নভেম্বরের শহরে পর্ব-০৯

0
729

#নভেম্বরের_শহরে
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৯

কালো কোর্ট পরিহিত কয়েকজন লোক মোটা মোটা ফাইল হাতে দাড়িয়ে আছে। নুহা লোকগুলোকে ভালো করে দেখে নিয়ে তাদের হাতের সেই মোটা ফাইলের দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। তাদের মধ্যে থেকে একজন ভারি গলায় বলল
–এটা কি এনামুল সাহেবের বাড়ি?

নুহা কৌতূহলী কণ্ঠে বলল
–জি। আপনারা?

–আমরা একটু অফিসিয়াল কাজে এসেছি। বাসায় কেউ নেই? মানে বড় কেউ নেই? একটু কথা বলতাম।

নুহা ঘাড় বেকিয়ে মায়ের দিকে তাকাল। মা তো আছে কিন্তু কথা বলতে দেয়া কি ঠিক হবে? কি কথা বলবে তারা? মাথায় অস্থির চিন্তা ভিড় করলো। লোকটা আবারো বলল
–কোন সমস্যা না থাকলে আমরা ভিতরে আসতে পারি?

নুহা একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–মা আছেন। ভেতরে আসুন।

দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো নুহা। লোকগুলো ভেতরে চলে আসলো। মৌ তাদেরকে দেখে ঘরে চলে গেলো। নুহার মা মাথার কাপড় বড় করে টেনে দিলেন। ভেতরে ঢুকেই তারা নুহার মাকে সালাম দিলো। তিনি বসতে বললেন তাদেরকে। নুহা এক পাশে গুটিসুটি মেরে দাড়িয়ে থাকলো। তাদের মধ্যে থেকে একজন অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলল
–বিরক্ত করার জন্য আমরা অত্যন্ত দুঃখিত। আমরা ব্যাংক থেকে এসেছি। আপনার সাথে জরুরী কথা বলতে চাই।

নুহার মা একটু চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এরকম ভাবে বাইরের কোন লোকের সাথে তিনি কখনও অফিসিয়ালি কথা বলেন নি। সব নুহার বাবাই সামলে নিত। কিন্তু এখন এই অবস্থায় কি কথা বলবেন আর কিভাবেই বা বলবেন তা বুঝতে পারছেন না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন
–জি বলেন।

যার হাতে মোটা ফাইল ছিল তিনি সেটা খুলে বিড়বিড় করে কি যেন পড়লেন। তারপর সেদিকে তাকিয়েই বললেন
–এনামুল সাহেব আমাদের ব্যাংক থেকে ১০ লক্ষ টাকা লোণ নিয়েছিলো ব্যবসার কাজে। পুরো টাকাটাই উনি ব্যবসার কাজে লাগিয়ে দেন। আর সেই টাকার চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ বাড়তে থাকে। কিন্তু তিনি এখন অব্দি কোন টাকাই ব্যাঙ্কে জমা দেন নি। গত ৫ বছরে সুদের টাকা অনেক বেড়ে গেছে। আর আসলটাও পড়ে আছে। সে হিসেবে অনেক টাকা ব্যাংক আপনাদের কাছ থেকে পায়। কিন্তু উনি তো এখন নেই। তাই ওনার হয়ে আপনাদের লোণটা শোধ করতে হবে। আর সেটা সম্ভব না হলে আপনাদের এই বাড়িটা হয়তো নিলামে চলে যাবে।

কথা গুলো স্থির হয়ে শুনছিল মা মেয়ে। তাদের কোন রকম প্রতিক্রিয়া হল না। কারন তারা কিছুই বুঝতে পারছে না। সব কেমন গোলমেলে লাগছে। কিন্তু শেষের কথাটা ঠিকই তাদের নাড়িয়ে দিয়েছিলো। বাড়ি নিলাম হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা। এর মাঝেই একজন একটা কাগজ নুহার মায়ের হাতে ধরিয়ে দিলো। বলল
–আপনাদের এই কাগজটা নিয়ে ব্যাঙ্কে দেখা করতে হবে। আর সেখানে কথা বলে আপনারা আপনাদের সমস্যার কথা বলবেন। ঠিক কতদিনের মধ্যে লোণটা শোধ করতে পারবেন।

লোকগুলো কথা শেষ করেই বের হয়ে গেলো। নুহা দরজা লাগিয়ে দিয়ে মায়ের হাত থেকে কাগজটা নিয়ে পড়ে দেখতে লাগলো। সেই একই কথা লেখা আছে কাগজে। মা মেয়ের মুখের কথা হারিয়ে গেছে। দুজন ছলছল চোখে দুজনের চোখের দিকে তাকাল। কিসব হচ্ছে তাদের সাথে কিছুই বুঝতে পারছে না। সেই সময় আবারো কলিং বেল বেজে উঠলো। চমকে উঠলো দুজনই। আবার কে এলো? নুহা কাগজটা লুকিয়ে রেখে চোখ মুছে দরজা খুলে দিলো। রেহানাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হল। এই সময় তো তার আসার কথা নয়। একটু অপ্রস্তুত হয়েই সালাম দিলো। রেহানা সালাম নিয়ে ভেতরে আসলেন। নুহা দরজা বন্ধ করতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন
–ব্যাংক থেকে লোক এসেছিলো দেখলাম। কোন সমস্যা?

নুহা তার মায়ের দিকে তাকাল। নুহার মা কথা বলার মতো কিছু খুজে পাচ্ছেন না। রেহানা এবার বসে পড়ল। নুহাকে হাত ধরে কাছে টেনে নিয়ে বলল
–কি হয়েছে মামনি? আমাকে বলতে কি সমস্যা আছে?

নুহা বুঝতে পারলো না বলবে কিনা। চুপ করে থাকলো। রেহানা একটু হতাশ কণ্ঠে বলল
–তোমাদের পরিবার নিয়ে কোন কথা থাকলে থাক। আমি জোর করবো না। ভেবেছিলাম কোন সমস্যা হল কিনা। আর আমি যদি কোন ভাবে সাহায্য করতে পারি তাই আর কি।

নুহা একটু ইতস্তত করতে করতেই বলে ফেলল
–আসলে আনটি ওনারা বলছিল বাবা নাকি ব্যাংক থেকে ১০ লক্ষ টাকা লোণ নিয়েছিলো। সেটা এখন বাবার অবর্তমানে আমাদেরকে শোধ করতে হবে। অনেক টাকা নাকি ব্যাংকে জমে গেছে।

রেহানা বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবেই নিলো। কারন সে আনিসের কাছে শুনেছিল লোণের কথা। কিন্তু কত টাকা লোণ আছে সেটা জানতো না। মা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো তাদের কাছে বিষয়টা অস্বাভাবিক। হয়তো টাকার অংকটা একটু বেশীই তাই। রেহানা শান্তনা দিতেই বলল
–চিন্তার কোন কারন নেই। ঠিক হয়ে যাবে।

কথাটা শেষ করতেই নুহার মা হুহু করে কেদে উঠলেন। নুহা তাকে ধরে বসাল সোফায়। রেহানা তার কাছে গিয়ে শান্তনা দিলেন। কিন্তু তার কান্না কিছুতেই কমছে না। রেহানার তাদের আচরন একটু অস্বাভাবিক লাগলো। নুহাকে বলল
–মামনি আর কোন সমস্যা আছে? থাকলে বলতে পারো।

নুহা মৃদু কণ্ঠে বলল
–আসলে আনটি বাবার যে এতো টাকা ব্যাংকে লোণ ছিল এটা বাবা কখনও বলেনি। আমরা তো জানি বাবার কোন লোণ নেই।

রেহানা কিছুক্ষন ভাবল। তারপর বলল
–হয়তো তোমার বাবা বাসায় জানাতে চান নি তাই বলেন নি। আমি জতদুর শুনেছি দোকানের জিনিসপত্র কেনার সময় ওনাকে ব্যাংক থেকে লোণ নিতে হয়।

নুহার মা রেহানার কথার তীব্র প্রতিবাদ করে বললেন
–এটা কিভাবে সম্ভব? ওনার দোকানের জন্য আমি নিজের গয়না বিক্রি করে টাকা দিয়েছি। আর ওটা দিয়েই উনি দোকানে জিনিসপত্র কিনেছেন। লোণ নেন নি তো।

রেহানার ভ্রু কুচকে এলো। কিছুক্ষন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল
–হয়তো ঐ টাকা দিয়ে হয়নি। আরও টাকা লেগেছিল। তাই লোণ নিয়েছিলেন।

সালেহা বলল
–না আপা। জমি বিক্রির টাকা ছাড়া যেটা লেগেছে সেটা আমি আমার গয়না বিক্রি করেই দিয়েছি। ওনার কোন লোণ ছিল না। আমি সব জানি।

রেহানা এবার বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। সেদিন হাসপাতালে আনিসের কথা আর আজ নুহার মায়ের কথা দুই রকম। কিন্তু কেন? যে কোন একজন মিথ্যা বলছে। মিথ্যা বলে তাদের লাভটা কি? নুহার মা মিথ্যা বলবে বলে মনে হয়না। কারন তিনি এখন পর্যন্ত কোন কথাই মিথ্যা বলেন নি। তাহলে কি আনিস মিথ্যা বলেছে? কিন্তু আনিসের কি লাভ মিথ্যা বলে? রেহানা এবার কৌতূহল বসতো জিজ্ঞেস করল
–এই বাড়িটা আপনারা কবে কিনেছেন?

নুহার মা কাদতে কাদতে বলল
–নুহা হওয়ার আগেই এই বাড়িটা ওর বাবা কিনেছে।

রেহানার এবার সন্দেহ গাড় হল। ঠাণ্ডা মস্তিষ্কে হিসাব মিলাতে চেষ্টা করলো। কিন্তু লাভ হল না। সেদিন আনিস বলেছিল মেয়েদের পড়ালেখার তাগিদে শহরে আসা। তাহলে আনিসের সব কথাই মন গড়া। কিন্তু এতে কি লাভ? রেহানা একটু ভেবে বললেন
–চিন্তা করবেন না আপা। আপনি একটু রেস্ট নেন। নাহলে অসুস্থ হয়ে পড়বেন।

নুহা সালেহাকে রুমে দিয়ে আসলো। বাইরে বের হয়ে দেখে রেহানা সোফায় বসে আছে। গভির চিন্তায় ডুবে আছে। কাছে গিয়ে বলল
–আনটি আপনাকে চা দেই?

রেহানা ভাবনা থেকে বের হয়ে বলল
–চা খাবনা। তুমি একটু বস। কথা ছিল।

নুহা বসলো। রেহানা একটু চিন্তিত হয়ে বললেন
–আচ্ছা আনিস সাহেব আর মাসুদ সাহেব কেমন লোক?

নুহা এমন কথা শুনে তার দিকে তাকাল। তার মানে সে কথাটা বুঝতে পারেনি। রেহানা একটু সহজ করার জন্য বলল
–আসলে আমি বলতে চেয়েছিলাম যে। ওনাদের সাথে তোমার বাবার সম্পর্ক কেমন ছিল? ভাই হিসেবে ঠিক কতটুকু মুল্যায়ন করতো? আর তোমার নাকি একটা ফুপু আছে? তিনি কোথায় থাকেন? তোমার বাবার খোজ পেতে গেলে এগুলো জানা দরকার মামনি। তাই জিজ্ঞেস করছি।

নুহা মাথা নাড়ল। সে এক এক করে তার বাবা আর বাবার পরিবারের সব লোক সম্পর্কে জানালো রেহানাকে। রেহানা সব শুনে আর সময় নষ্ট করলেন না উঠে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় নুহার দিকে ফিরে বললেন
–আমি একটা কথা বলতে এসেছিলাম। তোমার মায়ের সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এই অবস্থায় মনে হয়না কথাটা বলা ঠিক হবে।

নুহা কৌতূহল বসতো জিজ্ঞেস করলো
–কি কথা আনটি?

–তোমাদের বিয়ের কথা।

————-
চারিদিকে অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যা নেমেছে বললেই চলে। এই রাস্তাটায় গত দুইদিন যাবত এক ভাবেই গাড়ি পার্ক করে দাড়িয়ে অপেক্ষা করেছে সামিন। কিন্তু নুহার কোন খবর নেই। গত দুই দিন যাবত নুহা বাড়ি থেকে বের হয়নি। এমন কি তার ফোনটাও বন্ধ। তাই যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। সামিন প্রতিদিন একবার নুহার সাথে কথা বলতে আসে। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে নিরাশ হয়ে বাসায় ফিরে যায়। আজও একই সময় এই জায়গায় অপেক্ষা করছে। গাড়ির কাঁচ উঠানো। ভিতরে একটা পরিচিত বাংলা গান চলছে। সামিন সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে সামনে তাকিয়ে আছে। দূর দুরান্ত পর্যন্ত নুহার কোন খবর নাই। সামিনের মেজাজ বিগড়ে গেলো। সে কোন কিছু না ভেবেই সোজা চলে গেলো নুহার বাড়িতে। সেখানে গিয়েই জোরে জোরে কলিংবেল বাজাতে লাগলো। খানিকবাদেই মৌ এসে দরজা খুলে দিলো। মৌ এর সাথে সৌজন্য মুলক কথা বলে সামিন গম্ভীর গলায় বলল
–তোমার আপু বাসায় আছে?

মৌ মৃদু গলায় বলল
–জি।

–তোমার আপুকে বল আমি ডাকছি।

মৌ ভিতরে চলে গেলো। নুহা কিছুক্ষন পরেই এসে সামিনের সামনে দাঁড়ালো। মৃদু কণ্ঠে বলল
–আপনি এখানে?

সামিন প্রচণ্ড রাগি কণ্ঠে বলল
–আমাকে এভয়েড করছেন নুহা? এর ফল কিন্তু ভালো হবে না। বলেছিলাম আমার কাছে শাস্তির কোন মাফ নেই। আপনিও মাফ পাবেন না। শাস্তির জন্য প্রস্তুত হয়ে নিন।

চলবে………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে