দুজনা পর্ব-০১

0
1063

#দুজনা
#রোকসানা আক্তার
সূচনা পর্ব

চাকরির এক সপ্তাহ না গড়াতেই হঠাৎ আমার স্বামী আদিল ব্যাগপ্যাক নিয়ে বাসায় এসে হাজির।এসেই ভরা রুমে সবার সামনে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

“প্রিয়া,তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছি না।তাই চলে এসেছি।”

আমার ননদী,ঝাঁ এবং চাচি শাশুড়ী সবাই সামনে ছিল।লজ্জায় মাথা নুইয়ে আসে আমার।আদিল আমাকে সবার সামনে জড়িয়ে ধরার তার এই বাচ্চাসুলভ কান্ডটা প্রথমে ধরতে পারেনি সে।যখন চাচীমা বলে উঠেন,

“মানুষ এতটা বউয়ের পাগল হয়!আমাদের আদিলকে না দেখলে তো বুঝতামই না!”
তখন আদিল সাথে সাথে আমাকে ছাড়িয়ে নেয়।আর অপ্রস্ত কন্ঠে বলে,

“নাহ,মানে…..!”

চাচিমা থামিয়ে দিয়ে বলে উঠেন,
“হয়েছে,হয়েছে আর কিছু বলতে হবে না।প্রিয়া?তোমার আঁচলের নিচে গুঁজেূ রাখা স্বামীকে তুমি নিজের রুমেই নিয়ে যাও।দূর থেকে এসেছে একটু রেস্ট করতে দাও।”

আমি নৈঃশব্দে সম্মতি জানিয়ে উনার হাত থেকে ব্যাগ নিতে গেলে উনি বাঁধ সাধেন,
“এত বড় ব্যাগ তোমার নিতে হবে না।আমিই নিয়ে যাচ্ছি।আর আমার সাথে আসো।”

বলে আদিল ব্যাগ নিয়ে রুমে যায়।আমি তার পেছন পেছন পা বাড়াতে পেছন থেকে আমার ননদী ডেকে উঠেন,

“ভাবী?রুমে একটু পরে যাও?মার তােমার সাথে কি নাকি কথা আছে!মার সাথে কথা সেড়ে তারপর যাও।”

আমি ভেতরটা আঁতকে উঠে।শাশুড়ীকে আমি খুব ভয় পাই।আদিল চাকরি রেখে চলে এসেছে।এখন মা এটা নিয়ে আমার উপরই রাগবেন।আদিলের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে আজ ছয়মাস।এই ছয়মাসের মধ্যে আদিলের সাথে আমার একসাথে থাকা হয়েছে একমাস কি দেড়মাস।বাকি মাসগুলোতে শাশুড়ী, ননদী এবং ঝাঁ আদিলকে বিভিন্ন কাজের তদারকিতে বিভিন্ন জায়গায় পাঠাতো।যেমন আমার ননদীর জামাইয়ের যশোরে পাটের কারখানাা আছে।ননদীর জামাই একা সামলাতে পারবে না ভেবে আদিলকে শাশুড়ী মা ওখানে পাঠিয়ে দিতেন।আবার ভাসুরের খুলনায় চামড়ার কারখানা আছে।ওখানেও পাঠিয়ে দিতেন।আদিলও যেত।কথা হলো, সে যখন আমাকে বিয়ে করেছে তখন সে বেকার ছিল।তাই নতুন বিয়ে করা,নতুন একটা সংসার হওয়া মানেই তো সাতদিকে খরচ বাড়া।তাই আদিল ওতশত না ভেবে উনাদের কথায় রাজি হয়ে যায়।কিন্তু আমাকে নতুন বিয়ে করে রেখে দূরে বেশিদিন থাকতে পারেনি আদিল।সব ছেড়ে চলে আসে।আদিল ফিরে আসাতে কেউই খুশি হয়নি।পরিবারের সবার মুখ ভারী এবং কালো হয়ে যায়।আদিলের ফিরে আসায় সবাই আমাকেই দোষারোপ করতে থাকে।সেই রাতেই মা,ননদী এবং ঝাঁ রুমে এসে বলেন,

“নতুন একটা সংসার হয়েছে তোর!
এই যে তোমার সংসারটা চালাবে কে?কার উপর নির্ভর কারে তুই এখানে ফিরে এসেছিস?কারো কোটি টাকা নেই আরেকজনের সংসার চালাবে!”

আদিল মার মুখের উপর বলে উঠে,
“আমি নতুন চাকরি দেখবো।তবে খুলনায় যেতে পারবো না।এখান থেকে খুলনা অনেক দূরে।আমি আশপাশে কোথাও একটা চাকরি দেখে নিব।”

পরে আদিল এদিকে আর মনমতো চাকরি পায়নি।যা পায় খুব কম বেতনের।যা দিয়ে আমাদের সংসার চলতে কষ্টকর হয়ে যাবে।তাই পরে আর উপায় না পেয়ে এক বন্ধুর সহায়তায় ঢাকায় চাকরি দেখে।সেখানেই নামধারী একটা কোম্পানিতে মোটামুটি একটা ভালো এমাউন্টের চাকরি জোগাড় করে ফেলে।ওখানেই এক সপ্তাহ আগে জয়েনিং হয়ে আজ বাসায় আবার চলে আসে আদিল।

আমি মৌনমুখে ননদীর কথায় সায় দিয়ে মার রুমে ঢুকি।শান্ত স্বরে বলি,

“মা?ডেকেছেন?”

শাশুড়ী মা আমার কথার জবাব তুললেন না।চোখজোড়া তীক্ষ্ণ করে তাকিয়ে থাকলেন!মিনিট দুয়েক যেতে ননদী পাশ থেকে বলে উঠেন,

“কি নাকি বলবে তা বলে বিদেয় দাও তাড়াতাড়ি !”

শাশুড়ী মা গলাটা হালকা ঝেড়ে নিলেন। তারপর সামনে এক বাটিটা থেকে একটা পানের খিল মুখে ফুঁড়ে বলতে থাকলেন,

“সংসার করবে তোমরা।মাইনে যা পাবে তা সংসারে৷ খরচা করবে তোমরা!ছেলের মাথা টা খেয়ে ফেলো কেন?তাকে কেনো ঢাকা থেকে বাসায় নিয়ে এলে?তোমাদের সংসারটা কার উপর চলব শুনি?তোমার বাপের বাড়ি থেকে কি মাসে মাসে টাকা পাঠিয়ে দেবে নাকি?”

“মা আপনার ছেলেকে আমি আসার ব্যাপারে কিছুই বলিনি।উনি যে আজ আসবে তা আমিও জানি না।”
“আবার নাটক শুরু করেছো গতবারের মতন!ছেলে ত আমার আগে ঠিকই ছিল।ছুটি ছাড়াা বাসায় আসতাে না।কাজ চলাকালীন কাজ বরখাস্ত করে আসতো না।তোমাকে বিয়ে করার পরই বা কেনো এরকম করতেছে ছেলে!এই মেয়ে?আমার ছেলেকে কি মন্ত্র পড়িয়েছো,শুনি?”

ননদী বলে,
“এমন মন্ত্র পড়িয়েছে বউয়ের আঁচলের তলা ছাড়া তোমার ছেলের কোথাও ভালাে লাগে না!”
“সব দোষ এই মেয়েটার!ভালো ভেবে এঁকে বিয়ে করি এনিয়েছি।এ তো দেখি দিনেক দিন আমাদের জন্যে কালসাপ হয়ে দাঁড়াচ্ছে!”
“মা,আপু?আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে।দয়া করে এরকম মিথ্যে অপবাদ আমাকে দিবেন না।”
“সব ঠিক হয়ে যাবে।যদি আজকে রাতের মধ্যে ছেলেকে আবার ঢাকায় পাঠিয়ে দাও!বুঝাতে পেরেছি?এবার আসতে পারো।”

শাশুড়ী মার রুম থেকে বেরুতে আমার চোখজোড়া টলমল হয়ে যায়।দুইফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে দুইগাল বেয়ে।তরহর করে সেই পানি আবার মুছে নিই।তারপর আমাদের রুমের সামনে আসি।খানিকক্ষণ রুমের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করি।কিছুতেই আদিলকে এই বিষয়টা বুঝতে দেওয়া যাবে না।আগেরবারও দিই নি!আমার মার নিষেধ ছিল।এই বাড়িতে আসার আগে মা একটা কথাই বলেছিলে,প্রিয়া?এই দেয়ালের কথা যেনো ওই দেয়াল না শুনতে পারে।তোর বাবা ক্যান্সারের একজন রোগী।কতটা দারিদ্র্যের সহিত আমাদের সংসারটা চলতেছে তা তুই ভালো করেই দেখতেছিস।পরের বাড়িতে এমন কিছু করিস না মা, যাতে স্বামীর জন্যে শাশুড়ী,ননদীর,ঝাঁয়ের চোখে খারাপ হোস।বা শাশুড়ী,ননদী এবং ঝাঁয়ের জন্যে স্বামীর কাছে খারাপ হোস।

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে আদিলের চোখজোড়া ঝলমল করে উঠে।মুখে ফুঁটে উঠে বহুদিনের প্রতীক্ষার হাসি।আমিও জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলাম।তারপর সোঁজা টেবিলের কাছে এগিয়ে যেয়ে হাত থেকে চুঁড়িগুলো খোলার অভিনয় করতে করতে বললাম,

“কেনো এলেন?

আদিল আমার দিকে এগিয়ে এলো।পেছন থেকে কোমরে জড়িয়ে ধরতে ধরতে বললো,
“তোমাকে ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারছি না।কাজে মন বসে না।ভেতরটা হাহাকার হাহাকার লাগে প্রচন্ড।সারাক্ষণ তোমার চেহারা চোখের সামনে ভাসে।তাই নিজেকে আগলে রাখতে না পেরে ছুটে এসেছি!”
“আসাটা কি খুব বেশিই প্রয়োজন ছিল?”

উনি এবার আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে উনার দিকে ফেরাালেন।বললেন,

“জানি না।তবে তোমাকে ছাড়া থাকা অসম্ভব”

আমি উনার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এলাম।কথাটার পিঠে বলে উঠলাম,
“আপনি বুঝতেছেন?আপনি যে বাচ্চাদের মতন আচরণ করতেছেন?”
“এতে কি তুমি রাগ আমার উপর,প্রিয়া? ”

পরক্ষণে আমি হেসে উঠলাম।আসলে এমনিই হাসিটা আসেনি।ইচ্ছে করে হাসলাম।যাতে উনি আমার ভেতরের চাপা রাগটা না ধরতে পারেন।হাসিমুখেই বললাম,

“নাহ রাগ কেনো হবো!আসলে আপনি যেভাবে হুটহাট চাকরি রেখে চলে আসেন এরকম করলে তো আমাদেরই সমস্যা।আজ আপনার বেশি টাকার প্রয়োজন পড়ছে না।কিন্তু যখন আমাদের একটা বাচ্চা আসবে।তখন তো না চাইলেও করতো হবে চাাকরি।কারণ,বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ-এর কথা সর্বপ্রথম ভাবতে হবে। আর পিতামাতা হিসেবে এটা দায়িত্ব আমাদের।তাছাড়া,আপনি কাজ করতে চাচ্ছেন না কতকাল আপনার ভাই অথবা বোনের জামাইয়ের উপর নির্ভর করে থাকবেন,বলেন?আমাদেরও একটা লজ্জা থাকার বিষয় আছে!”

আদিল মিনিট তিনেকের মতন চুপ করে ছোট্ট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।তারপর আলতো কন্ঠে বললো,

“তাহলে আমি আবার ঢাকায় ব্যাক করবো প্রিয়া?”
“হ্যাঁ।আর আজকে রাতের মধ্যেই।”
“কিন্তু একটা রাত তোমার….!”
“আরো কত রাত কাঁটাতে পারবেন!আপনি চাকরির মাঝখান থেকে চলে আসছেন।কাল না গেলে আপনার বস রেগে যাবে।এমনকি চাকরির থেকে বাদও দিয়ে দিতে পারে।আপনি এখনই আবার চলে যান।”
“আমার বস ওরকম করবে না তুমি যেমনটি ভাবছো,প্রিয়া!”
“তারপরও..!মানুষদের মনের কথা বুঝা যায় না।আপনি যান।”

আদিল এবারো স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো।আমার এরকম অস্বাভাবিক কথাবার্তা হয়তো উনার মোটেও ভালো লাগে নি।তারপরও আমি যেহেতু বলেছি উনি ফিরে যাবেন এটা আমি জানি।উনার সাথে আমার বিয়ে হওয়ার পর উনাকে আমি যতটুকু বুঝেছি উনি আমার কোনো কথাই ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেন না কখনো।

———————————————–
অত্যন্ত ব্যথিতমুখে আদিল আমাদের সবাইকে রাত এগোরটার দিকে আমাদের সবাইকে আবার বিদেয় দেয়।আদিল যাওয়ার সময় আমি মুখে হাসি হাসি ভাব রাখার চেষ্টা করি।তারপরও আদিলের মাঝে একরাশ হাসতে দেখি নি।সে যাওয়ার সময় আমাকে শুধু এটুকুই বলে যায়,

“আসি।ভালো থেকো।আর নিজের খেয়াল নিও।”

আদিল চলে যাওয়ার পর আমার শাশুড়ী, ননদী এবং ঝাঁ খুবই খুশি হোন!

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে