প্রিয়ানুভব পর্ব-১২

0
361

#প্রিয়ানুভব [১২]
লেখা: প্রভা আফরিন

মাথার ওপর ধুসর ছায়াময় ম্লান আকাশ। সন্ধ্যা নামা পিচঢালা পথে প্রিয়া দ্রুত পায়ে হাঁটছে। কাঁধে ঝোলানো চিকন ফিতের ব্যাগটা চেপে ধরেছে শক্ত হাতে। এদিক ওদিকে তাকিয়ে মাথা নত করে চলেছে ও। আজকাল অল্পতেই বুক কাঁপে প্রিয়ার। হেঁটে যাওয়া-আসা করে বলে বাড়ি ফিরতে রোজ সন্ধ্যা পেরোয়। একা একটা মেয়ে রোজ সন্ধ্যার পর ফেরে বিষয়টা অনেকের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। বস্তির গলির মাথার চায়ের দোকানি গরম পানিতে চায়ের কাপ ধুতে ধুতে কেমন একটা বিদঘুটে দৃষ্টিতে তাকায়। চোখ নয় যেন শরীর মাপার ফিতে। প্রিয়ার গা গুলিয়ে ওঠে। দিয়া কিছুদিন আগে একবার কথার ছলে বলেছিল শেষ ঘরের আবুল চাচা নাকি তাকে দেখলে ডেকে জিজ্ঞেস করে বাবার কথা, পরিবারের কথা। হাত ধরে টানাটানিও করে। শুনে প্রিয়া যারপরনাই চমকে উঠেছে। দিয়া অত বুঝে বলেনি, কিন্তু প্রিয়ার মনে শঙ্কা উঁকি দেয়। মেয়েটা যে বড়ো হচ্ছে। কোনো কালো হাত ওকে স্পর্শ করুক সে চায়।

আজকাল বস্তির পুরুষগুলোর দৃষ্টিও প্রিয়ার নজরে আসছে। শিরশিরে একটা ভয় মেরুদণ্ড বেয়ে ঘোরাঘুরি করে সর্বাঙ্গে। এইসব অনিরাপত্তা কি এখনই তৈরি হচ্ছে নাকি আগেও ছিল! প্রিয়াই হয়তো খেয়াল করেনি এতদিন। দিয়াটার গায়ে কৈশোরের ছটা লাগতেই চারিদিকে শুধু অনিরাপত্তাই দেখছে সে। প্রিয়া আরো একটা জিনিস খেয়াল করেছে। মা কেমন চুপসে থাকেন ইদানীং। সেদিন টিউশনি গিয়ে জানতে পারে স্টুডেন্ট অসুস্থ। কাজেই না পড়িয়েই ফিরে আসতে হয়েছিল প্রিয়াকে। বাড়ি ফিরে দেখল মা প্রতিবেশী এক মহিলার সঙ্গে বসে গল্প করছেন। মহিলাটি পেশায় ঘটক। পান খেয়ে রাঙানো ঠোঁটে তিনি মুনিরাকে বলছেন,

“দেহো দিয়ার মা, তোমার জামাই নাই। মাইয়া একখান ডাঙ্গর, আরেকখানও হইলো বইলা। তুমি পারো না একলা চলতে। আবার মাইয়ারে দিছো ছাইড়া। রাইত-বিরাইতে বাড়িত ফিরে। যদি কেউ কিছু কইরা বয়? কিছু করতে পারবা? পারবা না। সময় থাকতে বিয়াডা দিয়া দেও। মাইয়ার চেহারা সুরুত দেখতে ভালা আছে। দেনাপাওনা লাগব না।”

মুনিরা হাসার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলেছিলেন,
“বিয়ে আল্লাহর হাতে, আপা। তিনি ইশারা করলে আমি আটকানোর কে?”

“আল্লাহর হাতে সব। কিন্তু বান্দার চেষ্টা থাকন লাগে। তোমার মাঝে তো তেমন দেখি না। কতগুলান পাত্র আনছি একটারেও দেখলা না। মাইয়া সংসার চালায়, বিয়া দিলে সংসার চলব না হেই ডরে আগাও না।”

মুনিরা বেগমের তখন মাটিতে মিশে যাওয়ার জোগাড়। প্রিয়া দৃশ্যপটে হাজির হলো তীক্ষ্ণ মেজাজে।
“আমি বিয়ে করে নিলে আমার সংসার আপনি দেখবেন, আন্টি?”

“আমি না দেখলেও পয়সাওয়ালা জামাই থাকলে তো দেখবই। আমি কোনো ছুডুমুডু বিয়ার ঘর আনি না।”

“বড়ো বিয়ের ঘর তো অনেকেরই এনেছেন। ও বাড়ির সামিরার বিয়েটা তো আপনিই দিলেন। মাস ঘুরতেই স্বামী মা’রধো’র করে রেখে চলে গেল। আর খোঁজও নিল না। আপনার কথায় নিরাপত্তার কথা ভেবে বিয়ের পিঁড়িতে বসে গেলাম নাহয়। কিন্তু স্বামীর ঘরে যে আমি নিরাপদে থাকব তার নিশ্চয়তা কী?”

মুনিরা তর্ক করতে বাঁধা দিচ্ছিলেন বারবার। মহিলা থমথমে মুখে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন,
“বস্তির মাইয়াগো এই আমিই ঘটকালি কইরা পার করছি। আর দুইদিনের মাইয়া আমার ভুল ধরে! মনে রাইখো, বিয়া দিতে আমার কাছেই আহন লাগব। আর যদি নাগর জুটাইয়া ভাইগ্যা যায় তাইলে কথাই নাই।”

প্রিয়া মায়ের ওপর ধমকে উঠেছিল,
“কতদিন ধরে এসব হচ্ছে?”

মুনিরা উত্তর দিতে পারেননি। প্রিয়া বুঝেছিল তার আড়ালে মা-ও একটা যু’দ্ধ করে চলেছে বস্তির মানুষগুলোর তেরছা বাক্যের সঙ্গে। ঘরভাড়া দেওয়া হয়নি দুমাসের। বই কিনতে টাকা গিয়েছে। ফলে অল্প টাকায় ভাড়া দিতে সংকুলান হয়নি। বাড়িওয়ালা ঘুরে গেছেন দুবার। প্রিয়ার আজকাল দিশেহারা লাগে। কোনোদিকে আলো নেই। শুধু আঁধারের হাতছানি। আরেকটা টিউশন খুঁজছে প্রাণপনে। চেষ্টা করেও মিলছে না। সকল ভাবনার ভার মাথায় নিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে বাড়ি পৌঁছাল প্রিয়া। চমকে দেখল মামা বসে আছেন মায়ের পাশে। বিছানায় ছড়ানো ছিটানো চিপস, জুস, বিস্কুট, পাউরুটি। মামা তাকে দেখেই কিঞ্চিৎ বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন,

“সন্ধ্যার পর বাড়ি ফেরা কেন?”

“টিউশনি ছিল, মামা।”

“দিনে করা যায় না? মেয়েরা আজকাল ঘরেই নিরাপদ না। আর তুমি আসো গোটা কতক বাজার পেরিয়ে!”

প্রিয়া কোনো জবাব দিল না। তার দেরিতে বাড়ি ফেরা নিয়ে সকলের কত চিন্তা। অথচ তারা খেয়েছে কিনা, বাড়িতে বাজারটা ঠিকঠাক হয় কিনা সে নিয়ে চিন্তা তো দূরে থাক জিজ্ঞেস করতেও কুণ্ঠা। প্রিয়া তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। আশেপাশে অভাব দেখলে আপন মানুষগুলোই আগে পিঠ দেখিয়ে বেড়ায়। মামা অবশ্য প্রিয়ার উত্তরের ধার ধারলেন না। বোনকে বললেন,
“শোন মুনিরা, ভালো একজন লইয়্যার আছে হাতে। তুই বললেই আমি এগোবো।”

“কীসের জন্য?” প্রিয়া উৎসুক হয়ে জানতে চায়।

“তোর বাবার ভাগের সম্পত্তি কি ছেড়ে দিবি নাকি? পৈত্রিক সূত্রে তোরা দুবোন যা পাবি তা দিয়ে নিজেদের বাড়িও হবে, ভবিষ্যতও নিশ্চিত থাকবে। তুই এখন প্রাপ্তবয়স্ক। দাদার বাড়ির সম্পত্তির দাবিদার। এটা তো মগের মুল্লুক না যে কেড়েকুড়ে তোদের চাচারা সব ভোগ করবে। দেশে আইনকানুন বলে কিছু আছে। আমি লড়ব তোদের হয়ে।”

প্রিয়া দেখল মামার চোখদুটো চকচক করছে। ভাগ্নীদের হয়ে নিজের দায়িত্ববোধ দেখাতে তিনি মরিয়া। নাকি সম্পত্তির লভ্যাংশ পেতে? মুনিরা বেগম ভাইয়ের বাসনা ধরে ফেলেছেন আরো আগেই৷ ইদানীং প্রায়ই ফোন দিয়ে ভাইজান এইসব কথা বলেন। আজ একেবারে চলেই এসেছেন। স্বার্থ ছাড়া কেউ কেন যে তাদের দিকে তাকায় না! মুনিরা বেগম জ্ব’ল’ন্ত দীর্ঘশ্বাসটা বুকের মাঝে চেপে বললেন,

“ভাইজান, আপনাকে তো আগেও বলেছি আমি আইনের জটিলতায় যাব না।”

“কেন যাবি না? তোর মেয়েদের কি কোনো ভবিষ্যত নাই? তোর ভবিষ্যত নাই? এই স্যাঁতস্যাঁতে টিনের ঘরে পড়ে পড়ে জীবন কাটাবি? তোর জামাই জেল থেকে বেরিয়ে তোদের উদ্ধার করবে সেই আশায় থাকবি কেন? তুই তো হাত পেতে নিতে যাচ্ছিস না। নিজেদের অধিকার নিবি।”

“অধিকার নিতে গিয়ে যদি তারা ক্ষু’ব্ধ হয়ে আমার ফুটফুটে দুই মেয়ের ক্ষতি করতে আসে তখন কে দেখবে, ভাইজান? আইন যেমন আছে আইনের ফাঁক ফোকরও আছে। মনে রাখবেন আইন অন্ধ। যা দেখানো হবে তাই দেখবে। প্রিয়ার চাচারা নিজেদের স্বার্থে ভাস্তিদের চেয়েও দেখবে না। তাদের টাকার মায়ার কাছে সম্পর্কের মায়া তুচ্ছ। দুটো মেয়েই আমার জীবন। তাদের সুস্থতার চেয়ে বড়ো সম্পদ কিছু নাই।”

প্রিয়া মায়ের পায়ের কাছে এসে চুপচাপ বসে। আলতো হাতে পায়ের অসাড় আঙুলগুলো টিপে দেয়। এই মানুষটা স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করতে না পারলেও বুদ্ধির হাঁটাচলা সুদূরপ্রসারী। লোভে পড়ে হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নেন না। আগে পারিপার্শ্বিক অবস্থাও খেয়াল করেন।
প্রিয়া দেখে ফোনটা কাঁপছে। অনুভবের ফোন। নানান মানসিক চাপে আজকাল অনুভবের সঙ্গেও কথা বলতে ইচ্ছে হয় না। কিন্তু সেই ছেলে কী কম ত্যাদড়! না ধরা পর্যন্ত একটানা কল দিয়েই যাবে। প্রিয়া ফোন নিয়ে উঠে গেল। বাইরে গিয়ে ফোন রিসিভ করে বলল,
“বলুন?”

কথোপকথনের শুরুতেই আকাঙ্ক্ষিত রমনী বিরস গলার স্বর শুনে অনুভব বলল,
“কী ব্যাপার? কণ্ঠ এতটা নিস্পৃহ কেন? আমার ফোনে তুমি বিরক্ত?”

“এত ঘন ঘন ফোন করার জন্য কী উচ্ছ্বসিত হওয়ার কথা?” প্রিয়া সোজাসাপটা জবাব দিল।

অনুভব আহ’ত হয়। বলে,
“ঘন ঘন মানে? সেই সকালে একবার ফোন দিয়েছিলাম, আর মাত্র দিলাম।”

“অকাজের ফোন আমার কাছে ঘন ঘনই মনে হয়।”

“এত নিরামিষ কেন তুমি? তোমার তো উল্লাসে ফেটে পড়া উচিৎ যে সবচেয়ে সুন্দর ছেলেটা এত এত সুন্দরীদের পাত্তা না দিয়ে তোমায় যেচে ফোন করছে।”

বিপরীত ব্যক্তিটি দেখবে না জেনেও প্রিয়া ঠোঁট বাঁকায়। বলে “রূপ নিয়ে খুব গর্ব আপনার?”

অনুভব ভাবের সঙ্গে বলল, “প্রতিপক্ষ যখন নিজেকে মুরুব্বি হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করে তখন আমারও জাহির করার মতো কিছু থাকা উচিত। ঠিক কিনা?”

প্রিয়া ঠোঁট টিপে হাসে। অনুভব পুনরায় বলল,
“রাতে খেয়েছো, হাসু?”

“খেয়েছি, অনু ভাইয়া?”

“হোয়াট ননসেন্স! অনু ভাইয়া আবার কী?”

“আমারও একই প্রশ্ন, হাসু আবার কী?”

অনুভব দুষ্টু হাসে, “আচ্ছা! শোধ নিচ্ছেন আপনি! কান খুলে শুনুন, আপনি আমার হাঁসমার্কা হাসু হয়েই থাকবেন চিরজীবন।”

“চিরজীবন!” স্বগোতক্তি করে প্রিয়া। বিহ্বল হয় তার চিত্ত। রাতের ভারী বাতাস হঠাৎ পূবালী দমকা হাওয়ায় লীন হয়ে ফুরফুরে হয়ে যায়৷ মনের অলিন্দে সুদর্শন কেউ এসে চুপি চুপি আসর বসায়। প্রিয়া ভেবে পায় না এই ছেলেটা তাকে এত চায় কেন? কী এমন আছে তার মাঝে? অসুন্দরী প্রিয়া নয়, এটুকু ধারণা তার নিজের সম্পর্কে আছে। গড়পড়তা বাঙালির চোখে সে রূপবতী তরুণী। কিন্তু অনুভবের সুদর্শনতার কাছে তা নিতান্তই ফিকে। সে কী ওই নিখুঁত পুরুষটির আগ্রাসী প্লাবনে ভাসা প্রণয়ের যোগ্য! প্রিয়া ম্লান স্বরে বলে,
“পান থেকে চুন খসলে গায়ে ফোসকা পড়ে আপনার। পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করেন। অথচ এত যে অবহেলা করি, সে বেলায় আপনার গায়ে লাগে না!”

“কারণ আমি জানি, সব বিষয়ে মুরুব্বি হলেও দ্য গ্রেট হিটলার লেডি এই একটা বিষয়েই নির্বোধ আর ভীতু। তাকে আমাকেই শিখিয়ে পড়িয়ে প্রেমিকা বানাতে হবে। মাস্টার হিসেবে আমি খুবই স্ট্রিক্ট। ছাত্রী পড়া না শেখা অবধি হাল ছাড়ব না।”

প্রিয়ার পক্ষ থেকে জবাব না পেয়ে অনুভব ব্যগ্র স্বরে বলে, “এই মেয়ে! কথা বলো না কেন?”

“কী বলব?

অনুভব দাম্ভিক কণ্ঠে বলল, “দ্য মোস্ট হ্যান্ডসাম গায় ইউ হ্যাভ এভার সিন, সে তোমায় হাসু বলে ডাকবে তার অন্তিম শ্বাস অবধি। তোমার তো গর্ব হওয়া উচিত।”

প্রিয়া নিঃশব্দে হাসে৷ প্রকাশ করে না সে অভিব্যক্তি। গম্ভীর স্বরে বলে,
“গর্বে বুক ফেটে যাচ্ছে আমার। এখন রাখি।”

“আরেকটা কথা…”

“আবার কী?”

“প্রিয়া জানলে হিংসে করবে যে, হাসু ইজ দ্য মোস্ট বিউটিফুল লেডি আই হ্যাভ এভার সিন ইন মাই লাইফ।”

কণ্ঠের নিরবতায় নিশ্বাসেরা সরব হয়। ছড়ায় মা’দ’কতা। ঘনিয়ে আসা তমসায় মৃদু পূবালী হাওয়ায় মন এলিয়ে অনুভব ফিসফিস করে বলল,
“হাসু লজ্জা পাচ্ছে? নাকি প্রিয়া হিংসে করছে?”

প্রিয়া তড়িঘড়ি করে ফোন কাটে। অনুভব ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসে। এই মেয়ে আজ আর তার ফোন ধরবে না।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে