দুজনা পর্ব-০৬

0
519

#দুজনা
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-০৬

আঁটটার দিকে আমার ঘুম ভাঙ্গে।পাশ ফিরে তাকাতেই আদিলের ঘুমন্ত মুখখানার দিকে চোখ যায়।আদিল ঘুমচ্ছে। নিষ্পাপ মুখের চোখের পাপড়ি জোড়া ফ্যানের বাতাসে বারবার কেঁপে উঠছে।সাথে টকটকে গোলাপী ঠোঁটজোড়াও।তাকিয়ে থাকলাম ওই মুখে খানিকক্ষণ। বিয়ের পর প্রথম প্রথম ভাবতাম মানুষটি খুব সহজ-সরল।কারো কথায় কষ্ট নেয় কম।বা কষ্ট পেলেও তা নিয়ে ওত ভাবে না।কিন্তু ইদানীং তা তাকে মোটেই মনে হচ্ছে না।খুব রাগ আছে মানুষটির!
আদিল নয়টার দিকে ঘুম থেকে উঠে।আমি তখন সবে বাথরুম থেকে বেরুলাম।আদিল আমাকে দেখতে পেয়েই বলে,

“রেডি হয়ে নাও।আজ বাইরে নাস্তা করবো।”

আমি আদিলের কথায় বেশ অবাক হলাম।হঠাৎ বাইরে নাস্তা?পরক্ষণে ঠাহরে আসলো,আদিল এই বাড়ির সবার উপর রাগ হওয়ার কারণে তাইতো বাইরে নাস্তা করার কথা বলেছে।কিন্তু বিষয়টি আমার কাছে বড্ড বেমানান লাগছে!আমি এগিয়ে গেলাম আদিলের কাছে।খাটের উপর বসে আদিলের দিকে তাকালাম।আদিল বুঝতে পারলো আমি কিছু তাকে বলবো,
“কিছু বলবে?”
“কাল মায়ের সাথে ওইভাবে রাগটা আসলে আমাদের ঠিক হয়নি।আমি,আপনি উনাদের উপর নির্ভর করে আছি।আপনি কর্মক্ষম এখন।এখনো যদি অন্যদের উপর নির্ভর করে থাকি সেটা আসলে আমাদেরও বিবেকে বাঁধে!আর উনাদেরও তো ভবিষ্যৎ আছে তাই না?কতকাল আরেকজনের গ্লানি টানবে।”
“কি বলতে চাইছো তুমি,প্রিয়া?”
বলে আদিল ভ্রু যুগল কুঁচকে আনলো।
“আমি না কাল সারারাত ভাবলাম।উনারা সংসারটা চালায় উনাদের খরচা হচ্ছে।কথাগুলো অন্যভাবেও কথা বলা যেত।এতটা রেগেমেগে কথা বলাটা একটু বেশিই হয়ে গেলো না?আমার না ভালো লাগছে না বিষয়টা কেনজানি।
শত হোক উনারা ত আপনার মা,বোন এবং ভাবী।”

আদিলের এবার ভ্রু যুগল আরো বেশিই কুঁচকে এলো।তারপর ভ্রু যুগল মসৃণ করে বললো,
“তুমি হয়তো অনেক কিছুই জানো না প্রিয়া!তাই এভাবে কথা বলছো।বাদ দাও।রেডি হয়ে নাও।আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

বলে আদিল বিছানা উঠে নিচে নেমে বাথরুমে চলে যায়।আমি ছোট্ট একটা নিশ্বাস বেরিয়ে এলো।এমন সময় শাশুড়ী মা দরজায় করাঘাত করেন।আমি দরজা খুলে দিই।উনি আমাকে উপেক্ষা করে রুমের চারপাশে তাকাতে থাকেন।আমি অপ্রস্তুতকর বললাম,
“মা কিছু খুঁজছেন?”

উনি আমার কথার জবাব দিলেন না।কিছুটা জোর গলায় “আদিল,আদিল” বলে ডেকে উঠলেন।আমি বললাম,
“মা?আদিল বাথরুমে।”

উনি আর কিছু বললেন না।ঘাড় ঘুরিয়ে আগের স্থানের দিকে হাঁটা ধরতে গেলেই থেমে গেলেন হঠাৎ।বললেন,

“আদিল বেরুলে ওকে যেন বলা হয় খেতে যেতে!”

আদিল আর কিছু খেলো না।পরের কয়েকগুলো দিনে বাইরে থেকে আদিল আমার জন্যে এবং ওর জন্যে খাবার নিয়ে আসতো।শাশুড়ী মা খাওয়ার জন্যে বললেও আদিলকে খাওয়াতে রাজি করাতে পারতো না।যতবার শাশুড়ী মা আদিলকে খেতে যেতে বলতো আদিল বারবার একই উত্তর করতো,

“যেই দিন নিজে ইনকাম করতে পারবো সেইদিন হ খাবো!”

———————————————————
এক সপ্তাহ আদিল গ্রামে থেকেছিল।তারপর আবার শহরে চলে যায়।আর যাওয়ার সময় আমাকে আমার বাপের বাড়ি রেখে যায়।বলেছিল,আমার ভাসুর গ্রামে এলে তিনিও তখন অফিস থেকে ছুটি নিয়ে গ্রামে আসবেন।ভাসুরের সাথে কিছু বোঝাপড়া আছে তা সমাধান করে তারপর নাহয় যেখানেই আমি থাকি তার ব্যবস্থা করবেন।আপাতত বাপের বাড়িতে থাকতাম।আমি মেনে নিই আদিলের কথা।তবে মস্তিষ্কে এখনো একটা প্রশ্নই বাঁধছে আদিল বারবার উনার বড় ভাইয়ের সাথে কি বোঝাপড়া করবে?কি এমন বোঝাপড়া!

দেখতে দেখতে আরো দু’টা মাস কেঁটে যায়।চৈত্রের খা খা রোদ চারপাশে উত্ত্যপ্ততায় হাহাকার।শুষ্ক পরিবেশের গাছপালা,পশুপাখি,মাঠ-ঘাট,নদী-নালা সব পানির তৃষ্ণায় তৃষ্ণার্ত হয়ে যায়।এক চটক বৃষ্টি নামলেই যেন তাদের প্রাণ ফিরে আসবে।আমি দক্ষিণের জানলার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি।বারান্দায় মসজিদের ইমাম বসে আছেন।আর বসে বসে জোরে জোরে তসবি,দোয়া-দুরূদ পড়ছেন,এবং বাবাকে ফু দিচ্ছেন।বাবার অবস্থা ভালো না।খুবই বেগতিক।কাল রাত থেকে বাবাকে পানি খাওয়ানো হচ্ছে শুধু।বাবা বারবার পানি খেতে চাচ্ছেন!মা ভীষণ ভয়ে।বাবা যদি মরে যায়?মা চান না বাবার কিছু হোক!তাইতো শেষবা আরো একটা চেষ্টা করে যাচ্ছেন,ওষুধের কাজ তো হলো না,শেষবার হুজুরকে দিয়ে মহান আল্লাহর কাছে দোয়া-দরুদ পড়ালে বাবা যদি রোগমুক্ত হলো?যদিও আমরা জানি উপরওয়ালার যখন ইচ্ছে উনার বান্দাকে রাখবেন,যখন ইচ্ছে নিয়ম যাবেন।কিন্তু তারপরও আমরা তা মানতে চাই না।চোখ জড়িয়ে এলো আমার!খুব কান্না পাচ্ছে বাবার জন্যে!এমন সময় মা আমার ঘরে এলেন,

“প্রিয়া?প্রিয়ারে তোর বাবা কি সেরে উঠবে?হুজুরতো মনপ্রাণ দিয়ে দোয়া-দরুদ পড়ছেন।আল্লাহর নিশ্চয়ই দয়া হবেন,না?”

——————————————————–
নাহ আল্লাহর আর দয়া হলো না।শেষ রাতেই বাবা পৃথিবী ত্যাগ করেন।আমাদের মাথার উপর ভেঙ্গে পড়ে আকাশ।থমকে যায় পৃথিবী।মা খুব চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন!প্রতিবেশীরা মাকে শান্ত করার চেষ্টায় আছেন।অবশ্যি আমাকে কেউ শান্ত করার চেষ্টা করছে না।কারণ আমি শক্ত একটা খুঁটির সাথে হেলান দিয়ে আঁটসাঁটভাবে দাঁড়িয়ে আছি।চুপচাপ দূরের দিকে দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছি।চোখে কোনো ভাষা নেই।মুখে কোনো কথা নেই।চোখে পানিও নেই।আমি জানি না কেন নেই।তবে কি সেই পানি আমার আরো আগেই শুকিয়ে গিয়েছে?!
দুপুরের পর আদিল আসে।এতক্ষণে সবাই আদিলের জন্যেই অপেক্ষা করেছিল।আদিল আসলে বাবার দাফন-কাপন হবে।আদিল আমার সামনে এসে দাঁড়ায়।
“প্রিয়া?”

আমি আদিলকে দেখলাম।মাথাটা আদিলের বুকে রাখলাম।তারপরও কোনো কথা বলতে পারলাম না।আদিল,

“মন খারাপ করে না প্রিয়া।পৃথিবীতে বেশিদিন কেউই স্থায়ী নয়।সবাইকেই যেতে হবে।সবাইকে!”

———————————————————
দেখতে আরো কয়কেকটা মাস কেঁটে গেল।মা কিছুটা এখন স্বাভাবিক।বাবার মৃত্যুর পর মা অনেকটা ভেঙ্গে পড়েছিল।আমি মায়ের সারাক্ষণ পাশে পাশে থেকেছি। বাবার মৃত্যুর পর থেকে আমি মায়ের সাথেই আপাতত থাকছি।আদিল ঢাকায় ।সে বাবার গতের সময় গ্রামে এসে আবার ঢাকায় গিয়ে এরমাঝে গ্রামে আর আসা হয়নি ওর।ওর বড় ভাই এলে আসবে তাই বললো আমাকে।ঠিক তার দিন বিশেক পর ভাসুর আমাদের বাড়িতে এসে ঘনঘটা হাজির।ভাসুর হঠাৎ আমাদের বাড়িতে আগমণ ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারলাম না।তাছাড়া আসার কারণও নেই তেমন।বিয়ের পর উনাকে একবার মাত্র দেখেছিলাম।তেমন কথা বলা হয়নি।তাই উনার আসাতে ব্যাপারটা একটু অবাক হবারই মতন।উনি সটাং বারান্দায় থাকা শক্ত কাঠের চেয়ারটার উপর ধপ করে বসেন।আমি সামনেই ছিলাম,তবে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে।বলেন,

“আদিলের ফোন বন্ধ কেন?ওকে কতবার কল করেছি কাল বাসায় আসার পর থেকে,বারবার ফোন বন্ধ বাতাচ্ছে!”

আমি বুঝলাম না ঠিক।বললাম,
“সিম তো খোলা।বন্ধ না। ”
“কিসের খোলা?!কল দিতেছি তোমার সামনে দেখো!”
বলেই উনি পাঞ্জাবীর পকেট থেকে তরহর ফোনটা বের করে আদিলকে কল লাগান।বন্ধ বাতাচ্ছে।ততক্ষণে আমার মনে পড়ে গেল সে’বার আদিল তো ওর সিম পরিবর্তন করেছিল।আর কেনোই বা পরিবর্তন করলো হুটহাট তা আমার অজানা।সেই নাম্বার ইনাকে দেয় নি?বললাম,
“ভাইয়া,উনার তো আরেকটা নাম্বার আছে!আপনি যেই নাম্বারে কল করেছেন ওটা চালান না উনি এখন আর।”

ওমনি ভাসুর চেয়ার থেকে টপটপ করে দাঁড়িয়ে গেলো।আর গদগদ গলায় বলে উঠলো,
“এটাই ভেবেছি!এটাই!পরিবারের কারো সাথে আর কথা বলবে না উনি!আমাদের মাথা খেয়ে বীর সেজেছে এখন! ওকে বলে দিও তাড়াতাড়ি গ্রামে আসতে!আমার সাথে ওর নাকি বোঝাপড়া আছে!?দেখবো কত বোঝাপড়া আছে ওর!আর আমার কি কি বোঝাপড়া আছে তাও দেখাবো!দেখবো দেমাক কই থাকে ওর!ওকে কল করে জানিয়ে দিও।মনে থাকবে ত?”

“ভাইয়া কিছু খেয়ে যান!”
“খাবো আবার!পাগল বানিয়ে দিয়েছো তোমরা!”

বলেই তরহর করে বেরিয়ে যান ঘর থেকে। আর চলে যান।

চলবে……..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে