পুতুল ছেলেটি পর্ব-০৫

0
839

#পুতুল_ছেলেটি
#Part_05
#Writer_NOVA

হালকা কফি রঙের একটা প্রাইভেট কার চলছে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে। তার মধ্যে সফট মিউজিকের আওয়াজ ভেসে আসছে।ইংলিশ মিউজিক হবে হয়তো।কারণ শব্দগুলো অস্পষ্ট। গাড়ি চালাচ্ছে ৩৭ এর উর্ধ্বে বয়সী এক লোক।তার পাশের সিটে ৩২ বয়সী এক মহিলা।কিন্তু তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই তার যে দুটো ছেলে সন্তান আছে।গায়ের রং মাত্রাতিরিক্ত ফর্সা।চোখ দুটো নীল বর্ণের।চুলগুলো ধূসর রঙের। পুতুলের থেকে কোন অংশ কম নয়।লোকটার চুলগুলো কালো।চোখ গুলো ধূসর।পেছনের সিটে বসে আছে ১২ বছরের ও ৮ বছরের দুটো ফুটফুটে ছেলে। বড় ছেলের চোখ নীল ও চুল তার মায়ের মতো ধূসর।আর ছোট ছেলের চোখ মায়ের মতো নীল হলেও চুলগুলো বাবার মতো কালো।সবার মুখে হাসি। ১২ বছরের ছেলেটা মুগ্ধ চোখে বাইরের পরিবেশ দেখছে।আর ছোট ছেলেটা তার হাতে থাকা স্পাইডার ম্যান নিয়ে খেলা করছে।

গতকাল রাতে বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তার আশেপাশে অনেকটা কাঁদাযুক্ত হয়ে আছে।পুরো রাস্তাও কাদায় মাখামাখি। পাহাড়ি রাস্তায় এভাবেই খুব সাবধানে ড্রাইভ করতে হয়।আর বৃষ্টি হলে তো কোন কথাই নেই। একটা বিশাল খাদের পাশ দিয়ে খুব সাবধানে ড্রাইভ করছিলো লোকটি।কিন্তু ভাগ্য তাদের সহায় ছিলো না।বাঁকে মোড় নিতে গিয়ে কাঁদায় পিছলে গাড়িটা উল্টে খাদে পড়ে যায়। ১২ বছরের ছেলেটি ছিটকে গাড়ি থেকে অপজিট দিকে পরে যায়।আর বাকি তিনজন সহ গাড়িটা খাদে পরে গিয়ে আগুন ধরে যায়।গাড়ি থাকা কেউ বাঁচে না।বাচ্চাটি চোখের সামনে তার বাবা-মা, ও ছোট ভাইকে গাড়িতে জ্বলতে দেখে। চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।কিন্তু জনমানবহীন বিরান এলাকায় কেউ ছেলেটার আর্তনাদ শুনতে পায় না।একসময় ছেলেটাও জ্ঞান হারায়।

লাফ দিয়ে ঘুমের থেকে উঠে পরে নীলাভ।আবারো সেই ভয়ানক স্বপ্নটা।সারা শরীর ঘেমে ভিজে একাকার। খাটের পাশে থাকা টুল থাকা জগ থেকে পানি খেয়ে নেয়।বুকটা এখনো ঢিপঢিপ করছে। পাশ থেকে আকিব ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে উঠে।

আকিবঃ কি ব্যাপার তুই ঘুমাসনি?

নীলাভঃ আবার ঐ স্বপ্নটা দেখেছি।

আকিবঃ কোন স্বপ্নটা?

নীলাভঃ বাবা-মা আর ভাইয়ের মৃত্যুর স্বপ্নটা।আমি আজও কেন সেই ঘটনা ভুলতে পারছি না। যত চাইছি ঐ ভয়ানক মুহুর্তগুলো মনে করতে না।ততই আমার সামনে এসে হানা দিচ্ছে। আমি তো ঐ ঘটনাগুলো মনে করতে চাই না।১৪ বছর আগের সেই কালো অধ্যায় কেন আমার স্বপ্নে আসে?

আকিব চোখ দুটো ডলে উঠে বসলো।নীলাভ ছটফট করছে।ওর এখন কিছুই ভালো লাগবে না।

আকিবঃ তুই শান্ত হো।আমাদের জীবনের এমন অনেক বিষাক্ত স্মৃতি আছে।যা আমরা হাজার চেষ্টা করেও ভুলে থাকতে পারি না।ঘুরে ফিরে আমাদের কাছে হাজির হবেই।তোর অতীত তোকে হানা দেবেই নীলাভ। এখন এসব না ভেবে ঘুমিয়ে পর।

নীলাভঃ আমি তো চাই না ঐ ভয়ংকর স্মৃতি মনে করতে।সব ভুলে নিজেকে শক্ত করে সামনে এগিয়ে যেতে চাই। তাহলে কেন আমার স্বপ্নে এসে সব এলোমেলো করে দেয়। তুই ঘুমিয়ে পড়।আমার আজ রাতের ঘুম হারাম।

নীলাভ উঠে তার রুমের সাথে ছোট বারান্দায় গিয়ে চেয়ার টেনে বসলো।আকিব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শুয়ে পরলো।সেদিনের বেঁচে থাকা ১২ বছরের ছেলেটি আজকের নীলাভ সফওয়াত।তার বাবা-মা ও ছোট ভাইকে নিজের চোখের সামনে জ্বলে,পুড়ে যেতে দেখেছে।তীব্র ইচ্ছা থাকতেও সে পারেনি তাদেরকে বাঁচাতে।

💗💗💗

সকালের নাস্তা সেরে মাত্রই উঠেছে হাবিবুর রহমান। চিন্তায়, চিন্তায় তার ডায়বেটিসও অনিয়ন্ত্রিত হয়ে গেছে।রুমে গিয়ে সোফায় মাথাটা হেলিয়ে দিলো। এখনো ঐ নীল চোখের ছেলেটাকে পাওয়া যায়নি।তার সব পাপের প্রমাণ আছে ছেলেটার কাছে।একবার খবরের কাগজে সেটা ছাপা হয়ে গেলে তার সুখের সম্রাজ্য শেষ। মিনারা খাতুন পানের বাটা নিয়ে তার স্বামীর পাশে এসে বসলো।

মিনারাঃ কি হয়েছে আপনের?কয়েকদিন ধইরা দেখতাছি আপনি সারাদিন কি জানি চিন্তা করেন?কাজ-কাম দেখতেও যান না।ফ্যাক্টরীতে একটা উঁকি মাইরাও তো আসতে পারেন।সারাদিন রুমে শুইয়া,বইসা না থাইকা ফ্যাক্টেরীতে গেলেও তো একটু ভালো লাগবো।

হাবিবঃ কানের সামনে ক্যাট ক্যাট করো না তো মাহিমের মা।আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। তোমার এই ক্যাট-ক্যাটানিতে আরো খারাপ লাগবে।

মিনারাঃ আল্লাহ,কি হইছে আপনার মাহিমের আব্বা?শরীর কি অনেক খারাপ লাগতাছে? ডাক্তার ডাকমু।কথা কোন না কে?ও মাহিমের আব্বা।

হাবিবঃ মাইয়া মানুষ নিয়া এই একটাই জ্বালা।সবসময় চার লাইন বেশি বোঝে।যেটা না বলবো তাতো বুঝবোই।সাথে আরো তিন লাইন বেশি জুড়ায় নিবো।তোমারে কি আমি বলছি আমার অনেক খারাপ লাগছে।বরং আমি বলছি এমনি ভালো লাগছে না। তোমার ফালতু প্যাঁচাল শুনলে আরো খারাপ লাগবে।

মিনারাঃ আমি ভালো কথা কইলেও তো আপনের ভালো লাগে না। আমি মূর্খ-সুর্খু মানুষ। গ্রামের মাইয়া।বেশি পড়ালেখা করবার পারি নাই।ক্লাশ সিক্স পর্যন্ত পড়ছিলাম।তারপর তো আপনে দেখতে আইয়া পছন্দ কইরা ফালাইলেন।আর আব্বায় আপনার সাথে বিয়া দিয়া দিলো। তবে আমি ভালো কইরা স্বামীর যত্ন-আত্তি করতে পারি।আপনি হইলেন মেট্রিক পাশ করা পোলা।গ্রামের চেয়ারম্যান। আপনার লগে কি আমার জোড়া।

হাবিবঃ মাহিমের মা,তুমি আবার শুরু করলা?এসব ছাড়া কি তোমার কোন কথা নাই?

মিনারাঃ মাহিমের আব্বা, পোলায় কি আপনেরে কল করছিলো?বউ,বাচ্চা লইয়া ভালো আছে তো?কতদিন ধইরা পোলাডারে একনজর দেহি না।একটামাত্র পোলা আমগো।কত আশা ছিলো আমগো সাথে থাকবো।কিন্তু ঐ বিদেশি মাইয়া বিয়া কইরা ঐ জায়গায় রইয়া গেল।

হাবিবঃ এই করোনার মধ্যে কি ছেলে আসতে পারবো?আমি তোমাকে ভিডিও কলে কথা বলায় দিবোনি।তাও তুমি এসব কথা বন্ধ করে তোমার কাজে যাও।আমাকে একটু একা থাকতে দেও।

মিনারা খাতুন পানের বাটা থেকে পান বের করে তার মধ্যে যাবতীয় জিনিসপত্র দিতে লাগলো।তারপর পানটাকে ভালোমতো মুড়িয়ে মুখে পুরে নিলো।আঙুলের ডোগায় চুনের ডিব্বা থেকে চুন নিলো।পানের বাটা পাশে রেখে স্বামীকে প্রশ্ন করলো।

মিনারাঃ আচ্ছা, আপনি কি করোনার ঔষধ বানাইতে পারেন না?আপনিও তো ম্যাট্রিক পাশ করা।সেই কালের ম্যাট্রিক পাশ তো এই যুগে অনেক দামী।আপনেও তো চেষ্টা করলে বানাইতে পারেন।আপনি পারেন না এমন কোন কাম আছে নাকি।আপনি হইলেন এই গ্রামের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। আপনি করোনার ঔষধ বানাইলে তো আমগোর গ্রামের সবাই সুস্থ থাকবো।

স্ত্রীর কথা শুনে হাবিবুর রহমান হাসবে না কাঁদবে তাই বুঝতে পারছেন না।তাই আহাম্মকের মতো তাকিয়ে রইলেন।মাথার ভেতর চিনচিন করে রাগ উঠছে।স্বামী তার দিকে তাকিয়ে আছে। তা দেখে মিনারা খাতুন পান চাবাতে চাবাতে একটা মন কাড়া হাসি দিলো।তাতে হাবিবুর রহমানের আরো বেশি রাগ উঠলো।কিন্তু কোন কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

💗💗💗

সকাল থেকে কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছে সাহিয়া।বাসায় মেহমান মানেই তো একগাদা কাজ-কর্ম। তা যদি হয় বড় বোনের হবু শ্বশুরবাড়ির মানুষ। তাহলে তো কোন কথাই নেই। সারা রুম গুছিয়ে সবেমাত্র বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিলো সাহিয়া।সেই মুহুর্তে মেহমান চলে এলো।সাজিয়ার হবু বর তুরাগ,তার বাবা-মা, ছোট ভাই তোরাব,বড় বোন তুশি ও তার হাজবেন্ড আরাফ এসেছে। তুশি ও আরাফের ছোট ২ বছরের মেয়ে আফিফাও আছে।

সাজিয়াঃ হিয়া,ওরা চলে এসেছে। শরবতটা ফ্রীজ থেকে বের করে সার্ভ করে দে।

সাহিয়াঃ কয়েকদিন তোমার বিয়ে। এখন তাদের আসার কি দরকার তা আমি বুঝলাম না।(বিরক্ত হয়ে)

সাজিয়াঃ চুপ কর মেয়ে। কি যা তা বলিস?তারা শুনতে পেলে খারাপ বলবে।আমার ননদের জামাই আমাকে সামনাসামনি দেখতে চেয়েছে। আর্মির চাকরী করে তো। তাই বিয়ের সময় ছুটি নিয়ে আসতে পারবে না।

সাহিয়াঃ তাহলে পরেই আসতে পারতো।এখন আসার কি দরকার ছিলো?

সাজিয়াঃ একটা চড় লাগাবো। চুপ কর।আর যা বলছি জলদী কর।তোর যে কি হয়েছে? আমিও বুঝতে পারছি না। আগে তো কখনও এসব কথা বলিস নি।

সাহিয়াঃ তোমায় ডাকছে। তুমি যাও।আর আমাকে নিয়ে গবেষণা করতে হবে না।

সাজিয়া চলে গেল। সাহিয়া নিজের মনে তার বোনের কথাগুলো ভেবে নিজেই অবাক হলো।তাই তো,ও তো কখনো এরকম করেনি। তাহলে হঠাৎ কি হলো?ঐ পুতুল ছেলেটি কে দেখার পর থেকে সে অনেকটা খিটখিটে মেজাজের হয়ে গেছে। কারো সাথে কথা বলতে ভালো লাগে না।একা থাকতেই ভালো লাগে। আর ঐ ছেলেটাকে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে। কোন কাজেই মনোযোগ বসে না।

বেশি কিছু না ভেবে শরবত ও অনান্য খাবার নিয়ে তাদের সামনে গেলো সাহিয়া। সেখানে বেশি সময় থাকলো না।দুপুরের সবার সাথে খাবার খেতে বসতে চায়নি হিয়া।ওর হবু দুলাভাই জোর করে ওকে নিয়ে সবার সাথে বসালো।কিন্তু সেখানে গিয়ে পরলো বিপাকে।বার বার আড়চোখে তোরাব, সাহিয়াকে দেখছে।একসময় কথাও বলে উঠলো।

তোরাবঃ তা বিয়াইন এবার কি SSC দিবেন নাকি?পড়াশোনা কেমন চলছে?আপনাকে দেখতে কিন্তু অনেকটা বাচ্চা লাগে।আপনি কি আরো নিচের ক্লাশে পড়েন নাকি?

সাহিয়া তার বোনের দিকে তাকালো।সাজিয়া মিটমিট করে হাসছে।সাহিয়া নিজের রাগকে কন্ট্রোল করে মুখে হাসি ঝুলিয়ে উত্তর দিলো।

সাহিয়াঃ নাহ্ ভাইয়া।আমি এবার অনার্স ২য় বর্ষে পড়ালেখা করছি।আর আমাকে দেখে যতটা বাচ্চা মনে হয় ততটা বাচ্চা আমি নই।তাই আমাকে বাচ্চা ডাকা বন্ধ করুন।আমি যথেষ্ট ম্যাচুউর।আমার বয়স ২৩ বছর।মুখে বাচ্চা ভাব আছে বলেই যে আমি বাচ্চা মেয়ে এমনটা ধরণা করেন না।

তোরাব হা করে তাকিয়ে রইলো।বলে কি মেয়েটা?এর নাকি ২৩ বছর।দেখে মনে হয় এবার SSC পরীক্ষা দিবে।তাই তো সে পরীক্ষার কথা জিজ্ঞেস করেছিলো।মেয়েটার মুখে বাচ্চা ভাব দেখে কখনো বুঝেনি যে এত বড় মেয়ে। সাহিয়া কিছুটা বিরক্ত হয়ে জলদি করে খাবার খেয়ে চলে এলো।

যদিও এটা প্রথম নয়।প্রায় সবাই তাকে বাচ্চা মেয়ে ভাবে।সাহিয়াকে দেখে বাচ্চা মনে হয় বলে, অনেকে তো বিশ্বাসও করতে চায় না যে ও অনার্সে পড়ে।নীলাভও তো ওকে বাচ্চা মেয়ে ভেবে বসে আছে।এই ধরনের পরিস্থিতিতে সাহিয়া আগেও বহুবার পরেছে। প্রথম প্রথম রাগ লাগলেও এখন কিছু মনে করে না। তাছাড়া সেখান থেকে চলে আসার আরেকটা কারণ আছে। সেটা হলো তোরাবের হাব-ভাব ভালো ঠেকছে না সাহিয়ার।তোরাবের কথার আকারে-ইঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছে সে সাহিয়াকে পছন্দ করে ফেলেছে।বড় বোনের দেবর থাকলে এই আরেক সমস্যা। চান্স মারতে ভুলবে না।কিন্তু এই তোরাব কি করবে তা আল্লাহ মালুম!!!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে