তোকে ভালোবেসে খুব পার্ট- ২+৩

0
3472

#তোকে_ভালোবেসে_খুব
#পার্ট_২+৩
#লেখিকা_সারা_মেহেক

আয়ানের মেসেজ দেখার সাথে সাথে মৌ আয়ানকে কল দিলো।
বন্ধুদের সাথে বাইরে বের হওয়ার জন্য আয়ান রেডি হচ্ছিলো।গুনগুন করে গান গায়ছিলো সে,আর মনের সুখে রেডি হচ্ছিলো।ঠিক তখনই মৌ এর কল এলো তার ফোনে।ফোনের স্ক্রিনে “মৌমাছি”নামটা ভেসে আসতেই বিরক্তিতে ভ্রুজুগল কুঁচকে এলো আয়ানের।মৌ কে নরমাল ভাবে ডাকে না সে।মৌ এর নিকনেম সে দিয়েছে “মৌমাছি “।কারন আয়ানের ধারনা মতে মৌ নামক মেয়েটার সাথে মৌমাছির বেশ কিছু সাদৃশ্যতা রয়েছে।

মুখ দিয়ে একটা বিরক্তিসূচক আওয়াজ বের করে আয়ান মৌ এর কল রিসিভ করলো।আর সাথে সাথেই ওপাশ থেকে একটা ঝড়ো আওয়াজ এসে আয়ানের কানে বারি খেলো।

—“আপনার সাহস তো কম না আয়ান ভাইয়া!!কি সব মেসেজ দিচ্ছেন দেখেছেন একবারো!!এতোটা ক্যারেক্টারলেস কি করে হতে পারে একজন মানুষ!!”

মৌ এর এমন কথার ঢং শুনে আয়ান এক ধমক দিয়ে বললো,

—“তোর সাহস তো কম দেখছি না মৌমাছি!আমার সাথে এভাবে কথা বলছিস কেনো??”

আয়ানের মুখে আবারো “মৌমাছি” নামটা শুনে মৌ তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো।সে একই সুরে বললো,

—“এই মিস্টার মিরর,আমাকে খবরদার মৌমাছি বলবেন না বলে দিলাম।”

আয়ান এবার কিছুটা অবাক হয়ে বললো,

—“কি বললি তুই??মিস্টার মিরর!!”

আয়ানের কথা শুনে মৌ নিজের জিব কাটলো।সে যে আয়ানকে মিরর নাম দিয়েছে এটা আয়ান জানে না।কারন জানলে তার যে নিস্তার নেই সেটা সে জানে।
মৌ রেগে আয়ানকে মাঝে মাঝে মিরর ডেকে ফেলে।কারন আয়ান নামটা আয়না শব্দের সাথে কিছুটা মিলসম্পন্ন। তাই মৌ আয়ানকে মিরর ডাকে।তবে আয়ান যখন মৌ কে “মৌমাছি” ডাকে, তখন মৌ ও রেগে গিয়ে আয়ানকে “মিস্টার মিরর” ডাকে।

মৌ এবার আমতা আমতা করে বললো,

—“কই মিস্টার মিরর বললাম??কানে বেশি শুনছেন আপনি।আমি বলেছি আয়ান ভাইয়া।”

মৌ এর কথা আয়ানের বিশ্বাস হতে চাইলো না। সে সন্দেহের সুরে বললো,

“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন

—“মিথ্যা বলিস কেনো??আমি স্পষ্ট শুনেছি তুই আমাকে মিস্টার মিরর বলেছিস।ঠিক নয় কি??”

মৌ এবার বিরক্তি নিয়ে বললো,

—“উফ,আমি কি বলছিলাম,আর আপনি কথাটা কোথায় নিয়ে গেলেন!!”

আয়ান ফোনটা লাউড স্পিকারে দিয়ে ড্রেসিং টেবিলে ফোনটা রেখে দিলো। এবার সে তার টিশার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বললো,

—“হ্যাঁ কি যেনো মেসেজের কথা বলছিলি তুই??”

মৌ এবার খানিকটা রাগী সুরে বললো,

—“আপনি আমাকে লাভ মেসেজ দিয়েছেন কোন দুঃখে??আমি আপনার লাভার লাগি নাকি??”

মৌ এর কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে আয়ান ফোনটা নিজের কানে তুলে নিয়ে বললো,

—“তোর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে??আমি তোকে লাভ মেসেজ দিবো কেনো??”

—“সেইম প্রশ্নটা আপনার কাছেও করলাম আমি। এবার উত্তর দিন।”

—“কি উত্তর দিবো?আমি তোকে কোনো মেসেজ দিয়েছি নাকি যে উত্তর দিবো এর??”

—“তো আপনার নাম্বার থেকে তাহলে ভুতে আমাকে এই মেসেজ দিলো??আপনি আপনার ফোনের মেসেজগুলো দেখুন ভালো করে।তারপর সব এন্সার পেয়ে যাবেন।”

আয়ান মৌ এর কথা শোনামাত্রই কল না কেটে আগে মেসেজ চেক করলো।
লাস্ট সেন্ড করা মেসেজটা দেখেই আয়ানের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো।কারন আসলেই সে মৌ কে মেসেজ দিয়েছে।তাও আবার সেই মেসেজ যেটা সে মৌসুমি কে দিতে চেয়েছিলো।আয়ান মেসেজটা মৌসুমি কে সেন্ড করতে গিয়ে ভুলে মৌ কে দিয়ে ফেলেছিলো।কারন ফোনবুকে মৌসুমি আর মৌ এর নাম পরপর রয়েছে।তাই আয়ানের দ্বারা এমন মহা ভুল হয়েছে।
নিজের এমন বোকামীর জন্য আয়ান নিজের কপালে নিজেই দু তিনটা চড় মারলো।এখন তার মনে এটাই ঘুরপাক খাচ্ছে যে সে এমন মেসেজ মৌ কে দেওয়ার পর মৌ এর সামনে যাবে কি করে।এতোক্ষন সে ভাবছিলো,হয়তো দোষ মৌ এরই।কিন্তু এখানে যে তারই দোষ আছে,এটা জানার পর নিজেকে জুতাপিটা করতে ইচ্ছা করছে আচ্ছামতো।

ওপাশ থেকে আয়ানের নিরবতাই বলে দিচ্ছে মৌ কে যে,এতোক্ষনে আয়ানের মেসেজ দেখা শেষ হয়ে গিয়েছে।মৌ এবার সুর তুলে বললো,

—“তো দোষ টা কার আয়ান ভাইয়া?? এবার বুঝতে পেরেছেন??তো কিসের জন্য এসব মেসেজ আমাকে দিয়েছেন সেটা বলেন।”

মৌ এর কণ্ঠস্বর শুনে আয়ান স্বাভাবিক হয়ে বললো,

—“ঐ মেসেজটা তোর জন্য ছিলো না।”

মৌ এবার ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাস করলো,

—“তো কার জন্য ছিলো??”

আয়ান নিচু স্বরে বললো,

—“মৌসুমির জন্য।”

—“এই মৌসুমি টা আবার কে?ওহ হ্যাঁ আপনার গার্লফ্রেন্ড নয়তো??”

আয়ান কিছু না বলে চুপ হয়ে রইলো।
মৌ এর তো খুশির সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে আয়ানের এ অবস্থা উপলব্ধি করতে পেরে।তার সামনে আয়ান নিজ দোষের জন্য চুপ করে দাঁড়ীয়ে আছে,এটা ভেবেই তার মধ্যে একটা পৈশাচিক আনন্দ বয়ে যাচ্ছে।

আয়ান এতোক্ষন নিচু স্বরে কথা বললেও এখন চড়া গলায় বললো,

—“এতো সওয়াল জওয়াব করিস কেনো তুই?আমি কি সাধে তোকে মৌমাছি বলি?সবসময় বিষাক্ত হুল ফু্ঁটাতে আসিস।খেয়েদেয়ে কাজ না থাকলে যা হয় আরকি।”

মৌ এবার রেগে বললো,

—“দেখুন আয়ান ভাইয়া……আপনি সবসময় বাড়াবাড়ি করেন।নিজে দোষ করে আমার উপর গলা চওড়া করেন কেনো??
জানেন কি এই মেসেজ দেখে আমার সাধের ঘুমটাও চোখ থেকে পালিয়ে গিয়েছে?কতো আরামসে ঘুমাচ্ছিলাম আমি……”

—“তোর ঘুম পালালো কেনো??তুই কি ভেবেছিলি এই মেসেজটা সত্যিই তোর জন্য ছিলো??”

—“ওসব ফালতু চিন্তা আমার মাথায় আসে না।”

—“না আসাই ভালো।”

—“সে যাই হোক,এরপর থেকে সাবধানে মেসেজ সেন্ড করবেন।আজকে আমাকে ভুলে মেসেজ সেন্ড করেছেন।দেখা গেলো একদিন ভুলে আংকেলকে এসব মেসেজ সেন্ড করে দিলেন।তখন??তখন তো আপনার সব ফাঁস হয়ে যাবে।”বলে মৌ হাসতে হাসতে ফোন কেটে দিলো।সে আয়ানকে আর কোনো কথা বলার সুযোগই দিলো না।
এদিকে মৌ কল কেটে দেওয়ার সাথে সাথে আয়ান রেগে ফোনটা ছুড়ে মারতে গিয়েও মারলো না। কারন ফোনটা তার শখের ফোন।
মৌ এর চিন্তা বাদ দিয়ে আয়ান টিশার্টের উপর জ্যাকেট গায়ে জড়িয়ে নিজ রুম থেকে বের হয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো।নুরুল খান, আয়ানের মা সিতারা খাতুন, আর আয়ানের দাদি বসে আছে।তারা নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করছেন।আয়ানকে নিচে নেমে মেইন দরজার কাছে যেতে দেখে নুরুল খান একটু উঁচু গলায় বললেন,

—“এতো রাতে কোথায় যাও??”

আয়ান জানে তার বাবা তাকে এ প্রশ্নটা করবে।তাই দরজার কাছে এগুতে এগুতে সে বললো,

—“ফ্রেন্ডদের সাথে একটু বাইরে যাচ্ছি।”

—“রাত কটা বাজে দেখেছো??”

—“আব্বু একটু কাজ আছে বলেই যাচ্ছি।”
এরপর আয়ান তার বাবাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বেড়িয়ে গেলো।
আয়ানের এমন কাজটা নুরুল খানের নিকট বেয়াদবি একটা কাজ মনে হলো।তিনি রেগে উনার স্ত্রী সিতারা খাতুনকে বললেন,

—“ছেলেটা কতো বেয়াদব হয়েছে দেখেছো??”

সিতারা বেগম নুরুল খানকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললেন,

—“শুধু তো বন্ধুদের সাথেই ঘুরতে যাচ্ছে।এতো রাগ করার কি আছে??”

—“সময়ের দিকে দেখেছো একবারো??এই সময়ে কোন ভদ্র ঘরের ছেলে আড্ডা দেওয়ার জন্য বের হয় বলতো??”

এবার আয়ানের দাদি যোগ করলেন,

—“ছেলেই তো।মেয়ে তো নয় যে এতো রাতে বের হতে পারবে না সুরক্ষার কথা চিন্তা করে??”

নুরুল খান এবার বিরক্তি নিয়ে চওড়া গলায় বললেন,

—“তোমাদের দুজনের জন্যই ছেলেটা মাথায় উঠে বসে আছে।সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানো ছাড়া কাজ নেই তার।কি জানি সারাটা দিন এতো কিসের ঘুরাঘুরি!!রাতে যে সে শান্ত থাকবে তাও না।রাতেও আবার আড্ডা দিতে বের হয়।
একটু কাজের কথা বললে প্রথম দুদিন কাজ করবে তারপর সব হাওয়া।ছেলেটা যে এতো বিগড়ে যাবে ভাবিনি। ”

আয়ানের দাদি এবার বললেন,

—“তুই এতো চিন্তা করছিস কেনো?দেখিস,বিয়ের পর আয়ান একদম ঠিক হয়ে যাবে।বিয়ের পর বউকে সময় দিবে।তখন আর এমন ঘুরে ঘুরে বেড়াবে না।”

সিতারা খাতুনও বললেন,

—“আম্মা একদম ঠিক বলেছে।দেখো,বিয়ের পর আয়ান ভদ্র হয়ে যাবে।আর অফিসে কাজও ঠিকঠাক ভাবে করবে।”

মা আর স্ত্রীর কথা শুনে নুরুল খান হাল ছেড়ে দিলেন।তিনি জানেন এই দুজনের কাছে আয়ানের খারাপ কিছু বলা যায় না বেশিক্ষণ। কোনো না কোনো যুক্তি দিয়ে তারা চুপ করিয়েই ফেলবে তাকে।
নুরুল খান সোফা থেকে উঠে নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে বললেন,

—“আল্লাহ জানেন,এ বাড়ির বউয়ের কপালে কি আছে……”
নুরুল খানের কথা শোনার পর হতাশ ভঙ্গিতে আয়ানের দাদি আর মা একে অপরের দিকে তাকালেন।তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে যে যার রুমে চলে গেলেন।
.
.
এদিকে বাড়ির বাইরে বের হওয়ার পর পাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আয়ান তার এক বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।সাথে তার আরো দুই বন্ধু আছে।প্রায় দশ মিনিট যাবত আয়ান,রাহুল,পুলক দাঁড়ীয়ে আছে রওনক এর জন্য।আয়ানের মাথাটা এমনিই কিছুটা গরম হয়ে গিয়েছিলো মৌ এর জন্য এখন রওনকের দেরি করে আসায় তার আর রাগের সীমা থাকলো না।সে রেগে বললো,

—“এই রওনকের বাচ্চাটা এতো দেরি করে কেনো প্রতিদিন?ঘরে কি বউ বাচ্চা সামলে রেখে আসে নাকি যে এতো দেরি হয়??”

আয়ানের কথা শুনে পুলক খানিকটা অবাক দৃষ্টিতে আয়ানের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,

—“কি ব্যাপার আয়ান?আজ এতো রাগ কেনো করছিস বলতো?অন্যদিন তো রাগ করিস না?মাথা আজকে গরম হয়ে আছে নাকি?”

পুলকের কথা শুনে রাহুল হাসা শুরু করে দিলো।রাহুলের এমন হুটহাট হেসে ফেলার বিষয়টা আয়ান,পুলক আর রওনক,কারোরই পছন্দের না।রাহুল সামান্য একটা বিষয় নিয়েও এমন হাসাহাসি করে যে তাকে দেখে মনে হয় পৃথিবীর বেস্ট জোকস তার সামনে বলা হয়েছে।
রাহুল হাসতে হাসতেই বললো,

—“আই এম শিওর ওর গার্লফ্রেন্ড এর সাথে ঝগড়া হয়েছে।তাই এতো মাথা গরম।”

রাহুলের কথা শুনে পুলক ভ্রু কু্ঁচকে আয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,

—“সত্যি নাকি রে??”

আয়ান পুলক আর রাহুলের কথায় মহা বিরক্তি নিয়ে বললো,

—“আরে নাহ…মৌসুমির সাথে ঝগড়া হয়নি।হয়েছে মৌ এর সাথে।তবে সিরিয়াস ঝগড়া হয়নি।কথা কাটাকাটি টাইপ।”

আয়ানের কথা শোনামাত্রই রাহুলের হাসি থেমে গেলো।পুলক এখনো আয়ানের দিকে ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।এতোক্ষনে রওনকও চলে এসেছে।
রওনককে দেখামাত্রই আয়ান রাগি দৃষ্টিতে তাকালো রওনকের দিকে।আয়ানের দৃষ্টি দেখে রওনক জোরপূর্বক একটা হাসি দিয়ে শুকনো একটা ঢোক গিললো।
আয়ান এবার রেগে দাঁত কটমট করে বললো,

—“এই তোর আসার সময় হলো??এতো দেরি করিস কেনো প্রতিদিন??”

—“আরে বাসায় মেহমান এসেছে। তো এভাবে কি আর রাতে বের হওয়া যায় নাকি…তাই একটু বাহানা বানিয়ে আসতে লেট হলো আরকি।
কিন্তু আয়ান…আজকে তুুই রাগ করছিস কেনো আমার উপর?অন্যান্য দিনও তো একটু আধটুকু লেট হয়, তখন তো রাগ করিস না।”

রওনকের কথায় রাহুল বললো,
—“মহাশয় ঝগড়া করে এসেছে। তাও আবার মৌ এর সাথে…..”

মৌ নামটা শুনে বুকটা ধক করে উঠলো রওনকের।কারন সে মৌ কে পছন্দ করে।কিন্তু এ ব্যাপারটা সে বাদে আর কেউই জানে না।সে চায়েও নি এটা কেউ জানুক।রওনক এর আগে মৌ কে প্রপোজ ও করতে চেয়েছিলো,কিন্তু নিজের সাথে সাহসে পেরে উঠতে পারেনি বলে প্রপোজ করার চিন্তাটা মনের এক কোনেই লুকিয়ে বসে আছে।

পুলক আয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,

—“আচ্ছা আয়ান একটা কথা জিজ্ঞাস করবো??”

আয়ানের রাগ এখন কিছুটা কমে গিয়েছে।তাই সে বললো,

—“আগে হাঁটা শুরু কর।তারপর প্রশ্ন করিস।”

আয়ানের কথায় সবাই হাঁটা শুরু করলো।প্রতিদিন তারা হেঁটেই আড্ডা দেয়।ঘুরাঘুরি করে।

পুলক এবার প্রশ্ন করলো,

—“আচ্ছা, আয়ান…তুই কি মৌ কে লাইক করিস??”

পুলকের প্রশ্ন শুনে আয়ান হাঁটা থেমে দাঁড়ীয়ে পরলো।সাথে রওনক,রাহুল আর পুলকও।সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে।রওনকের বুকের ভিতরটা ভয়ে ঢিপঢিপ আওয়াজ করে যাচ্ছে।আচ্ছা,আয়ান যদি সত্যিই মৌ কে পছন্দ করে তাহলে?আরে না….আয়ান মৌ কে পছন্দ করে না।পছন্দ করলে এতোদিনে আয়ান মৌ এর গার্লফ্রেন্ড হতো।কিন্তু আয়ান মনে মনে যদি তার মতো মৌ কে পছন্দ করে?বোনের বান্ধবি বলে মুখে বলতে পারছে না সে,এমনও তো হতে পারে।এভাবে শখানেক প্রশ্ন ঘুরছে রওনকের মাথায়।যতক্ষণ না আয়া কিছু বলবে ততোক্ষণ প্রশ্ন গুলো রওনকের মাথায় এভাবেই ঘুরতে থাকবে।
আয়ান এবার তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দিয়ে বললো,

—“পুলক….তুইও না….প্রশ্ন করার আর টপিক পাসনি…..আমি আর মৌ কে পছন্দ করবো?হ্যাভ ইউ লস্ট ইউর মাইন্ড??”

আয়ানের কথা শোনামাত্রই রওনকের মনের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যেতে লাগলো।আয়ান মৌ কে পছন্দ করে না,এটা শুনতেই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো রওনক।
পুলক সামান্য হেসে বললো,

—“পছন্দ করতেই পারিস।মৌ কে পছন্দ না করার মতো কোনো ব্যাপারই দেখছি না আমি।”

আয়ান বাঁকা হাসি দিয়ে বললো,

—“তুই মৌ কে খুব ভালো জানিস মনে হচ্ছে??”

পুলক আগের মতোই বললো,

—“আমি তো ওর সম্পর্কে যা জেনেছি তোর কাছ থেকেই জেনেছি। আর দু একবার যে দেখা হয়েছে,তা থেকে একটু আধটুকু জানি।তো আমি ওকে আনলাইক করার কোনো রিজন দেখছি না।”

—“তুই কি জানিস পুলক ওর সম্পর্কে?ও কেমন?ওকে আমার একদমই ভালো লাগে না। সবসময় আমার বিষয়ে নাক গলাতে থাকে।আমাদের ফ্যামিলির কেউ না অথচ এমন ভাব করে যে আমাদের ফ্যামিলিরই মেম্বার।আর একটু থেকে একটু হলে আমার কমপ্লেইন করতে যায় আব্বু,আম্মুর কাছে।একদিন তো আব্বুকে বলেই দিয়েছিলো সোজাসুজি যে আমি সারাদিন ঘুরে বেড়াই,কাজ করি না।সাথে আবার অহনাকেও নিয়েছিলো।মৌ এর সাথে থাকতে থাকতে আমার অহনাটাও কেমন যেনো হয়ে গিয়েছে।
আর আমি ওকে যতোবারই আমার জিএফ এর কথা বলতে মানা করি,আমার মনে হয় ও ঠিক ততোবারই আমার ফ্যামিলিকে এ বিষয়ে বলার চেষ্টা করে।মেয়েটা আমার লাইফটাকে স্পয়েল করার ধান্ধায় থাকে অলওয়েজ।”
এরপর কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে আয়ান আবারো বললো,

—“কিন্তু জানিস……আমার মনে হয় মৌ অনেক ভালো মনের মানুষ।সবার সাথে ভালো ব্যবহার করে।সবার মনে জায়গা করে নিতে পারে।কিন্তু হ্যাঁ এসবের একটাও আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না।
মেয়েটা দুষ্টু বটে,কিন্তু কিছু কিছু সময় ওর দুষ্টুমিগুলো খুব হাসায় আমাকে।”

পুলক এবার মুচকি হেসে বললো,

—“তুই তো তাহলে সবই জানিস মনে হচ্ছে মৌ এর ব্যাপারে।”

—“তো জানবো না?এতো বছর ধরে চিনি ওকে।আফটার অল বোনের বান্ধবী বলে কথা।”

রাহুল এবার হেসে বললো,

—“সেই লজিকে তো মৌ কে লাইকও করার কথা।”

রাহুলের কথা শুনে আয়ান একবার আড়চোখে রাহুলের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,

—“লাইক করবো তাও আবার মৌ কে!!ইম্পসিবল। ”

পুলক আয়ানের কথা শুনে সামান্য হেসে বললো,

—“শুধু পছন্দ নয় রে পাগলা….ভালোওবাসবি ওকে….দেখে নিস।”

আয়ান আগের মতোই বললো,

—“এমন কিছুই হবে না রে। কজ আমি মৌসুমিকে লাইক করি। এন্ড লাভও করি।সো মৌ কে ভালোবাসা আমার পক্ষে তো সম্ভবই না ”

রাহুল বললো,

—“মৌসুমিকে তুই লাইক করিস নাকি সেটা জানা নেই।বাট মৌসুমিকে যে তুই ভালোবাসিস না,এটা তুই সহ আমরা সবাই জানি।”

আয়ান এবার মুখ বাঁকিয়ে বললো,

—“ওরে আমার সবজান্তা রে…আমার মনের খবর আমার চেয়ে বেশি তোরা জানবি কি করে হুম?”

রাহুল আর পুলক হয়তো আরো কিছু বলতো,কিন্তু তার আগেই রওনক তাদের থামিয়ে দিয়ে বললো,

—“তোরা এসব মৌ আর মৌসুমির কথাবার্তা বাদ দিবি?যার জন্য এসেছিস সেটা না করে শুধু লাভ,লাইক নিয়ে কথা বলছিস।”
রওনকের কথা শুনে আয়ান,পুলক আর রাহুল একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে চুপ হয়ে গেলো।

#চলবে

#তোকে_ভালোবেসে_খুব
#পার্ট_৩
#লেখিকা_সারা_মেহেক

ফজরের আজান দেওয়ার আধ ঘন্টা পর ফোনের অ্যালার্ম এ ঘুম ভাঙলো মৌ এর।প্রতিদিন ফোনের এ কান ফাটানো আওয়াজে ঘুম ভাঙে মৌ এর।রোজকার মতো আজকেও নিজে ঘুম থেকে উঠে বাসার সবাইকে ঘুম থেকে ডাকতে গেলো সে।একে একে সবাইকে ডাকার পর রান্নাঘরে এলো অজুর পানি গরম করতে।কারন অন্যান্যদের তুলনায় তার শীত একটু বেশিই।এজন্য সবাই যেখানে সকালের ঠান্ডা পানি দিয়ে কষ্ট করে অজু করে সেখানে মৌ প্রতিদিন গরম পানি দিয়ে অজু করে।কারন ঠান্ডা পানি দিয়ে অজু করলে তার ঠকঠক করা কাঁপুনি বন্ধ হতেই ১৫/২০মিনিট লেগে যায়।
মৌ অজু করে ফজরের নামাজ পরে আগে থেকেই গায়ে থাকা সোয়েটারের উপরে একটা চাদর জড়িয়ে নিলো।এরপর ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে দরজা খুলে সোজা ছাদে চলে গেলো।প্রতিদিনের একটা অভ্যাস বানিয়ে নিয়েছে মৌ এটাকে।রোজ রোজ ভোরে ছাদে না গেলে তার মনটা সারাদিন বিষণ্ণতায় ডুবে থাকে।এভাবে ভোরের দিকে একা একা ছাদে যাওয়া নিয়ে মৌ তার বাবা, মা দুজনের কাছেই বেশ বকা শুনেছে। তারপরও জিদ ধরে মৌ ছাদে গিয়েছে প্রতিদিন।

আস্তে আস্তে ছাদের দরজা খুলে ছাদে প্রবেশ করলো মৌ।ফ্ল্যাট বাসায় থাকার পরও এই ভোরবেলায় যে কেউ ছাদে আসে না এটাতেই বেশ খুশি সে।
পূর্ব দিগন্তের কুশাশা ভেদ করে ধীরে ধীরে সুর্য উঠে জানান দিচ্ছে এ পৃথিবীকে যে সকাল হয়ে গিয়েছে।চারপাশের অন্ধকার চিড়ে নতুন একটা দিন,নতুন এক উদ্যম, নতুন এক প্রত্যয়ে দিন শুরু করতে হবে এটা সূর্য্যি মামা নির্বাক থেকেও বলে দিচ্ছে।
মৌ জোরে একটা শ্বাস নিয়ে সকালের সতেজ হাওয়া নিজের ভেতর টেনে নিলো।চারদিক থেকে ঠান্ডা বাতাস মৌ কে জাপটে ধরার চেষ্টায় ব্যস্ত।কিন্তু মৌ সে চেষ্টাকে আগেই ব্যর্থ করে দিয়েছে নিজের সঙ্গে ঢাল স্বরূপ সোয়াটার আর চাদর নিয়ে এসে।
—“এই যে মৌ পাখি…..একা একা সূর্যোদয় উপভোগ করছো আমাকে ছাড়া!!”

—“একা একা কোথায়?তুমি তো পাশেই দাঁড়ীয়ে আছো।”

—“পাশে দাঁড়ীয়ে আছি,কিন্তু একবারো তো আমায় ডাকলে না।”

—“ডাকবো কেনো?সারাদিন তে এখানেই থাকো।সারাদিন সূর্য দেখো।আবার আমার আসাতে কি স্পেশাল সূর্য উঠে নাকি যে তোমাকে ডাকতে হবে??”

—“হুম স্পেশাল সূর্য উঠে তো। তুমি আসলে যে আমার মনটা খুশিতে নাচতে থাকে তা কি দেখো না তুমি??”

—“হুহ।বাতাস এসে তোমাকে নাচিয়ে দিয়ে যায়।তুমি একা নাচো নাকি?”

—“যেই নাচাক আমাকে,সেটা বিষয় না।বিষয় হলো এটা যে আমি তোমার উপস্থিতিতে খুব খুশি হই।”

—“ওহ তাই।যখন অন্য জায়গায় ছিলে তখন কার উপস্থিতিতে খুশি হতে??”

—“কারোরই না।তুমিই প্রথম মানুষ যার উপস্থিতি আমাকে এতোটা খুশি দেয়।কারন না চাইতেও তুমি আমার এতো যত্ন করো।”

—“যত্ন তো করবোই….আমার পছন্দের একজন তুমি।”

—“আচ্ছা, এখন না হয় যত্ন করছো তুমি।কিন্তু যখন তুমি চলে যাবে তখন কে যত্ন নিবে আমার??”

—“আমি আবার কোথায় যাবো??”

—“কেনো শ্বশুড় বাড়ীতে যাবে।”

সাথে সাথে মৌ এর মনটা খারাপ হয়ে গেলো।মৌ প্রতিদিন ছাদে এসে গাছের সাথে এ কাল্পনিক কথাবার্তায় মেতে উঠে।এটা বেশ উপভোগ করে সে।তার মতে গাছের সাথে কথা বলতে হলে শান্ত মনের মানুষ হতে হয়।আর সে জানে যে সে শান্ত মনের মানুষ।
মৌ যে গাছের সাথে এমন কাল্পনিক কথাবার্তা বলো এটা কেউই জানে না। এমনকি তার বেস্ট ফ্রেন্ড অহনাও জানে না।মৌ ইচ্ছা করেই কাউকে এটা বলেনি। কারন সে জানে,এ কথা যে শুনবে সে-ই তাকে নির্ঘাত পাগল বলবে।কিন্তু সহজ মনের মৌ বিশ্বাস করে,গাছের সাথে এভাবে নির্বাক আলাপও মানুষের মন ভালো করতে সক্ষম।যে গাছ আমাদের এতো উপকার করে সবদিক দিয়ে সে গাছটার সাথে দুদন্ড কথা বললে নিজের মনটা এমনিই ভালো হয়ে যায়।
মৌ দের বাসার এ কাঠগোলাপ গাছটা প্রায় ১ বছর পুরোনো।এর আগের বছরের বৃক্ষমেলায় মৌ এর মনে ধরেছিলো এ গাছটি।তখনই কিনে নেওয়ার বড্ড শখ জেগেছিলো তার মনের মধ্যে।কিন্তু তখন তার কাছে প্রয়োজনীয় টাকা ছিলো না। আয়ান আর অহনাও সেদিন মৌ এর সাথে ছিলো।কাঠগোলাপ গাছটা যে মৌ এর মনে ধরেছে, এ বিষয়টা কিভাবে যেনো আয়ান বুঝতে পারলো।তাই সে মৌ কে কাঠগোলাপ গাছটা কিনে দিতে চাইলো।কিন্তু মৌ তখন কিছুতেই রাজি হলো না আয়ানের টাকায় নিজের শখের জিনিস কেনার জন্য।পরে অহনার জোরাজুরিতে মৌ রাজি হয়ে যায়।পরে আয়ানকে গাছ কেনার টাকা দিতে চাইলেও আয়ান মৌ এর টাকা নেয় না।সেই থেকে কাঠগোলাপ গাছটা মৌ দের বাসার ছাদে রয়েছে।জীবন মাঝে মাঝে এসে গাছটার উপর হামলা চালায়, কিন্তু মৌ থাকায় সে কিছু করতে পারেনা।

মৌ উদাস মনে কিছুক্ষন ছাদে দাঁড়ীয়ে থেকে বাসার পথে পা বাড়ালো।যাওয়ার পথে প্রত্যেকটা সিঁড়ি মৌ এর মনে এক অজানা উদাসীনতা,ভয়,নতুন কিছু পাওয়ার আবার হারিয়ে যাওয়ার এক মিশ্র অনুভুতি শুরু হয়ে যাচ্ছে। মৌ এসব অনুভুতিকে পাশ কাটিয়ে বাসায় নিজের রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে নিলো।
আজকে শুক্রবার বলে মৌ আর মাহতাবের বাবা এনাম হোসেন আর মাহতাব বাসায় আছেন।
মৌ ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে গিয়ে তার মা আর ভাবিকে কাজে সাহায্য করতে লাগলো।মৌ এর মা পপি বেগম আজ বেজায় ব্যস্ততা দেখাচ্ছেন।এই সেই নানা আইটেম রান্না করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন,যা মৌ এর চোখ এড়ায়নি।প্রথমে সে ভেবেছিলো এতো রান্নার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাস করবে না।কিন্তু মৌ বেশিক্ষণ তার ইচ্ছাকে দমিয়ে রাখতে পারলো না। তাই কৌতুহল বশত সে তার মা কে জিজ্ঞাসই করে ফেললো রান্নার কথা।

—“আজকে হঠাৎ এতো রকমারি রান্না কেনো করছো আম্মু?”

পপি বেগম মেয়ের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে শুধু মুচকি হেসে দিলেন।
নিজের প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে মায়ের মুখে এ হাসিটা দেখে তেমন একটা খুশি হলো না মৌ।সে তার ভাবি জান্নাতের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।জান্নাত মৌ এর এমন চাহনি দেখে মৃদু হেসে বললো,

—“স্পেশাল মেহমান আসবে বলে এতো কিছু করা।”

মৌ এবার ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাস করলো,

—“সেই স্পেশাল মেহমান আবার কারা??”

পপি বেগম ঠোটে সেই হাসি রেখেই বললেন,

—“তারা আসলেই জানতে পারবি।এটা একটা সারপ্রাইজ তোর জন্য।”

মায়ের মুখে “সারপ্রাইজ” শব্দটা শোনার সাথে সাথে মৌ এর চোখমুখ খুশিতে চকচক করতে লাগলো।অন্যান্য সবার মতো সেও সারপ্রাইজ পেতে অধীর আগ্রহে থাকে।তার উপর সেটা যদি পরিবার কর্তৃক দেওয়া সারপ্রাইজ হয় তাহলে তো কথাই নেই।
মৌ এবার হাসিমুখে বললো,

—“আই লাভ সারপ্রাইজেস। আমি ওয়েট করছি সেই সারপ্রাইজ এর জন্য।”

মৌ এর কথা শুনে পপি বেগম আর জান্নাত একে অপরের দিকে হাসিমুখে চাওয়াচাওয়ি করলো।
মৌ আর সেদিকে তোয়াক্কা না করে রান্নাঘর থেকে সোজা নিজের রুমে চলে গেলো।নিজের রুমে গিয়ে হাজারো কল্পনাজল্পনায় সে ব্যস্ত হয়ে পরলো।মেহমানরা আসলে কি করবে, কি পরবে, কোথায় ঘুরতে যাবে এসব মৌ এর কল্পনায় বাসা বাঁধছে।কারন সে ভাবছে হয়তো গ্রামের বাড়ী থেকে কোনো কাজিন আসবে।অথবা তাদের পরিচিত কেউ।মৌ নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করছে,আচ্ছা কারা আসতে পারে?শিউলিরা নাকি মামারা?আচ্ছা আমাদের বাসায় অনেকদিন কারা আসেনি?উম….কই কেউই তো এমন নেই।প্রায় সবাই ই এক বছরের মধ্যে আমাদের বাসায় ঘুরে গিয়েছে। তাহলে কারা আসছে?
এতো শত প্রশ্ন করার পরও উত্তর না পেলো না মৌ।শেষে হতাশ ভঙ্গিতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে।এখন তারা পেটের মধ্যে এতোগুলো প্রশ্ন যে নাড়িভুড়ি জড়িয়ে মুচড়িয়ে দিচ্ছে সেটার কি হবে?এই সারপ্রাইজ এর ব্যাপারটা না জানলে সে নির্ঘাত হার্টফেল করবে।এখন মৌ এর কাছে এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য একজনের চেহারাই ভেসে উঠছে চোখের সামনে।আর সে একজনটা হলো মাহতাব।মৌ জানে মাহতাব তাকে খুব ভালোবাসে।তার কোনো আবদার অপূর্ণ রাখে না।তো এ সারপ্রাইজ এর ব্যাপারে জানার আবদারটাও যে মাহতাব নিঃসন্দেহে পূরন করবে তা মৌ এর জানা আছে।
মৌ আর এক মূহুর্তও দেরি না করে সোজা ড্রইংরুম এ চলে গেলো।কিন্তু সেখানে গিয়েই তাকে হতাশ হতে হলো।কারন ড্রইংরুম এ মাহতাব আর এনাম সাহেব আলাপ করছেন কোনো একটা বিষয়ে,যা মৌ এর কান পর্যন্ত পৌছাচ্ছে না।
মৌ ড্রইংরুম এর দরজার কাছে গিয়েই থমকে দাঁড়ীয়ে রইলো।কারন এখন চাওয়া সত্ত্বেও সে তার বাবার সামনে থেকে তার ভাইকে এদিকে নিয়ে আসতে পারবে না সে। এটার একটাই কারন, সেটা হলো এনাম হোসেনের প্রতি মৌ এর চাপা ভয়।মৌ ছোটো থেকেই তার বাবাকে খুব ভয় পায়।এতে অবশ্য মৌ তার বাবার দোষই খুঁজে পায়।কারন ছোটো থেকেই একটু একটু করে মৌ আর তার বাবার মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়।কারন এনাম সাহেব কাজের প্রতি বেশি মনোযোগী ছিলেন তখন।আবার মৌ এর দ্বারা হওয়া ভুল গুলো দুচোখে সহ্য করতে পারতেন না তিনি।মৌ কিছু ভুল করলেই এনাম সাহেব দুচারটা কথা শুনিয়ে দিতে পিছপা হতেন না। এখনো তাইই হয়।আর মৌ এর ব্যাপারে এনাম সাহেব যা নির্ধারণ করবেন তাইই এ হবে।এনাম সাহেবের উপরে কথা বলার কেউই নেই এ বাসায়।
কথার মাঝে হঠাৎ মাহতাব খেয়াল করলো মৌ দরজার কাছে দাঁড়ীয়ে আছে।মৌ এর চেহারার মাঝে প্রশ্নের সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম দাগ গুলো ঠিকই নজরে পরলো মাহতাবের।তাই সে তার বাবাকে বলে উঠে এগিয়ে এলো মৌ এর দিকে।
মাহতাবকে এদিকে এগিয়ে আসতে দেখে বেশ খুশি হলো মৌ।
মাহতাব মৌ এর কাছে গিয়ে বললো,

—“কিছু বলবি পিচ্চি??”

মৌ উৎফুল্লতা প্রকাশ করে বললো,

—“হুম।আচ্ছা ভাইয়া, আমার জন্য সারপ্রাইজ হিসেবে কারা আসছে??”

মাহতাব মৌ এর দিকে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

—“কিসের সারপ্রাইজ? ”

—“আম্মু আর ভাবি যে বললো,আজকে যেনো কারা আসবে।বাট আমাকে বলবে না।সারপ্রাইজ বলে।এবার তুমিই বলো ভাইয়া,কারা আসবে।আমার পেটটা কুড়মুড় করছে এটা জানার জন্য যে কারা আসবে যে আমাকে বলা হচ্ছে না।সারপ্রাইজ রাখা হচ্ছে আমার জন্য।”
মৌ এর কথা শুনে মাহতাব বুঝতে পারলো কিসের সারপ্রাইজ এর কথা বলছে মৌ।
মৌ এর কথার জবাবে মাহতাব মুচকি হেসে বললো,

—“সারপ্রাইজ, সারপ্রাইজই থাক।শুধু শুধু বলে সারপ্রাইজ এর মজাটা নষ্ট করার কোনো মানে হয়না।” এ কথাটা বলে মাহতাব আর মৌ কে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেলো।
এদিকে মৌ একরাশ হতাশা নিয়ে নিজের রুমে এসে বিছানার উপর ধপ করে বসে পরলো।কি আশা নিয়ে গিয়েছিলো,আর কি হয়ে গেলো।এখন জীবনও ঘুমাচ্ছে।সে জেগে থাকলে মৌ এর সময় এমনিই কেটে যেতো।তাই আর কিছু করার না পেয়ে একটা হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে সে ফোনটা হাতে নিলো।
.
.
—“নবাবজাদা উঠবেন না আজকে??”

সকাল সকাল কারোর কর্কশ আওয়াজে শান্তির ঘুমটা নষ্ট হয়ে গেলো আয়ানের।সে আধো আধো চোখে তাকিয়ে দেখলো নুরুল খান রাগী তবে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
বাবার এমন দৃষ্টি মোটেও উপেক্ষা করতে পারলো না আয়ান।তাই সে তাড়াহুড়ো করে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।
নুরুল খান আগের মতোই বললেন,

—“আজকে বুঝি সারাদিন ঘুমিয়ে কাটানোর প্ল্যানিং এ ছিলে দেখছি….”

আয়ান কোনো কথা না বলে চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়ীয়ে রইলো।
নুরুল খান আয়ানের দিকে একবার তাকিয়ে চলে যেতে যেতে বললেন,

—“রেডি হয়ে নিও তাড়াতাড়ি।নামাজ পরে আমরা সবাই এক বাসায় যাবো।দুপুরে সেখানেই খাওয়াদাওয়া হবে।
আর হ্যাঁ ভালো দেখে একটা পাঞ্জাবী পরো।”

নুরুল খানের কথা শোনার পর আয়ান একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে আবারো বিছানায় শুয়ে পরে।সে ভেবেছিলো এখন আবার ঘুমাবে।কিন্তু ঘুম আর চোখে এসে ধরা দিলো না। তাই আয়ান মুখ দিয়ে একটা বিরক্তিসূচক আওয়াজ বের করে সোজা ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে।
ফ্রেশ হয়ে এসে আয়ান একটা টিশার্ট আর ট্রাউজার পরে গায়ে জ্যাকেট জড়িয়ে রুম থেকে বের হলো।সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে তার চোখ গেলো ডাইনিং টেবিলে।খাবার বলতে আজকে রুটি আর সবজি আছে।এসব দেখেই বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকালো আয়ান।তাই সে আর রুটি সবজি না খেয়ে দুটো পাউরুটি হাতে নিয়ে খেতে খেতে গেলো অহনার রুমের দিকে।
অহনার রুম ঢুকতেই আয়ান দেখলো অনেকগুলো কাপড়চোপড় বিছানায় উল্টোপাল্টা করে রাখা।এসব দেখে আয়ান অহনাকে জিজ্ঞাস করলো,

—“কি রে অহ….এসব কি?”

অহনা ড্রেসিংটেবিলের সামনে তার সাজার জিনিস গুলো বের করছিলো।আয়ানের প্রশ্ন শুনে সে ড্রেসিংটেবিলের কাছ থেকে এসে আয়ানের সামনে দাঁড়ীয়ে বললো,

—“এসব কাপড়চোপড়। ”

—“সে তো আমিও জানি।বাট এগুলোর অবস্থা এতো করুন কেনো?”

—“আমি না বুঝতে পারছি না আজকের জন কোন ড্রেসটা পরবো।”

আয়ান পাউরুটি চিবুতে চিবুতে বললো,

—“পর যেকোনো একটা।
আচ্ছা আব্বু আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে আজকে??”

অহনা একটা ড্রেস নিয়ে এদিক ওদিক দেখে বললো,

—“জানি না।শুধু বললো যে ভালো ড্রেস পরে রেডি হয়ে নিতে।আজকে দুপুরের খাবার বলে সে বাসায়ই খাবে।”

—“ওহ আচ্ছা।তাহলে মনে হয় আব্বুর পরিচিত কারোর বাসায় দাওয়াত।”

—“হুম হতে পারে।ভাইয়া তুই এখন যা।জুম্মার নামাজ পরে নে।নামাজ শেষ হয়ে তুই আর আব্বু বাসায় এলেই আমরা রওনা দিবো।”

আয়ান ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে অহনার রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমের দিকে গেলো।

জুম্মার নামাজ শেষে সবাই রেডি হয়ে গাড়ীতে বসে পরলো।সাদা রংয়ের পাঞ্জাবীর উপর নীল রংয়ের একটা কটি পরেছে আয়ান।দুপুরের দিকে বলে তেমন শীত লাগছে না তার।তাই কোনো শীতের কাপড়ও আনেনি সাথে।
আয়ান ড্রাইভিং সিটে বসার সাথে সাথে নুরুল খান বাইরের থেকে বললেন,

—“তুমি পিছনের সিটে বসো।গাড়ী আজকে আমি ড্রাইভ করবো।”

বাবার মুখে এ কথা শুনে খানিকটা অবাক হলো আয়ান।কারন সে জানে, তার বাবা তার তাকে যেকোনো কাজ করানোর কোনো সুযোগ ছাড়েন না।তাহলে আজকে ড্রাইভিং এর কাজটা তার বাবা কেনো স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে নিলো সেটা আয়ানকে বেশ ভাবাচ্ছে।তারপরও এ ভাবনাটাকে পাশ কাটিয়ে দিয়ে আয়ান অহনা আর তাদের দাদির সাথে পিছনের সিটে বসে পরলো।আর সামনে বসলো তাদের বাবা মা।
.
.
—“ভাবি…..তোমাদের এসব লক্ষন আমার মোটেও ভালো লাগছে না।”

জান্নাত মুচকি হেসে বললো,

—“কেনো ভালো লাগছে না??”

মৌ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো,

—“আমাকে এতো সাজিয়ে দিচ্ছো,নিশ্চয় বড় কোনো ব্যাপার আছে।”

জান্নাত মৌ এর মাথার চুলগুলো বেঁধে দিতে দিতে বললো,

—“তোমার কি কারন মনে হচ্ছে বলো তো দেখি।”

মৌ করুন সুরে বললো,

—“যেভাবে আমাদের বাসায় সব গোছগাছ হলো, রান্নাবাড়া হলো আর আমাকে এভাবে সাজানো হলো, তা দেখে মনে হচ্ছে ছেলেপক্ষ আমাকে দেখতে আসবে।ঠিক বলেছি না ভাবি?? ”

জান্নাত মুচকি হেসে বললো,

—“জ্বি হ্যাঁ, আমার প্রিয় ননদিনী। তুমি একদম ঠিক গেস করেছো।”

নিজের আন্দাজ এভাবে ঠিক হতে দেখে মৌ এর হৃদয়টাই ভেঙে গেলো।সে কিছুুটা কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো,

—“কারা দেখতে আসবে ভাবি?? আর আমাকে আগে বলোনি কেনো?আমার বিয়ের খোঁজখবর চলছে অথচ আমাকেই জানানো হয়নি!!এটা কেনো হলো ভাবি??”

জান্নাত আর কিছু বলতে যাবে তার আগেই পপি বেগম তাকে ডাক দিলেন।তাই সে মৌ কে আর কিছু না বলে সোজা রুম থেকে বের হয়ে চলে গেলো।
এদিকে মৌ দেখতে আসার বিষয়টাকে একটুও মেনে নিতে পারছে না।এভাবে তাকে না বলে তার মতামত না জেনে তাকে দেখতে আসবে ব্যাপারটা কিছুতেই মানানসই লাগছে না তার কাছে।কষ্টে চোখের কোণে বিন্দুজল এসে উপস্থিত হলো।যেকোনো সময়েই তা গড়িয়ে পরতে পারে।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে