পুতুল ছেলেটি পর্ব-১২

0
734

#পুতুল_ছেলেটি
#Part_12
#Writer_NOVA

আকাশের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে আকিব।চোখের কোণা বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পরছে।তার মাকে আজ বড্ড মনে পরছে।মা থাকলে হয়তো তার ছেলের সাফল্যে অনেক খুশি হতো।বাবা নামক নরপশুর কথা মনে পরে না। পরলেও রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে যায়।মানুষটার প্রতি ঘৃণা ছাড়া আর কিছু খুঁজে পায় না।কারণ তার বাবায় তার মা কে তার কাছে থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেতেই চোখ মুছে, হাসি মুখে ঘুরলো আকিব।

নীলাভঃ কাঁদছিস কেন?

আকিবঃ কোথায় না তো?(কৃত্রিম হাসি দিয়ে)

নীলাভঃ আমার কাছে মিথ্যে বলছিস?

আকিব এবার নিজেকে আটকাতে পারলো না। নীলাভকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠলো।নীলাভ কিছু বললো না।মাঝে মাঝে মন খুলে কাঁদতে দিতে হয়।তাতে মনের বোঝা হালকা হয়।কাঁদতে কাঁদতে আকিব বললো।

আকিবঃ আজ মা কে খুব মনে পরছে রে।সে আজ আমাকে এই পজিশনে দেখে খুব খুশি হতো।জানিস,
মৃত্যুর আগে আমি মায়ের চোখে বাঁচার আকুলতা দেখতে পেয়েছি। আমার জন্য বাঁচতে চেয়েছিলো।কিন্তু আল্লাহ তাকে নিয়ে গেলো।আমার জন্য তাকে ছেড়ে যেতে পারলো না।

নীলাভঃ আল্লাহ মানুষের যতটুকু হায়াত রেখেছে ততটুকু বাঁচতে পারবে।এক মিনিট বেশিও নয় কমও নয়।তাই কান্না না করে তার জন্য নামাজ পরে দোয়া কর কাজে দিবে।আমি তো চোখের সামনে নিজের বাবা,মা,ছোট ভাইরাকে পরপারে চলে যেতে দেখলাম।তখন তো তাদের আটকাতে পারিনি। তাদের মৃত্যু ছিলো এভাবে।তাই তো সেদিন বাবা যেতে রাজী না হলেও আমরা জোর করে বাবাকে রাজী করেছিলাম।

আকিবঃ বাবা প্রচুর জুয়া খেলতো।রাত নেই, দিন নেই মায়ের ওপর অমানুষিক অত্যাচার করতে।যখন তখন গায়ে হাত তুলতো।মা আমার জন্য মাটি কামড় দিয়ে সব মেনে নিতো।সে চাইতো না আমি বাবা ছাড়া বড় হই।প্রায় নানাবাড়ি থেকে টাকা এনে দিতে বলতো।মা দুইবার মামাদের হাতে,পায়ে ধরে টাকা এনে দিয়েছিলো।যদি তার নির্যাতনটা কমে সেই আশায়।কিন্তু তার লোভ দিনকে দিন বেড়ে যেতে লাগলো।আবারো ২০ হাজার টাকা আনার জন্য মা কে চাপ দিতে লাগলো।কিন্তু মা এবার আনতে চায়নি। কারণ মামাদের অবস্থা ভালো ছিলো না। একমাত্র বোন হওয়ায় তারা অনেক হেল্প করেছে।সেবার টাকা আনতে না পারায় বাবা ইচ্ছে মতো মাকে মেরেছে। রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে চলে যায়।আমি তখন মাত্র ৮ বছরের ছেলে।জীবন সম্পর্কে কিছুই বুঝতাম না। মা সেদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্না করেছিলো।আর বলেছিলো সে চলে গেলে আমি যাতে অনেক দূরে চলে যাই।হাসপাতালে নিতে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল। পরের দিন সকালে মা আমাকে একা করে চলে গেছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছিল। মাথা ফাটিয়ে ফেলেছিলো মায়ের। মায়ের কথা মতো আমি সব ছেড়ে চলে এলাম এখানে।বিশ্বাস কর নীলাভ, এখনো আমার চোখে আবছা ভাবে সেই সেই বিষাক্ত স্মৃতিগুলো ভাসে।আমার মায়ের বাঁচার আকুতি।

নীলাভঃ জীবন বড় অদ্ভুত আকিব।এখনো গ্রামের অনেক ছেলেরা এই ঘৃণিত কাজগুলো করে।কথায় কথায় গায়ে হাত তুলে।তারা ভাবে এতেই তাদের পুরুষের বীরত্ব প্রকাশ পায়।নারীকে অবলা ভেবে তারা তাদের শক্তি দেখায়।কিন্তু তারা একবারও ভাবে না এই নারীরা ছাড়া তারা অচল।জুয়ার মতো বাজে খেলার জন্য তারা শ্বশুরবাড়ি থেকে টাকা আনতেও দ্বিধাবোধ করে না।

আকিবঃ তার শাস্তি হয়েছিল। মামারা কেস করেছিলো।৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। কিন্তু মানুষটা নাকি এখনো বদলায়নি।নর্দমার কীট কি কখনো ভালো হয়।তাকে নিজের বাবা ভাবতেও আমার ঘৃণা হয়।তার কথা মনে হলেই মাথায় চিনচিন রাগ উঠে।

নীলাভঃ তার শাস্তি নিশ্চিয়ই আল্লাহ করবে।তার বিচারে কেউ নিরাশ হয় না।তিনি সর্বত্তম বিচারকারী।তার কাছে অন্যায়ের কোন নিস্তার নেই। আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখ।আর আন্টির জন্য বেশি বেশি করে নামাজ পড়ে দোয়া করবি।আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি না ফেলে জায়নামাজে বসে মোনাজাতে ফেলিস।তাহলে কাজে দিবে।

আকিবঃ হ্যাঁ,তুই ঠিক বলেছিস।আল্লাহর কাছে লাখো কোটি শুকরিয়া। সে আমাকে তোর মতো একটা বন্ধু মিলিয়ে দিয়েছে। যে আমাকে সর্বদা সৎ পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করিস।আমাকে সাপোর্ট করিস।

নীলাভঃ হয়েছে আমার গুণগান গাইতে হবে না। প্রশংসা সবসময় মানুষের আগেচরে করতে হয়।সামনাসামনি করলে সেটাকে পাম মারা বলে।আর দোষ বলতে হয় সামনাসামনি। যাতে সে তার দোষ গুলো জেনে নিজেকে শুধরে নিতে পারি।কিন্তু আমরা দোষ বলি আগেচরে।যেটা গিবতের শামিল।এখন এটা নিয়ে আলোচনা নয়।বিকেল তো হয়ে এসেছে। চল বৃদ্ধাশ্রম থেকে ঘুরে আসি।দেখবি মনটা এভাবেই ভালো হয়ে গেছে।

আকিবঃ আচ্ছা চল।অনেকদিন যাওয়া হয় না।

নীলাভ ও আকিব তৈরি হতে চলে গেল। মন বেশি খারাপ থাকলেই তারা বৃদ্ধাশ্রম থেকে ঘুরে আসে।এতে ওদের অনেক ভালো লাগে। যাওয়ার আগে তাদের জন্য খাবার ও উপহার নিতে ভুলে না।বৃদ্ধাশ্রমের মানুষগুলো ওদের পেলে ছারতেই চায় না।একসাথে রাতের খাবার খেয়ে তবেই ফিরতে দেয়।দুনিয়াটা সত্যিই বড় অদ্ভুত। কারো বাবা-মা নেই বলে কাঁদে। আর কেউ তাদের বোঝা ভেবে ফেলে রেখে যায়।

💗💗💗

পরেরদিন………

দুপুরে রোদটা আজ বেশি তেজ নেই। তারপরেও একটা ভাপসা গরমে সবাই অতিষ্ঠ। সাহিয়া কলেজ থেকে হেঁটে ফিরছে।রিকশা ইচ্ছে করে নেয়নি।কারণ রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে নীলাভকে খুঁজবে। দুদিন ধরে সে লাপাত্তা। তার কোন খোঁজ খবর নেই। আজ পেলে তার ৩৬০° সত্যিই বাজাবে।

সাহিয়াঃ আমার থেকে কতদিন পালিয়ে বাঁচবে পুতুল ছেলে।আমি তো তোমাকে পাকড়াও করবোই করবো।একবার সামনে পাই তোমাকে। আমাকে দূরে ঠেলে দেওয়া জন্মের মতো ঘুচিয়ে দিবো।আমাকে তো চিনো না। তোমার কথা আমি কত সাহস করে বাবাইকে বললাম।আর তুমি লাপাত্তা। দাঁড়া ব্যাটা।তোমার মজা যদি আমি না দেখাই তাহলে আমি নাম পাল্টে ফেলবো।আমার মন বলছে আজ তোমার সাথে দেখা হবে।যদি দেখা হয় তাহলে তুমি আজকে গেলে পুতুল ছেলে।

সাহিয়া নিজের মনে বিরবির করতে করতে রাস্তা চলছে।সে অনেকটা রেগে আছে।হঠাৎ সামনে চোখ যেতেই নীলাভকে দেখতে পেলো।একটা ভ্যান গাড়ি ভর্তি নানা প্যাকেট জাতীয় খাবার।নীলাভের এক হাতে ছোট একটা ডায়েরি, অপর হাতে কলম।সে একটা ফুড স্টোরের দোকানদারের সাথে কথা বলছে।আর অর্ডার কাটছে।কথা শেষ হতেই দুই কাটন বিস্কুট দিয়ে অন্য দিকে চললো।সাহিয়া দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে পরলো।নীলাভ ওর সামনে দিয়ে যেতে নিলে ওর এক হাত টেনে দেয়ালের আড়ালে নিয়ে এলো।

নীলাভঃ আরে কে আপনি?আমার হাত ধরেছেন কেন?ছাড়ুন আমায়।

সাহিয়াঃ একদম ঢং করবে না পুতুল ছেলে।নয়তো ঘুষি মেরে মুখের আদল বদলে দিবো।

নীলাভঃ ম্যাম, আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি পুতুল ছেলে নই।

সাহিয়াঃ আরেকবার ম্যাম বললে রাস্তার মানুষের হাতে গণধোলাই খাওয়াবো।কল মি হিয়া।তোমার হিয়াপাখি।তুমি আমাকে হিয়াপাখি বলে ডাকবে।আর আপনি বললে অবস্থা খারাপ করে দিবো।

সাহিয়া সামনে এসে নীলাভের টি-শার্টের কলার ধরে কথাগুলো বললো।নীলাভ বড়সড় একটা শুকনো ঢোক গিললো।অভিনয় করেও লাভ হলো না।সাহিয়ার ধমক শুনে ভিজে বিড়াল হয়ে গেলো। আজ তার ৩৬০° নির্ঘাত বাজবে।

নীলাভঃ আমার কলার ছাড়ুন।এটা কোন ধরনের অসভ্যতামী?রাস্তার মানুষ দেখলে খারাপ বলবে।

সাহিয়াঃ একদম চুপ।তোমার কোন কথা শুনবো না।তুমি আমাকে কল করোনি কেন?দুই দিন ধরে তোমার কলের অপেক্ষা করতে করতে আমি বুড়ি হতে চললাম।আর তোমার কোন খবর নেই।

নীলাভঃ কলারটা ছাড়ুন।(শান্ত গলায়)

সাহিয়াঃ ছাড়বো না, কি করবে?

নীলাভঃ নিজেই ছাড়িয়ে নিবো।

নীলাভ এক ঝাটকায় ওর কলারটা ছাড়িয়ে নিলো।ছেলেরা আর যাই করুক নিজের কলারে অন্য কারো হাত সহ্য করতে পারে না। রাগ উঠে যায়। কিন্তু নীলাভ রাগের জন্য ছাড়ায়নি।রাস্তার মানুষ দেখলে খারাপ ভাববে। তার জন্য সাহিয়ার হাত সরিয়ে দিয়েছে।

সাহিয়াঃ তুমি কোথায় ছিলে এই দুই দিন?

নীলাভঃ একটু কাজ ছিলো।আজ আবার একজনের বদলে ফুড ফ্যাক্টরী থেকে অর্ডার কাটতে এসেছি।আরো অনেকগুলো দোকান বাকি আছে। আমি এখন যাচ্ছি।

সাহিয়াঃ কোথায় যাচ্ছো?

নীলাভঃ বাসায়,বাকি অর্ডার বিকেলে কাটবো।

সাহিয়াঃ চলো আমিও যাবো।

নীলাভঃ মানে!!!!!( অবাক হয়ে)

সাহিয়াঃ মানে, আমি তোমার বাসায় যাবো।যাতে করে তুমি আবার লাপাত্তা হলে সোজা তোমার বাসায় গিয়ে উঠতে পারি।

নীলাভঃ বিনা দাওয়াতের মানুষ আমি আমাদের বাসায় নেই না।সেধে সেধে কেউ গেলে তাকে ছোঁচা উপাধি দেই।(মুখ টিপে হেসে)

সাহিয়াঃ একদম ফাইজলামি করবে না পুতুল ছেলে।আমি যেহেতু বলেছি তোমার বাসায় যাবো তার মানে যাবো।আর কোন কথা নেই। আমার হবু বরের বাসা আমাকে তো জানতে হবে।যাতে করে আমি আগের থেকে সংসারের সবকিছু প্ল্যান করতে পারি।

নীলাভঃ হবু বর???

সাহিয়াঃ বাবাই কে তোমার কথা বলেছি।বাবাই তোমাকে বাসায় নিয়ে যেতে বলেছে।তোমার সাথে কথা বলবে।তোমাকে বাবাইয়ের পছন্দ হলে আমাদের বিয়ের কথা পাকা।আর সেজন্য তোমাকে আমি হারিকেন দিয়ে খুঁজছি। কিন্তু তোমার খোঁজ নেই।

সাহিয়া এক প্রকার জোর করেই নীলাভের বাসায় যেতে লাগলো।নীলাভ অবাক হয়ে আছে। এই মেয়ে তো সবকিছুতে তার দুই ডবল আগে। নীলাভ আগে চলছে।সাহিয়া পেছনে।সাহিয়া এগিয়ে এসে নীলাভের এক হাতের ধরে হাঁটতে লাগলো।নীলাভ চোখ দুটো বড় বড় করে সাহিয়ার দিকে তাকালো। সাহিয়া এই সুযোগের অপেক্ষা করছিলো।নীলাভের হাত ছেড়ে তার ওড়না দিয়ে নীলাভের মুখের ঘাম মুছে দিলো।তারপর একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে নীলাভের হাত ধরে হাঁটতে লাগলো। নীলাভ এখন ঘোরের মধ্যে আছে। ডোজটা আজ একটু বেশি হয়ে গেছে। সাহিয়া মিটমিট করে হাসতে হাসতে পথ চলছে।আর নীলাভ শর্কড।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে