তোমার সন্ধানে পর্ব-০৪

0
972

#তোমার_সন্ধানে ♥️
#ফারজানা_আফরোজ

নিয়তির এক হাত ধরে মেইন গেইটের সামনে যেতে লাগলো শুদ্ধ। নিয়তি হাত ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করতে লাগলো। অভ্র তখন মিশুর সামনে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,

–” আমি কী আপনার হাত ধরব মিস শিশু?”

রাগী চোখে তাকালো মিশু। অভ্র ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে শুদ্ধর পিছু নিলো, মিশুও আল্লাহ আল্লাহ বলে হাঁটা দিল। আজকে যে তাদের কপালে মারাত্বক লেবেলের শাস্তি আছে ঠিকই বুঝতে পারলো।

আকাশে তারায় পরিপূর্ণ কিন্তু চাঁদ নেই। নিয়তি কাঁদো কাঁদো মুখ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে, চাঁদের অভাব বোধ করছে সেই সাথে মনের ভিতর লুকিয়ে থাকা ভয়টা গাঢ় হয়ে উঠছে। সে যে ক্লাবে গিয়েছিল এই কথা যদি একবার তার পরিবার জানতে পারে তাহলে আর তার রক্ষা নেই। গেইটের সামনে দারোয়ান চাচাকে দেখে দুজন ঢোক গিলল। দারোয়ান চাচা এত রাতে হোস্টেলের দুজন মেয়েকে বাহিরে থাকতে দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হলো, আরো বেশি অবাক হলো ক্রিকেটার শুদ্ধ এবং রিপোর্টার অভ্রকে দেখে। ভারী গলায় বলে উঠলেন দারোয়ান চাচা,

–” নিয়তি, মিশু তোমরা এত রাতে বাইরে কেন? তোমাগো না আমি হোস্টেলের ভিতরে দেখছিলাম। আর উনারা দুজন তোমাগো লগে কেন? আবার কিছু করছ নাকি? তোমাগো দুজনের সাহস দিনদিন বহুত বাইরা গেছে। আমি কিন্তু হেড অফিসে বিচার দিমু।”

দারোয়ান চাচার কথা শোনে শুদ্ধ মৃদু স্বরে বলল,

–” এইবার আর কিছু বলতে হবে না। ওদের দুজনকে ভিতরে পাঠান। আজকের রাতের ঘটনা যেন কেউ না জানে। আমি এই কারণে আপনাকে পুরস্কৃত করবো।”

বোকার মত তাকিয়ে আছে নিয়তি। সে কি সব ঠিক শুনছে? এই লোকটা আদো এত ভালো? নাহ কিছুতেই এই লোক এত ভালো নয়। নিশ্চয় কোনো মতলব আছে কিন্তু কী সেই মতলব? ভাবতে ভাবতেই মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে নিয়তির। কোনো রকম নিজেকে শান্ত রেখে মিশুর হাত ধরে নিজেদের রুমে চলে গেল। একটা বারও পিছন ফিরে তাকালো না। শুদ্ধ তখন বিড়বিড় করে বলল,

–” উপকার করলাম কিন্তু একটা ধন্যবাদ জানালো না। জীবনে দেখা দুজন নারী দেখলাম অকৃতজ্ঞ।”

মিশুর চেঁচামেচিতে চোখ মেলে তাকালো নিয়তি। দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে এখন বেশ বিরক্ত। গরম চোখে তাকিয়ে আছে মিশুর দিকে। যেন পারছে না খুন করে ফেলতে।

–” সমস্যা কি তোর? ডাকাত পড়েছে নাকি রুমে?”

–” ক্লাস করবি না? সেই কখন থেকে ডাকছি তাড়াতাড়ি উঠ।”

ক্লাস নামক শব্দটি শোনে শরীরে হাজারো রোগ চলে আসলো নিয়তির। পড়াশোনা করতে তার মোটেও ভালো লাগে না কিন্তু বাবার কড়া আদেশ পড়াশোনা তাকে করতেই হবে, একবার তো বাবাকে বলেই ফেলছিল, আব্বু দেখো আমার দ্বারা পড়াশোনা হবে না তুমি বরং কোনো রিক্সা চালক ধরে এনে আমায় বিয়ে দিয়ে দাও। সেদিন এই কথার কারণে মায়ের হাতে সেই লেবেলের মার খেয়েছিল। শুধু কি মার সাথে পুরো বাড়ি তাকে দিয়ে পরিষ্কার করিয়ে নিয়েছিল তার বাবা। এরপর থেকে বিয়ে নামক শব্দটির প্রতি বেশ আতঙ্ক সে। মিশু নিয়তিকে এইভাবে বসে থাকতে দেখে রাজ্যর বিরক্তি নিয়ে বলল,

–” বসে বসে কী এখন ধ্যান করবেন মাতাজী? ক্লাস করার ইচ্ছা না থাকলে সোজাসাপ্টা বলুন আমি একাই চলে যাচ্ছি। এমনিতেই ব্রেকআপ হয়ে গেছে, মন ভালো নেই।”

নিয়তি বালিশ পেটের কাছে চেপে ধরে মিশুর একটি হাত ধরে বাচ্চাদের মত করে বলল,

–” আজ আমার প্রেজেন্ট তুই দিয়ে দিস বাবু। আমার না ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। গতকাল রাতে তোর জন্য কম কষ্ট করেনি আমি। তোর কারণে নিজের ক্রাশ নামক বাঁশকেও অপমান করেছি। দেখছিলি লোকটার কী অহংকার? ভাব দেখে আর বাঁচি না। একটা মাত্র সেলফি তুলতে চাইছিলাম সেই কারণে কতগুলো কথা শুনিয়েছে। লোকটা আসলেই খুব খারাপ।”

______________________

বারান্দায় দাঁড়িয়ে একের পর এক সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে শুদ্ধ। গতকাল রাত থেকে এই অব্দি প্রায় বিশটা প্যাকেট শেষ করে ফেলেছে। অভ্র পাশেই বসে আছে। মিলির মত মেয়ে এমন কাজ করবে সে যেন আগেই জানতো। তবে শুদ্ধর চাচার সাথে ঘটনা ঘটবে সেটা বুঝতে পারেনি। শুদ্ধর ঘাড়ে হাত রেখে মুখে সেই জাদুকরী হাসি রেখেই বলল,

–” দোস্ত, এত আপসেট কেন হচ্ছিস? মিলি যদি তোর চাচার সাথে সুখী হতে পারে তাহলে তো ভালোই। তাছাড়া তোর চাচাও এই বিয়েতে খুব খুশি।”

শুদ্ধর চোখজোড়া লাল হয়ে আছে। অভ্রের নিজেরই ভয় হচ্ছে এখন শুদ্ধকে দেখে। কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে কিছুটা দূরে দাঁড়ালো অভ্র। শুদ্ধ রাগী গলায় বলল,

–” মিলির বিয়ে যদি অন্য কোথাও হতো তাহলে আমার এত খারাপ লাগতো না। কিন্তু ওর বিয়ে হয়েছে আমার আপন ছোট চাচার সাথে। যেখানে বাড়িতে গেলেই সেই বিশ্বাসঘাতকের মুখ আমায় দেখতে হবে। ওকে দেখলেই আমার খুন করতে ইচ্ছা করে অভ্র। যদি আল্লাহ তায়ালা একটা খুন মাফ করে দিত তাহলে আমি মিলিকে খুন করে ফেলতাম।”

সিগারেটের প্যাকেট দুমড়ে মুচড়ে ফেলে দিল শুদ্ধ। অভ্র ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

–” তুই তো এমনিতেই বেশি একটা বাড়িতে থাকিস না। মাঝে মাঝে যখন যাস তখন না হয় একটু সহ্য করে নিবি। এত বড় ক্রিকেটার হয়ে তোর এই সামান্যটুকু ধৈর্য থাকবে বলে আশা করি।”

শুদ্ধ কথা ঘোরানোর জন্য বলল,

–” ঘুরতে বের হবি?”

–” কোথায় যেতে চাস বল?”

–” জানি না তবে প্রকৃতির সাথে আজকের দিনটা কাটাতে চাই। আজকের দিনটা আমি সবুজ রঙের দেশে থাকতে চাই। প্রাকৃতিক বাতাসের স্পর্শে নিজেকে বিলিয়ে দিতে চাই।”

শুদ্ধর কথা মনোযোগ সহকারে শুনলো অভ্র। বন্ধুর এই করুন দশা তার মোটেও সহ্য হচ্ছে না। মিলিকে সামনে পেলে থাপ্পড় মেরে গাল লাল করে ফেলত হয়তো। নিজেকে শান্ত রাখার জন্য মুখে হাসির রেখা টেনে শুদ্ধর সাথে বাহিরে বের হয়ে পড়লো।

______________________

রুমে একা বসে থাকতে থাকতে বোরিং হচ্ছিল নিয়তি। বোরিং নামক অসুখটি দূর করার জন্য নিয়তি প্রায় একটা কাজ করে আর সেটা হলো সাজ। ছোট্ট ট্রাঙ্ক থেকে গোলাপী রঙের থ্রী পিছ, হালকা বল বল গোলাপী রঙের ওড়না বের করে গায়ে পরিধান করে নিলো। যেহেতু হোস্টেলে থাকে তাই ড্রেসিং টেবিল নাই সেই কারণে ছোট্ট আয়না বের করে লম্বা কানের দুল, গলায় চিকন পাথরের চেইন, ডান হাতে ঘড়ি, বাম হাতে ব্রেইসলাইট, পায়ে পায়েল, ঠোঁটে গোলাপী রঙের লিপস্টিক, চোখে গাঢ় কাজল, চুলগুলো খোলা রেখে এক পাশে কিছু চুল ছেড়ে দিয়ে অন্যপাশে ওড়না দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে পড়ল। বের হওয়ার আগে নিলয়কে ফোন দিয়ে বলল,

–” হ্যালো?”

–” হালোর গুষ্টি কিলাই শালী, কাজকাম নাই মনে হয় তাই না? অসময়ে ফোন দিয়ে জলাইতাছস কেন? কুত্তা কামরাইছে তোরে? আইচ্ছা সমস্যা নাই একটা পাউরুটির প্যাকেট আর এক হালি কলা নিয়ে তোরে দেখতে যামু নে। হাজার হোক কুত্তা কামড় দেওয়া রোগী শাকচুন্নি।”

–” ইচ্ছা করতেছে তোরে ফোনের মধ্য দিয়েই ফিক্কা মারি। শালা বন্ধু নামের কলঙ্গ তুই। তোর মত বন্ধু থাকার চেয়ে এক সপ্তাহ না খেয়ে থাকা ভালো।”

–” তো? তোরে কেডা খইছে খাইতে? না খাইয়া থাক না। তাইলে তো আংকেলের টাকা পয়সা কিছুটা বাইচ্চা যায়। এখন ক কিয়ের লাইগ্গা ফোন দিছস?”

–” দোস্ত তোর কাছে একশোটা টাকা হবে? আসলে হইছে কি আমার টাকা পয়সা সব শেষ হয়ে গেছে। জানিস তো আমার আব্বাজান হিসাব করে পয়সা দেয়। বেশি টাকা পয়সা দিলে নাকি আমি খারাপ হয়ে যাবো।”

–” ওই শালী, তোর কী আমারে এটিএম কার্ড মনে হয়। যখন খুশি তখন উত্তোলন করবি। আমি পড়ছি আরেক জ্বালায়। এর লাইগ্গা মাইয়া মানুষের লগে কথা কইতে নাই। খালি লাভের কারণে আসে।”

–” ছিঃ দোস্ত ছিঃ, এইভাবে বলতে পারলি। যা লাগবে না তোর টাকা। আরেকবার এসে বলিস দোস্ত অমুক মেয়েকে পছন্দ হইছে লাইন করে দে না তখন আমার জুতো আর তোর গাল মনে রাখিস।”

রাগে ফোনটা কেটে দিলো নিয়তি। সে জানে এখন নিলয় তার নাম্বারে দুইশ টাকা পাঠাবে। কারণ নিলয় ছেলেটাই এমন ঘাড় ত্যাড়া টাইপের। সহজ খাঁটি বাংলা ভাষায় কিছু বললে সে মানতে নারাজ। কিছুক্ষণের মাঝেই ফোনে টুং করে একটা শব্দ আসলো। বিকাশ অ্যাপসে গিয়ে দেখলো নিলয় দুইশ টাকা পাঠিয়েছে আর সাথে লিখে দিছে, দুআ করলাম তোর বিয়ে যেন দুই বাচ্চার বাপের কাছে হয়, বদ মহিলা।

নিয়তি এক গাল হেসে রুম থেকে বের হয়ে পড়ল। মৃদু বাতাসে খোলা চুল এবং ওড়না এদিক ওদিক চলে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই আকাশ হয়ে উঠলো মেঘলা, গাছের পাতাগুলো ক্রমশ নড়াচড়া করতে লাগলো। রাস্তার মোড়ে ঘাসের উপরে বসে একা একা বাদাম, ভুট্টা ভাজা, ঝাল মুড়ি নিয়ে বসে আছে নিয়তি। ঝালমুড়ি ঠোঙ্গা থেকে নিয়ে মুখে দিচ্ছে আর বলছে,

–” এই প্রথম একটা জামাইয়ের অভাব বোধ করতেছি। কী রোমান্টিক ওয়েদার কিন্তু জামাই নাই। আমার মনে হয়, আমার আব্বাজানের ভয়ে জামাই আমার পৃথিবীতে লেন্ডিং করতে ভুলে গেছে।”

কথাগুলো বলে ঝালমুড়ির ঠোঙ্গা পিছনে ফেলতেই শুদ্ধর মুখে গিয়ে পড়লো ঠোঙ্গা। বসা থেকে দম মেরে দাঁড়িয়ে জিবে কামড় দিয়ে নিয়তি বলল,

–” আমার কোনো দোষ নাই সব দোষ বাতাসের।”

চলবে,

বানান ভুল ক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে