প্রজাপতির রং পর্ব-১০+১১

0
966

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_10
#Writer_NOVA

হঠাৎ ঘুমের ঘোরে মনে হলো কেউ আমার ওপর তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে।তার উষ্ণ নিঃশ্বাস আমার উপর পরছে।তার শরীরের ঘ্রাণটাও আমার বড্ড চেনা।চোখ খুলতেই আমি চারিদিকে অন্ধকার দেখতে পেলাম।তড়িঘড়ি করে লাফিয়ে উঠলাম।হাতরে লাইটের সুইচ অন করলাম।কিন্তু আশেপাশে তাকিয়ে আমি অবাক।কেউ নেই। কিন্তু আমার মনে হয়েছে এখানে কেউ ছিলো।এটাকে আমি হ্যালুসিউশন ধরে নিলাম।কারণ এরকম আমার মাঝে মাঝে হয়।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আৎকে উঠলাম।১০ টা বেজে ২২ মিনিট। এতক্ষণ ঘুমিয়েছি টেরও পাইনি।ড্রেস পাল্টিয়ে এরিনদের রুমে গেলাম।

আমিঃ এরিন,হিমি কি করছিস? নাভান কি ঘুমিয়ে গেছে?

এরিনঃ একদম ধরবি না নাভানকে।ও আজকে আমাদের সাথে থাকবে।এভাবে কেউ ছোট বাচ্চাটাকে মারে।গাল দুটো লাল টকটকে হয়ে আছে।

হিমিঃ অনেক কষ্টে ঘুম পারিয়েছি। তোকে কতবার বলছি ছেলেটাকে এভাবে মারবি না।কাঁদতে কাঁদতে হেচকি উঠে গিয়েছিলো ছেলেটার।ও যদি বুঝতো তাহলে কি এসব জিজ্ঞেস করতো।রাগ উঠলে নিজেকে কন্ট্রোল করতে কেন পারিস না?

আমিঃ জানি না রে।তখন এত কথা শুনে মেজাজটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তার মধ্যে ও আবার মর্জি করছিলো।তাই নিজেকে সামলাতে পারিনি।তোরা এসে না ধরলে আরো দুটো দিতাম।এবার আমার ছেলেকে দে।তোরা তো জানিস, ওকে ছাড়া আমি ঘুমাতে পারবো না।

এরিনঃ যা ভাগ।তোকে আমি নাভানকে নিতে দিবো না।মারার সময় মনে ছিলো না। এক রাত ওকে ছাড়া থাকলে তোর শিক্ষা হবে।পরেরবার থেকে মারার সময় নিজেকে সামলাতে পারবি।

আমিঃ বোইন এমন করিস না।আমার পোলাডারে দিয়া দে🥺।

হিমিঃ দিতে পারি তবে এক শর্তে।

আমিঃ আমার ছেলে আমি নিবো তাও আবার শর্ত লাগবে।

হিমিঃ শর্তে রাজী থাকলে বল। নয়তো ভাগ।

আমিঃ কি শর্ত বল?

হিমিঃ এরিন, কাগজটা দেখা তো।

আমিঃ কিসের কাগজ?

এরিন বসা থেকে উঠে গিয়ে টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা কাগজ বের করে নিয়ে এলো।

আমিঃ কি এটা?

এরিনঃ পড়ে দেখ।

আমিঃ চাকরীর বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আমি কি করবো?

হিমিঃ এখানে তোকে চাকরী করতে হবে।আর এটাই হলো আমার শর্ত।তোর C.V আমরা আজ জমা দিয়ে এসেছি। আগামী পরশু ইন্টারভিউ। মার্কেটিং সম্পর্কে তোর যথেষ্ট ধারণা আছে। তাই তোকে না জানিয়ে তোর ড্রয়ার থেকে C.V নিয়ে আজ বিকেলে আমরা দুজন জমা দিয়ে এসেছি।

এরিনঃ তুই এবার ভালোয় ভালোই আগামী পরশু ইন্টারভিউ দিতে যাবি।আমার বিশ্বাস চাকরীটা তুই পাবি।কোম্পানিটা নতুন।তবে সবদিক দিয়ে ভালো আছে।

আমিঃ তোদের কে বলেছে এসব করতে? আমি তো এভাবেই ভালো আছি।

হিমিঃ দেখ নোভা, তোর আর আমাদের বিষয় কিন্তু এক নয়।তোর ছোট একটা ছেলে আছে।ও বড় হচ্ছে। ওরো তো একটা ভবিষ্যত আছে। ওর জন্য তোকে ভাবতে হবে।

এরিনঃ আর জে ক্যারিয়ারটা আমরা দুজন করি শখের বশে।পড়াশোনার পাশাপাশি হাত খরচ চলে আসে তার জন্য করি। কিন্তু তুই কিন্তু শখের বশে করিস না।তোকে করতে হয় ছেলের জন্য। যেহেতু তোর অনার্স কমপ্লিট আছে তাহলে সমস্যা কি? আমরা অবিবাহিত মেয়ে। আজ হোক কাল হোক আমাদের বিয়ে হবে।তখন হয়তো আমরা এই ক্যারিয়ারে আর থাকবো না।

আমিঃ আমি এতকিছু সামলাবো কি করে?

হিমিঃ সকাল দশটা থেকে বিকেল তিনটে অব্দি কাজ করবি।তাতে তোর শো করতেও কোন সমস্যা হবে না। তাছাড়া কোম্পানিটা আমাদের কাছাকাছিই।আগে ইন্টারভিউ দে।সেখানে টিকলে তারপর বাকি চিন্তা করবি।

আমিঃ কি করবো বুঝতে পারছি না।

এরিনঃ তোর কিছু বুঝতে হবে না। আগামীকাল শুক্রবার মানে আমাদের অফ ডে।সারাদিন ভাবার সময় পাবি।তবে পরশু সকালে তোকে ইন্টারভিউ দিতে যেতে হবে এটাই শেষ কথা।

আমিঃ আচ্ছা, দেখি কি করা যায়।

নাভানকে কোলে করে এনে আমার রুমে শুইয়ে দিলাম।মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম।হাতে থাকা বিজ্ঞপ্তির কাগজটা নিয়ে বারবার পরলাম। কোম্পানির নাম MAT । ওনারের নাম দুইটা।আরিয়ান আজওয়ার, তাজরান তাজওয়ার।নাম দুটো ভীষণ অদ্ভুত লাগলো আমার কাছে। তবে কেন জানি মনে হচ্ছে এবার অন্য কিছু ঘটতে চলেছে আমার সাথে। কিন্তু কি সেটা?

🦋🦋🦋

In Canada…………

কফির মগটা হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো রোশান।তিন দিন যাবত সে কানাডা আছে।বড় এক মন্ত্রীর সাথে জরুরি মিটিং-য়ে এসেছে।রোশানের আসার কোন ইচ্ছে ছিলো না।কিন্তু মানা করতেও পারেনি। মন্ত্রী ওকে ভীষণ ভালোবাসে।প্রায় সব মিটিংয়ে ওকে রাখে।সেদিন রাতে তমালের সাথে কথা বলার পরই মন্ত্রীর কল আসে।সকালের ফ্লাইটেই কানাডা চলে আসতে হয়েছে। এই তিনদিন প্রচুর ব্যস্ত ছিলো।একটু দম ছাড়ার সময়ও সে পাইনি।আজ কাজের চাপ কম থাকায় সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরেছে।তারা এক আবাসিক হোটেলে উঠেছে। কফিতে চুমুক দিয়ে সামনের ব্যস্ত নগরী দেখায় মনোযোগ দিলো।বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পরছে।আলোকোজ্জ্বল নগরীতে বৃষ্টির ফোঁটায় অন্যরকম দেখাচ্ছে। কিন্তু রোশানের মন এখানে নেই। তার মনে পরে গেছে নোভার সাথে প্রথম দেখা হওয়ার দিন।সেদিনও এরকম ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ছিলো।

অতীত……….

সকাল থেকে আকাশটা কালো মেঘে অন্ধকার হয়ে আছে। হুটহাট করে হালকা ধারায় বৃষ্টি ঝরছে।রোশান এলাকার কলেজের ছাত্রনেতা।কলেজের নবীন বরণ অনুষ্ঠান নিয়ে তাদের হাতে প্রচুর কাজ জমে আছে। তাই সেরে বাসায় ফিরছিলো।তখুনি ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হলো।বাধ্য হয়ে তাকে কলেজের দালানের নিচে দাঁড়াতে হলো।তার পরনে সাদা শার্ট।এই বৃষ্টিতে নির্ঘাত তিল পরে যাবে।তাই দালানের সামনের বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।

রোশানঃ এই বৃষ্টি যে কি শুরু করছে? ধূর, বিরক্তিকর। এখন এই বৃষ্টিতে ভিজে বাড়িতে গেলে আমার সাধের শার্ট-টা নষ্ট হবে।কি আর করার? একটু অপেক্ষা করে দেখি কমে কিনা।

মাথার চুল ঝাড়তে ঝাড়তে এদিক সেদিক তাকালো।তখুনি ওর চোখে পরলো নোভার দিকে।বুকের বা পাশটা ধক করে উঠলো।না চাইতেও ভালো লাগায় তাকে ঘিরে ধরলো।নোভা ছাতা হাতে জামা-কাপড় থেকে পানি ঝারছে।ততক্ষণে ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি নেমে গেছে। হিজাবের কারণে মুখ দেখা যাচ্ছিলো না।তাই রোশান উকি ঝুকি মারছিলো।নোভার পরনে কলেজ ড্রেস। রোশান নোভাকে দেখে সিউর হলো ও ইন্টার ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী হবে।কারণ এর আগে ওকে দেখেনি।রোশান ধীর পায়ে নোভার পেছনে এসে দাঁড়ালো। সামনের থেকে মুখটা ওর কাছে স্পষ্ট হলো।হুট করে রোশনকে দেখে নোভা ভয় পেয়ে গেলো।চমকে দু পা পিছিয়ে গেল।

রোশানঃ আরে ভয় পেয়ো না।আমি কিছু করবো না।

কিন্তু নোভা বিশ্বাস করলো না। চোখ দুটো ছোট ছোট করে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলো।তারপর আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিলো।

রোশানঃ নাম কি তোমার?

নোভা কোন উত্তর দিলো না।আড়চোখে একবার রোশানের দিকে তাকালো।এমন একটা ভাব যেনো রোশানকে সে দেখেইনি।সামনের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখায় মনোযোগ দিলো।

রোশানঃ আমার নাম রোশান দেওয়ান। আমি দেওয়ান বাড়ির মেজো ছেলে। তুমি নিশ্চয়ই এবার ইন্টার ১ম বর্ষের ছাত্রী? তোমাদের বাসা কোথায়? আমি কি একা বকবক করে যাবো? তুমি কি কথা বলতে পারো না নাকি? ও হ্যালো, আমি তোমাকে বলছি।তুমি কি শুনতে পাচ্ছো? তুমি কি কানে কালা নাকি?

নোভার এতক্ষণ ভয় ভয় করছিলো।একটা অচেনা ছেলের সাথে বৃষ্টির মধ্যে একা দাঁড়িয়ে থাকলে যে কোন মেয়ের ভয় করবে।তার মধ্যে আশেপাশে কোন মানুষ নেই। কিন্তু এখন নোভার রাগ উঠছে। কানের সামনে কি পটর পটর শুরু করছে।এই ছেলেকে কি তার বায়োডাটা দিতে বলেছে সে।তবে চুপচাপ ওর কথা দাঁতে দাঁত চেপে হজম করে নিলো।একবার কটমট করে রোশানের দিকে তাকিয়ে আবার বৃষ্টি দেখতে মনোযোগ দিলো।

রোশানঃ তুমি আমাকে হয়তো বাঁচাল ছেলে ভাবছো।আসলে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তুমি যাতে বোর না হয়ে যাও তাই তোমার সাথে আড্ডা জমানোর চেষ্টা করতে চাইছিলাম।কিন্তু তুমি তো আমার কথা পাত্তাই দিচ্ছো না।

নোভা এবারো কোন উত্তর দিলো না। এদেরকে উত্তর দিলেই মাথায় চরে বসে। তাই খুব শান্তপর্ণে রোশানকে সাইড কাটিয়ে অন্য দিকে চলে গেল। রোশানও ওর পিছু নিলো।অন্যদিকে এসে নোভা বৃষ্টিতে হাত ভিজিয়ে দিলো।ওমনি মনটা অনেকটা ভালো হয়ে গেলো। মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো।রোশান তা কিছু দূর থেকে পিলারে হেলান দিয়ে মুগ্ধ নয়নে দেখতে লাগলো।প্রথম দেখায় নোভাকে ভীষণ ভালো লেগে গিয়েছিলো রোশানের।যাকে বলে লাভ এট ফাস্ট সাইড।তাই নিজের অজান্তে মনে মনে বিরবির করে বলে উঠেছিলো।

রোশানঃ তোমাকে আমার চাই। আমি তোমাকে আমার করেই ছারবো।প্রথম দেখায় মনে হচ্ছে তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না। শতচেষ্টা করে তোমাকে আমি হাসিল করেই নিবো পাখি।হ্যাঁ,তুমি আমার পাখি।

সেদিন রোশান, নোভা একসাথে এক ছাতার নিচে বাসায় ফিরেছিলো।নোভা অবশ্য ওকে নিয়ে আসতে চাইনি।কিন্তু রোশান ওকে ইমোশনাল ব্লাকমেইল করে নিতে বাধ্য করেছে। এরপর থেকে নোভার পিছনে ঘোরা আরম্ভ হয়েছিল। সবসময় ওকে নজরে নজরে রাখতো।দুই বার প্রপোজ করেছিলো।কিন্তু নোভা একসেপ্ট করেনি।তবুও রোশান থামেনি।পাক্কা এক বছর ওর পিছু ঘুরেছে।এক বছর পর নোভার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোর কথা চিন্তা করছিলো রোশান।তখুনি ঘটলো এক অঘটন।ইলেকশনের ছোট একটা বিষয় নিয়ে দুইপক্ষের মারামারি লেগে যায়। সেই ঝামেলার মূল ছিলো রোশান।তাই রোশানের বিরুদ্ধে কেস করা হয়।সেই কেসের থেকে বাঁচানোর জন্য লুকিয়ে রোশানকে আমেরিকা পাঠিয়ে দেয় ওর বাবা।দুই বছর পর যখন রোশান ফিরে তখন জানতে পারে মাসখানিক আগে নোভার বিয়ে হয়ে গেছে। প্রথমে পাগলামি করলেও পরে নিজেকে নোভার থেকে সরিয়ে নেয়।মাসখানেক দেশে থাকার পর আবার আমেরিকা চলে যায়। তারপর এক বছর পর আবার ফিরে আসে।ফিরেই মন্ত্রী পদের জন্য নমিনেশন জমা দেয়।ভাগ্যক্রমে বিপুল ভোটে জিতেও যায়।একদিন জানতে পারে নোভার স্বামী মারা গেছে। এটা শুনে যেনো রোশান ঈদের চাঁদ পেয়ে যায়।ওর বাচ্চাসহ ওকে বিয়ে করার প্রস্তাব পাঠায়।কিন্তু নোভা ওর বাচ্চা নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।আবারো পাগলোর মতো খুঁজতে থাকে ওকে।একদিন খোঁজ পেয়েও যায়।কিছু দিন নোভার গতিবিধি লক্ষ্য করে। সুযোগ বুঝে তুলেও নিয়ে যায়।কিন্তু জরুরি মিটিং-এর ডাক পরে যাওয়ায় বিয়ের আগ মুহুর্তে তাকে চলে যেতে হয়।আর নোভা বাচ্চা নিয়ে ওর ডেরা থেকে পালায়।তারপরের ঘটনা তো আমাদের সবার জানা।

বর্তমান………

কফি ঠান্ডা হয়ে পানি হয়ে গেছে।সেদিকে কোন খেয়াল নেই। রোশান কখন যে অতীতের দিনে হারিয়ে গিয়েছিলো তাই জানে না।মোবাইলের রিংটোনে তার হুশ ফিরে আসে।ভাবনা থেকে ফিরে মোবাইল হাতে নেয়।তার বাবা কল করেছে। ইদানীং বাসা থেকে বিয়ের অনেক চাপ দিচ্ছে রোশানকে।কিন্তু তারা কেন বুঝে না নোভাকে ছাড়া যে তার চলবে না।

#চলবে

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_11
#Writer_NOVA

এক দিন পর………

—–আসসালামু আলাইকুম। কি খবর সবার? হেই গাইস, দিস ইজ মি RJ নোভানাজ আছি আপনাদের সাথে। আপনাদের শো ভোরের পাখি নিয়ে। আপনারা শুনছেন, 90.4 ঢাকা এফএম। এখন বাজে ৯ টা বেজে ১৭ মিনিট। আমি আর ৪৩ মিনিট আছি আপনাদের সাথে। আপনাদের মনের মধ্যে থাকা যেকোনো কথা কিন্তু আমাকে শেয়ার করতে পারেন।তাছাড়া কোন গানটা আপনারা শুনতে চান তাও কিন্তু জানাতে ভুলবেন না।তাহলে দেরী কিসের?এখুনি টেক্সট করে আপনার নাম,লোকেশন ও যা আপনি বলতে চান টাইপ করে পাঠিয়ে দিন। কমেন্ট করতে চাইলে অফিসিয়াল পেইজে যুক্ত হয়ে যান।আপনার পছন্দের গানের কথাও টেক্সট করে কিংবা কমেন্ট করে জানিয়ে দিতে পারেন।আমি যথাসাধ্য তা বাজিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবো।কথা না বলে গানে ফেরা যাক।আপনাদের পছন্দের গান বাজাবো এখন।দেরী না করে জলদী জলদী আপনার পছন্দের গানটির কথা জানিয়ে দিন আমাকে।আমি সেটা—–

আদরঃ স্যার, আজ এত তাড়াতাড়ি অফিসে চলে এসেছেন যে? এখনও তো কেউ আসেনি?

এক ধ্যানে মোবাইলে ইয়ারফোন লাগিয়ে জোরে সাউন্ড দিয়ে এফএম শুনছিলো তাজরান।আদরের কণ্ঠ শুনে এফএম রেডিও অফ করে ওর দিকে তাকালো।আজ খুলে জলদী অফিস চলে এসেছে সে।

তাজঃ আজ অফিসে ইন্টারভিউ আছে,সেটা কি তুমি জানো আদর?

আদরঃ জী, স্যার।

তাজঃ ইন্টারভিউগুলো সব আমায় নিতে হবে।আর আমি যদি জলদী না আসি তাহলে কে নিবে? ঢাকা শহরের যামের কথা তো জানো।যদি সাড়ে নয়টার দিকে রওনা দিতাম তাহলে আমি সাড়ে দশটায়ও পৌঁছাতে পারবো না।তাই নয়টার আগেই রওনা দিয়েছিলাম। কিন্তু এখানে এসে দেখি মাত্র নয়টা পাঁচ বাজে।তাই কি আর করবো? বসে বসে আমার ফেভারিট শো শুনছিলাম।তুমি এতো তাড়াতাড়ি?

আদরঃ আমিও ভাবলাম আজ তাড়াতাড়ি চলে আসি।যদি লেট হয়ে যায়।স্যার, আমাদের শেয়ার ব্যবসার কি খবর?

তাজঃ আবেদন করেছি।এখনো পাস হয়নি।

আদরঃ ওহ আচ্ছা। স্যার, চা বা কফি কিছু আনবো?

তাজঃ এক মগ কফি হলে খারাপ হয় না।

আদর কেবিন থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলো।তাজ কিছু একটা ভেবে আদরকে ডাকলো।

তাজঃ আদর!!!

আদরঃ জ্বী স্যার, কিছু বলবেন?

তাজঃ আজকে ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য কয়জন কে সিলেক্ট করা হয়েছে?

আদরঃ প্রায় ৩০ জন হবে।ডেট তো কমিয়ে ফেললেন।নয়তো আরো ১০০ জন হতো।১০০ এর কাছাকাছি হয়েছিল। তার থেকে ৩০ জন সিলেকশন করা হয়েছে। এখন এই ৩০ জন থেকে মাত্র ৩ জন নেওয়া হবে।আপনার যাকে মনে হবে তাকে সিলেক্ট করবেন।মাস্টার্স ও অনার্স পাস করা অনেক CV পেয়েছি আমরা।এর থেকে ২০ জন মাস্টার্স কমপ্লিট করা আর ১০ জন অনার্স পাস করা সিলেকশন হয়েছে।

তাজঃ আমাকে সিলেক্ট হওয়া ৩০ জনের CV দিয়ে যেয়ো।আমি একবার চেক করে নিবো।

আদরঃ ওকে স্যার।

তাজঃ আদর, আরেকটা কথা।

আদরঃ জ্বি বলুন।

তাজঃ কফিতে সুগার ১ চামচ।

আদরঃ ওকে।

আদর কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো।তাজ কিছু সময় চুপ করে বসে রইলো।হুট করে আজ আবার ঘাড় ব্যাথা করছে।গতরাতে বিজনেসের একটা বই নিয়ে একটু পড়তে বসেছিলো। সেটা তাকের ওপর রাখতে গিয়ে অসাবধানতাবশত ওর ঘাড়ের ওপর পরে যায়।তখন ব্যাথাটা টের না পেলেও এখন প্রচুর ব্যাথা করছে।তাজ বুঝতে পারছে না এতো হালকা একটা বইয়ে ওর ঘাড় এত ব্যাথা করছে কেন? হাত দিয়ে মেসাজ করার সময় টের পেলো থাড়ের রগের মাঝ বরাবরি ফুলে আছে।এটা অবশ্য বহু আগের থেকেই আছে।সেই জায়গাটাই আবার ব্যাথা করছে।ঘাড়ের পেছনে দুই হাত দিয়ে মাথা এদিক সেদিক করে সামান্য সময় ব্যায়াম করলো।তারপর আবার এফএম রেডিও ওন করে দিলো।ইদানীং ওর মন ভালো করার ঔষধ নোভানাজের শো দুটো হয়ে গেছে। মেয়েটার কণ্ঠ ওর ভীষণ প্রিয়। যুগ যুগ ধরে চেনা ও আপন মনে হয় তার কাছে।

🦋🦋🦋

আজকে ১৫ মিনিট আগে শো শেষ করে অফিস থেকে বের হওয়ার জন্য উঠলাম।ইন্টারভিউতে সিলেকশন হয়েছি।তাই ইন্টারভিউ দিতে যাবো।গতকাল অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ভেবে দেখলাম কাজটা আমার সত্যি দরকার।নাভান বড় হচ্ছে। ওর তো একটা ভবিষ্যৎ আছে।চাকরীটা পাওয়ার সর্বস্ব চেষ্টা করবো।তারপরেও যদি না হয় তাহলে আর কিছু করার নেই।
সাদা রঙের একটা বড় গাউন আর মাথায় সাদা হিজাব বেঁধেছি।শো-এর রুম থেকে বের হতেই সাইমনের সাথে দেখা।ওর সাথে কথা বলার কোন ইচ্ছে নেই। তাই পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলাম।

সাইমনঃ কোথাও যাচ্ছেন নাকি মিসেস এনাজ আহমেদ? পোশাক-আশাকে তো মনে হচ্ছে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাচ্ছেন।

আমিঃ আমি কোথায় যাবো না যাবো সেটা কি আপনাকে কৈফিয়ত দিবো মিস্টার সাইমন?

সাইমনঃ তা নয়।কলিগ হিসেবে তো জিজ্ঞেস করতেই পারি।আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন?

আমিঃ কলিগ হিসেবে হলে কাজের প্রশ্ন আমায় করবেন।আমার পার্সোনাল বিষয়ে নাক গলাবেন না।আমি এটা পছন্দ করি না।আমি কোথায় যাবো কি করবো তা সম্পূর্ণ আমার ব্যাপার।তা নিয়ে আপনার মাথা না ঘামালেও চলবে।

সাইমনঃ আপনি কিন্তু সামান্য কারণে রেগে যাচ্ছেন?

আমিঃ আপনি আমার বিষয়ে নাক না গোলালে আমি খুশি হবো।আপনার ওপর একটুও রাগবো না।আপনি নিজের চরকায় তেল দিবেন।আমাকে নিয়ে আপনার এতো বেশি মাতামাতি আমার ভালো লাগে না। অন্য কাউকে নিয়ে তো আপনি এতটা পসেসিভ নন।তাহলে আমার সবকিছু তে আপনি কেন যেচে বা হাত ঢুকান।

সাইমনঃ আপনি কিন্তু আমায় অপমান করছেন।

আমিঃ আপনার মান-সম্মান আছে🤔? আমি তো জানতাম না।আপনার মান-সম্মান থাকলে না এসব অপমান আপনার গায়ে লাগতো।যদি আপমানগুলো আদোও আপনার গায়ে লাগতো তাহলে আমাকে নিয়ে আপনার এতো আগ্রহ থাকতো না।

সাইমনঃ আজ কিন্তু একটু বেশি বলছেন মিসেস নোভা ইসলাম।

আমিঃ লজ্জা থাকলে আমার সাথে যেচে আর কথা বলতে আইসেন না।অবশ্য আপনাকে তো আবার কুকুরের লেজের সাথেও তুলনা দেওয়া যায়।কুকুরের লেজ যেরকম হাজার টানলেও সোজা হয় না।তেমনি আপনাকে হাজার কথা শুনালেও সেই আমার পিছুই নিবেন।আপনার মতো বেহায়া লোক আমি দুটো দেখিনি।আজকের অপমান যদি মাথায় থাকে তাহলে আর আমার বিষয়ে কথা বলেন না।

সাইমনঃ সব কিছুর একটা লিমিট আছে।আমাকে এভাবে অপমান করার ফল কি হতে পারে তা তোমার ধারণায়ও নেই। মনে রাখবে পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে।ইদানীং তুমিও অতিরিক্ত উড়ছো।দেখো, আবার পাখা যেনো কেউ ছাটাই করে না দেয়।

আমিঃ আমাকে নিয়ে আপনার না ভাবলেও চলবে।আমি নিজের খেয়াল রাখতে পারি😊।ভবিষ্যতে কি হবে তা আল্লাহ ঠিক করে রেখেছে। তা নিয়ে এখন শুধু শুধু টেনশন করে ঘুম হারাম করার কোন প্রয়োজন নেই। আপনার শো শুরু করার সময় হয়ে গেছে। আমাকে নিয়ে না ভেবে শো তো সময় দিন।

কথাগুলো বলে চলে এলাম।সাইমন চোখ দুটো ছোট ছোট করে আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে ছিলো।
ঠোটে ছিলো এক রহস্যময়ী বাঁকা হাসি।যেটার মর্মার্থ বোঝার কোন ক্লু আমি পেলাম না।অফিস থেকে বের হয়ে একটা রিকশা নিয়ে ইন্টারভিউয়ের উদ্দেশ্য বের হয়ে গেলাম।

🦋🦋🦋

রিকশা এসে থামলো ৬ তালা একটা ভবনের সামনে।এই ভবনের ৩য়,৪র্থ,৫ম ফ্লোর নিয়ে একটা ছোট কোম্পানি। আমি রিকশার ভাড়া মিটিয়ে লিফটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। লিফটে উঠে তিন নাম্বার বাটনে ক্লিক করলাম।তিন তালায় এসে রিসিপশনে থাকা মেয়ের দিকে এগিয়ে গেলাম।

আমিঃ আসসালামু আলাইকুম আপু। আজ এই কোম্পানির ইন্টারভিউয়ের কথা ছিলো।দয়া করে আমাকে বলতে পারবেন তা কোথায় হচ্ছে?

—- আপনি ফোর্থ ফ্লোরে গিয়ে মিস্টার আদরের সাথে দেখা করুন।আদর হলো কোম্পানির ওনারের এসিস্ট্যান্ট।

আমিঃ আচ্ছা,শুকরিয়া আপু।

আবার লিফটে উঠে পরলাম।আমার সাথে এবার অনেকে ছিলো।সবাই সম্ভবত ইন্টারভিউ দিতে এসেছে। কারণ সবার হাতে ফাইল ছিলো।আমরা লিফট থেকে বের হয়ে সামনের দিক যেতেই প্রায় ২৭/২৮ বছরের একটা ছেলে আমাদেরকে একটা রুমে বসতে বলে চলে গেল। সম্ভবত এই ছেলেটার নাম আদর।কারণ একটা লোক এসে তাকে আদর বলে ডাক দিতেই সে বেরিয়ে গেলো। আমি দরদর করে ঘামছি।অনেক নার্ভাস লাগছে।কিছু সময়ের মধ্যে ইন্টারভিউ নেওয়া শুরু হয়ে গেলো।প্রায় ঘন্টাখানিক পর আমার নামে ডাক পরলো।আমি সাইড ব্যাগ থেকে ফাইল বের করে ধীর পায়ে ভেতরে এগিয়ে গেলাম।আমার সাথে আদর নামের ছেলেটি ছিলো।সে আমায় কেবিন দেখিয়ে দিচ্ছে।

আদরঃ এখান থেকে ডানে গিয়ে তিন রুমের পর শেষের রুমটায় আপনার ইন্টারভিউ নেওয়া হবে।আপনার আগে একটা ছোট ব্রেক গিয়েছে। তাই স্যার হয়তো বাইরেও থাকতে পারে। তবে পারমিশন নিয়ে ভেতরে ঢুকবেন।

আমিঃ আচ্ছা।

আদরঃ স্যারকে একটুও ভয় পাবেন না।উনি খুব ভালো মানুষ। আপনাকে খুব নার্ভাস লাগছে।তাই বললাম আরকি।

আমিঃ উনার নামটা কি? আসলে বিজ্ঞপ্তিতে দুটো নাম দেখেছিলাম। তাই জিজ্ঞেস করলাম।

আদরঃ তাজরান তাজওয়ার।

আদর চলে যাচ্ছিলো।আমি পেছন ফিরে তাকে ডাকলাম।

আমিঃ শুনুন।

আদরঃ জ্বি বলুন।

আমিঃ বলছিলাম কি, ইন্টারভিউ কয়জন নিচ্ছে? আমি জীবনের প্রথমে কোন কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিতে আসলাম।তাই কিছু জানি না।নাটক, সিনেমায় দেখেছি ইন্টারভিউতে অনেক মানুষ থাকে।যদি অনেক মানুষ থাকে তাহলে নিজেকে সেভাবে প্রস্তুত করে নিবো।

আদরঃ আপনি মে বি ভয় পাচ্ছেন।ভয় পাওয়ার মতো কিছু নেই। তাজরান স্যার একাই ইন্টারভিউ নিচ্ছে। অনেক মানুষ আছে এমনটা ভেবে ভয় পাওয়ার কোন দরকার নেই। আপনি কেবিনে গেলেই তাজরান স্যারকে পাবেন।

আমিঃ শুকরিয়া, সাহস দেওয়ার জন্য।

আদর আমাকে কেবিন দেখিয়ে দিয়ে অন্য দিকে চলে গেল।আমি ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম।যত এগিয়ে যাচ্ছি তত ভয়টা জেঁকে ধরেছে। কেবিনের সামনে গিয়ে থুম মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম।ভয়ে ইচ্ছে করছে উল্টো দিকে দৌড় দিতে।ভাবছি ভেতরে ঢুকবো কি ঢুকবো না।দোটানায় পরে গেছি।থাই গ্লাসের দরজায় কয়েকটা টোকা দিয়ে পারমিশন চাইলাম।

আমিঃ মে আই কাম ইন।

ভেতর থেকে কোন উত্তর এলো না।তাই আমি আবারো পারমিশন চাইলাম।এবার গম্ভীর কণ্ঠে কেউ বলে উঠলো।

— ইয়েস কাম ইন।

তার গলার স্বর পেয়ে আমার সারা শরীর কাঁপতে লাগলো।শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা একটা শিহরণ বয়ে গেলো।এই কণ্ঠ, এই কণ্ঠটা তো আমার চিরচেনা।আমি এই কণ্ঠের সাথে বহু আগের থেকে পরিচিত। আমার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে।আমি ভেতরে ঢুকছি না বলে আবারো সে বলো উঠলো।

— ভেতরে আসুন।

না,এবার আমি ভুল শুনিনি।আমার চিরচেনা কন্ঠ। কোনরকম থাই গ্লাস ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম।ছাই
রঙের কোর্ট-প্যান্ট পরিহিত এক লোক উল্টো দিকে ঘুরে পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ তার বাইরের ব্যস্ত নগরীর দিকে।তার পেছন দিক দেখে আমি আরেকটা বড়সড় ঝাটকা খেলাম।চোখ দুটো আমার কোটর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। সেই চিরচেনা দাড়িয়ে থাকা স্টাইল, পেছনের চুলের কাটিং,পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়ানো, পারফিউমের স্মেল। নাহ্ আমার ভুল হওয়ার কথা তো নয়।এটা কি করে সম্ভব??উনি সম্ভবত তাজরান তাজওয়ার। তার সবকিছুর সাথে তো মাত্র একজনের মিল আছে।তাহলে কি সে বেঁচে আছে। তাও বা কিভাবে?আমার হাত-পা ঠান্ডা হতে লাগলো।আমি স্পষ্ট সুরে মুখ ফসকে শেষ পর্যন্ত তার নাম নিয়েই ফেললাম।

আমিঃ এনাজ!!!!!!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে