#তোর_শহরে_ভালোবাসা?
পর্ব-২
ফাবিহা নওশীন
এভাবেই দুমাস কেটে গেছে।সামান্তা আদিলের সামনে এই দুইমাসে একবারো পরেনি।একপ্রকার ইচ্ছে করেই আড়ালে থেকেছে।তবে রোজ সকালে নিয়ম করে আদিলের ঘরে গিয়ে চুপিচুপি আদিলকে দেখে আসে।আদিল তখন ঘুমে তলিয়ে থাকে।
সামান্তাকে একমাস যাবৎ একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে।ভার্সিটি,বাসা এ নিয়ে বেশ আছে।নিশি শুধু ননদই নয় খুব ভালো বন্ধু।আর আদিলের বাবা-মা নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসে।আদিলের মা সামান্তাকে বলে দিয়েছে,
–ও যেন কখনো নিজেকে এই বাড়ির বউ না ভাবে বরং মেয়ে ভাবে।
সামান্তা এখন ওনাদের আংকেল আন্টির বদলে মা আর বাবা ডাকে।
অপরদিকে আদিল আর খোঁজ নেয়নি সামান্তা এই বাড়িতে আছে কিনা চলে গেছে।এই ব্যাপারে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস ও করেনি।ওর ঘুম ভাংগে দুপুর ১২,১টায়।বিকেলে বাসা থেকে বের হয়ে ফিরে মাঝরাতে।ও ওর লাইফ নিয়ে ব্যস্ত।তাই বাসায় কে আছে না আছে সেটা ওর পক্ষে জানা সম্ভব নয়।
সামান্তা ৯টায় ভার্সিটির জন্য বেরিয়ে যায় ফিরে ২-৩টায়।কোনোদিন সন্ধ্যাও হয়।তাই দুজনকে সামনাসামনি হতে হয়না।তারউপর সামান্তা নিচের রুমে থাকে।ও হাল ছেড়ে দেয়নি বরং হাল ধরার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে।প্রস্তুতি ছাড়া বড় খেলায় নামা বোকামি ছাড়া কিছুইনা।তাই এই খেলায় নামার আগে সবটা বুঝে নিচ্ছে।এখানকার পরিবেশ,ইচ্ছে-অনিচ্ছে,রুচি সবটাই আয়ত্ত করার চেষ্টা করছে।
ভার্সিটি অফ।বেকার বসে আছে।সামান্তার খোলা জায়গা খুব প্রিয় কিন্তু এই কালো পোশাকের গার্ডদের দেখলেই অস্বস্তি হয়।বাগানে গিয়ে যে একটু হাওয়া খাবে তারোও কোনো উপায় নেই।কারণ বাগানে কোনো প্রাইভেসি নেই।এখানে সেখানে বন্ধুক নিয়ে ঘুরতেই থাকে।তাই ছাদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।
ছাদে গিয়ে রেলিং ঘেঁষে নিচের দিকে ঝুকে আছে।এটা ওর পুরনো অভ্যাস।ঝুকে থাকায় অর্ধেক চুল পিঠে আর বাকি অর্ধেক চুল নিচের দিকে ঝুকে আছে।চেহারাও দেখা যাচ্ছেনা।শুধুমাত্র ফরসা হাত দেখা যাচ্ছে যা দাড়া রেলিং ধরে আছে।
আদিল ফেসবুকিং করতে করতে ছাদে এলো ছাদে এসেই এই দৃশ্য দেখতে পেলো।একটা মেয়ে আকাশি রংয়ের ড্রেস পড়া।ছাদে নিচের দিকে ঝুকে দাড়িয়ে আছে।সবকিছুই আগের মতো শুধুমাত্র সেদিনের মতো হাতে মেহেদী পড়া নেই।
আদিলের বুঝতে বাকি রইলো না এটা কে,,।সামান্তা যে এখনো এই বাড়িতেই আছে সেটা বুঝতে পেরে রাগে ফেটে যাচ্ছে।তারপর আস্তে আস্তে পা ফেলে সামান্তাকে বুঝতে না দিয়ে ছাদ থেকে নেমে গেলো।
আদিল ওর রুমে বেডের উপর হাতের মুঠো শক্ত করে বসে আছে।তারপর উঠে গিয়ে ফুলদানিটা দেওয়ালে ছুরে মারলো।
–আমাকেই কিছু করতে হবে।ওই মেয়ের সাথে কথা বলতে হবে।ওকে আমার লাইফ থেকে বের করতে হবে।
আদিলের মা আদিলের বাবাকে বললো,
–সামু,ভার্সিটি যাবার জন্য রেডি হচ্ছে কিন্তু ড্রাইভার একটা কাজে গেছে এখনো ফিরেনি।
আহনাফ চৌধুরী পেপার পরছিলো।পেপারে থেকে চোখ তুলে বললো,
–তোমার ছেলে কই?ছেলেকে ডাকো।
–আদি তো এখনো উঠে নি।তুমি তো জানো দুপুরের আগে ওর ঘুম ভাংগে না।
–ওকে ডেকে তুলো।আমার বাড়িতে এসব নবাবি চলবেনা।বউ ভার্সিটি যাবার জন্য মানুষ পায়না আর সে পড়ে পড়ে ঘুমায়।
ওকে বলো সামুকে ভার্সিটি দিয়ে আসতে।
–আদি,,এই আদি।উঠ বাবা।
–কি হলো মা,এই সকাল সকাল ডাকছো কেন?
–তোর বাবা অনেক রেগে আছে তুই যদি এখন না উঠিস তোর বাবা কেয়ামত ঘটিয়ে দিবে।
আদি উঠে বসলো,
–মা,আমি এখন উঠে কি করবো?
–ফ্রেশ হ,,সামান্তাকে ভার্সিটি দিয়ে আসবি।ড্রাইভার নেই।
আদির ঘুম উবে গেলো।
–কি!!!আদিল চৌধুরী এখন ড্রাইভারি করবে?আমি কাউকে কোথাও দিয়ে আসতে পারবোনা।
–আদি,,,ও তোর বউ।
আদির হটাৎ মনে পড়লো ওর তো সামান্তার সাথে কথা বলা প্রয়োজন তাই আর কথা না বারিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলো।
আদি গাড়িতে বসে আছে।অপেক্ষা করছে সামান্তার জন্য।
সামান্তা রেডি হয়ে বে হতে গেলেই নিশি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
–সামু,ড্রাইভার কিন্তু আজ ভাই স্বয়ং।সো বি কেয়ারফুল।
–আচ্ছা,তাই নাকি।পেয়েছি সুযোগ।তোমার ভাইকে অল দ্যা বেষ্ট বলে এসো,আমাকে ভয় না দেখিয়ে।
আদি বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে।আমি আদিল চৌধুরী স্বয়ং ড্রাইভার হয়ে অপেক্ষা করছি আর ম্যাডামের খবর নেই।উফফ,,কতক্ষণ বসে থাকবো।
আদি বিরক্ত হয়ে গ্লাস খোলে বাড়ির দিকে চাইলো।সামান্ত আসছে।সাদা রংয়ের লং টপস,টপসের উপর গোল্ডেন কালারের ডিজাইন করা কটি,কালো জিন্স,লেডিস সো,কাধে লেডিস ব্যাগ,সাদা হ্যান্ড ওয়াচ,আঁকাবাকা লালচে চুলগুলো উড়ছে।মুখে কোনো সাজগোজ নেই তবুও স্বিগ্ধ লাগছে।
আদি পলকহীন ভাবে সামান্তাকে দেখছে।সামান্তার কোনো খেয়াল নেই।সে গাড়ির দরজা খোলে সোজা উঠে বসলো।সামনে কে আছে,কি আছে দেখার প্রয়োজন মনে করেনি।
গাড়িতে বসে ব্যাগ থেকে ফোন আর হেডফোন বের করে কানে গুজে দিলো।
আদির অনেক অস্বস্তি হচ্ছে সামান্তার সাথে যেতে।সামান্তার অবস্থা বুঝার জন্য লুকিং গ্লাসে চোখ রাখলো।সামান্তাকে নরমাল লাগছে।সে দিব্যি কানে হেডফোন গুঁজে দু’হাতে ফোন টিপছে।মাঝে মাঝে ফোনের দিকে চেয়ে ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু পড়ছে আর মুচকি হেসে আবারো টাইপ করছে।আদি স্পষ্ট বুঝতে পারছে সামান্তা চ্যাটিং করছে।
সামান্তার গা থেকে পারফিউমের মিস্টি ঘ্রাণ ভেসে আসছে।আদির অবাক হয়ে ওকে দেখছে।
মেয়েটা এত নরমাল ভাবে কি করে বসে আছে,সামনে কে আছে তাতে যেন কিছু এসে যায়না।কিন্তু আদির তো অনেক অস্বস্তি হচ্ছে।যাকে বউ হিসেবে মেনে নেয়নি তার সাথে একা গাড়িতে করে যাচ্ছে।তাও তাকে তার গন্তব্যে পৌঁছে দিতে।কি অদ্ভুৎ।
আদি তো সামান্তার সাথে কথা বলার জন্য এসেছে কিন্তু কি বলবে,কিভাবে বলবে বুঝতে পারছেনা।তার চেয়ে বড় কথা ওর এখন কিছু বলতে মনে চাইছেনা।এসব ভাবনায় বিভোর হয়ে গাড়ির স্পিড কমিয়ে দিয়েছে।
সামান্তার ৯টা ২০মিনিটের মধ্যে ভার্সিটি গেইটে উপস্থিত থাকতে হবে।নয়তো ঢুকতে পারবেনা।এভাবে গাড়ি চালালে নির্ঘাত ফিরে আসতে হবে।
কানে থেকে হেডফোন সরিয়ে বললো,
–এক্সকিউজ মি,,আপনি নতুন নাকি,,?বাবা যে কোত্থেকে এসব ড্রাইভার নিয়ে এসেছে আল্লাহ ই জানে।একটু জোরে ড্রাইভ করুন।আমার দেরি হয়ে যাবে।
আদি সামান্তার কথায় চমকে গেলো।আবার রাগ ও হলো আদিল চৌধুরীকে ড্রাইভার বলা হচ্ছে।পিছনে ঘুরে বললো,
আমাকে দেখে তোমার ড্রাইভার মনে হচ্ছে?
সামান্তা চোখ তুলে ওর দিকে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থেকে বললো,
–না আপনাকে ঠিক ড্রাইভার মনে হয়না,,কারণ ড্রাইভারদের ফেসে একটা ইনোসেন্ট ভাব থাকে যেটা আপনার ফেসে নেই।
আপনাকে কোথাও দেখেছি বলে মনে হচ্ছে।কোথায় দেখেছি বলুন তো?দূর,,বাদ দিন।ওসব পরে ভাবা যাবে।আপনি এখন প্লিজ একটু তাড়াতাড়ি ড্রাইভ করুন।আমার ফ্রেন্ডরা অপেক্ষা করছে।
আদি অবাকের সপ্তম আকাশে উঠে গেলো।এই মেয়ে আমাকে চিনে না।আদি পাল্টা প্রশ্ন করলো,
–তোমার কয়জন ফ্রেন্ড?
–৭-৮জন।
–কয়দিন যাবত ক্লাস করছো?
–একমাস।
–এই কয়দিনে ৭-৮টা ফ্রেন্ড বানিয়ে ফেলেছো?
–এ তো কম ই।আমার কলেজে ৫০জনের মতো ফ্রেন্ড ছিলো।
–ও,,এম,,জি,,(আমারো তো পুরো লাইফে এত ফ্রেন্ড হয়নি।)কয়টা বয়ফ্রেন্ড ছিলো?
–একটাও না।প্রেম করার আগেই তো বাবা ধরে এক লাফাঙ্গার সাথে বিয়ে দিয়ে দিলো।
আদি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
–হুয়াট ডু ইউ মিন বাই লাফাঙ্গা?
–লাফাঙ্গা মানে জানেন না?লাফাঙ্গা মানে হলো এই ধরুন উৎশৃঙ্খল,বখাটে,অহংকারী,একগুঁয়ে,
বদমেজাজি,অভদ্র,বেয়াদপ টাইপ ছেলে যারা বাপের পয়সায় ফুটানি করে।
আদি দাতে দাত চেপে সামান্তার সব কথা হজম করছে।ও সামান্তার সামনে নিজের পরিচয় দিতে চসিছে না এই মুহুর্তে।ও জানতে চায় আসলে সামান্তা ওকে কি ভাবে,,
তাই নিজের রাগ সব হাতের মুঠোতে রাখা স্টেয়ারিংয়ের উপর ঝাড়ছে।
তারপর ফুসফুস করতে করতে বললো,
–এতোই যখন অপছন্দ তবে বিয়ে করেছিলে কেন?
–ওই মিয়া আপনি কি বয়রা?কানে কম শুনেন?
আদি হকচকিয়ে গেলো।
–মানে কি?
–আমি কি বলেছি আপনি শুনতে পান নি?আমি বলেছি বাবা ধরে আমাকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে।নয়তো এই বয়সে কেউ বিয়ে করে?একটা প্রেম ও করতে পারলাম না।সামু তোর কপালই খারাপ।
আদি সামান্তার মনের কথা জানার জন্য।একটু বাজিয়ে দেখার জন্য বললো,
–তাহলে ডিভোর্স দিয়ে দেও।
–আরে আপনি তো ওই লোকের মতোই?
–কোন লোকের মতো?
–যেই গন্ডারের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে।বাইয়াদ প্রাণী।মাই হাসব্যান্ড।
আদির সামান্তার মুখে হাসব্যান্ড কথাটা শুনে কেমন অদ্ভুৎ ফিলিংস হচ্ছে।
–তারপর আমি ওই লোকের মতো মানে?
–এই বিয়েকে ছেলে খেলামনে করছেন।মনে চাইলে একজনকে বিয়ে করে নিলাম আর ভালো লাগলো না ডিভোর্স দিয়ে দিলাম।বিয়ে হলো আল্লাহর দেওয়া পবিত্র সম্পর্ক।একটা কাগজ কিংবা একটা সাইন এই সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারেনা।
যাইহোক আপনার সাথে আমার আর কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা।চুপ করে গাড়ি চালান।
শহরের সব ছেলেরা এক।কোনো কিছুর মূল্য এদের কাছে নাই।
বিরবির করে কথাগুলো সামান্তা আদিকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো।
সামান্তার কথাগুলো আদিকে খুব ভাবাচ্ছে।আদি চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করলো,
–তারমানে তুমি তাকে ছাড়বে না?
সামান্তা কি উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছেনা।বাইরের দিকে চেয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুটা জোর করেই বললো,
–জানিনা,,যে ছেলে মেয়েদের নূন্যতম সম্মান দেয় না তার সাথে আমি সত্যিই জানিনা।আমাকে বিয়ে করেছে ভালো না বাসতো,,আমি তো ভালো বাসতে বলিনি,,একটু সম্মান তো দিতে পারতো,,সেটাও দেয়নি।
সামান্তাকে গলা ধরে এলো।চোখের কোনে পানি জমেছে।আদির চোখে তা এড়ায়নি।ওর কেন জানি খুব মায়া হচ্ছে।কোনো মেয়েই তার স্বামীর কাছে থেকে অবহেলা সহ্য করতে পারেনা।সে স্বামী যেমনই হোক।
গাড়ি এসে ভার্সিটির গেইটের সামনে থামলো।সামান্তা গাড়ি থেকে নেমে পিছনে না চেয়েই হাটা ধরলো।ওর জন্য ২টো ছেলে,২টো মেয়ে অপেক্ষা করছে।ও তাদের সাথে ভিতরে যাচ্ছে।
আদি তখনো সামান্তার দিকেই চেয়ে আছে।কেন জানি অদ্ভুৎ ফিলিংস হচ্ছে।সবকিছু এলোমেলো লাগছে।অস্থির লাগছে।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
বারবার সামান্তার কথাগুলো কানে বাজছে।ওর ছলছল চোখগুলো বারবার ভেসে উঠছে।
চলবে,,,