#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-১৪
________________
গায়ে হলুদ লাগিয়ে নিশ্চুপে বাড়ির উঠানে বসে আছে রাগান্বিতা। বুক ভরা দীর্ঘশ্বাস ব্যতীত আর কিছু ফিল হচ্ছে না। সেই দীর্ঘশ্বাসের ভিড়েই গায়ে কলসি ভরা ঠান্ডা পানি ঢালা হলো গায়ে, করানো হলো গোসল। গায়ে বয়া হলুদগুলো নিমিষেই একটু একটু করে মুছে যাচ্ছিল শরীর থেকে। রাগান্বিতা তার চোখ বন্ধ করে নিলো। সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠলো সেই ভরসন্ধ্যা বেলা বাঁশির সুর শুনে দেখতে যাওয়া সেই ইমতিয়াজ সিকদারকে। রাগান্বিতা চোখ খুলে ফেললো এটা কি ঠিক হচ্ছে বিয়ের আসরে অন্য পুরুষের চেহারা ভেসে ওঠা। রাগান্বিতা চোখ খুলে ফেললো আর ভাবলো না কিছু।
অন্যদিকে কলাগাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল ইমতিয়াজ সে এসেছিল এক ঝলক হলদে রাঙা রাগান্বিতাকে দেখতে। এক ঝলক দেখলো। নিচু স্বরে আওড়ালো,
“তুমি এত মায়াবী কেন রাগান্বিতা! তোমাকে দেখলেই আমার বড্ড মায়া লাগে।”
ইমতিয়াজ কথাটা বলেই চলে গেল। হঠাৎই রাস্তার পথে দেখা মিললো রাগান্বিতার বাবার সাথে তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল রেজওয়ান দুজনেই বিয়ের কাজে ব্যস্ত। ইমতিয়াজ তেমন কিছু না বলেই পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলো তাদের, কিন্তু যাওয়া আর হলো না তাকে ডাকলেন রাগান্বিতার বাবা। বললেন,
“এই ছেলে তুমি ইমতিয়াজ না এখানে কি করছো?”
ইমতিয়াজ এগিয়ে গেল স্পষ্ট ভাষায় বললো,
“জি জমিদার সাহেব আমি ইমতিয়াজই,ইমতিয়াজ সিকদার।”
“হুম ঠিক আছে, ঠিক আছে। এখানে কি করছো?”
“তেমন কিছুই করছি না আসলে কাল চলে যাবো তো তাই একটু গ্রাম ঘুরতে বেরিয়ে ছিলাম কিন্তু কখন যে আপনাদের বাড়ির পিছনে চলে এসেছি বুঝতে পারিনি তাই চলে যাচ্ছি আপনাদের বিব্রত করার জন্য দুঃখিত!”
রাগান্বিতার বাবা কেন যেন মুগ্ধ হলেন ইমতিয়াজের কথা শুনে কত সহজে সত্যি কথা নিরদ্বিধায় বলে দিল আবার ক্ষমাও চাইলো। রাগান্বিতার বাবা হাল্কা একটু হাসলেন বললেন,
“ঠিক আছে কোনো ব্যাপার না। কাল বিয়েতে কিন্তু অবশ্যই এসো।”
“জি অবশ্যই আসবো। রাগান্বিতাও বলেছিল আমি যেন বিয়েটা খেয়ে যাই। আমি বিয়ে খেয়েই চলে যাবো। যতই হোক জমিদার কন্যার বিয়ে না আসলে হয়।”
“হুম এসো।”
“জি আজ তাহলে আসি জমিদার সাহেব?”
“হুম এসো।”
ইমতিয়াজ আর দাঁড়ালো না চলে গেল সামনে। তবে যাওয়ার আগে রেজওয়ানের দিকে তাকিয়ে এক ঝলক মিষ্টি হেঁসেছিল রেজওয়ানও হেঁসেছে। ইমতিয়াজ বাড়ির বাহিরে বেরিয়ে গেল। দূর থেকে বাড়ির বারান্দার পথ পেরিয়ে ভেজালো শরীরে গামছা পেঁচিয়ে যাওয়া রাগান্বিতা তা খেয়াল করলো। সে বুঝেছে ইমতিয়াজ এসেছিল কিন্তু তার সাথে দেখা হলো না। কিন্তু সে তো জানলো না, আড়ালে একঝলক তাকে দেখেই চলে যাচ্ছে ইমতিয়াজ!’
——–
রাতের আকাশ জুড়ে ঝলমল করছে তারা, চাঁদ উঠেছে মাঝখান দিয়ে। গাছের পাতা নড়ছে বারংবার। কি ছমছমে ব্যাপার! রাগান্বিতা দাঁড়িয়ে আছে তার রুমের জানালার ধারে। কাল এমন সময় বুঝি সে থাকবে শশুর বাড়ি। মাহাদ নামের ছেলেটি হয়ে যাবে তার স্বামী। রাগান্বিতার কেন যেন খারাপ লাগছে মাহাদকে তার স্বামী হিসেবে মানতে, কেন যেন মেনে নিতে ইচ্ছে করছে না। রাগান্বিতার ইমতিয়াজকে বড্ড মনে ধরেছে তার জন্য মনটা কাঁদছে। একটা ষোলো বয়সী কন্যার মাথায় এসব ভাবনা আসা কি আধও সঠিক। সে বুঝি ভুল করছে যা হওয়ার নয় তা নিয়ে ভাবছে এগুলো ঠিক হচ্ছে না। রাগান্বিতা চোখ বন্ধ ফেললো।
.
একটা সুন্দর সকাল। বিয়ের আমেজে চারপাশ মুখরিত। বাড়ির উঠানে এক কর্নারে ইট পেতে চুলা বানিয়ে বড় বড় ডেগে বিয়ের রান্নার কাজ চলছে। পর পর দুটো ইটের চুলোয় রান্না হচ্ছে। গ্রামের সকলে হাতে হাতে কাজ করছেন। বাবুর্চিও ডাকা হয়েছে। রাগান্বিতার চাচা মজিদ তালুকদার দারুণ রান্না করেন গ্রামগঞ্জের কোনো বিয়ের অনুষ্ঠান পড়লেই সবার আগে তাকে ডাকা হয়। সেও ভাবে নি হঠাৎ করেই ভাইজান রাগান্বিতার বিয়ে দিয়ে দিবে। তবে আবার ভাবলো বুঝি বড় মেয়েটার কার্যক্রমের ভয়ে।’
দুপুর ঠিক বারোটা। কাটফাটা রোদ্দুর উঠেছে গ্রাম জুড়ে। গরমের তৃষ্ণায় বুঝি সবারই প্রাণ যায় যায়। সেই রোদের তাপেই বাড়ির উঠানে পা রাখলো ইমতিয়াজ। পড়নে তার সাদা পাঞ্জাবি। চুলগুলো গোছানো, চোখে চশমা নেই। চশমাটা সবসময় ঠিক লাগে না ইমতিয়াজের মাঝে মধ্যে মাথা ব্যাথা করলে পড়ে। আর কতক্ষণ পরই রাগান্বিতার বিয়ে কাজী সাহেবও ইতিমধ্যে এসে পৌঁছেছে রাগান্বিতাদের বাড়ির উঠানে। রান্নার কার্যক্রম প্রায় শেষের দিকে ফিন্নি চড়িয়েছেন তারা তাও হয়ে এসেছে। খাবার শেষে ফিন্নি দেয়া এখানকার একটা রিচুয়াল বলা যায়। সব বিয়ের ক্ষেত্রেই ফিন্নিটা মাস্ট থাকবেই।
ইমতিয়াজ এদিকে সেদিক ঘুরে তাকিয়ে চলে গেল বাড়ির ভিতরে। হাতে তার একগুচ্ছ গোলাপ ফুল। ইমতিয়াজ নিরদ্বিধায় সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলো ঘর ভর্তি মানুষের আনাগোনা থাকায় তাকে কেউ তেমন নজরে আনলো না।’
দুপুরের রোদ্দুরে পোড়া গরমের মাঝে হাতে পাখা নিয়ে আতিব আর গ্রামের ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা গোল হয়ে বসে আছে রাগান্বিতার পাশে। রাগান্বিতাকে বাতাস করছে তারা। রাগান্বিতার বুকটা কেমন যেন করে উঠলো তার মনে হলো আবার বুঝি কেউ এলো। পরান পাখি বড্ড ছটফট করছে তার। সেই ছটফটের মাঝেই তার রুমের দরজায় নক করলো কেউ। স্পষ্ট স্বরে ভেসে আসলো এক পুরুষালির কণ্ঠ। কানে বাজলো কেউ বললো,
“আসবো?”
রাগান্বিতা থমকে গেল বিয়ের ভাড়ি সাজ আর গাড়ো চোখের কাজল নিয়ে সে তাকালো দুয়ারের দিকে। সাদা পাঞ্জাবি পরিধিত চশমা বিহীন দেখা মিললো সেই মানুষটির। সে দেখলো, গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ছেলেটার দিকে। কি সাহস ছেলেটার এভাবে এসে পড়লো তার রুমে। কেউ দেখে ফেলার ভয়ডর নেই নাকি। রাগান্বিতা চোখের ইশারায় ভিতরে আসতে বললো। ইমতিয়াজ এলো, রাগান্বিতা ধীরে ধীরে লাল বেনারসি ধরে বিছানা ছেড়ে নামলো। ইমতিয়াজ তার চোখের তৃষ্ণা মিটালো। লাল রঙা বেনারসি শাড়ি, গা ভর্তি গহনাগাঁটি, কোমড়ে বিছা, হাত ভর্তি সোনার অলংকার, নাকে অলংকার, ঠোঁটে লিপস্টিক, কাজল কালো চোখ। রাগান্বিতার এই রূপ যেন নিমিষেই গোটা এক পুরুষজাতি ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে। মেয়েটা এত বেশি সুন্দর কেন?
ইমতিয়াজ চোখ সরিয়ে ফেললো। নীরবে বললো,
“আপনার এই রূপের কাছে আমার আনা এই হাতের গোলাপও বুঝি তুচ্ছ লাগছে রাগান্বিতা।”
রাগান্বিতা কিছু বলে না তাকায় ইমতিয়াজের হাতের ফুলগুলোর দিকে। বলে,
“আমার জন্য?”
সম্মতি জানায় ইমতিয়াজ। বলে,
“হুম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে না আনাই ঠিক ছিল। আপনি নিজেই তো একটা জলন্ত ফুল।”
রাগান্বিতা এবারও এ কথার জবাব দেয় না। নিজের হাতটা এগিয়ে দিয়ে বলে,
“এনেছেন যখন দিন আমায়।”
ইমতিয়াজ দিল। বললো,
“একটু সাবধান কাটা ছাড়িয়েছি তাও আল লাগতে পারে।”
“একটু না হয় লাগুক ক্ষত। আপনায় তো আর পাওয়া হলো না আপনার দেয়া ফুলের আঘাতই না হয় নিলাম।”
ইমতিয়াজ হাসে। ফিস ফিস করে বলে,
“ইমতিয়াজ যে খুব ধারালো অস্ত্র ষোড়শী কন্যা যাকে ধরতে গেলে ক্ষত ছাড়া আর কিছুই মিলতো না।”
রাগান্বিতা এবার দমলো না। নিজেও ফিস ফিস করে বললো,
“ইমতিয়াজ পাথর হলে রাগান্বিতাও সেই পাথরে ফুঠে ওঠা ফুল হতো। মিলন হলে আঘাত শেষে সেই অস্ত্রের ধার কমিয়ে প্রেমের ফুল ফোটাতো।”
ইমতিয়াজ দু’কদম পিছিয়ে গেল। বিস্মিত স্বরে বললো,
“ইমতিয়াজের মায়াতে বেশি আটকিয়েও না মেয়ে, সে যে ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই দিতে পারবে না।”
কথাটা বলেই আর দাঁড়ালো না ইমতিয়াজ দ্রুত নিচে চলে এলো। রাগান্বিতা ঠায় দাঁড়িয়ে শুধু দেখেই গেল ইমতিয়াজের যাওয়াটা আচমকাই হাতে কাটা বিঁধলো রাগান্বিতার সে তাকালো তার হাতের দিকে বাম হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। আঘাত লেগেছে। রাগান্বিতা স্তব্ধ হয়ে আঘাত প্রাপ্ত আঙুলের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আপনি কাঁটার আঘাতই দিলেন ইমতিয়াজ,ভালোবাসার সুভাস আর ছড়াতে পারলেন না।”
—-
সময় গড়ালো দুপুর ছাড়িয়ে বিকেল হওয়ার পূর্বাভাস আসছে। চিন্তিত মুখে বসে আছে সবাই কারন বরপক্ষের আসার কোনো নাম গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে না। কথা ছিল যোহরের নামাজ সেরেই বিয়ে পড়ানো হবে। কিন্তু যোহর পেরিয়ে আসর চলে আসলো তাও তাদের খবর নেই। রাগান্বিতার বাবার মাথায় হাত সে কিছু বুঝতে পারছে না। কাশেমকে পাঠিয়েছে মাহাদের বাড়ি খবর আনতে। অনেক্ক্ষণ পর কাশেম ছুটে আসলো। থমথমে কণ্ঠে বললো,
“সর্বনাশ হইয়া গেছে ভাইজানেরা মাহাদকে নাকি খুঁইজ্জা পাওয়া যাচ্ছে না কাল রাইত থেইক্কা।”
সঙ্গে সঙ্গে পুরো জমিদার বাড়ি থমকে গেল। রাগান্বিতার বাবা পড়ে যেতে নিলেন তাকে ধরলো রেজওয়ান। এটা কি হলো! এখন মেয়েটার জীবনটার কি হবে? বিয়ে ভেঙে যাওয়া মেয়েকে কেউ কি আর বিয়ে করতে চাইবে! কিন্তু মাহাদ গেল কই! হঠাৎ করে নিখোঁজ হলো কেন!’
#চলবে……