকে গেল তার। স্থির হলো চোখ, আঁটকে গেল শরীর। কি যেন এক মায়া সৃষ্টি হলো ঠিক বুঝলো না ইমতিয়াজ!’
রাগান্বিতা পিছন ঘুরলো। ইমতিয়াজকে দেখেই একটু চমকালো। এগিয়ে এসে বললো,
“আপনার ঘুম ভেঙে গেছে?”
কেমন এক ঘোরলাগানো স্বরে বললো ইমতিয়াজ,
“তুমি ঘুমাতে দিচ্ছো কই।”
“আমি আঁটকে রাখলামও বা কই?”
“রেখেছো তো তোমার ওই চুলে, কানে ঝুলানো দুলে, হাতের কাঁকনে, গলার গহনে, চোখের ওই মায়াবী ধরনে। এতভাবে আঁটকে রেখে বলছো, আটকালাম কই! এ কিন্তু ভাড়ি অন্যায়!’
রাগান্বিতা লজ্জা পেল। তবে দমলো না মাথা নুইয়ে হাসতে হাসতে বললো,
“আপনার দৃষ্টি ভালো না তাই আঁটকে যান।”
ইমতিয়াজ এগিয়ে যায়। রাগান্বিতার থুতনি ধরে মাথাটা উচু করে বললো,
“আমি তোমার চোখে বার বার আমার সর্বনাশ কেন দেখি বউ?”
রাগান্বিতা চমকালো, ভড়কালো, অবাক হলো খুব। এ বুঝি প্রেমকথন ছিল! রাগান্বিতা লাজুক হয়ে মিষ্টি হেঁসে কেমন করে যেন জড়িয়ে ধরলো ইমতিয়াজের বুক!’
#চলবে…..
#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-১৯
________________
স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইমতিয়াজ, হঠাৎ করেই রাগান্বিতার জড়িয়ে ধরার বিষয়টার জন্য সে মোটেও প্রস্তত ছিল না। রাগান্বিতা ইমতিয়াজকে জড়িয়ে ধরলেও ইমতিয়াজের হাত ছিল স্থির সে ধরে নি রাগান্বিতাকে। ইমতিয়াজের বুকের ভিতর টিপ টিপ করে শব্দ হচ্ছে। রাগান্বিতা তো তার বুকেই মাথা রেখে দাড়িয়ে আছে ‘মেয়েটা নিশ্চয়ই শুনতে পাচ্ছে তার বুুকের ধুকপুকানি। রাগান্বিতা চোখ বন্ধ করে মুচকি হাসলো। আকাশে তখন প্রবল বেগে বিদ্যুৎ চমকালো রাগান্বিতা হাল্কা একটু ঘাবড়ে গিয়ে ইমতিয়াজকে আর একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রাগান্বিতার ডান কানটা তখন ইমতিয়াজের বুকের ধুপকানি খুব সুন্দরভাবেই শুনতে পাচ্ছিল সে বুঝেছিল ইমতিয়াজের বুক কাঁপছে। সেই বুঝি প্রথম মেয়ে ছিল যে ইমতিয়াজকে জড়িয়ে ধরলো।
অনেক্ক্ষণ যাওয়ার পরও যখন রাগান্বিতা ইমতিয়াজকে ছাড়ছিল না তখন ইমতিয়াজেরও যেন কি হলো সে চোখ বন্ধ করে জড়িয়ে ধরলো রাগান্বিতাকে। আকাশ পথ বেয়ে তখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামছিল, কি সুন্দর এক মুহুর্ত! প্রকৃতি জুড়ানো ঠান্ডা বাতাস বইছিল তখন। বাতাসের সংস্পর্শতা রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজকে নাড়িয়ে দিচ্ছিল খুব। অনেকক্ষণ পর রাগান্বিতা মুখ খুললো। শীতল সুরে বললো,
“আপনার বুকখানায় আমার এত শান্তি কেন লাগছে ইমতিয়াজ ছাড়তে একটুও ইচ্ছে করছে না।”
ইমতিয়াজ চোখ বন্ধ করেই মুচকি হাসলো। বললো,
“ওটা তো তোমারই স্থান যতপারো শান্তি নেও আমি কিছু মনে করবো না বউ।”
রাগান্বিতার শরীর জুড়ে এক হিমশীতল হাওয়া বয়ে গেল যেন। সে হাসলো, আনমনা মুচকি হাসলো। কেমন এক অদ্ভুত শান্তি শান্তি লাগছে রাগান্বিতার, যা এর আগে কখনো লাগে নি।’
——-
রাত প্রায় সাড়ে আট’টা। পুরো বাড়ি জুড়ে অন্ধকার। বাহিরে প্রবল বেগে ঝড় চলছে। বাড়িতে বর্তমানে রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ ছাড়া কেউ নেই। রবিন চাচা তার বাড়িতে গিয়েছে, বিকেলের আবহাওয়া দেখেই ইমতিয়াজ বুঝেছিল রাতে ঝড় উঠবে তাই ঝড়ের আগেই যেন রবিন বাড়ি যেতে পারে তাই পাঠিয়ে দিয়েছে তার বউ বাচ্চাও অপেক্ষা করছে কি না। ইমতিয়াজ চুপটি করে নিজ রুমের পালঙ্কে বসে আছে পুরো রুমে অন্ধকার কিন্তু সে বিষয়ে তার কোনো আক্ষেপ নেই উল্টো এই অন্ধকারে বসে থাকতেই বড্ড ভালো লাগছে। কিছু একটা ভাবছে ইমতিয়াজ, নিজেকে বড্ড এলেমেলো লাগছে সে বুঝি সবটা গুলিয়ে ফেলছে নিজের পুরো গন্তব্যই যেন গুলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। হঠাৎই দুয়ার খোলার শব্দ আসতেই দুয়ারের দিকে তাকালো ইমতিয়াজ বাসন্তী রঙের লাল পাড়ের শাড়ি, মাথায় ঘোমটা, হাতে অলংকার, গায়ে অলংকার সঙ্গে ল্যাম হাতে রুমে প্রবেশ করলো রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ মুগ্ধ হয়ে শুধু তাকিয়েই রইলো ওর পানে। কি এক অদ্ভুত অনূভুতি কিছুতেই দমানো যাচ্ছে না। ইমতিয়াজ দৃষ্টি সরিয়ে ফেললো। রাগান্বিতা এগিয়ে আসলো ল্যামটা টেবিলের কর্নারে রেখে বললো,
“এভাবে অন্ধকারে বসে কি করছেন? খাবেন না।”
ইমতিয়াজ উত্তর দিলো না উল্টো প্রশ্ন করলো,
“তুমি এত সুন্দর কেন রাগান্বিতা?”
গাড়ো কাজলের আঁখিজোড়া নিয়ে শীতল দৃষ্টিতে ইমতিয়াজের দিকে তাকালো রাগান্বিতা। ধীর স্বরে লাজুকতা নিয়ে বললো,
“আপনার বউ বলে।”
কি এক উত্তর! পাল্টা কিছু বলতেই পারলো না ইমতিয়াজ। সে চুপ করে রইলো। অনেকক্ষণ পর বললো,
“তোমার এখানে অসুবিধা হচ্ছে না তো আমি কিন্তু কাল থেকে বাসায় থাকবো না দুপুরে আসতেও পারি নয়তো একবারে রাতে আসবো তোমার ভয় করবে না তো।”
রাগান্বিতা চুপ করে রইলো। রাগান্বিতাকে চুপ থাকতে দেখে আবারও বললো ইমতিয়াজ,
“কি হলো কথা বলছো না যে ভয় করবে বুঝি।”
রাগান্বিতা হাসলো। বললো,
“আপনি বোধহয় আমার সম্পর্কে সবকিছু এখনো জানেন নি রাগান্বিতা একা থাকতে ভয় পায় না।”
“খুব ভালো। চলো একসাথে খাই?”
কথাটা বলেই ইমতিয়াজ পালঙ্ক থেকে নামলো রাগান্বিতাও নামলো তারপর দুজন চললো নিচে একসাথে রাতের খাবারটা শেষ করার জন্য। বাহিরে তখনও তুমুলবেগে বৃষ্টি হচ্ছিল।’
—–
জানালার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে রাগান্বিতার বাবা। আকাশে ঘনকালো মেঘেরা ঝাপটে ধরে আছে। রাগান্বিতার বাবার ধারণার মতে তাদের এদিকে ঝড় বৃষ্টি না আসলেও আকাশের অবস্থা দেখে তিনি বেশ ধরে নিয়েছেন শহরের ওদিকে বেশ ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। রাগান্বিতার বাবার এসব ধারণা কখনোই ভুল হয় না। জোরে নিশ্বাস ফেললো রাগান্বিতার বাবা। মেয়েটা বাড়ি নেই দুইরাত হতে চললো। বুকের ভিতর খাঁ খাঁ করছে চারপাশ যেন শূন্য শূন্য লাগছে। রাগান্বিতার বাবার রুমটা থেকে কুহুর কবরটা দেখা যায় সেই বাঁশ ঝারের মধ্যে মেয়েটা শুয়ে আছে। না জানি কিভাবে আছে মেয়েটা। চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো রাগান্বিতার বাবা। মেয়ের বাবাদের বুঝি বড্ড জ্বালা।’
“বাবা আসবো?”
হঠাৎই রেজওয়ানের কণ্ঠটা কানে আসতেই দ্রুত চোখের পানি মুছে ফেললেন মোতালেব তালুকদার। ঘন নিশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করে বললেন,
“জি বললো,
রেজওয়ান এগিয়ে আসলো। বাবার পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
“বহুদিন তো হলো বাবা আমি গ্রামে এসেছি এবার তো আমার শহরে যাওয়া উচিত।”
রেজওয়ানের কথা শুনে অনেকক্ষণ চুপ থাকলেন মোতালেব তালুকদার। দৃষ্টি শান্ত রেখে বললো,
“তুমিও চলে যাবে রেজওয়ান।”
বাবার কথা শুনে বেশ খারাপ লাগলো রেজওয়ানের। সে বললো,
“আমি চলে আসবো বাবা আমার কিছু জিনিসপত্র আছে ওখানে ওগুলো নিয়েই চলে আসবো তোমায় একা থাকতে হবে না। আমি ফিরে এসে দুজন একসাথে জায়গা জমি দেখবো চাষাবাদ করবো। ঠিক আছে বাবা।”
মোতালেব তালুকদার যেন খুশি হলেন। বললেন,
“তুমি সত্যি বলছো গ্রামেই থাকবে তুমি।”
“হ্যাঁ বাবা। আমি থাকবো না পড়াশোনাও তো শেষ চাকরি করার ইচ্ছে থাকলেও এখন আর করবো না তোমার সাথেই থাকবো এখানে এসে কিছু করবো।”
রেজওয়ানের মাথায় হাত বুলালেন মোতালেব তালুকদার। বললেন,
“ঠিক আছে। তুমি ফিরে এলেই তোমার জন্য একটা লাল টুকটকে বউ খুঁজে আনবো আমি।”
এক্ষেত্রে কিছু বলে না রেজওয়ান লাজুক হাসে শুধু। যা দেখে রাগান্বিতার বাবা মিষ্টি হেঁসে বলে,
“তা কবে যেতে চাইছো শহরে?”
রেজওয়ান বেশি সময় না নিয়েই বললো,
“কালই যাই বাবা।”
“কিন্তু আকাশের যে অবস্থা।”
“চিন্তা করো না প্রকৃতি ঠিক-ঠাক থাকলেই যাবো বাবা।”
—–
রাত তখন একটু গভীরে। বলতে গেলে আজ রাগান্বিতার আর ইমতিয়াজের বাসররাত। কিন্তু রুমের মাঝে নেই কোনো সুভাশ্বোতা আর নাহি আছে রুমের কোনো সাজসজ্জা। তাও খারাপ লাগছে না রাগান্বিতার। সে চুপচাপ বসে আছে পালঙ্কে। দাদিমা আসার আগে অনেককিছু বলেছিল তাকে। দাদিমার কথা মতো একগ্লাস দুধও জোগাড় করে রেখেছে রাগান্বিতা। নিজেকে সাজিয়েছে একটু ভিন্নভাবে। বাসন্তী রঙটা রাগান্বিতার অনেক প্রিয় তাই তো এটাই পড়েছে। বাহিরে বৃষ্টি পড়া থেমেছে। তবে বাতাস বিদ্যমান। আজই প্রথম রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ একই পালঙ্কে একই সঙ্গে ঘুমাবে। রাগান্বিতা মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে বড্ড সংশয় লাগছে মনে। কেমন একটা ঝিম ঝিম ভাব। বলতে বলতে সময় গড়ালো। ঠকঠক শব্দ করে রুমে এগিয়ে আসছিল কেউ। রাগান্বিতা ভাবলো ইমতিয়াজ এসেছে। সে মাথা নিচু করে চুপটি করে বসে রইলো। ঠকঠক শব্দটা ধীরে ধীরে আরো যেন বেড়ে গেল। রাগান্বিতার এবার কেমন যেন লাগলো এভাবে শব্দ করে ইমতিয়াজ তো কখনো হাঁটে না। আর হাঁটলেও এতক্ষণে তো ঘরে চলে আসার কথা। ঠকঠক শব্দটা কানে আবার বাজলো। রাগান্বিতা সে কি ভেবে যেন পালঙ্ক ছেড়ে নামলো। আস্তে আস্তে এগিয়ে যেতে লাগলো সামনে। ঘরে তো সে আর ইমতিয়াজ ছাড়া কেউ নেই তবে ঠকঠক শব্দটা করছে কে! ইমতিয়াজই করছে কি!
নানাবিদ ভাবনা ভেবে হাতে ল্যামটা নিয়ে চললো রাগান্বিতা। ঘরের দুয়ার খুলে যেই না বের হবে এরই মাঝে দুয়ারের সামনে এসে দাঁড়ালো ইমতিয়াজ৷ এতে খানিকটা ভড়কে গিয়ে দু’পা পিছিয়ে যায় রাগান্বিতা। রাগান্বিতার রিয়েকশন দেখে বললো ইমতিয়াজ,
“কি হলো কোথায় যাচ্ছো তুমি?”
রাগান্বিতা থরথর করে বললো,
“কে যেন বাহিরে ঠকঠক করে আওয়াজ করছিল?”
ইমতিয়াজ হাসে। নিজের হাতের কোদালটা দেখিয়ে বলে,
“ঠকঠক সে তো এ করছিল।”
রাগান্বিতা এবার তাকালো ইমতিয়াজের হাতের কোদালটার দিকে। অবাক স্বরে বললো,
“আপনি এইসময় হাতে কোদাল নিয়ে কি করছিলেন?”
ইমতিয়াজ গম্ভীর আওয়াজে বলে,
“যদি বলি তোমায় খুন করতে আসছিলাম বউ।”
চলবে……