তুমি_আছো_হৃদয়ে পর্ব-০৭

0
2126

#তুমি_আছো_হৃদয়ে
#পর্ব-৭

জীবনটা কি থেকে কি হয়ে গেলো বুঝতেই পারলাম না। ভেবেছিলাম বিয়ের পর বউকে ভালোবেসে অতীতের সব কিছু মন থেকে মুছে ফেলবো,নতুন করে নিজের জীবনটাকে রঙিন করে রাঙাবো। যদিও আমার মনে হয় আমি অতীতের সবকিছু ভুলে গিয়েছি তবুও কিছু কিছু স্মৃতি থাকে যেগুলো জীবন থেকে কখনো মুছে ফেলা যায় না। কিন্তু আমি মুছে ফেলেছিলাম অতীতের সব স্মৃতি তবুও আমি আমার সাদাকালো জাঁকজমকহীন সাধারণ জীবনটাকে রঙিন করতে পারিনি। তাহলে কি নুসরাতের কথায় সত্য? আমি এখনো নিজেকে কারো সাথে মানিয়ে নিতে পারি না। কি নেই আমার? দেখতে শুনতে ভালো,চলাফেরায়,আচার আচরণে সবকিছুতেই ভালো,মানুষ হিসেবেও ভালো। জীবনে প্রতিষ্ঠিত সফল একজন মানুষ। তবুও আমি রোদেলাকে আপন করে নিতে ব্যর্থ। তাঁর মনের মতো না,সে আমাকে ভালোবাসতে চায় না,কাছে টানতে চায় না। মেয়েরা আসলে কেমন ছেলে পছন্দ করে খুব করে জানতে ইচ্ছে করে আমার। রোদেলা কি চাইলে আমাকে ভালোবেসে তাঁর বুকে আশ্রয় দিতে পারে না? তাহলে সে কেনো এমন করে আমার জানা নেই। সে কি জানে না আমি ভালোবাসার কাঙাল। আমি তাঁর থেকে ভালোবাসা পেতে চাই,তাকে ভালোবাসা দিতে চাই। আমার হৃদয়ের সমস্ত মধু আহরণের দায়িত্ব আমি তাকে দিতে চাই। কিন্তু আমি যতোই তাঁর কাছে যেতে চাই সে ততোই আমার থেকে দূরে যেতে চায়।

সেদিনের পর থেকে সে আমার সাথে কথা বলা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে। পুরোপুরি মানে একদমই,বিগত সাত দিন ধরে আমাদের দুজনের কোনো কথা হয় না। আপনার আপনজন যখন আপনার আশেপাশে থাকবে,আপনার সাথে প্রতিনিয়ত দেখা হবে কিন্তু কোনো কথা বলবে না তখন খুব খারাপ লাগবে। মনে হবে নীরবে শাস্তি দিয়ে যাচ্ছে মানুষটা। এক ছাদের নিচে বাস করলেও রোদেলা আমার থেকে যোজন যোজন দুরত্ব বিরাজ করে চলেছে প্রতিনিয়ত। যদিও ওইদিন আমার ওইভাবে তাকে চুমু খাওয়া উচিত হয়নি তবে এমনটা না করে উপায়ও ছিলো না। এটা করার কারণে অন্তত সে আমাকে একটু হলেও ভয় পাবে। এটা যদি না করতাম তাহলে হয়তো সে এমন কিছু করতো যেটা আমি কল্পনাও করতে পারতাম না কিন্তু সে এখন সেটা করতে পারবে না। কারণ তাঁর মনে হয়তো ভয় ঢুগে গেছে,তাঁর ওপর আমি চাইলেই ঝাপিয়ে পড়তে পারি,নিজের অধিকারটা আদায় করতে পারি। যদিও আমি কখনো এমনটা চাই না,আমি শুধু বুঝাতে চেয়েছি আমি চাইলে এটা করতে পারি। সারাদিন চিৎকার চেঁচামেচি করলেও এই ইট পাথরের দেয়াল ভেদ করে সেটা বাহিরে যাবে না। সে এই জিনিসটা খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছে।

আজ সাতদিন হয়ে গেছে কোনো বাজার করি না। ঘরে যা ছিলো সেগুলো দিয়েই কোনোমতে চলে গিয়েছে। রোদেলা নিজের জন্য শুধু রান্না করে,আমার জন্য করে না। সকালে হালকা ফল জাতীয় কিছু খেয়ে অফিসে চলে যাই,কারণ রোদেলা দশটার আগে ঘুম থেকেই উঠে না। হয়তো বা ইচ্ছে করেই ঘুমিয়ে থাকে যাতে করে আমি তাকে রান্নার কথা না বলতে পারি। দুপুরে অফিসেই লাঞ্চ করে নেই। কারণ আমি জানি বাসায় গেলে রোদেলা আমার জন্য রান্না করে রেখে দিবে এতোটা সৌভাগ্য আমার হয়নি। তাই বাঁধ্য হয়েই বাহিরে খেতে হয় আমাকে। আর রাতে বাসায় এসে নিজেই রান্না করে খাই। এভাবেই চলছিলো আমাদের সংসার জীবন। যে জীবনে কোনো সুখ নেই কোনো শান্তি নেই,আছে শুধু জেদ আর দ্বন্দ্ব। অথচ বিয়ের আগে মনে হতো দাম্পত্য জীবন অনেক সুখের হয়। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন,গল্প উপন্যাস কিংবা নাটক সিনেমায় দাম্পত্য জীবন সুখের দেখা গেলেও বাস্তবে এতো সুখের হয় না। বাস্তবে বিবাহিত জীবন মানে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। যেখান থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

সাতদিন পর আমি আমার বউ এর মুখ থেকে কোনো কথা শুনলাম। প্রয়োজনে যে নিজের চরম শত্রুর কাছেও মানুষ মাথানত করতে দ্বিধাবোধ করে না। তার প্রমাণ আমার সামনে উপস্থিত। রোদেলাও হয়তো না পেরে আমার সাথে কথা বলেছে,কারণ এখন আমাকে তাঁর ভীষণ দরকার। ঘরে বাজার না থাকার কারণে রান্না বান্না কিছু হচ্ছে না,আমি বাহিরে খেলেও রোদেলা বাহিরে খেতে পারে না। শুধু টাকা থাকলেই বাহিরে খাওয়া যায় না। পুরুষ মানুষ বাহিরে খেলে জিনিসটা যেরকম দেখায় মেয়ে মানুষ বাহিরে খেলে জিনিসটা ততো ভালো দেখায় না। আমার কাছে মেয়ে মানুষের হোটেলে ভাত খাওয়া জিনিসটা একদম বাজে দেখায়। কোথাও ঘুরতে গিয়ে সমস্যায় পড়ে খেলে সেটা আলাদা কথা। কিন্তু একটা মেয়ে বাসা থেকে হোটেলে গিয়ে খাবার খাবে জিনিসটা খুব খারাপ দেখায় অন্তত আমার কাছে। রোদেলার কাছেও এই জিনিসটা হয়তো ভালো লাগে না। তাই সে বাঁধ্য হয়ে আমার সাথে কথা বলল।

আপনি বাজার করছেন না কেনো? প্রথমদিন তো খুব বাজার করলেন। আমাকে একা রেখে রাতে বাজার করতে চলে গিয়েছিলেন। আর এখন কোনো কিছু না থাকার পরেও কেনো বাজার করছেন না?
– সেদিনের ব্যাপার আর আজকের ব্যাপার অনেক আলাদা। সেদিন রান্না করার মানুষ ছিলো কিন্তু আজ নেই। সেদিনের আপনি আর আজকের আপনির মধ্যে অনেক পার্থক্য। যেহেতু আপনি শুধু নিজের জন্য রান্না করবেন,নিজে খাবেন। সেহেতু বাজারটা আপনিই করেন। আমি টাকা দিচ্ছি,আপনার দরকার হলে আপনি বাজারে যান,যা ইচ্ছা বাজার করে নিয়ে আসেন।
– আপনি তো খুব খারাপ মানুষ। মেয়ে হয়ে বাজারে যাবো? আপনি নাকি অনেক দায়িত্বশীল পুরুষ। তো কোথায় গেলো আপনার দায়িত্ব? একটা মেয়েকে না খেয়ে রেখে নিজেকে দায়িত্ববান পুরুষ ভাবছেন।
– দায়িত্ব তো আর নিতে দেন নাই। নিতে দিলে কি আর এরকম করতেন।
– কি রকম করি? আপনি যেই কাজটা ওইদিন করেছেন তাঁর জন্য আপনার সাথে কথা বলাই উচিত না। একটা নিরীহ মেয়েকে একা পেয়ে কি কাজটাই না করলেন। সেটা মনে হলেই আপনার জন্য আমার মনে প্রচন্ড ঘৃণা কাজ করে।
– আপনি নিরীহ? আপনাকে নিরীহ বলা হলে পৃৃথিবীর সমস্ত নিরীহ মেয়েদেরকে অপমান করা হবে। আপনার ভিতরে জেলাপির প্যাঁচ ব্যতীত কিছু নেই। ওই দিনের ঘটনাটা ভুলে গেলেই পারেন,শুধু শুধু মনে করে আমাকে ঘৃণা করার কোনো দরকার নেই। হাসবেন্ডকে ভালোবাসতে হয়,ঘৃণা করতে হয় না।
– আপনি বাজার করে নিয়ে আসুন। আমি দুজনের জন্যই রান্না করবো।
– কিভাবে বিশ্বাস করবো?
– এখানে বিশ্বাস না করার কি আছে? আমি বললাম তো রান্না করলে দুজনের জন্যই করবো। আপনি যদি বাজার না করেন আজকে তাহলে আমি বাসায় ফোন দিবো। বলবো আপনি আমাকে না খাইয়ে রেখেছেন। তখন আপনিই তাদের সাথে কথা বইলেন।

আমি বাজার করতে বেরিয়ে গেলাম। মেয়েটার জন্য অনেক মায়া লাগছে। সেই সকাল থেকে না খেয়ে আছে,যদিও আমিও কিছু খাইনি। তবে নিজের জন্য খারাপ লাগছে না। অতীতে টানা দুইদিন পর্যন্ত না খেয়ে কাটানোর অভ্যাস আছে আমার। তাই এক বেলা দুবেলা না খেলে খুব বেশি কষ্ট হয় না আমার। যতোটা সম্ভব বেশি করেই বাজার নিয়ে আসলাম। বাজার নিয়ে আসার সাথে সাথেই রোদেলা রান্না শুরু করে দিলো। আমি ভাবলাম কতো ক্ষুধাই না জানি লেগেছে,আমার আরও আগে বাজার করা উচিত ছিলো। এভাবে একটা মেয়েকে না খাইয়ে রাখা আসলেই কোনো দায়িত্ববান পুরুষের কাজ না।

আমি রান্না ঘরে যেতেই রোদেলা বলল,
আপনি এখানে কেনো?
– আমারও অনেক ক্ষুধা লেগেছে। তাই সহ্য হচ্ছে না,তাড়াতাড়ি রান্না করুণ।
– আপনি তো খুব স্বার্থপর একজন মানুষ।
– কি এমন করলাম যে হঠাৎ করেই আমাকে সেলফিস মানুষ মনে হলো।
– আপনি জানেন আমি সকাল থেকে না খেয়ে আছি। তাহলে বাহিরে যেহেতু গিয়েছিলেনই খাওয়ার জন্য কিছু নিয়ে আসলেই তো পারতেন। কিন্তু তা করেন নি। আপনি তো ঠিকই খেয়ে এসেছেন মনে হয়।
– আমার মনে ছিলো না। আপনি বললেই তো হতো। তাহলে নিয়ে আসতাম।
– এগুলো বলতে হয় না। আমি আপনার জন্য রান্না করবো না। যা রান্না করছি সেটা দিয়ে আমারই হবে নাকি কে জানে। আমি খাওয়ার পর বাঁচলে আপনি খাবেন না হলে আপনি নিজে রান্না করে খাবেন।
– আপনাকে দেখে মনে হয় না আপনি এতোটা খাদক। আর তাছাড়া আপনি কিন্ত বলেছিলেন,আর আমি আপনাকে বিশ্বাসও করেছিলাম। সেজন্যই এতো কষ্ট করে বাজার করে নিয়ে এসেছি।
– খুব রাগ হচ্ছে আমার ওপর? কিছু করতে মন চাচ্ছে? সেদিনও আমার অনেক রাগ হয়েছিলো,মনে হয়েছিলো আপনাকে খুন করে ফেলি। যেই জিনিসটার জন্য মানুষ এতো কিছু করে,কতোটা কাছের হতে হয়,কতোটা ভালোবাসতে হয় দুজন দুজনকে। তাহলেই কেবল লিপ কিস করা যায়। এই জিনিসটা কি আপনি বোঝেন? বুঝেন না,আপনার মতো পুরুষেরা ভালোবাসা বলতে কিছু বোঝে না,বোঝেন শুধু ভোগ করতে। আমার আর আপনার মধ্যে এসবের কিছুই ছিলো না,তবুও আপনি এই কাজটা করেছেন। খুব জঘন্য, খুব খুব খারাপ মানুষ আপনি।
– আজও যদি এমন কিছু করি?
– করেন,আমি প্রস্তুত। চুমু খাবেন তো? খেতে পারেন,সমস্যা নাই। আমি না করবো না। যেই জিনিসটা এতো যত্ন করে রেখেছিলাম নিজের ভালোবাসার মানুষের জন্য। ভেবেছিলাম পৃৃথিবীর অন্য কোনো পুরষ সেখানে কখনো কোনোদিনও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। কিন্তু আপনি সেটাকে অপবিত্র করে দিয়েছেন। অবৈধ ভাবে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। এখন আর আগের মতো যত্ন করার কোনো মানে হয় না। আপনার জন্য উন্মুক্ত, চাইলে ব্যবহার করতে পারেন।

আমি স্তব্ধ হয়ে রোদেলার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। দিন যতো যাচ্ছে এই মেয়েটাকে ততো ডেঞ্জারাস মনে হচ্ছে আমার কাছে। অথচ এই মেয়েটা নিজেকে নিরীহ দাবি করে।

চলবে……….

লেখাঃ আমিনুর রহমান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে