তোমায় পাবো বলে পর্ব-১৩

0
1114

#তোমায়_পাবো_বলে
#পর্ব_১৩
#নিশাত_জাহান_নিশি

দরজায় হেলান দিয়ে বুকে দু হাত গুঁজে পরশ ভাই ঠোঁটের কোণে একই হাসি বজায় রেখে আমার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে বললেন,,

“এই সামান্য কয়েকটা আঁচারের জন্যই রাতের খাবারটা স্কিপ করে গেছো তাই না?”

নিতান্তই বিবেচকহীন চিন্তা ভাবনা লোকটার। আমাকে সম্পূর্ণ বুঝার সক্ষমতা লোকটার এখনো অবধি অর্জিত হয়ে উঠে নি। উনার ভালোবাসায় অতি স্বল্প পরিমানে হলে ও খামতি দেখতে পারছি আমি। মনের কথা কিছুতেই বুঝতে চাইছেন না। অবিবেচকদের মতোই মন্তব্য করে বসলেন সামান্য আঁচারের জন্য নাকি আমি রাতের খাবারটা স্কিপ করে গেছি! অবশ্য একদিক থেকে ভালোই হলো আন্টি এবং আমার মধ্যে তৈরী হওয়া বিবেধের দেয়ালটা অন্তত পরশ ভাই আঁচ করতে পারেন নি। বাড়ির বাকি সদস্যরা ও কিছু বুঝার সক্ষমতা অর্জন করতে পারেন নি। বিষয়টা অতি গোপনীয় থাকাটাই আপাতত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছি। রীতিমতো ঘোর অন্যায় করেছিলাম আমি। মুখের উপর আন্টিকে আন্টির ছেলে সম্পর্কেই যা তা বলে বসলাম? এর সাজা তো আমাকে ভোগ করতেই হবে! তবে আমি চেষ্টা করতে পারি অন্তত একবার রিস্ক নিয়ে আন্টির সাথে ঐদিনের বিষয়টা খোলসা ভাবে আলোচনা করতে। পরশ ভাই সম্পর্কে তৈরী হওয়া ভুল ধারনা গুলো এক এক করে শেয়ার করতে। তাহলেই আন্টি বুঝতে পারতেন কিসের প্রেক্ষিতে আমি পরশ ভাই সম্পর্কে কটুক্তি করার সাহস দেখিয়েছিলাম।

নিজস্ব ভাবনা চিন্তায় পুরোপুরি ডুবন্ত আমি৷ সারা রুম জুড়ে পিনপতন মৌনতা বিরাজ করছিলো খুব গাঢ়ভাবে। হুট করেই আমার মৌণ শক্তিতে পরশ ভাইয়ার গলা খাঁকারির শব্দ সক্রিয় হয়ে উঠল। খানিক কেঁপে উঠে আমি অস্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম পরশ ভাইয়ার ভ্রু উঁচিয়ে রাখা মুখমন্ডলে। দরজায় হেলানরত অবস্থা থেকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পরশ ভাই আমার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে বললেন,,

“কি ভাবছ?”

মাথা নাঁড়িয়ে আমি জোরপূর্বক হাসি টেনে বললাম,,

“কিছু না।”

“খালি পেটেই আঁচার খাবে?”

“এখন না। সকালে খাবো।”

“মন খারাপ তোমার?”

“কই? না তো!”

“সত্যি?”

প্রসঙ্গ পাল্টাতে যেনো আমি মরিয়া হয়ে উঠলাম। ইতস্তত গলায় আমি বেশ তৎপর ভঙ্গিতে বললাম,,

“পিয়াস ভাইকে কোথাও দেখেছেন?”

“প্রসঙ্গ পাল্টাতে চাইছ?”

“উঁহু। ভুল ভাবছেন!”

রাগে গজগজ করে পরশ ভাই স্থান পরিত্যাগ করে ঠিক আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেন। চোয়াল শক্ত করে খড়তড় গলায় আমায় শুধিয়ে বললেন,,

“বলো কি হয়েছে? কি আড়াল করতে চাইছ?”

ভয়কে বিন্দু পরিমান প্রশ্রয় না দিয়েই আমি সাবলীল কন্ঠে প্রত্যত্তুরে বললাম,,

“কই? কিছু হয় নি তো! অযথা কি আড়াল করতে চাইব আমি?”

“তাহলে রাতের খাবারটা খেলে না কেনো?

“ক্ষুধা ছিলো না তাই খাই নি। এর উপর আর কোনো প্রশ্ন থাকতে পারে কি?”

“আমার প্রশ্ন আছে, অবশ্যই আছে। রাতে না খেয়ে থাকাটা স্বাস্থ্যের পক্ষে মোটে ও ভালো নয়। ক্ষুধা না থাকলে ও অল্প পরিমানে হলে ও খেতে হয়। এক্ষনি বসা থেকে উঠো, আর খাবার টেবিলে এসো। আন্টি তোমার জন্য খাবার সাজিয়ে রেখেছেন টেবিলে।”

মেজাজটা যেনো মুহূর্তের মধ্যেই চওড়া হয়ে উঠল। দমানো যেনো কোনো মতেই সম্ভব হয়ে উঠছিলো না। অবশেষে তিরিক্ষিপূর্ণ গলায় আমি বলতে বাধ্য হলাম,,

“বলছি তো খাবো না আমি। কেনো এতো জোর করছেন? প্লিজ আপনি এখন আমার রুম থেকে বের হউন। আমাকে একটু থাকতে দিন!”

“বিরক্ত লাগছে আমাকে? ইদানিং খুব বিরক্ত লাগছে?”

“হুম লাগছে। তাছাড়া এতো রাতে আপনি আমার রুমে কি করছেন? এটা আমার প্রশ্ন না। বাকি যারা আমার রুমে এতো রাতে আপনাকে দেখবেন, তারাই এই প্রশ্নটা আমার দিকে ছুঁড়ে মারবেন। আমি অন্তত এই কেলেঙ্কারিপূর্ণ প্রশ্নটার সম্মুখীন হতে চাই না। প্লিজ আপনি এক্ষনি, এই রুম থেকে বের হোন।”

“ভয় দেখাচ্ছ আমায় না? হুমকি দিচ্ছ?”

“সত্যিটা বলছি। আদৌতে এখানে কোনো ভয় বা হুমকির প্রশ্রয় নেই।”

“প্রশ্নের সম্মুখীন হলে আমি হবো। কেলেঙ্কারি হলে আমার হবে। ইউ প্লিজ ডোন্ট ওরি। তোমার গাঁয়ে কেলেঙ্কারির কোনো ছিটেফোঁটা ও লাগতে দিবো না আমি!”

ইতিমধ্যেই রুমে তৃতীয় কারো উপস্থিতি টের পেলাম আমি। বুকটা অনাকাঙ্ক্ষিত ভয়ে ধুকপুক করে কেঁপে উঠল। দরজা ঠেলে কেউ রুমে প্রবেশ করতেই আমার দৃষ্টি পড়ল পরশ ভাইয়ার ঠিক পেছনের দিকটায়। পিয়াস ভাইয়া হাসোজ্জল মুখ নিয়ে দরজা ঠেলে নিশব্দে রুমে প্রবেশ করলেন। হাতে অবশ্য বড় একটা শপিং ব্যাগ ও আছে। পরশ ভাই কটমট দৃষ্টিতে পিছু ফিরে পিয়াস ভাইকে দেখা মাএই রাগে ফুসফুস করে উঠলেন। পরশ ভাইয়ার রাগী দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে পিয়াস ভাই শপিং ব্যাগটা উপরের দিকে উঁচিয়ে ধরে দাঁত কপাটি বের করে হেসে আমায় উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“ব্যবস্থা হয়ে গেছে, ছাদে চল।”

হুড়মুড়িয়ে আমি বসা থেকে উঠে আনন্দের জোয়ারে ভেসে উঠে পিয়াস ভাইয়ার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে বললাম,,

“কেউ দেখে নি তো?”

“ধ্যাত। সেই সুযোগ দিলে তো? কেউ দেখি নি। তুই নিশ্চিন্ত থাক।”

“বাকিরা কোথায়?”

“সবাই ছাদে।”

“মিলি আপু ও?”

পিয়াস ভাই মুখটা ভাড় করে বললেন,,

“রুম্পাকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু, মিলি বলল আসবে না!”

“আমি একবার ডেকে আসব?”

সঙ্গে সঙ্গেই পিয়াস ভাই সম্মতি জানিয়ে মৃদ্যু হেসে বললেন,,

“তাহলে তো খুবই ভালো!”

“আচ্ছা আমি যাচ্ছি।”

তড়িঘড়ি করে আমি রুম থেকে প্রস্থান নেওয়ার পূর্বেই পরশ ভাই পেছন থেকে তেজী কন্ঠে আমায় শুধিয়ে বললেন,,

“খালি পেটে এসব না খেলে হয় না?”

গুরুগম্ভীর কন্ঠে আমি প্রত্যত্তুরে বললাম,

“না৷ হয় না।”

আর একটা মুহূর্ত ও বিলম্ব করলেন না পরশ ভাই। ভীষন অপমানিত বোধ করে রুম থেকে প্রস্থান নিতে বাধ্য হলেন। আকস্মিকভাবেই পিয়াস ভাই পেছন থেকে পরশ ভাইকে ডেকে বললেন,,

“পরশ। আপনি ও চাইলে আমাদের সাথে জয়েন করতে পারেন।”

গাম্ভীর্যপূর্ণ কন্ঠে পরশ ভাই প্রত্যত্তুরে বললেন,,

“আ’ম নট ইন্টারেস্টেড।”

পরশ ভাই শো শো বেগে আমাকে উপেক্ষা করে নিজের রুমের দিকে মোড় নিলেন। লোকটার যাওয়ার পথে কিঞ্চিৎ মুহূর্ত মৌণচিত্তে তাকিয়ে থেকে আমি পুনরায় দীর্ঘশ্বাস নির্গত করে মিহি কন্ঠে বললাম,,

“আপনার রগচটা স্বভাবটা কখনো পাল্টাবে না পরশ ভাই। হুটহাট রেগে যাওয়াটা আপনার স্বভাব৷ আপনার এই বদ স্বভাবটার জন্যই আন্টির চোখে আজ আমি হেয়প্রতিপন্ন! সঠিক দিকটা বিচার-বিশ্লেষণ না করেই আন্টি আমায় একতরফা দোষী ভাবছেন। যা মেনে নেওয়া আমার পক্ষে আদৌ সম্ভব হয়ে উঠছে না!”

মন্থর গতিতে হেঁটে আমি মিলি আপুর রুমের দিকে পা বাড়ালাম। লক করা দরজাটায় ক্রমাগত দু, তিন টোকা দিতেই মিলি আপু তড়িঘড়ি করে রুমের দরজাটা খুলে নিলেন। শুকনো মুখে আমাকে অবলোকন করা মাএই আপু অকস্মাৎ মৃদ্যু হেসে এক টানে আমায় রুমে ঢুকিয়ে নিলেন। অতঃপর আমার কাঁধে দু হাত রেখে আপু প্রফুল্ল গলায় অনর্গল বলতে আরম্ভ করলেন,,

“আজ ভীষন খুশি আমি টয়া। ভীষষষষন খুশি!”

কৌতুহলীপ্রবণ হয়ে আমি ম্লান হাসিতে আপুকে প্রশ্ন ছুঁড়ে বললাম,,

“কেনো আপু? এতো খুশি হওয়ার কারণটা কি?”

“ঐ যে আন্টিটা? মানে পরশের মা, উনি বোধ হয় মনে মনে আমাকে ভীষন পছন্দ করেছেন। কথা বার্তায় বেশ আঁচ করতে পেরেছি আমি। হাজারটা প্রশ্ন জিগ্যেস করছিলেন আমায়। আমার সম্পর্কে জানার খুব আগ্রহ দেখেছিলাম। ধারনা করতে পারছি, ছেলের বউ হিসেবে উনি আমাকেই পছন্দ করছেন!”

সঙ্গে সঙ্গেই আমি মাথা নুঁইয়ে নিলাম। চোখের শ্রাবণ ঢাকার এ যেনো এক বৃথা চেষ্টা। মনে খুব ঝড়ো হাওয়া বইছে আমার। ঠিক যেনো কাল বৈশাখী ঝড়ের মতো উচ্চগতিসম্পন্ন এই ঝড়ের তান্ডব। ভেতরটা নিংড়ে অঢেল ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। কে দেখবে ভেতরের এই অকথিত যন্ত্রনাটা? কাকে দেখাবো আমি ভেতরটা? এর’চে তো ভালো স্বাভাবিক ভাবেই এই বিরূপ পরিস্থিতিটা সামলে নেওয়া। মনে জমাট বাঁধা সুপ্ত অনুভূতি গুলোকে দুহাত দিয়ে দাফন করে দেওয়া। কোনো এক্সপেক্টেশান না রাখা। পূর্বে যেমন পরশ ভাইয়ার ছোঁয়ায় আমি কোনো রূপ অনুভূতি খুঁজতে যেতাম না, এখন ও ঠিক সেই ছোঁয়াতে আমি ইতিবাচক কোনো অনুভূতি খুঁজতে যাবো না। শুরু থেকেই নিজেকে দমিয়ে নেওয়াটাই ভালো। অনুভূতিরা যখন পাকাপোক্ত ভাবে ঝেঁকে বসবে তখনই আমার মনের মৃত্যু ঘটবে। আমি চাই না, আমার মনের মৃত্যু ঘটুক।

যদি ও কান্নার বেগ বৃদ্ধি পেয়ে হেচকি উঠার পথে রীতিমতো ধাবিত হচ্ছিলো তা ও আমি নাক টেনে কান্না নিবারন করার চেষ্টায় অটল আছি প্রায়। পরিশেষে আমি পেরেছিলাম, কান্না নামক বেদনাকে সঠিকভাবে নিবারন করতে। জোরপূর্বক হাসি টেনে আমি মলিন কন্ঠে আপুকে বললাম,,

“বাঃহ খুব ভালো খবর তো। শুনে আমার ও খুব আনন্দ হচ্ছে!”

আপু লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে মুচকি হেসে বললেন,,

“ইয়েস। এবার শুধু পরশের মনে একটু খানি জায়গা করে নেওয়ার পালা। আমি খুব এক্সাইটেড রে টয়া!”

প্রসঙ্গ পাল্টাতে আমি দ্রুতগতিতে বললাম,,

“চলো আপু। আমরা ছাঁদে যাই। পিয়াস ভাইয়া ছাঁদে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।”

“এই তুই পাগল হয়ে গেছিস নাকি? ভাং খেয়ে মাতলামো করে নিজের হাতে ধরেই বিয়েটা ভেস্তে দেই আর কি! পরশের আম্মু যদি কোনো মতে আঁচ করতে পারেন না? আমি ভাং খেয়েছি, নেশা করেছি, নির্ঘাত আমায় খারাপ ভাবতে দু সেকেন্ড সময় ও ব্যয় করবেন না। হুট করে পছন্দের তালিকা থেকে আমায় অতি শীঘ্রই উচ্ছেদ করবেন। আমি এই রিস্ক নিতে পারব না বাপু!”

নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ থেকেই আমি দ্রুত পায়ে হেঁটে রুম থেকে প্রস্থান নিলাম। কতদূর ভেবে রেখেছেন আপু! আপুর অত্যধিক ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা দেখে আমি আশ্চর্য না হয়ে পারছি না। আপু বুঝি আন্টিকে এতোটাই জাদু করে বসেছেন যে, আন্টি প্রথম দেখাতেই আপুকে উনার ছেলের বউ হিসেবে ভাবতে শুরু করেছেন? হাহ্! মানুষের মন! বদলাতে দু সেকেন্ড সময় ও লাগে না।

বিষন্ন মনে আমি। সিঁড়ি টপকে ছাদের দরজার দিকে গতিপথ নির্ধারন করতেই পিয়াস ভাই আমার সম্মুখস্থ হয়ে দাঁড়ালেন। অস্থির দৃষ্টিতে আমার আশেপাশে চোখ বুলিয়ে পিয়াস ভাই পরিশেষে আহত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। কেমন যেনো মনমরা কন্ঠে পিয়াস ভাই আমায় শুধিয়ে বললেন,,

“মিলি আসে নি?”

নির্লিপ্ত গলায় আমি পিয়াস ভাইকে প্রশ্ন ছুঁড়ে বললাম,,

“মিলি আপুকে খুব ভালোবাসো না?”

পিয়াস ভাই হেয় হেসে বললেন,,

“হয়তো অতোটা ও বাসি না! যতোটা বাসলে মিলি আমার মনের কথাটা বুঝতে পারে!”

“যদি কখনো জানতে পারো, মিলি আপু তোমার হবে না! খুব বেশি আঘাত পাবে কি?”

আঁখি জোড়ায় অশ্রুকণা সমেত পিয়াস ভাই উচ্চ আওয়াজে হেসে বললেন,,

“তাহলে আমি জানার আগ্রহটাই ছেড়ে দেবো। মিলিকে না পাওয়ার আঘাত আমি সহ্য করতে পারব না।”

“জানার আগ্রহটা বাড়িয়ে নাও। মিলি আপু হয়তো তোমার হবে না!”

পিয়াস ভাইকে উপেক্ষা করে আমি ছাঁদে পা রাখতেই রুম্পা আপু, স্নিগ্ধা, নীলা, পিয়ালী আপু, পায়েল, পাশের বাড়ির কয়েকজন সমবয়সী ফ্রেন্ড পরিশেষে বড় আপু এবং জিহাদ ভাইয়ার মুখোমুখি হলাম। আমাকে পেয়ে সবাই আনন্দে আত্নহারা হয়ে বোতলের ছিঁপি খুলে এক এক করে গ্লাসে ভাং ঢালতে আরম্ভ করলেন। পিয়ালী আপু এবং পায়েলকে দেখে তো আমি অবাকের চরম শীর্ষে আরোহন করছি। আমার আশ্চর্যিত মুখমন্ডল দেখে পিয়ালী আপু আমার পাশে দাঁড়িয়ে চোখ টিপে বললেন,,

“চলে এলাম তোমাদের সাথে জয়েন হতে। এই প্রথম ভাং এর টেস্ট নিবো। আ’ম সো এক্সাইটেড টয়া।”

উদ্বিগ্নচিত্তে আমি পিয়ালী আপুর দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললাম,,

“আন্টি রাগ করবেন না?”

“একদিনেরই তো ব্যাপার। ঠিক ম্যানেজ করে নিবো।”

গোল হয়ে ছাদে বসে সবাই যে যার গ্লাসে চুমুক দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। পাশে অবশ্য লেবুর জলের ব্যবস্থা ও আছে। ভাং এর স্বাদ নেওয়ার পর পরই লেবুর জল সবাই এক গ্লাস করে খেয়ে নিবে৷ হ্যাংওভার কাটানোর জন্যই এই ব্যবস্থা৷ সবাই বেশ আমোদ, ফুর্তি, হাসাহাসিতে লিপ্ত থাকলে ও আমি এবং পিয়াস ভাই মনে সাংঘাতিক বিষন্নতা নিয়ে চুপচাপ ভাং এর গ্লাসে চুমুক দিয়ে যাচ্ছি। পারিপার্শ্বিক আনন্দ আমাদের মস্তিষ্কে বাহিত হওয়ার বদলে তিক্ততার জন্ম দিচ্ছিলো খুব বিক্ষিপ্তভাবে। পর পর দু দুটো ভাং এর গ্লাস নিমিষের মধ্যেই শেষ করি আমি টাল মাটাল হয়ে রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম। মনে হলো যেনো বুকটা কেউ চাপ দিয়ে ধরে আছে৷ শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে। আমার আশপাশটা চড়কির মতো ঘুড়ছে। শরীরটা ক্রমান্বয়ে অসাড়, বেসামালহীন, নিস্তেজ হয়ে আসছে৷ আঁখি যুগল ঝাপসা হয়ে আসছে৷ দেহ জ্বালা পোঁড়া করছে। টুপটাপ শব্দে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। কম্পিত শরীর নিয়ে আমি অনেকটা সময় পর নিজের রুমে প্রবেশ করতে সফল হলাম। বুকে হাত দিয়ে এক অসহ্য যন্ত্রনায় নাক, মুখ কুঁচকে আমি বিছানায় গাঁ এলাতেই শরীর থেকে জবজবে ঘামের আবির্ভাব হলো। বড় বড় রুদ্ধশ্বাস নির্গত করে আমি বুকের ব্যাথায় কুঁকিয়ে উঠে নিম্ন আওয়াজে আর্তনাদ করে বললাম,,

“প্লিজ কেউ আমায় একটু হেল্প করো। বাঁচিয়ে তুলো আমায়৷ মরে যাচ্ছি আমি! বুকটা যন্ত্রনায় ফেঁটে যাচ্ছে।”

সঙ্গে সঙ্গেই আমি অচেতন হয়ে বিছানায় পুরোপুরি লুটিয়ে পড়লাম। শরীরের সমস্ত ভাড় বিছানার উপর ছেড়ে দিলাম। দিন-দুনিয়ার আদৌতে কোনো খবর নেই আমার। মনে হলো যেনো এই বুঝি আমি মৃত্যুর বুকে ঢলে পড়লাম! আর বুঝি এই জন্মে বেঁচে থাকার স্বাদ আস্বাদন করতে পারব না।

,
,

মস্তিষ্কে বিকিরণ ক্ষমতা সংযোজন হতেই আমি অবচেতন অবস্থা থেকে লাফিয়ে উঠলাম। দীর্ঘ সময়ের জন্য স্থগিত থাকা মস্তিষ্কের প্রতিটা সেল সতেজ হয়ে উঠতেই বিকিরণ সমতায় মোটামুটি অনেকটাই আঘাতপ্রাপ্ত হলাম আমি। কপালে হাত রেখে নাক, মুখ কুঁচকে আমি আধো চোখে পারিপার্শ্বিক দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই আমার রুমে জট পাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পরিবারের প্রতিটা সদস্যকে দেখতে পেলাম। দরজার এক কোণায় তেজীয়ান দুটো চোখ হিংস্র দৃষ্টিতে আমায় পর্যবেক্ষন করছে। কখন যেনো হিংস্রতা নিবারন করতে না পেরে তেজীয়ান লোকটা আমার দিকে তেঁড়ে এসে ঘাড় থেকে আমার মন্ডু আলাদা করে নেয় তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। শুকনো ঢোক গিলে আমি পাশ ফিরে তাকাতেই আম্মুর ভয়াল থাবার মুখোমুখি হলাম। ঠাস করে আম্মু এক চড় বসিয়ে দিলেন আমার গালে। গালে হাত রাখার সময়টা ও পেলাম না। এর মধ্যেই পাশ থেকে আব্বু দাঁতে দাঁত চেঁপে আমায় শাসিয়ে বললেন,,

“আর ও একটা চড় তোমার প্রাপ্য। বুঝেছ তুমি? রীতিমতো বেয়াদব হয়ে উঠছ দিন দিন। সারা রাত ছাদে বেলাল্লাপনা করে বুকে ব্যাথা নিয়ে শয্যাশায়িত ছিলে তাই না? বাড়ি ভর্তি মেহমানদের সামনে আমার মান-সম্মান নিলামে উঠাতে একেবারে প্রস্তুত হয়ে আছো। যথার্থ সময়ে যদি পরশ আমাদের ডেকে না দিতো, তোমার ঠিক কি অবস্থা হতো আন্দাজ করতে পারছ তো তুমি?”

#চলবে…?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে