প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-১৭

0
514

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-১৭
________________
জোৎস্না ভরা আলো। নদীতে থৈ থৈ করছে পানি। ঢেউয়ের স্রোতে ভাসছে কতকিছু। জাহাজ ছুটছে নিজ মনে। পরিবেশটা চুপচাপ। এমনই চুপচাপ পরিবেশে জাহাজের এক কিনারায় পা ঝুলিয়ে বসে ছিল রাগান্বিতা আর ইমতিয়াজ। এখনো বসে আছে তারা তবে রাগান্বিতা ঘুমিয়ে পড়েছে কখন যে কথা বলতে বলতে ইমতিয়াজের কাঁধে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো বুঝতে পারে নি। ইমতিয়াজের হাত খুব শক্ত করে ধরে আছে রাগান্বিতা। কোনো দ্বিধা নেই তার মাঝে কেমন শক্ত করে ধরে আছে। ইমতিয়াজের দৃষ্টি রাগান্বিতার সেই হাতের মাঝেই “মেয়েটা এত দ্রুত তাকে এত বিশ্বাস করছে কি করে? খুব গভীর ভাবেই কি ইমতিয়াজের প্রতি আসক্ত হচ্ছে রাগান্বিতা। আচমকাই রাগান্বিতার মাথাটা ইমতিয়াজের কাঁধ থেকে সরে যেতে নিলো সঙ্গে সঙ্গে ইমতিয়াজ ধরলো তাকে নিচে পানিগুলো কেমন জোরে জোরে ভেসে যাচ্ছে কেউ পড়ে গেলে আর বাঁচার উপায় নেই। ইমতিয়াজ কতক্ষণ কি যেন ভাবলো এরই মাঝে রাগান্বিতা চোখ খুলে নিস্তব্ধ স্বরে বললো,
“ইমতিয়াজ কি সত্যি আঘাত দিতে জানে প্রিয়?”

ইমতিয়াজ যেন থমকে গেল রাগান্বিতার কথা শুনে।কথার অর্থটা যেন ধরতে পারলো না। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“মানে?”
“মানে কিছু না আমায় নিয়ে কেভিনে চলুন। পড়ে গেলেই তো মরে যেতাম খুঁজে আর পেতেন না।”

বলেই হেঁসে ফেললো রাগান্বিতা। ইমতিয়াজ শুধু ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে ছিল রাগান্বিতার চোখের দিকে। বোধহয় বুঝলো কিছু তবে জবাবে কিছু বলে নি। নীরবতা নিয়ে অনেকক্ষণ কাটার পর ধীরে সুস্থে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো ইমতিয়াজ রাগান্বিতাকেও উঠালো মেয়েটার তখন পড়ে যেতে নিতেই ঘুমটা হাল্কা হয়ে গেছিল। ইমতিয়াজ হাত ধরে রাগান্বিতাকে নিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,
“আমায় এত বিশ্বাস করছো কেন?”

রাগান্বিতা ঘুমু ঘুমু কণ্ঠতেই বলে,
“বারে আপনি আমার মনের মানুষ আপনায় আমি বিশ্বাস করবো না। জানেন আপনায় যেদিন প্রথম ওই সন্ধ্যেবেলা বাঁশি বাজাতে দেখেছিলাম সেদিনই আপনার প্রতি আমি একটা টান সঙ্গে কেমন একটা অনভূতি অনুভব করি। ধীরে ধীরে অনুভূতিগুলো বেড়ে যায়। ভেবেছিলাম আপনার বিরহ নিয়েই সারাজীবন কাটাতে হবে। কিন্তু দেখুন কি এক আশ্চর্যকর বিষয় শেষমেশ আপনার সাথেই বিয়ে হয়ে গেল। আমার ভাগ্যে বোধহয় আপনিই ছিলেন।”

রাগান্বিতার প্রত্যেকটা কথাই মন দিয়ে শুনলো ইমতিয়াজ জবাবে কিছু বললো না। ইমতিয়াজ রাগান্বিতাকে নিয়ে এসে কেভিনে শুয়ে দিল। বললো,
“ঘুমাও বাকি কথা কাল হবে।”

রাগান্বিতা মিষ্টি হাসে। বলে,
“আপনিও ঘুমান।”

রাগান্বিতার পাশে বসে ইমতিয়াজ। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
“ঘুমাবো তুমি আগে ঘুমাও।”

রাগান্বিতা শুনলো। ইমতিয়াজের হাতের স্পর্শে এক অজানা ভালোলাগা অনুভব করলো রাগান্বিতা। চোখ বুজে নিলো নিমিষেই। মনে মনে ভাবলো,
“সে বুঝি সত্যি খুব ভাগ্যবতী।”

সময় গড়ালো রাগান্বিতা ঘুমিয়ে পড়লো ইমতিয়াজ বসে ছিল পুরোটা সময়। তার মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে বুঝি সবটা এলেমেলো হয়ে যাচ্ছে। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না।
—–
ভোরের প্রভাতি আলো। প্রকৃতি ধীরে ধীরে হচ্ছিল পরিষ্কার। রাগান্বিতা অনেক আগেই ঘুম থেকে উঠে নামাজ সেরে নেয় গায়ের গহনাগাটি খুলে ব্যাগে ভরেছে তারও আগে। ইমতিয়াজ কেভিনে নেই নামাজ সেরে কোথায় যেন গেছে তাকে বলেছে সবটা গুছিয়ে নিয়ে বোরকা পড়ে তৈরি হতে আর কিছুক্ষণের মাঝেই তারা ঢাকায় পৌছাবে। রাগান্বিতাও শোনে বর্তমানে গায়ে হাল্কা কিছু গহনা আর শাড়ি পড়া। রাগান্বিতা চিরুনী দিয়ে তার প্যাচিয়ে যাওয়া চুলগুলো আঁচড়িয়ে খোপা করতে ব্যস্ত এখন। এমন সময় কেভিনের দরজায় নক করলো ইমতিয়াজ। মৃদুস্বরে বললো,
“আসবো?”

রাগান্বিতা মাথায় শাড়ির আঁচলটা দিয়ে বললো,
“জি আসুন।”

ইমতিয়াজ ভিতরে ঢুকলো লাল টুকটকে শাড়িতে রাগান্বিতাকে কি মায়াবী দেখাচ্ছে। ইমতিয়াজ দৃষ্টি সরিয়ে তার হাতে করে আনা এক কাপ চা আর একটা বিস্কুটের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললো,
“খেয়ে নেও। আমি বাহিরে আছি। খেয়ে তৈরি হয়ে আমায় ডেকো।”

উত্তরে রাগান্বিতা শুধু মাথা নাড়ালো। ইমতিয়াজ বেরিয়ে গেল। রাগান্বিতা মুচকি হেঁসে বেডে বসলো। তারপর খেতে লাগলো ইমতিয়াজের দিয়ে যাওয়া চা আর বিস্কুট।’
—-

বাড়ির উঠানে থমথমে চেহারা নিয়ে বসে আছে মোতালেব তালুকদার। মাহাদের মৃত্যুটা যেন কেমন সবটা এলেমেলো করে দিলো। দুশ্চিন্তার পাহাড় যেন আরো বেড়ে গেল ‘মেয়েটা সুখে থাকবে তো’ কথাটা যেন বারংবার মাথায় বারি মারছে মোতালেব তালুকদারের। তার কাঁধে হাত রাখলো দাদিমা। বললেন,
“চা খাবি না?”
“কিছু ভালো লাগছে না তুমি খাও গিয়ে।”

দাদিমা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন,
“পোলাডারে কে মারতে পারে জানো কিছু।”

‘না’ বোধক মাথায় নাড়ায় রাগান্বিতার বাবা সাথে নিম্নস্বরে বলে,
“কে মারলো জানতে না পারলেও কেন যেন মনে হচ্ছে রাগান্বিতার সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার জন্যই কেউ মেরে দিয়েছে। এখন যদি ইমতিয়াজেরও কেউ ক্ষতি করে তখন!”

মোতালেব তালুকদার খানিকটা ঘাবড়ালেন। মোতালেবের কথাগুলো ঠিক শুনলো না দাদিমা। তাই প্রশ্ন করলেন,
“কিছু কইলি?”

চমকে উঠলো রাগান্বিতার বাবা। দাদিমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“না। তুমি বরং ঘরে যাও।”

দাদিমা শুনলেন আর কথা না বারিয়ে চলে গেল বাড়ির ভিতর। অন্যদিকে দরজার সামনে মাত্রই এসে দাঁড়িয়ে ছিল রেজওয়ান ভেবেছিল বাবাকে শহরে যাওয়ার কথাটা বলবে কিন্তু আর বলতে পারলো না। সে বুঝেছে বোনের চিন্তায় বাবা খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্থ।’
—-
পুরনো একটা বাড়ি, খুবই পুরনো বাড়িটা। বাড়িটার আশপাশের দূর দূরান্ত পর্যন্ত তেমন কোনো বাড়িঘর নেই। আশেপাশে ঘোর জঙ্গল টাইপের। গাছপালায় ভরপুর। কিছুটা গা ছমছমে বিষয়। রাগান্বিতা আশেপাশে তাকিয়ে বললো,
“আপনি এখানে একা থাকতেন?”

ইমতিয়াজ মাথা নাড়িয়ে বললো,
“হুম। তবে একজন আছে যে আমায় মাঝে মাঝে রান্নাবান্না করে দিয়ে যায়। ভিতরে চলো দেখতে পাবে।”

রাগান্বিতা শুনলো আশপাশ দেখতে দেখতেই এগিয়ে গেল। বাড়ির উঠানে শেওলা জমেছে বোঝাই যাচ্ছে অনেকদিন যাবৎ এখানে কি কেউ ছিল না। রাগান্বিতা বুঝতে পেরেছে তাকে অনেক কাজ করতে হবে এই জায়গা ঘর সবটা গোছাতে হবে। রাগান্বিতা ধীরে সুস্থ এগিয়ে গেল ভিতরে। বাড়ির দরজার সামনে আসতেই রাগান্বিতা বললো,
“আপনার এখানে একা থাকতে ভয় করতো না?”

ইমতিয়াজ খানিকটা হাসে। বলে,
“না। অভ্যাস হয়ে গেছে তোমারও হয়ে যাবে দেখে নিও।”

রাগান্বিতা পাল্টা কিছু বললো না। ইমতিয়াজ দরজায় নক করলো। বললো,
“রবিন চাচা দরজা খুলো।”

ইমতিয়াজের ডাকার চার মিনিটের মাথাতেই দৌড়ে আসলো রবিন। দরজা খুললো দ্রুত। বললো,
“ইমতিয়াজ তুমি আইছো?”

ইমতিয়াজও হাল্কা হেঁসে বললো,
“হুম।”

হঠাৎই রবিনের নজরে আসলো বোরকা পরিধিত এক রমণীর দিকে। সে বেশ অবাক হয়ে বললো,
“এ কে?”
“তোমার বউমা চাচা।”

সঙ্গে সঙ্গে যেন বড় ধরনের ধাক্কা খেল রবিন চাচা। অদ্ভুত স্বরে বললো,
“তুমি বিয়ে করছো ইমতিয়াজ?”

উত্তরে এক শব্দে জবাব দিলো ইমতিয়াজ,
“হুম।”


ইমতিয়াজের পিছু পিছু বাড়ির ভিতর ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলো রাগান্বিতা। পর পর কয়েকটা রুম পার হতেই একটা রুম ছিল তালাবদ্ধ। সব রুমের দরজা খোলা এটার তালাবদ্ধ কেন কথাটা মাথায় আসলেও খুব বেশি ভাবলো না রাগান্বিতা। ধীরে ধীরে চলছিল ইমতিয়াজের পিছন পিছন। সবার মাঝখানে একটা রুম ছিল ইমতিয়াজ রাগান্বিতাকে নিয়ে সেই রুমটাতেই ঢুকলো। রাগান্বিতাও ঢুকলো। দেয়ালের এক কর্নারে ছোট্ট একটা খাট। খাটের পাশে ছোট্ট টেবিল তাতে কিছু বই রাখা। পেপার পেন্সিল আঁকাআকির সরঞ্জামও ছিল। খাটের বিপরীতেই বিশাল একটা জানালা। পর্দা দেয়া শুধু, ইমতিয়াজ সর্বপ্রথম জানালার পর্দাগুলো সরালো সঙ্গে সঙ্গে দিনের ফুড়ফুড়ের আলো এসে সোজা এসে পড়লো রুমে। পুরো রুম হলো চকচকে। ছোট ছোট আসবাবপত্র আর একটা কাঠের আলমারী ছিল রুমে। পুরো রুমটাকেই চোখ বুলালো রাগান্বিতা। রুমটা তার ঠিক কতটুকু ভালো লেগেছে জানা নেই। হঠাৎই ইমতিয়াজ বললো,
“তুমি বসো আমি একটু আসছি।”

রাগান্বিতা খানিকটা থমথমে গলায় বললো,
“কোথায় যাচ্ছেন?”

ইমতিয়াজ হাসে খানিকটা কাছে যায় রাগান্বিতার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“কেন ভয় করছে বুঝি!”

রাগান্বিতা দু’কদম সরে এসে বললো,
“না তো।”

মৃদু হাসে ইমতিয়াজ। বলে,
“বুঝেছি। তুমি বসো আমি দেখি রবিন চাচা কতদূর কি গোছাচ্ছেন খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে তো।”
“আমি রান্না করি?”
“করবে তো তবে এখন নয় পরে।”

রাগান্বিতা আর কিছু বললো না। ইমতিয়াজ চলে গেল। ইমতিয়াজ যেতেই রাগান্বিতা তার বোরকা নিকাব খুলে রাখলো খাটে। খোঁপা করা চুলগুলো আলগা হয়ে আপনাআপনি খুলে গেছিল। সেগুলো হাত দিয়ে আবার খোঁপা করতে করতে হঠাৎই বাড়ির জানালায় একটা কবুতর আসলো। পায়ে তার চিঠি। কবুতরটিকে দেখেই বুকটা যেন দক করে উঠলো রাগান্বিতার। থমথমে গলায় বললো,
“আবার চিঠি!’

#চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে