তোর_শহরে_ভালোবাসা পর্ব~৮

0
2468

#তোর_শহরে_ভালোবাসা??
……..{সিজন-২}
#ফাবিহা_নওশীন

পর্ব~৮

??
সামান্তা দুহাত ভর্তি মেহেদী দিয়ে বসে আছে।আশেপাশে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা ছুটোছুটি করছে।উঠতি বয়সী মেয়েরা হাতে মেহেদী দিয়ে বসে আছে।নিশিও হাতে মেহেদী লাগিয়েছে।
সামান্তা আশেপাশের উচ্ছ্বসিত মানুষগুলোকে দেখছে।

নিশি এসে সামান্তাকে বললো,
—–দেখি দেখি।

সামান্তা দুহাত উঁচু করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিশিকে দেখাচ্ছে।
নিশি হাতের মেহেদী দেখে সন্তুষ্ট নয় সেটা ওর মুখ বলে দিচ্ছে।নিশি ভ্রু কুচকে সামুর দিকে তাকালো।সামান্তা বুঝতে পারছেনা কি হয়েছে।সামু আবারো নিজের মেহেদী দেওয়া হাত দেখছে।

নিশি হেয়ালি ছেড়ে দিয়ে বললো,
—–রাজের নাম কই?নামের প্রথম অক্ষর তো দেবে?কি করেছে এরা?
দাড়া আমি দেখছি।

নিশি একজনকে ডেকে সামুর হাতের মেহেদী ঠিক করে নিলো।সামু অপলক নিজের হাতের দিকে চেয়ে আছে।প্রতিটি বাংগালী মেয়ে স্বপ্ন দেখে দুহাত ভর্তি মেহেদী দিবে।মেহেদী রাঙ্গা হাতে বউ সাজবে।সামু একটু পর পর এদিক সেদিক মানুষজন দেখছে আর নিজের হাতের মেহেদী দেখছে।

নিশি ওর পাশে বসে বললো,
—–কি গো কি দেখছো?বরের নাম?

সামু দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে লজ্জামাখা মুখে বললো,
—–নিশিপু,,আমি কিছুই দেখছিনা।

—–তাহলে আমি কি ভুল দেখলাম?একটু পর পর মুচকি মুচকি হেসে লাজুক লতার মতো কে নুয়ে পড়ছে?

সামু ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,
——যাও মজা করোনা।হুহ!!

নিশি সামুর গাল টেনে বললো,
—–ইশশ লজ্জা পাচ্ছে মেরি বেহেনা।

আদি সিড়িতে ভর ছেড়ে দিয়ে ওদের কথা শুনছে।তারপর মিনমিন করে বললো,
“এটা কি হলো?ওর হাতে রাজের নাম।উহু এটা তো মেনে নেওয়া যায়না।একদমই না।”

আদি শিষ বাজাতে বাজাতে ওদের আশেপাশে কয়েক চক্কর দিলো।সামান্তার উঠে দাড়ানোর অপেক্ষায় আছে।

সামান্তা উঠে দাড়ালো।এতো মানুষের ভীর।মেহেদী শুকানোর জন্য ফাকা জায়গায় যাওয়া দরকার।সামান্তা এদিক সেদিক দেখছে।আদি ফোন বের করে আড়চোখে সামান্তার দিকে চেয়ে হাটছে।সামান্তা নিজের হাতের দিকে চেয়ে আছে।আদি দাতে দাত চেপে সামান্তার সামনে গিয়ে দাড়ালো যাতে ধাক্কা খায়।সামান্তার অন্য দিকে খেয়াল নেই।তাই তাল রাখতে না পেরে আদির বুকে হাত রাখলো।
তারপর বিকট আওয়াজে চিতকার করে উঠলো কেননা সামান্তা বুঝতে পেরেছে ওর মেহেদী শেষ।
আদির চোখ বড়বড় হয়ে গেছে।ও চেয়েছিলো সামুর মেহেদী নষ্ট করতে কিন্তু সামু যে ওর টিশার্ট নষ্ট করে দেবে,,ওর টিশার্টে বড়সড় ছাপ মেরে দিবে বুঝতে পারেনি।

আদি রাগের ভান করে বললো,
—–হোয়াট দ্যা হেল আর ইউ?কি করলে এটা?

সামান্তার কানে আদির কথা ঢুকছেনা।ও তো অসহায় ভাবে দুহাতের দিকে চেয়ে আছে।ওর বুকের ভিতরে হু হু করে উঠলো।
মেয়েদের বিয়ের মেহেদী নষ্ট হয়ে যাওয়া অমঙ্গলের মানুষ এসব বলে বেড়ায়।তবে সামু এসব একদম বিশ্বাস করেনা।কিন্তু কেন জানি আজ ওর মন খুতখুত করছে।কেমন জানি কু ডাকছে।মনে হচ্ছে খারাপ কিছু হচ্ছে।এইসব কুসংস্কার ওর মনে গেথে যাচ্ছে।কেন যাচ্ছে?ওর মন হটাৎ করে অস্থির হয়ে উঠছে।ও তো এসব বিশ্বাস করে না তবে কেন?

আদি সামুর মুখের দিকে চেয়ে আছে।সামু চোখ তুলে এক পলক আদির দিকে তাকালো।তারপর ছোট্ট করে বললো সরি।সামু ঝড়ের গতিতে চলে গেলো।
আদি বুঝতে পারছে সামু প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছে।ওর মনে ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
“সরি বেবি সরি।তোমার হাতে রাজের নাম আমি কি করে মেনে নিবো?”

সামু ওয়াশরুমে গিয়ে নিজের হাত ধুয়ে ফেললো।তারপর নিজের হাতের দিকে তাকালো।
“বদ ছেলে,কানা আমার মেহেদী নষ্ট করে দিলো।আমি নাহয় মেহেদীতে বিভোর ছিলাম।ডেবিলটা কিসে বিভোর ছিলো?ছিহ কি জঘন্য লাগছে।আমি এই মেহেদী নিয়ে বিয়েতে বসবো?”
আচ্ছা মেহেদী নষ্ট হয়ে গেলো কেন?ছিহ আমি কি ভাবছি।নষ্ট হয়েছে,হয়ে গেছে এ নিয়ে এতো ভাবার কি আছে।

রাতে হলুদের অনুষ্ঠান।চারদিকে আলোয় ঝলমল করছে।বিভিন্ন ফুলের ছড়াছড়ি।
সামু কাচিহলুদ রঙের শাড়ি পড়েছে।ফুলের গহনা দিয়ে নিজেকে সাজিয়েছে।ওকে স্টেজে বসানো হয়েছে।নিশি সবুজ রঙের শাড়ি পড়েছে।নিশির মা এসে একবার সামুকে দেখে গেলো।
নিশিকে হলুদ দেওয়া হচ্ছে।আদি গাঢ় হলুদ রঙের পাঞ্জাবি পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।সেটা সামুর চোখে পড়েছে।ওর চোখ যেনো ঝলসে যাচ্ছে।
সবাই একে একে সামুকে হলুদ ছুইয়ে দিলো।

আদি মনে মনে বলছে,
আগামীকাল সামান্তার বিয়ে আর আমি ওকে হলুদ ছোয়াবো না ব্যাপারটা কি ভালো দেখায়?উহু!!

আদি সামুর কাছে গিয়ে বসলো।সামু আদিকে ভ্রু কুচকে আদিকে দেখে চোখ সরিয়ে নিলো।আদি একটু হলুদ নিয়ে ওর গালে ছুইয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বললো,
—–নজর সরাচ্ছো কেন?

সামু অন্যদিকে চেয়ে বললো,
—–কারণ আমার চোখ ঝলসে যাচ্ছে।

আদি মুচকি হেসে বললো,
—–বাহ!! আমাকে দেখে তোমার চোখ ঝলসে যাচ্ছে? ইন্টারেস্টিং ভেরি ইন্টারেস্টিং।

সামান্তা ফিক করে হেসে মিনমিন করে বললো,
—–যেই না চেহেরা তার নাম পেয়ারা।

—–কিহ!!পেয়েরা!! তুমি আমাকে পেয়েরা বললে?

সামু আদির দিকে চেয়ে চোখ ছোট ছোট করে বললো,
—–জ্বি হ্যা।আর হ্যা আমার চোখ আপনাকে দেখে ঝলসে যায়নি আপনার পাঞ্জাবি দেখে চোখ ঝলসে যাচ্ছে।মনে হচ্ছে সরিষা ক্ষেতে আছি।এক্ষুনি মৌমাছির দল ঝাক বেধে চলে আসবে।কি জঘন্য ব্যাপার!!

আদি হেসে দিলো।ও সামান্তার কথা শুনে খুব মজা পেয়েছে।

সামান্তা ভ্রু কুচকে বললো,
—–হাসছেন কেন মি.সরিষা ক্ষেত?

আদি হাসি থামিয়ে বললো,
—–তোমার কি হলুদ রঙ খুব অপছন্দের?

সামু ঠোঁট উল্টিয়ে বললো,
—-জ্বি।

—–বাহ বেশ!! তাহলে তোমাকে তো ক্ষেপানোর আরেকটা ওয়ে পেয়ে গেলাম।আর হ্যা তোমার বিয়েতে আমি গাঢ় হলুদ রঙের এত্ত এত্ত উপহার দেবো।

সামু চোখ মুখ ছিটকে বললো,
—–নাহ!!

আদি হেসে উঠে চলে গেলো।সামুর আজকে আদিকে খারাপ লাগছে না।

হলুদের অনুষ্ঠান শেষে সামু হলুদের শাড়ি পড়ে ছাদের রেলিঙ ধরে দাড়িয়ে আছে।চারদিকে পিনপতন নীরবতা।হয়তো পুরো শহর ঘুমিয়ে পড়েছে।দূরে আলো জ্বলছে।এবাড়িতেও আলো জ্বলছে।পুরো গার্ডেন আলোকিত।কিন্তু ছাদে কোনো আলো নেই।সামুর এই অন্ধকার ভালো লাগছে।এই অন্ধকারে নীরবে চোখের পানি ফেলছে।
কিছুক্ষণ পর ভোরের আলো ফুটবে।বিয়ের তোরজোড় শুরু হয়ে যাবে।ওর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে,গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন অথচ ওর ফ্যামিলি নেই।
আদি শিষ বাজিয়ে ছাদে উঠছে।ওর মন প্রচুর ভালো।কিছুক্ষণ আগেই খুব ভালো একটা নিউজ পেয়েছে।
সামু চোখের পানি মুছে চোখ মুখ শক্ত করে পেছনে ঘুরলো।আদিকে দেখে ওর মেজাজ চটে গেলো।

রাগে গজগজ করতে করতে বললো,
—-কি সমস্যা আপনার? এখানেও বিরক্ত করতে চলে এসেছেন?

আদি সামুর কথা শুনে আর ওকে দেখে থমকে গেলো।।
—-এই ওয়েট ওয়েট,,তোমার কি মনে হয় আমি এতটাই বেকার যে সারাদিন তোমাকে ফলো করে বেড়াই?লিসেন দিস ইজ মাই হাউস।ডোন্ট ফরগেট।আর তাছাড়া এখন আমি তোমাকে বিরক্ত করার মুডে নেই।আমি এখন খুব ভালো মুডে আছি।মন খুব ফুরফুরে তাই সেলিব্রেশন করতে ছাদে এসেছি আর তোমার সাথে দেখা।
বাই দ্যা ওয়ে মিস.ধানি লংকা তুমি কাদছিলে?স্ট্রেঞ্জ!! এতো স্ট্রং পার্সোনালিটির মানুষ কাদে?

আদির শেষের কথাগুলো সামুর হজম হলোনা।তাই কড়াভাবে বললো,
—–কেন শক্ত মনের মানুষের কি হৃদয় নেই?ওরা কি ইট কাঠ পাথর দিয়ে তৈরি?ওদের কষ্ট হয়না?
আর আট-দশজনের মতো শক্ত মনের মানুষেরও কষ্ট হয়।এরাও কাদে।হয়তো এরা ভেঙে পড়েনা,নিজেকে সামলে নিতে পারে।নিজের কষ্ট আড়াল করে নিতে পারে।কিন্তু এদেরও স্বপ্ন ভাংগার,হৃদয় ভাংগার কষ্ট হয়।সবাই এদেরকে কষ্টের গুহায় নিমজ্জিত করে।কারণ তারা ভাবে এদের বহন করার ক্ষমতা আছে।তাই এই প্রকার ব্যক্তিরা বেশী কষ্ট পায়।

আদি আনমনে বলে উঠলো,
—–আর যারা নিজেকে প্রকাশ করতে পারেনা তারাও কষ্ট পায়।

সামু আদির দিকে চমকে তাকালো।
আদি একবার সামুর দিকে দৃষ্টি দিয়ে ঘুরে রেলিঙ ধরে বললো,
—–যারা নিজের মনের কথা,ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারেনা,যাদের কেউ বুঝেনা তারাও পৃথিবীতে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হয়।অনেক কিছু মন থেকে চেয়েও পায়না।কারণ তারা প্রকাশ করতে পারেনা।যদি জোর করে কিংবা ছলনার মাধ্যমে ছিনিয়ে নেয় তবেই সেটা পায় অন্যথায় দিনশেষে তাকে শুন্যই থাকতে হয়।
অনেক রাত হয়েছে যাও।আগামীকাল তোমার বিয়ে।অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে।ঘুমিয়ে পড়ো।

সামু এতোক্ষণ আদির কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো।আদির শেষের গম্ভীর কথায় ওর মনোযোগ ক্ষুন্ন হয়।
সামু আদিকে কিছু না বলে ধীর পায়ে ছাদ থেকে নেমে যায়।

আদি নিজেকে নিজেই বললো,
—–বাট আম শুন্য থাকবোনা।এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার।

.

সামু গিয়ে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লো।আর ভাবতে লাগলো আগামীকাল কি হতে চলেছে।কি হবে?
তখনই রাজের ফোন।সামু ফোন নিয়ে রাজের নাম্বার দেখে আবারো রেখে দিলো।
ওর এখন কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।ফোনটা হাতে নিয়ে সাইলেন্ট মুডে রেখে চোখ বন্ধ করে নিলো।তারপর সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলো।

আদি নিজের রুমে গিয়ে বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে।ওর মন কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না।আগামীকাল সব ঠিকঠাক হবে তো এই ভাবনা ওকে ঘিরে ধরেছে।তারপর উঠে গিয়ে একটা ওয়াইনের বোতল হাতে নিলো।

.

সামান্তা গোল্ডেন কালার লেহেঙ্গা পড়েছে।গায়ে ভারী গহনা।ভারি মেকাপ।চুলগুলো কার্লি করে অর্কিড দিয়ে বাধা।পুরো বাড়ি মেহমানে গমগম করছে।সামান্তা হেসে হেসে সবার সাথে কথা বলছে।আদিও গোল্ডেন কালার শেরোয়ানী পড়েছে।আদি বারবার চিন্তিত ভংগীতে ফোনের দিকে চোখ দিচ্ছে।সামান্তাকে বিয়ের আসরে নেওয়া হয়েছে।রাজ আগে থেকেই সেখানে বসে আছে।হটাৎ করে আদির ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে।
আদি একবার সামুর দিকে চেয়ে ঘুরে যায় তারপর কাউন্ট করতে শুরু করে,
ফাইভ,ফোর,থ্রি,টু,,

অপরিচিত এক কন্ঠস্বর বললো,
—–রাজ!!!

আদি চেহারায় কৃত্রিম আফসোসের রেখা ফুটিয়ে বললো,
—–উফফফ…ওয়ানও বলতে দিলোনা।তার আগেই অ্যাকশন।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে