#তোকে_ভালোবেসে_খুব
#পার্ট_১২
Writer:#সারা_মেহেক
আয়ান আর তানভীরের কথার মাঝেই মৌ কিছু না বলে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে পরে।দরজায় সিটকানি দেওয়া ছিলো না বলে সে সহজেই রুমে ঢুকে পরে।
মৌ কে এভাবে রুমে ঢুকতে দেখে আয়ান আর তানভীর দুজনেই একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে চুপ হয়ে যায়।
মৌ ও কিছু না বলে আয়ানের দিকে এগিয়ে যায়।আয়ান মৌ কে দেখে একটা শুকনো ঢোক গিলে জিজ্ঞাস করলো,
—“তুই এখানে কি করছিস?পার্মিশন না নিয়ে রুমে ঢুকলি কেন?”
মৌ আয়ানের কথার কোনো জবাব না দিয়ে ঠাস করে আয়ানের গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয়।হুট করে এমন চড়টা আশা করেনি সে।গালে হাত দিয়ে বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে মৌ এর দিকে।
এতোক্ষন মৌ চুপচাপ ছিলো,কিন্তু আয়ানকে চড় মারার সাথে সাথে সে চিৎকার করে কান্না করতে থাকে।মৌ এর এমন কান্না দেখে তানভীর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।মৌ এবার কান্নারত অবস্থায়ই আয়ানের পরনের টিশার্টের কলার চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
—“আমি কি একটা পণ্য??যাকে দুই ভাই মিলে বেট এ ধরেছেন?কিসের জন্য এমনটা করলেন?একবারও কলিজা কাঁপেনি আপনার?”
এতোক্ষনে মৌ এর চেঁচামেঁচিতে ড্রইংরুমে বসে থাকা সবাই গেস্ট রুমে চলে আসে।অহনা চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞাস করলো,
—“কি হলো মৌ?এমন করছিস কেনো?”
মৌ অহনার কথা শুনে আয়ানের টিশার্টের কলার ছেড়ে দিয়ে বললো,
—“অহ….জানিস??তোর দুই ভাই আমাকে বেট এ ধরেছিলো।বেট এ তানভীর ভাইয়া জিতেছিলো। তাই এখন শর্ত মতে তানভীর ভাই আমাকে পাবে।”
মৌ এর কথা শুনে আয়ান আর তানভীর লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে।তারা জানে,এখন সম্পূর্ণ কথা বললে কেউ শুনতে চাইবে না।বিশেষ করে মৌ তো জানতেও চাইবে না কি হয়েছিলো,কেনো এমন করেছিলো তারা।
নুরুল খান মৌ এর মুখে এমন কথা শুনে আর এক মূহুর্তও দেরী না করে আয়ানের কাছে গিয়ে আয়ানের গালে একটা চড় বসিয়ে দেয়।আয়ানকে চড়টা মারার পর তিনি গিয়ে তানভীরের গালেও একটা চড় বসিয়ে দেয়।দুই ভাইই চড় খেয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়ীয়ে থাকে।আয়ানের বাবা প্রচন্ড রেগে আছেন।রাগের মাথায়ই তিনি হাতের মুঠো শক্ত করে ধরে বললেন,
—“ছিঃ..তোদের কে আমার ছেলে বলে পরিচয় দিতেও লজ্জা করে।তোরা কি মানুষ নাকি অমানুষ?”বলে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে তিনি বড় বড় কয়েকটা শ্বাস নিলেন।এরপর তানভীরের দিকে তাকিয়ে বললেন,
—“তুই তো বড়।এমন কাজটা করার আগে তুই তো আয়ানকো বুঝাতেও পারতি।ভাইয়া, ভাবি তো তোকে খারাপ শিক্ষা দেয়নি, আমার জানামতে।তাহলে এমনটা করলি কি করে তুই?”
আয়ান এবার মাথা উঁচু করে তার বাবাকে বললো,
—“পুরো কথাটা একবার শুনো তো আব্বু।আমরা….”
ছেলেকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে নুরুল খান বললেন,
—“তোদের দুটোরই তো ঘরে বোন আছে।তারপরেও এতে নিচু কাজ তোরা করতে পারলি!!ছিঃ!!একটা মেয়েকে বাজিতে ধরা কোন ভদ্র পরিবারের ছেলেদের কাজ বলতো?”
আয়ানের মা,দাদি দুজনেই চুপ হয়ে আছেন।ছেলের এমন কাজে পুরোই তব্দা খেয়ে গিয়েছেন আয়ানের মা।আয়ানের দাদিও এ শক থেকে বেরুতে পারছে না।এদিকে মৌ ভাবলেশহীনভাবে দাঁড়ীয়ে দাঁড়ীয়ে সবটা দেখছে। যেটার ভয়ে সে ছিলো,ঠিক সেটাই হলো।আয়ানের জন্য তার মনের তৈরী হওয়া ভালোবাসা ধীরে ধীরে ঘৃণায় পরিনত হচ্ছে।পুরো মন জুড়ে এক দমকা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। যে দমকা হাওয়ায় নতুন নতুন সব অনুভুতি গুলোও উড়ে চলে যাচ্ছে। মৌ এগুলোকে আগলে রাখারও চেষ্টা করছে না।করবেই বা কেনো,এমন জঘন্য কাজ করার পর সে চাইছে না আয়ানের জন তার মনে কোনো অনুভুতি থাকুক।মৌ কিছু না বলে নিরবে রুম ত্যাগ করে নিজের রুমে এসে দরজা আটকিয়ে দেয়।
নুরুল খান আর কিছু না বলে রুম থেকে বেড়িয়ে চলে যান।অহনা,আয়ানের মা আর দাদি তখনও সেখানে দাঁড়ীয়ে আছেন।
কয়েক সেকেন্ড পর আয়ান গিয়ে তার মায়ের সামনে দাঁড়ালো।কাঁদো কাঁদো সুরে সে বললো,
—“আম্মু তুমি কি সবটা জানতে চাইবে না?নাকি মৌ আর আব্বুর মতো কয়েকটা কথা শুনেই রিয়েক্ট করবে?”
ছেলের এমন কণ্ঠস্বর শুনে আয়ানের মা এর মনে যে একটু রাগ ছিলো, তাও গলে পানি হয়ে গেলো।তিনি আয়ানের মাথায় আদরের পরশ বুলিয়ে বললেন,
—“আমি জানি,আমার ছেলে কখনো কোনো খারাপ কাজ করবে না। তোর পুরো কথাই আমি শুনবো।তবে হ্যাঁ, এক্ষেত্রে তোর বা তানভীর কারোর কোনো দোষ থাকলে আমি মাফ করবো না তোদের।”
মায়ের মুখের কথা শুনে আয়ান আশাবাদী হয়ে বললো,
—“ঠিক আছে আম্মু।”বলে আয়ান তার দাদি আর মা কে নিয়ে গিয়ে খাটে বসালো।অহনাও তাদের সাথে গিয়ে বসলো।তানভীর অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে আয়ানের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
আয়ান বড় বড় কয়েকটা শ্বাস ফেলে বলা শুরু করলো,
—“তানভীর ভাই বিদেশে যাওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগেকার ঘটনা।একদিন সবাই মিলে আড্ডা দিতে দিতে তানভীর ভাই বললো যে সে মৌ কে পছন্দ করে।আমিও ছিলাম সেখানে।তানভীর ভাই মৌ কে পছন্দ করতো, এটা আমি কিছুটা আইডিয়া করেছিলাম।তরী আপুর বিয়েতে মৌ কে দেখে পছন্দ করেছিলো ও।তানভীর ভাই মৌ কে পছন্দ করলেও মৌ তাকে দুচোখে দেখতে পেতো না।কারনটা অবশ্য বেশ সামান্যই।তানভীর ভাই সিগারেট খেতো খুব।এটা বলে মৌ এর একদমই সহ্য হতো না।
তো সেদিন আড্ডা দেওয়ার ফাঁকেই তানভীর ভাই বললো,যে আমি যদি মৌ কে তার সাথে রিলেশন করানোর জন্য রাজি করাতে পারি তাহলে সে আমাকে তার বাইকটা দিবে।আমার আবার তানভীর ভাইয়ের কাছে থাকা ব্র্যান্ড নিউ বাইকটা খুব মনে ধরেছিলো।আমি জানি,আব্বুকে বাইকটা কেনার কথা বললে তিনি কোনোমতেই রাজি হতেন না।তাই বাইকের লোভে পরে আমি তানভীর ভাইয়ের শর্তে রাজি হয়ে যাই।ব্যাপারটা তখনও এতো গোলমেলে পাকেনি।গোলমাল হলো তানভীর ভাইয়ের বন্ধুর কথা মানতে গিয়ে।”বলে কয়েক সেকেন্ডের জন্য চুপ হয়ে গেলো সে।আবারো তার কিছু বলার আগে তানভীর বলা শুরু করলো,
—“আমার ফ্রেন্ড বললো,এতো সহজে এতো দামী বাইকটা পেলে তো কোনো মজা থাকবে না।তাই সে বললো,তার বাইক আর আমার বাইক নিয়ে আমাকে আর আয়ানকে রেস লাগাতে হবে।সে রেসে যে জিতবে সে বাইকটা পাবে।আর মৌ কে যার ইচ্ছা সে নিবে।
জানি না তখন কি হয়েছিলো আমার আর আয়ানের। দুজনেই ওর কথায় রাজি হয়ে যাই।ওর কথামতো আমরা রেস লাগালাম।বাট রেসে জিতলাম আমি।আয়ান একটুর জন্য হেরে গিয়েছিলো।এ নিয়ে অবশ্য ও খুব কষ্টও পেয়েছিলো।বন্ধুর কথায় রেসে জেতার পরেও আমি আয়ানকে বাইকটা দিয়ে দিলাম খুশি মনে,এই ভেবে যে ও মৌ কে আমার সাথে রিলশনে রাজি করাবে।
সেদিন আমি আমার বাইকটা নিয়ে গিয়েছিলাম।কারন শর্ত মোতাবেক আয়ানকে আগে মৌ কে রাজি করাতে হবে।তারপর সে বাইকটা পাবে।
পরের দিন সে মৌ এর সাথে কথা বলার আগেই আমার বাইকটা চুরি হয়ে যায়।এ নিয়ে আয়ানের কষ্টের শেষ ছিলো না।আমি ভয়ে ছিলাম যে মৌ এর সাথে কি আয়ান তাহলে কথা বলবে না?এই ভয়ে আমি আয়ানকে বলেছিলাম,আমি ওকে বাইক কেনার টাকা দিবো।তার বদলে সে মৌ কে রাজি করাবে।
এদিকে আমি টাকা জোগাড় করছিলাম,আর ওদিকে আয়ান মৌ এর সাথে নানা তালবাহানায় এ ব্যাপারে কথা বলতে চাইছিলো। এদিকে টাকা জোগাড় করতে করতে আমার ফ্লাইটের ডেট পরে যায়।যাওয়ার আগে আমি অবশ্য আয়ানের থেকে ওয়াদা নিয়ে ছিলাম যে সে মৌ এর সাথে কথা বলবে।
এভাবে দিন গড়িয়ে যেতে যেতে আয়ান এ বিষয়টা সম্পূর্ণ ভুলে।কাজের চাপে আমিও বিষয়টা ভুলে যেতে বসেছিলাম।কিন্তু দেশে আসার পর ফ্রি হওয়ায় আগেকার কথাগুলো সব মাথায় আবারো ঘুরপাক খেতে লাগলো।আর এ বিষয়ে কথা বলার জন্যই আমি এখানে এসেছিলাম।কিন্তু এখানে আসার পর সবটা দেখে আমার খুব রাগ লেগেছিলো।পুরো ব্যাপারটাই বেটের মতো ছিলো।”বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তানভীর মাথা নিচু করে দাঁড়ীয়ে রইলো।
পুরো কথা শুনে অহনা,আয়ানের দাদি আর মা তব্দা খেয়ে বসে রইলো।দুজনের লোভ দেখে তিনজনের মাথায় হাত।একজনের বাইকের প্রতি লোভ,আরেকজনের মৌ এর সাথে রিলেশনে যাওয়ার লোভ।আসলেই বলে না,লোভে পাপ,পাপে মৃত্যু। এক্ষেত্রে অবশ্য মৃত্যু না হয়ে থাপ্পড় খাওয়া হয়েছে।
আয়ানের আম্মু উঠে এসে রাগী গলায় তানভীর আর আয়ানকে বললেন,
—“কি বলবো…বুঝতে পারছি না।তোদের দুটোর মনে এতো লোভ!!আল্লাহ!!!…আয়ান..তোর মাথায় কি নূন্যতম বুদ্ধি ছিলো না?এক বাইকের লোভে এসব!আর তানভীর,তোর মাথায়ও কোনো ভালো কাজ আসেনি।শেষপর্যন্ত আয়ানকে দিয়েই মৌ কে রাজি করাতে হবে তোকে!দুজনের নাদানি দেখে আমার নিজের গালেই নিজের কয়েকটা চড় মারতে ইচ্ছা করছে। ”
আয়ান আবারো কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললো,
—“আম্মু,প্লিজ..আমাদের মাফ করে দাও।আর তুমি একটু মৌ এর সাথে কথা বলো প্লিজ।ও খামোখা আমাকে ভুল বুঝছে।ও আমার উপর খুব রেগে আছে। ”
আয়ানের মা সামান্য রাগী গলায় বললো,
—“মৌ এর জায়গায় অন্য মেয়ে হলে সেও রেগে যেতো।”
—“আম্মু,প্লিজ।মৌ এর সাথে কথা বলে ব্যাপারটাকে সলভ করার চেষ্টা করো।ভুলটা আমাদের দুজনেরই ছিলো।আমাদের দুজনেরই ওর কাছে মাফ চাওয়া উচিত।কিন্তু ও এতো সহজে আমাদের কথা শুনবে না।তার চেয়ে ভালো তুমি ওকে একটু বুঝিয়ে বলো।”
—“ঝামেলা তোরা পাকিয়েছিস।তোরাই সলভ করবি।আমি এর মধ্যে নেই।”
মায়ের কথা শুনে আয়ান হাল ছেড়ে বললো,
—“আচ্ছা ঠিক আছে।আমিই যাচ্ছি।”বলে সে মাথা নিচু করে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।
নিজের রুমের সামনে দাঁড়ীয়ে আছে আয়ান।মনের মধ্যে একরাশ ভয়,উদ্বিগ্ন কাজ করছে তার।দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে সে দরজায় নক করতে করতে বললো,
—“মৌ..আমার পুরো কথাটা একবার শোন।ঐ কথাটা ভালো করে না শুনেই তুই রেগে গিয়েছিস কেনো?”
আয়ানের কথা শুনে রুমের ভিতর কান্নারত অবস্থায় থাকা মৌ তেজি গলায় বললো,
—“আমি আপনার কোনো কথাই শুনবো না।আপনি এখন আমাকে তানভীর ভাইয়ের কাছে দিয়ে দিবেন তাইতো?আপনি চলে যান এখান থেকে।আমার মাথা এখন গরম হয়ে আছে।কি দিয়ে কি করে ফেলবো জানি না।সো প্লিজ চলে যান।”
মৌ এর কথা শুনে আয়ান ভয়ে একটা শুকনো ঢোক গিলে নিচে চলে আসলো।কি করে এখন সে মৌ কে পুরো কথা বলবে তা চিন্তা করতে লাগলো।
চলবে….
পড়তে পড়তে আমারো চোখ দিয়েও কেনো জেনো পানি চলে আসলো😅💔
মাস্টারপিস 🤍🤎
বিশেষ করে last পর্ব টা >>>>>>