দৃষ্টিভ্রম পর্ব-১৩+১৪

0
584

||দৃষ্টিভ্রম|| ||অংশ: ১৩||

রানুকে সম্পূর্ণ ঘর খুঁজে পায় না শতরূপা। গতকাল রাত থেকেই তাকে দেখছে না। তার মানে হাম্মাদ তাকে আবারো বিদায় করে দিয়েছে। পাঁচ মিনিট এভাবেই চলে যায়। বাকি পাঁচ মিনিটে সে কী খাবার তৈরি করবে ভেবে পায় না। দশ মিনিট বললেও হাম্মাদ নিচে আসলে বিশ মিনিটের মাথায়। টেবিলে বসে দেখে স্যান্ডউইচ বানিয়ে রাখা।

“এটা কী দুপুরের খাবার?”

“না, আমি দুপুরের খাবার রান্না করেছিলাম। কিন্তু গোসল করে এসে দেখলাম পাতিলে কিছুই নেই।”

হাম্মাদ চেয়ারটা বাঁকা করে বসে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “মানে কী? তুমি কী বলতে চাচ্ছ খাবার গায়েব হয়ে গেছে?”

“জি, আমি ঠিক এটাই বলতে চাচ্ছি।”

অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে সে। মনে হচ্ছে যেন শতরূপা কোনো ঠাট্টা করছে তার সাথে। মাথাটা ঈষৎ বাঁকিয়ে বলল, “রান্না না করলে অন্তত এমন কোনো বাহানা দিও যাতে বিশ্বাস করা যায়৷ তুমি আর আমি ছাড়া এই বাড়িতে এমন কেউ নেই যে খেয়ে পাতিল খালি করে যাবে। আর এখানে নিশ্চয়ই কোনো ভূত নেই যে তোমার খাবার গায়েব করে দেবে। তাছাড়া তোমার হাতের এমন বাজে রান্না কেউ খেয়ে হায়াত থাকতে মরতে চাইবে না।”

শতরূপা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। জবাবে তার বলার কিছুই নেই। কারণ হাম্মাদকে কিছু বললে সে বিশ্বাস করবে না। তাই কথাটা চেপে যায়।

শায়ান হাম্মাদের খোঁজ নিতে ঢাকা এসেছে। ঠিকানা একদিন কথায় কথায় তার মুখ থেকেই শুনেছিল। কিন্তু অবাক হয় এই ঠিকানায় অন্য কেউ থাকে। ঠিকানাটাও ভুল দিয়েছে। অসহায়ভাবে এক বন্ধু আরাফাতের বাসায় গিয়ে উঠে। চাকরিটাও ছেড়ে দিয়েছে। নতুন চাকরিও খুঁজতে হবে তাকে। আরাফাতের জন্ম-কর্ম সব ঢাকাতেই। চ্যানেল আই এর একজন সংবাদ কর্মী সে। বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে সংবাদ কালেক্ট করে। বেশিরভাব সময়ই বাইরে বাইরে থাকতে হয়। সেই সাথে তার আরেকটা পেশা হলো ফটোগ্রাফি করা। নিজস্ব স্টুডিও আছে। শায়ান তার ঢাকা আসার কারণটা তাকে জানায়।

কারণ শুনে আরাফাত বলল, “এই হাম্মাদ খন্দকার কে একটু ছবি দেখাতে পারবি? আমি তোর কোনো সাহায্য করতে পারি নাকি দেখতাম।”

শায়ান ফেইসবুকে ঘাটাঘাটি করে কিন্তু হাম্মাদের কোনো আইডি পায় না। এই যুগে এসে কার ফেইসবুক আইডি নেই এটা ভেবে বেশ খটকা লাগে তার। ইন্সটাগ্রাম, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ সব যোগাযোগ মাধ্যমে খুঁজেও পায় না। হঠাৎ মনে হয় শতরূপার কোম্পানির বসের বিবাহবার্ষিকীর কিছু ছবি আছে তার কাছে। সেখানে হাম্মাদেরও ছবি রয়েছে। গ্যালারি খুঁজে ভাগ্যবশত তার ছবি পেয়েও যায়।

আরাফাত ছবির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “দোস্ত! এই মানুষটাকে তো বেশ চেনা চেনা লাগছে আমার।”

শায়ান উদ্ধিগ্ন হয়ে বলে, “একটু ভেবে দেখ। এর কিছু মনে আসে নাকি। শালা রূপার জীবনটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। সব প্রমাণ নিয়ে তাকে জেলের ভাত খাওয়াতে চাই।”

“আচ্ছা, আমাকে দুই দিন সময় দে। আমাকে একটু ঘাটাঘাটি করতে হবে। আমার কলিগ রাহাত আবার গোয়েন্দাগিরিতে বেশ ভালো। ওকে কাজে লাগিয়ে দিলে সব উদ্ধার হয়ে আসবে।”

“প্লিজ দোস্ত, তাড়াতাড়ি কর তাহলে।”

শায়ান এবার যেন একটু স্বস্তি পায়। কেন জানি তার মনে হচ্ছে সামনে ভালো কিছু হতে যাচ্ছে। কিছু একটা জানতে পারবে এবার৷ এই হাম্মাদের চেহারার পেছনের চেহারা উদঘাটন করেই ছাড়বে সে। শতরূপাকে মুক্ত করে উন্মুক্ত আকাশের নিচে নিয়ে আসবে। যেখানে বুক ভরে নিশ্বাস নিতে কোনো বাধা থাকবে না।

দু’দিন পর পুনরায় অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটে শতরূপার সাথে। ঘড়ির কাটা তখন রাত দুইটা। বিকট এক শব্দে ঘুম ভেঙে যায় তার। ঘুম থেকে উঠে পূর্বের ন্যায় হাম্মাদের রুম থেকে কান্নার শব্দ শুনতে পায় সে। কিন্তু এবারের শব্দটা ভিন্ন। দ্রুত পায়ে সেদিকে আগায় সে। আজকে তাকে জানতেই হবে এই শব্দটা কোত্থেকে আসছে। এটা অন্তত তার শোনার ভুল নয়। রুমের বাইরে এসে দরজায় ধাক্কা দিতেই দেখল খোলা। হাম্মাদ এত রাতে দরজা খোলা কেন রেখেছে এই ভেদ বুঝতে পারে না। তবু এসব তোয়াক্কা না করে ভেতরে ঢুকে যায়। তাকে দেখামাত্রই হাম্মাদ ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। হাম্মাদের চোখে জল। শতরূপার মন যতটা শক্ত হয়ে এসেছিল তার চোখে জল দেখে মুহূর্তেই তা নরম হয়ে আসে। মনের ভেতর একটা সহানুভূতি তৈরি হয়ে যায়।

“তুমি এখানে কেন এসেছ? চলে যাও এখান থেকে। এক্ষুনি বের হয়ে যাও। নাহলে আমি ধাক্কা দিয়ে বের করে দিব।”, বলেই আড়ালে চোখের জল মোছার চেষ্টা করছে হাম্মাদ।

শতরূপা এগিয়ে এসে বলল, “আমিও এখানে থাকতে আসিনি। কিন্তু আপনার কান্নার শব্দ শুনে ছুটে এসেছি। কী হয়েছে বলবেন? কষ্ট ভাগ করলে তার পরিমাণটা কমে আসে আর সুখ ভাগ করলে তার পরিমাণ বেড়ে যায়।”

“আমার কোনো কষ্ট নেই৷ আর থাকলেও তোমার কী?”

“আমার কিছুই না, তবে আমি শুনতে চাচ্ছিলাম।”

“যদি বলি, তাহলে কী তুমি বুঝবে?”

“কেন বুঝব না? একবার বলেই দেখুন।”

হাম্মাদ বিছানায় শান্ত হয়ে বসে। শতরূপার দিকে তাকিয়ে তাকে পাশে বসতে বলল। যেদিন থেকে সিন্থিয়া এখানে আসা বন্ধ করেছে সেদিন থেকেই হাম্মাদের মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে সে। কিন্তু আজ যেন সে তার চরিত্রের একদম বাইরে চলে গেছে। বিয়ের পর এই প্রথম তার সাথে এত ভালো করে কথা বলছে। সে যেন পূর্বের সব কষ্ট ভুলে যাচ্ছে। শুরু থেকেই হাম্মাদের প্রতি তার একটা দুর্বলতা ছিল এখন আরো বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছে।

“সিন্থিয়া আমাকে ভালোবাসে না।”, বলেই হাম্মাদ মাথাটা নিচের দিকে করে নেয়।

কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে তাকায় শতরূপা। এই কথার মানে কী! এখন মনে হচ্ছে এতদিন ধরে সিন্থিয়া না আসার পেছনে অনেক বড় কারণ আছে। হাম্মাদের সাথে হয়তো ঝামেলা লেগেছে।

“ভালোবাসবে না কেন? সে তো আপনার স্ত্রী। একটুতে মনমালিন্য হতে পারে তার মানে এই নয় যে সে আপনাকে ভালোবাসে না।”

“তুমি জানো না তাই এভাবে বলছ। সিন্থিয়া সত্যিই আমাকে ভালোবাসে না। যদি সে আমাকে ভালোবাসতো তাহলে কী আমার ভালোবাসার চিহ্নকে সে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইতো?”

চমকে উঠে শতরূপা। ভেতরে ভেতরে একটা ভয়ও কাজ করছে। কী বলতে চাইছে হাম্মাদ! ভালোবাসার চিহ্ন মুছে ফেলতে চাইছে এর মানেটা কী! তার বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যায়৷

হাম্মাদ শতরূপার একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নেয়। তার চোখে চোখ রেখে বলল, “তুমি চাইলে আমার ভালোবাসার চিহ্নিটা এই পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকবে রূপা।”

সে ইতস্তত করে বলল, “আপনি কী বলতে চাচ্ছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”

“আমার উৎসবকে মায়ের আদর দেবে?”

নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে শতরূপার। সে যা ভিয় পাচ্ছিল অবশেষে সেটাই হলো। তাকে চিন্তাভাবনার কোনো সুযোগ না দিয়ে হাম্মাদ আবারো বলল, “দেখ রূপা, আমি সারাজীবন উৎসবের খরচ চালিয়ে যাব। তুমি শুধু তাকে মায়ের আদরটুকু দাও। আমি চাইলে জোর করে তোমার উপর তাকে চাপিয়ে দিতে পারতাম। একটু ভাবলেই বুঝতে পারবে এই কথা আমি কেন বলছি কিন্তু আমি চাই তুমি তাকে ভালোবেসে গ্রহণ করো। প্লিজ রূপা, একটা শিশুকে তুমি অনাথ আশ্রমে যেতে দিবে না নিশ্চয়ই। তোমার মন তো পাথর নয়। তুমি তো বাচ্চাদের অনেক ভালোবাসো, আমি তা নিজ চোখে দেখেছি।”

এখন শতরূপার কাছে বিষয়গুলো সব ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে আসছে। হাম্মাদ কেন কাবিননামাতে লিখিয়েছিল যে, শতরূপা কখনো তাকে ডিভোর্স দিলে হাম্মাদের সন্তানকে মোহরানার সাথে পাবে। হাম্মাদ তাকে কেন পছন্দ করেছে সেটাও বুঝতে বাকি রইল না। প্রথম যেদিন তাকে দেখেছিল বাচ্চা মেয়েটাকে সাহায্য করতে সেদিনই সে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু সেটা তো তিন বছর আগে। তাহলে হাম্মাদের সন্তানের বয়স কী তিন! যদি তিন বছর হয় তবে কেন এই তিনটি বছর বাচ্চাটাকে নিজেদের কাছে রেখেছে! আদৌও নিজেদের কাছে রেখেছে নাকি! প্রশ্নে শতরূপার মাথা কিলবিল করছে। মনে হচ্ছে এখনই মাথা ফেটে রক্ত বেরিয়ে যাবে। মস্তিষ্কের চিন্তাভাবনা বন্ধ হয়ে গেছে তার। হাম্মাদ তার সাথে এতবড় ছল করেছে! যাকে বিশ্বাস করে সে জীবনের বাকিটা পথ পার করার স্বপ্ন দেখছিল সেই কিনা মাঝপথে এনে ফেলে দিতে চাচ্ছে।

শতরূপার ঠোঁট কাঁপছে। কিছু একটা বলতে চাচ্ছে সে। তৎক্ষনাৎ হাম্মাদ তাকে বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। কান্নার ফোয়ারা তৈরি হয়েছে তার চোখে। সে কাঁদোকাঁদো কণ্ঠে বলল, “রূপা, আমাকে ফিরিয়ে দিও না তুমি। আমি জানি তোমার মনে এখন অজস্র প্রশ্ন। আমি তোমার সব প্রশ্নের জবাব দিতে পারব না। শুধু জেনে রেখ ভুল কিছু করছি না আমি। আমার সংসার, আমার ভালোবাসাকে বাঁচাতে উৎসবকে তুমি মায়ের আদর দাও।”

আচমকা এভাবে তাকে জড়িয়ে ধরবে কল্পনাও করতে পারেনি সে। বুকের ধুকপুকানি শান্ত হয়ে এসেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে শতরূপা। হাম্মাদ তাকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসে বলল, “উৎসবের বয়স সাড়ে তিন বছর। আমার একমাত্র ছেলে। কিন্তু অনেক চাওয়ার পরেও আমরা তাকে আমাদের কাছে রাখতে পারছি না। তাই তুমি আগামী সপ্তাহে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে উৎসবকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবে। আমি সব কাগজপত্র তৈরি করে নিয়েছি। দশ লক্ষ টাকা তোমার একাউন্টে জমা করে দিব আর প্রতি মাসে একটা এমাউন্ট যাবে।”

শতরূপা হাম্মাদের কথাগুলো নিশ্চুপ বসে শুনছে। একটা মানুষ কীভাবে এমন কথা বলতে পারে! নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না তার৷ মনে হচ্ছে কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছে সে। স্বপ্নটা ভেঙে গেলেই সব স্বাভাবিক হয়ে আসবে।

হাম্মাদ আবারো বলল, “তবে, তুমি চাইলেও এই কাজ করতে হবে, না চাইলেও করতে হবে। কারণটা জানতে চাইলে বলতে পারি আমি।”

অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। আর কী বাকি আছে তার বলার! এত কথা একসাথে হজম করতে পারছে না সে।

চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা

||দৃষ্টিভ্রম|| ||অংশ: ১৪||

“আমার সন্তানকে স্বেচ্ছায় সাথে নিয়ে গেলে তোমার এবং তোমার পরিবারের কোনো ক্ষতি হবে না। যদি তুমি নিজ থেকে নিতে না চাও তবুও তোমাকে কাবিননামা অনুসারে তাকে বাধ্য হয়ে হলেও সাথে নিতে হবে। কিন্তু তখন তোমার না হোক, তোমার পরিবারের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।”

শতরূপা কিছুটা গম্ভীর, কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে বসে রয়। ঘাড়টা বাঁকা করে অপূর্ব কণ্ঠে শুধালো, “আপনি কী আমাকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করছেন? নাকি হুমকি দিচ্ছেন”

সে পরিমিত হেসে বলল, “কোনোটাই না! সে সাধ্য আমার নেই। তবে সিন্থিয়ার ঠিকই আছে।”

কিঞ্চিৎ বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “মানে! বাচ্চাটা কী আপনাদের দু’জনের না?”

“উৎসব আমাদেরই সন্তান। সিন্থিয়ার গর্ভ থেকেই তার জন্ম।”

“তাহলে কেন আপনারা এমন করতে চাচ্ছেন একটা বাচ্চার সাথে? কেন তাকে পিতৃ-মাতৃহীন করতে চাচ্ছেন?”

সে তার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “কে বলল পিতৃ-মাতৃহীন? তুমি হবে মা আর শায়ান হবে বাবা।”

বেশ আশ্চর্যান্বিত হয় সে। শায়ানের কথা এখানে কেন আসছে। তাছাড়া শায়ান তাকে ভালোবাসলেও সে কখনো ভালোবাসেনি, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কই ছিল তাদের মধ্যে। শতরূপার মনে হাজারটা প্রশ্ন পুতে রাখে। কারণ হাম্মাদ তাকে এর থেকে বেশি কিছু জানাতে চায় না।

আরাফাত তার বন্ধু রাহাতকে নিয়ে বাসায় আসে শায়ানের সাথে দেখা করাতে। এর মধ্যে সে বেশ কিছু তথ্য যোগাড় করে নিয়েছে হাম্মাদের বিষয়ে। কিছু ছবি আর কাগজপত্র এনে তার হাতে দেয়।

“শায়ান ভাই, যার নাম হাম্মাদ বলছেন তার বাবার বেশ বড়সড় বিজনেস। তিনি দুই বিয়ে করেছেন। সে তার বাবার ছোট স্ত্রীর সন্তান। আসলে বড় বউয়ের সন্তান হচ্ছে না দেখেই তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন কিন্তু হাম্মাদের জন্মের পর বড় বউয়ের কোল জুড়ে আরো দুই সন্তান হয়। তার ছোট ভাই এবং এক বোন আছে। ভাইটা আদি, মানে আদিয়ান খন্দকারকে খুব বেশি শহরে দেখা যায় না। সে কী করে, না করে তা সম্পর্কে তেমন কিছু জানতে পারিনি। আর বোন নীতি পড়ালেখা ছেড়ে বন্ধুবান্ধবদের সাথে টইটই করে ঘুরে বেড়াতো। বিভিন্ন জায়গায় ট্যুর আর পার্টি এসবই ছিল তার কাজ। শুনেছি মাঝেমধ্যে ড্রাগসও নিত। একবার একটা কেইসে পুলিশ কেইসেও নাম জড়িয়ে যায়। তারপর তাকে মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি দিতে রিহ্যাব সেন্টারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এখনো সেখানেই আছে। হাম্মাদের মা বেঁচে আছেন কিন্তু তার বড় মা মানে আদিয়ানের মা বেঁচে নেই।”

একটু পানি মুখে দেয় রাহাত। একে একে সবার ছবি দেখাচ্ছে শায়ানকে। শুধু আদিয়ানের ছবি পায়নি কোথাও। ক্ষণকাল থেমে আবার বলল, “সবচেয়ে বড় তথ্য হলো হাম্মাদ বিবাহিত। তার স্ত্রীর নাম সিন্থিয়া শৈলী। হাম্মাদের পরিবারের যেই বিজনেস সেটা সিন্থিয়ার বাবার। সিন্থিয়ার বাবা হাম্মাদের আপন চাচা ছিলেন। তিনি এই শহরে এসে প্রথম বিজনেস শুরু করেন। হাম্মাদের বাবা যখন গ্রাম থেকে শহরে আসেন তখন তার কিছুই ছিল না। ভাইয়ের কাছে থেকেই বিজনেসে জয়েন করেন তিনি। সিন্থিয়ার বাবা মারা যাওয়ার সময় সব সহায় সম্পত্তি তার হাতে দিয়ে যান। সিন্থিয়ার আঠারো বছর হওয়ার পর সব তাকে ট্রান্সফার করে দেওয়া হয়। কিন্তু এর কিছুদিন আগে হাম্মাদ হুট করে একদিন সিন্থিয়াকে বিয়ে করে বাসায় চলে আসে। আপাতত এতটুকুই জানতে পেরেছি। আর কিছু লাগবে?”

শায়ান ভাবনায় পড়ে গেল। এর মাঝে শতরূপাকে কেন টেনে আনা হলো তাহলে! তাদের সংসার তো দিব্যি চলছিল। কোনো বাধাও নেই।

আরাফাত আবার বলল, “ওহ আরেকটা কথা, জানি না এটা কোনো কাজের কি না! তবে সিন্থিয়া কিছুদিন আগে ঢাকার বাইরে গেছে। খুব সম্ভাবনা বান্দরবান। সে অবশ্য প্রায়ই এভাবে বাইরে যায়। খুবই উড়নচণ্ডী স্বভাবের মেয়েটা। তিন বছর আগে তো বেশ বড় একটা স্ক্যান্ডাল করেছিল। একটা এতিমখানাতে নাকি আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। পরবর্তীতে অবশ্য ওই এতিমখানার জন্য অন্যত্র জায়গা দেয়। বুঝো এবার কেমন দজ্জাল স্বভাবের মেয়ে। শুনেছি সে নাকি বাচ্চাকাচ্চা একদম সহ্য করতে পারে না। কিছুটা মেন্টাল সম্ভবত। তাই তো বিয়ের ছয় বছর হয়ে গেল এখনো বাচ্চাকাচ্চা নেই তাদের। হাম্মাদ আর সে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে বেড়ায়।”

শায়ান বুঝতে পারেনি এখানে এসে এত বেশি তথ্য পেয়ে যাবে সে। শতরূপার সাথে তার কথা বলতে হবে। উঠে গিয়ে কল করে দুইবার কিন্তু বারবার এংগেইজড আসে।

সিন্থিয়ার সাথে ফোনে কথা বলছে হাম্মাদ। কিছুদিন হলো কাজের জন্য ঢাকা এসেছে। বিজিনেস এখন সে আর হাম্মাদই সামলায়।

“তোমার বউ কী রাজী হলো ডিভোর্স দিতে?”, প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় সিন্থিয়া।

“সঠিকভাবে বলতে পারছি না তবে মনে হয় ঢিলটা সঠিক জায়গাতেই পড়েছে। কাল আমি উৎসবকে নিয়ে আসব এখানে। তাকে দেখে আরো পটে যাবে এই মেয়ে। সে তো আবার অনেক ইমোশনাল।”

“প্রেমেটেমে পড়ে গেলে নাকি বউয়ের? আর কী বলতে চাচ্ছ আমি ইমোশনাল নই? আমি তো আগেই বলেছিলাম আমি এসব বাচ্চাকাচ্চার ঝামেলায় জড়াতে চাই না। এভরশানও করাতে চেয়েছিলাম কিন্তু ক্রিটিকাল সিচুয়েশনে পড়ে যাওয়ায় করতে পারলাম না। জানো আমার বডি শেইপ কতটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল! কত কষ্টের বিনিময়ে আমি আগের মতো হতে পেরেছি। নিজেকে আয়নাতে দেখলে চিনতেই পারতাম না এতটা মুটিয়ে গিয়েছিলাম।”

সিন্থিয়ার কথা নিশ্চুপ শুনে যায় হাম্মাদ। মনে পড়ে যায় তার তখনকার কথাগুলো। কত করে সে চাইতো একটা বাচ্চা হোক। কিন্তু সিন্থিয়া পার্টি, ফ্রেন্ডস এসবের পেছনে ঘুরে বেড়ানোটাকেই বেশি প্রাধান্য দিত। আর বাকিটা হাম্মাদের সাথে রোমান্স করে। বিন্দাস জীবন তার পছন্দ। উন্মুক্ত আকাশে পাখির মতো উড়বে। এখানে সেখাছে ছুটে বেড়াবে। যখনই জানতে পারে সে প্রেগন্যান্ট তখন বাচ্চার বয়স পাঁচমাস। এই পাঁচমাসে সে একবারের জন্যেও টের পায়নি সে প্রেগন্যান্ট। তারপর গর্ভপাত করাতে যায় কিন্তু ডাক্তাররা নিষেধ করে দেয়। এতে মায়ের জীবনেরও ঝুঁকি। সিন্থিয়ার শরীরের রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। গর্ভপাত করলে সে মারা যেতে পারে। তখন কোনো উপায় না দেখে বাচ্চা রেখে দেয়। নিজের পরিবারকেও জানতে দেয় না সে যে প্রেগন্যান্ট ছিল। বান্দরবান একটা বাসা নিয়ে চলে আসে। টানা এক বছর সে ঘর থেকে বেরোয়নি। হাম্মাদ ভেবেছিল বাচ্চার জন্মের পর হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে। সিন্থিয়ার মায়া হয়ে যাবে বাচ্চার প্রতি। কিন্তু না, সে বাচ্চাটাকে বুকের দুধটা পর্যন্ত খাওয়ায়নি। জন্মের পাঁচমাস একজন আয়া বাচ্চাকে দেখাশোনা করে। তারপর সে তাকে একটা এতিমখানাতে রেখে আসতে যায় কিন্তু সেখানে বিপত্তি ঘটে এতিমখানার মানুষ বাচ্চার পিতা-মাতা থাকতে রাখতে চান না। রাগে সিন্থিয়া সেদিন রাতেই মানুষ দিয়ে এতিমখানাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরদিন ভালো মানুষের বেশে তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু হাম্মাদ উৎসবকে সেখানে রাখতে দেয় না। সে অন্য চিন্তা করে। বাচ্চাটার প্রতি তার মায়া তাকে এতিমখানাতে রাখতে দেয় না। এমন কোনো মানুষের আওতায় বাচ্চাকে দিতে চায় যে তাকে মায়ের আদর দিয়ে বড় করবে, ভালোবাসবে। তিন বছর আগে যখন শতরূপাকে দেখে বাচ্চাকে সাহায্য করতে সেদিনই তাকে টার্গেট করে। কিন্তু তাকে হারিয়ে ফেলে সে। যখন খুঁজে পায় তখন থেকেই তার সবকিছু অনুসরণ করতে লেগে যায়। এই সাড়ে তিন বছর কাজের মানুষের কাছে বাচ্চার সব দায়িত্ব দিয়ে রেখেছিল। অপেক্ষায় ছিল শতরূপাকে কীভাবে বাচ্চার দায়িত্ব দেওয়া যায়। এখন তার কাছে সেই সুযোগটা চলে এসেছে। শতরূপার চাইতে কেউ উৎসবকে ভালো রাখবে না।

“কী হলো কথা বলছো না যে?”, সিন্থিয়া জিজ্ঞেস করে।

তার কণ্ঠে ভাবনার ঘোর কাটে হাম্মাদের। উৎসবকে আনতে যেতে হবে তার। সকালে ঘুম থেকে উঠেই উৎসবকে নিয়ে বাসায় চলে আসে। শতরূপা তখনো ঘুমে। বিছানায় উৎসবকে নামিয়ে দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকে হাম্মাদ। ঠিক যেন মা আর ছেলে লাগছে দেখতে। উৎসব গিয়ে শতরূপার মুখে আঙুল দিয়ে আঁকিবুঁকি করছে। কারো স্পর্শ অনুভব করতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে সে। চোখ খুলে বাচ্চাকে দেখে হতভম্ব হয়ে যায়। কী সুন্দর ফুটফুটে ছেলে। ঠিক যেন চাঁদের টুকরো। ধূসর রঙের চোখের মণি। পোকা খাওয়া দাঁত বের করে হাসছে। শতরূপার এই মুহূর্তে কী করা উচিত কিছুই বুঝতে পারছে না। কেবল উৎসবকে কোলে তুলে নেয়। ওমনি ছেলেটা তার রঙিন শাড়ির ভাঁজে হাত দিয়ে খেলতে শুরু করে। বাচ্চাদের উজ্জ্বল রঙের দিকে আকর্ষণ বেশি থাকে। উৎসবেরও তাই। এত দ্রুত কোনো বাচ্চাকে মিশতে দেখেনি সে। গাল ধরে চুমু এঁকে দেয়। আদর করে সেও তার সাথে খেলতে শুরু করে। এত মায়াবী বাচ্চাকে কেউ আদর না করে পারবেই না। হাম্মাদ তাকে জাগতে দেখতেই আড়ালে লুকিয়ে গিয়েছিল। শতরূপা কী করে দেখার জন্য। এভাবে আপন করে নিতে দেখে চোখ জলে ভরে উঠে তার। ভালোবাসার মানুষের জন্য তার একমাত্র ছেলেকে দূরে সরাতে হচ্ছে। বুকটা কাঁপছে। কিন্তু তার কিছুই করার নেই। সিন্থিয়া রেগে গেলে পথে বসতে হবে তাকে। তাছাড়া সে তাকে হারাতেও চায় না। সন্তান হয়তো পরবর্তীতে পেয়ে যাবে কিন্তু ভালোবাসার মানুষ আর এত আরাম আয়েশের জীবন আর ফিরে পাবে না।

চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে