#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-১৩
________________
বাড়ি জুড়ে উৎসবের মেলা। গায়ে হলুদের তোড়জোড় চলছে সকাল থেকে। লাল, নীল, হলুদসহ নানা রঙের রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো হয়েছে রাগান্বিতাদের বাড়ির উঠোনটা। গ্রামের আশপাশের মেয়ে বউরা ভীড় করছে রাগান্বিতাদের বাড়ির চারদিকে। গায়ে হলুদের জন্য হলদি, গিলা, মেহেন্দি পাতা, পান সুপুারিসহ ল্যাম দিয়ে সাজানো হচ্ছে ডালা। কোলে কলসি চেপে আম গাছের মাঝখানের ডালসহ পাতা দিয়ে কলসির মুখের ভিতর দিয়ে খানিকটা ঢেকে বাড়ির উত্তর দিকের বড় খালটায় দিকে যাচ্ছে সবাই পানি আনার জন্য। সেই পানি দিয়েই, রাগান্বিতার গায়ে হলুদ মাখিয়ে গোসল করানো হবে।’
বিয়ের তোড়জোড়ে পুরো তালুকদার ভিলা মেতে উঠেছে। রাগান্বিতার বাবা সকাল থেকেই এটা ওটা নিয়ে কাজ করেই যাচ্ছেন রেজওয়ানও বসে নেই। তালুকদার ভিলার কাজের লোক রামুকেও খবর দেয়া হয়েছিল কিন্তু তার বাবা অনেক অসুস্থ থাকায় আসতে পারি নি।’
বাড়ির উঠানে পাটা পুঁতা বিছিয়ে হলুদ,গিলা আর মেহেন্দি পাতা বাটছেন রাগান্বিতার দাদিমা, সঙ্গে নারীরা তাদের প্রচলিত হয়লা গান করছেন। আনন্দে মাতয়ারা হচ্ছে পুরো তালুকদার ভিলা। ছোট ছোট বাচ্চারা নাচছে মন খুলে, গ্রামবাসীরা কাজ করছে আনন্দ নিয়ে।
গায়ে হলুদ রঙের একটা শাড়ি পড়ে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে রাগান্বিতা। হলদে ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে তাকে। রাগান্বিতার মন ভালো নেই তার বড্ড খারাপ লাগছে এই মুহূর্তে তার বিয়ে করার একদমই কোনো ইচ্ছে নেই। কিন্তু বাবা, রাগান্বিতা তার গালে হাত দিলো বাবার দেয়া চড়টা সে মনে করলো এমনটা নয় রাগান্বিতা খুব বেশি আঘাত পেয়েছে বাবার চড় দেয়ার জন্য তার খারাপ লাগছে তার থেকে তার বাবা কিছু লুকাচ্ছে বলে।
রাগান্বিতা বুঝেছে কোনো এক অজানা ভয়ের কারণে তার বাবা তাকে বিয়ে দিতে চাইছে সঙ্গে এই কেশবপুর ছাড়ার জন্য বলছে। কিন্তু এমন কি থাকতে পারে যার জন্য তার বাবা তাকে দূরে সরানোর জন্য এতটা উতলা হয়ে গেছে। তাকে পাঠানো ওই চিঠিগুলো কে লেখে এটাই বুঝতে পারছে না রাগান্বিতা? এই গ্রামের যে কেউ নয় এটা সে বুঝেছে। তবে কোথাকার সে?”
রাগান্বিতার রুম কড়া নাড়লো। রাগান্বিতা পিছন ঘুরলো তার রুমের দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে আতিক। মুখটা শুঁকনো। রাগান্বিতা এগিয়ে গেল। ধীর স্বরে বললো,
“কিছু কি বলবি?”
আতিক তার দিকে একটা চিরকুট এগিয়ে দিয়ে বললো,
“এইডা আমনের জন্য আফা।”
রাগান্বিতা নিলো। বিস্মিত হলো খুব। বললো,
“এটা কোথায় পেলি তুই?”
আতিক কিছু বললো না দৌড়ে ছুটে গেল নিচে। রাগান্বিতা ডাকলো একবার কিন্তু তাও সে দাঁড়ালো না। রাগান্বিতা চিঠিটার দিকে চেয়ে রইলো অনেকক্ষণ। তার রাগ হলো, নাকি ভালো লাগলো, নাকি অবাক হলো, নাকি ঘাবড়ে গেল কোনোটাই বুঝলো না। কারণ এই মুহূর্তে তার মধ্যে এই চিরকুটের প্রতি কোনো অনূভুতি কাজ করছে না। রাগান্বিতা তাও চিরকুটটা খুললো। দুইটা অক্ষর লেখা ছিল শুধু,
“ঠিক দ্বিপ্রহর!’
রাগান্বিতা শব্দ দুটো উচ্চারণ করলো তবে বেশি ভাবলো না। এই বাক্যের হাতের লেখা ভিন্ন এ ব্যক্তি সে নয়। এবার রাগান্বিতার টনক নড়লো এ যখন সে নয় তাহলে কে? রাগান্বিতার ভাবনার মাঝেই দাদিমা রুমে হাজির হলেন। বললেন,
“রাগান্বিতা আহো তোমারে এহন হলুদ মাখানো হইবো।”
রাগান্বিতা চমকে উঠলো হাত থেকে চিরকুটটা পড়ে গেল তার। পরমুহূর্তেই পা দিয়ে সেটা চেপে ধরে দাদিমার দিকে ঘুরে তাকালো। বললো,
“তুমি যাও আমি আসছি।”
“রাগ হইও না বুবু দেখবা তোমার জীবনডা অনেক সুখের হইবো।”
রাগান্বিতা শুনলো মাথা নাড়িয়ে বললো,
“আমি রাগ হই নি আমি বুঝেছি তোমরা কোনো কারণে আমার ভালোর জন্যই এই বিয়েটা দিতে চাইছো। বাবাকেও বলে দিও আমার তার প্রতি কোনো অভিযোগ নেই।”
রাগান্বিতার বাবা শুনলেন কারণ সে মেয়ের রুমের দরজার বাহিরেই যে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মাত্রই আসলেন তিনি দাদিমার পিছন পিছন রাগান্বিতার অবস্থাটা বুঝতে। রাগান্বিতার বাবা জানে তার মেয়ে খুশি নেই তারপরও কি করার। রাগান্বিতার বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওখান থেকে চলে গেলেন।’
এদিকে দাদিমা। বললো,
“চলো তাইলে এহন? তোমারে গায়ে হলুদ করান লাগবো।”
“হুম আসছি আমি তুমি যাও।”
দাদিমাও শুনলেন আর জোর না করে বললেন,
“ঠিক আছে। একটু তাড়াতাড়ি আইয়ো।”
“হুম আমি এক্ষুনিই আসছি।”
দাদিমাও আর কথা না বারিয়ে চলে গেলেন। দাদিমা যেতেই রাগান্বিতা পায়ের নিচ থেকে চিরকুটটা বের করে তার পড়ার টেবিলের ডয়ারের ভিতরে রাখলো। তারপর আর না ভেবে দ্রুত ছুটে গেল নিচে।
—–
নিজের সেই ছোট্ট কুঁড়েঘরের নিচে মাটিতে মাথার নিচে দুই হাত দিয়ে শুয়ে আছে ইমতিয়াজ। কাল রাগান্বিতার বিয়ে। এই বিয়ে খেয়েই সে চলে যাবে। শহরের তার ব্যবসার না জানি তাকে ছাড়া কি অবস্থা হচ্ছে। ইমতিয়াজ মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারে আছে অবশ্য আছে বললে ভুল হবে সে ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েই এখানে এসেছে আর ক’দিন পর রেজাল্ট দিলো বলে। রাগান্বিতার সাথে ইমতিয়াজের বয়সের তুলনা করলে গুনে গুনে সে রাগান্বিতার থেকে ৯ বছরের বড়। আর মাহাদের সাথে প্রায় ১০ বছরের ওই সেইম সেইমই ধরা যায়। ইমতিয়াজ তার মাথা ঝাঁকড়ালো এগুলো কি ভাবছে সে। মাঝে মাঝে নিজের কিছু উদ্ভট কথা শুনলে ইমতিয়াজের বড্ড রাগ উঠে নিজেই নিজেকে খুন করার ইচ্ছে জাগে। কিন্তু তাকে তো খুন হলে চলবে না।
ইমতিয়াজের বাড়ি দৌড়ে আসলো মোকলেস। বললো,
“ইমতিয়াজ ভাই রাগান্বিতা আফার গায়ে হলুদে যাইবেন না?”
ইমতিয়াজের কোনো হেলদোল দেখা গেল না। সে নিশ্চুপ স্বরে বললো,
“না মাইয়া মানুষের গায়ে হলুদে যাইয়া আমরা কি করতাম?”
মোকলেস হাসলো। ইমতিয়াজের পাশে শুয়ে বললো,
“জানেন ভাই আমনে যহন আমার মতো কইরা কতা কন আমার যে কি ভালো লাগে? কালই চইল্লা যাবেন ভাইজান?”
প্রচন্ড মন খারাপ হলো মোকলেসের। ইমতিয়াজ মোকলেসের মাথায় হাত বুলালো। বললো,
“আরে মন খারাপ করিস কেন আমি আবার আসবো তো?”
“সত্যি আইবেন ভাইজান?”
ইমতিয়াজ আশ্বাস দিলো। বললো,
“হুম।”
মোকলেস খুশি হলো। আচমকাই ইমতিয়াজকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“আমনে খুব ভালো ভাইজান।”
ইমতিয়াজ অবাক হলো মিটমিট করে হাসলো শুধু কিছু বললো না। তবে তার মাথায় ঘুরছিল মোকলেসের বলা কথাটা “আমনে খুব ভালো ভাইজান!”
—-
(১)❝পুসকুনি পূবপাড় কালা দলা মাটি,
সেই মাটিতে জন্ম হইছে মেন্দিনাগাছটি
মেন্দি গাছটির আড়ালে রাগান্বিতা-মাহাদ দুইজনে
হাতে বাঁশি মুখে পান বাজায় বাঁশি মাহাদ চান!❞
(২)❝নতুনও পুসকুনির পাড়ে ভুয়া রইলাম সাইরে সাইরে
ও পানো সখিরে আমি কি ফুল ভাসাইলাম জলে
সেই না ফুলের রেনু খাইয়া রাগান্বিতা গেল পাগল হইয়া।❞
(৩)❝আম্বুলতলা বইয়া বিবি তাম্বুরা টানায়
ফুলোতলা বইয়া বিবি বাবাজানরে বোলায়
বাবাজানের দুয়ারদারে রেশমের বান্দন
তাইয়ার তলে যাইয়া বিবি জুড়িলো কান্দন
বাবায় কইছে,
কাইন্দো না, কাইন্দো না বিবি বেলা হইলো শেষ
জলদি কইরা মেলা করো আপোনার ওই দেশ।
কদ্দুরহানে যাইয়া বিবি ফিরা ফিরা চায়
আজ বুঝি বাবাজানের দালান খালি হইয়া যায়।❞
রাগান্বিতার গায়ে হলুদ মাখাতে মাখাতে এ ধরনের নানা রকমের হয়লা গান গাইছেন গায়ের ভাবি, বউ, দাদিরা। সঙ্গে নারকেল গাছের শলার একটু অংশ নিয়ে রাগান্বিতার হাতে মেহেন্দি লাগানো হচ্ছে। দুটো হাত ভরিয়ে দিচ্ছে সবাই মিলে। রাগান্বিতা ঠায় বসে আছে চুপচাপ কেমন যেন নিজেকে বড্ড অনুভূতিহীন লাগছে। কোথাও গিয়ে বড্ড খারাপ লাগছে কেউ বুঝি ছেড়ে চলে যাচ্ছে তাকে । হঠাৎই হাল্কা হাওয়া উঠলো। রাগান্বিতার ভিতরটা বুঝি থমকে গেল। সে আশেপাশে তাকালো তার মনে হলো ‘কেউ বুঝি এসেছে তার আশেপাশে, বড় আপন কেউ।”
চলবে……