#গল্পপোকা_চিঠি_প্রতিযোগিতা_২০২০
#চিঠি_নং_১
প্রিয় মা,
আজ তোমাকেই চিঠি লেখার কথা কেন মনে এলো বলোতো?আমি তো তোমার কাছেই থাকি,তাহলে চিঠি কেন?আসলে অনেক গুলো কথা বলার ছিল জানো তো।সেগুলো তোমায় বলব বলে লিখছি কি?জানি না,হয়তো কোনোদিন দেখতে পাবে,কিন্তু আমি নিজে কখনো তোমার হাতে দিয়ে উঠতে পারব না চিঠিটা।আমি তো বড্ড অগোছালো,চিঠিটাও সবার মত গুছিয়ে লিখতে পারি না।কখনো তো কাউকে লিখিনি এভাবে।কিন্তু তুমি তো মা,আমি জানি ঠিক বুঝে নেবে।
সেবারে হাসপাতালের ডাক্তার ম্যাডামরা যখন স্কুলের সেমিনারে এককোণে ‘ প্রিয় মা ‘ লেখা সবুজ চিঠির কাগজ দিলেন সবাইকে,সেবারেও ওনাদের কথায় চিঠি লিখেছিলাম তোমায়।কিন্তু কিছুই লিখতে পারিনি প্রায়,কারণ ওটা তো তোমার হাতে দিতে হয়েছিল লেখার পর।
অবাক হচ্ছো মা?কিন্তু কি করবো বলো,আমি যে এরকমই,তুমি তো জানো।জানিনা কেন এমন অক্ষম আমি যে কোনোদিন তোমায় জড়িয়ে ধরে বলতে পারিনি,”মাগো,তোমায় বড্ড ভালোবাসি।”কোনোদিনও তোমার অসুখে জিজ্ঞাসা করে উঠতে পারিনি,”মা তোমার কী কষ্ট হচ্ছে?কতটা যন্ত্রণা হচ্ছে?” বোঝার জন্য মনটা আঁকুপাঁকু করেছে,কিন্তু তবুও তোমার পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকেছি,জিজ্ঞাসা করে উঠতে পারিনি।কখনো জিজ্ঞাসা উঠতে পারিনি,”মা,ওষুধটা খেয়েছ?”
অথচ দেখো,আমার অসুখে তুমি রাতের পর রাত জেগে কাটিয়েছ। জ্বর হলে অরুচির মুখে খাওয়া নিয়ে হাজার ঝামেলা করেছি,তোমার উপর কত চেঁচামেচি করেছি।আমার সব রাগ অভিমান হাসিমুখে মেনে নিয়েছ তুমি।যখন ভুল করেছি,শাসন করতে গিয়ে রাগের মাথায় মেরেছ আমায়।আবার খানিক পরে আমার ক্ষতে,কালশিটেতে মলম আর বরফ লাগিয়েছো,তখন তোমার দুচোখে অবিরাম বৃষ্টি ঝরে চলেছে।আমি তো অনেক অভিমান করেছি,কিন্তু কখনো তোমার চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলা হয়ে ওঠেনি,”কেঁদো না গো মা,তোমার ভালোবাসা আর স্নেহের স্পর্শেই যে আমার সব যন্ত্রণা মুছে গেছে,আর একটুও ব্যাথা নেই।” না,আমি বলে উঠতে পারিনি।
আমি বড্ড খারাপ,তাই না?সবার তো কত্ত গুণ, কত কি পারে সবাই,আমি তো কিছুই পারি না।তবু তোমার আর বাপির চোখে আমিই সেরা থেকেছি সবসময়,গুণের ঘাটতিতে অন্যদের ভালোবাসায় খামতি হয়,কিন্তু তোমাদের ভালোবাসা যে সব বিচারের উর্ধ্বে,একটুও কম হয়নি।আর আমি?মনে জমে থাকা কথাগুলো অব্দি নিজের মাকে বলে উঠতে পারিনি,এতটাই অপদার্থ!
কিন্তু বলেছি জানো তো,অন্যভাবে।তোমার মনে আছে সেই একদিনের একলা দুপুরটার কথা?আমি স্কুলে,বাপি কাজে,আর তুমি নির্জন মধ্যাহ্নে ঘরে বসে আমার চুড়িদার রিফু করতে করতে তোমার প্রিয় গানটা শুনছো।তোমার সবসময়ের সেই প্রিয় গান,’ তুমি আমার মা,আমি তোমার মেয়ে’।শুনতে শুনতে তোমার চোখ ছলছলে হয়ে উঠছে।’মেয়ে যে তুই লালন শুধুই করছি আমি রে,পরের ঘরে যাবার জন্যে তা কি বুঝিস নে ‘ লাইনটা আসতেই তোমার চোখে বাঁধ রইল না আর,মুখে আঁচল চাপা দিয়ে নীরবে ঝরঝর করে অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলে তুমি।তখনও জানতে পারোনি, দরজার পিছনে দাঁড়িয়ে প্রাণপণে নিজের কান্নার কণ্ঠরোধের চেষ্টা করে যাচ্ছি আমি।স্কুলের তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গিয়েছিল,বাড়ি এসে ঘরে প্রবেশ করতে গিয়েই তোমায় দেখে থমকে গিয়েছিলাম।তোমার প্রিয় গানকে ‘ সেকেলে গান ‘ বলে অনেক ব্যঙ্গ করেছি,কিন্তু সেদিন গানটা নাড়িয়ে দিল ভিতর থেকে,না চাইতেও কান্না ঠেলে উঠে এলো গলা থেকে।যখন এলো, ‘ মাগো তুমিও তো মা এসেছিলে তোমার মা কে ছেড়ে ‘ আর পারলাম না আমি,দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম তোমার বুকে।তুমিও আবেগ আটকাতে পারলে না আর,মা মেয়েতে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে লাগলাম।আমার চোখের জলের প্রতিটা ফোঁটা ঝরে পড়তে পড়তে আকুলস্বরে বলছিল সেদিন,” মা,বাপি তোমাদের বড্ড ভালোবাসি গো,আমি তোমাদের ছেড়ে কোত্থাও যেতে চাই না।তোমাদের ছোট্ট রাজকুমারী হয়েই থাকতে চাই।”
তুমি শুনতে পেয়েছিলে মা ওদের কথা?
আমার জন্মদিনে ধান দূর্বায় আশীর্বাদ করতে গিয়ে তুমি আর বাপি কেঁদে ফেলেছিলে যখন,সামনে রাখা হলুদজলে আরো একজোড়া চোখের নোনাজল চুপিচুপি টপটপ করে মিশছিল। ওগুলোয় অনেক কথা লেখা ছিল জানো তো?তুমি পড়তে পেরেছিলে মা?
এই দেখো, কী বলতে কী কথায় এসে যাচ্ছি।আসলে তোমায় এত কথা বলার আছে যে কোথায় শুরু আর কোথায় শেষ করব বুঝেই উঠতে পারছি না।
সব বলতেই পারব কি?বলা,না বলা সবেই তো তুমি।আমার ভ্রূণ হয়ে আসার পর ন মাস দশ দিনের সম্পূর্ণ নীরব দিনগুলো তোমার মাঝে,আমার বলা প্রথম শব্দেও তুমি।আমার লেখা প্রথম অক্ষরেও তুমিই মিশে।আমার সারাদিন তুমিময়,তুমি এত ব্যাপ্ত যে ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত বাক্য জুড়েও তোমায় নিয়ে লিখে শেষ হবে না।অথচ এমনি নিঃশব্দে আত্মত্যাগ করে যাও যে বুঝতেই পারিনি।নাকি বুঝতে পেরেও তার স্বীকৃতি দিয়ে ওঠা হয়নি কখনো?ইচ্ছে তো হয়েছে,তোমার চোখের জল দুহাত দিয়ে মুছিয়ে দিতে,ক্লান্তির ঘামে ভেজা তোমায় হাওয়া করে দিতে।কিন্তু না,করে ওঠা হয়নি আর,কিছু বলেও ওঠা হয়নি,অব্যক্ত রয়ে গেছে সব। দেখেছো,আবেগে আমার শব্দগুলো সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে,লিখতে গিয়ে কেঁদে ফেলছি বারবার।তুমি যে আমার জীবনের ধ্রুবতারা। স্পেশাল করে কিছু বলতে না পারলেও তোমার এই মুখচোরা,অপদার্থ,অকর্মণ্য মেয়েটা তোমায় সত্যিই বড়ো ভালোবাসে গো।তুমি যখন ‘মা’ বলে ডাকো,সত্যি সত্যি তোমার মা হয়ে যেতে ইচ্ছে হয়।অনেক ভুল করি জানি,কিন্তু দেখো,একদিন ঠিক মানুষের মত মানুষ হয়ে তোমার মুখ উজ্জ্বল করব আমি।এখনও তো অনেক কিছু না বলা থেকে গেলো,জানি অনুভবে বুঝে নেবে তুমি,নিও।
কয় জন্ম হয় জানি না,যতই হোক,তুমি সবজন্মে আমার মা হয়ে এসো,যেন আমি তোমার মত দুর্গার কোলে লক্ষ্মী সরস্বতী না হলেও অপদার্থ সাধারণ মেয়ে হয়ে জন্মাতে পারি।
ইতি—
তোমার ‘মা’