তুমিময় ভালোবাসা পর্ব-১২+১৩

0
1854

#তুমিময়_ভালোবাসা
#পর্ব: ১২
#লেখিকা: মার্জিয়া রহমান হিমা

নিলা রেগে বলে
” তুমি আমাকে কোন দিক দিয়ে মোটা দেখো ??” ইশান মাথা চুলকে বলে
” মোটা না তবে আগে তো সোহার মতোই ছিলে পরে ফিটফাট হয়েছো সেটাই বলছি।” বলে দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে যায়। সিমি আর সামির মিটমিট করে হাসতে থাকে। শান চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে। সিমি আর সামির কিছুক্ষণ পরে চলে যায়। শান কিছুক্ষণ বসে থেকে ওয়াসরুমে ঢুকে পরে। নিলা একবার শানের দিকে তাকিয়ে নিশ্বাস ফেলে নাইসার কাছে এসে বলে
” বাবু আসো আমরা রুমে যাই।” নাইসা সোহার গা ঘেঁষে বসে বলে
” নাহ আমি কোথাও যাবো না। মিষ্টিমনি ঘুম থেকে উঠলে আমরা খেলবো।” নিলা নাইসার সামনের চুল গুলো হাত দিয়ে ঠিক করে দিতে দিতে বলে
” নাইসা কি জানে না ?? তার মিষ্টিমনি তো আজকে অসুস্থ!! এখন যদি সে সারাক্ষণ মিষ্টিমনির পাশে বসে থাকে তাহলে মিষ্টিমনি ঘুম থেকে উঠে খেলতে বসবে তারপর আবার মিষ্টিমনির শরীর খারাপ হবে। এতো বার অসুস্থ হলে তোমার মিষ্টি মনি সুস্থ হবে কখন ?? আর সুস্থ না হলে তো তোমার সাথে খেলতে পারবে না। তাহলে আজকে তুমি তোমার মিষ্টি মনিকে রেস্ট নিতে দাও বাবু ?? কালকে খেলবে ওকে ??” নাইসা মাথা নেড়ে বলে
” ঠিকাছে কিন্তু মিষ্টিমনি ঘুম থেকে উঠবে কখন ?? আজকে তো একবারও উঠেনি। আমি কথা বলবো তো !!” নিলা মুচকি হেসে বলে
” তোমার মিষ্টিমনি অসুস্থ তো তাই দেড়ি করে ঘুম থেকে উঠবে। তুমি কালকে সকালে মিষ্টিমনির কাছে আসবে। ঠিকাছে ??” নাইসা মাথা নেড়ে নিলার কোলে উঠে টমির দিকে তাকিয়ে দেখে টমি খাটের সাইডে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদেরকে দেখছে। নাইসা টমিকে উদ্দেশ্য করে বলে
” টমি মিষ্টিমনির পাশে বসে থাকবি নাহলে শান তোকে বকবে।” টমি কি বুঝলো কে জানে?? টমি চুপচাপ আগের মতো সোহার গা ঘেঁষে বসে পড়লো। নিলা হেসে নাইসাকে নিয়ে বেড়িয়ে যায়।
কিছুক্ষণ পর শান বেড়িয়ে আসে ওয়াসরুম থেকে। টাওয়ালটা হাত থেকে রেখে দরজা ভিরিয়ে টেবিলের চেয়ার টেনে সোহার পাশে বসে পরে। শানকে দেখে টমি বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। শান টমিকে উঠতে দেখে ভাবে টমি শানের কোলে লাফ দেবে তাই শান শাসন স্বরে বলে
” এই একদম আমার কাছে আসবি না। আসলে তোকে ব্যালকনি থেকে বাইরে ফেলে দেবো।” টমি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখ ফিরিয়ে বিছানা থেকে নেমে নিজের সুন্দর ঝুড়িতে বসে পরে। শান স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সোহার দিকে তাকায়। সোহার মলিন মুখ দেখে শানের প্রচণ্ড মায়া হলো। শান সোহার একটা হাত নিজের দুই হাতের মুঠোয় পুড়ে নেয়। সোহার হাতের উপরের হালকা ভাবে নিজের অধর জোড়া ছুঁয়ে দেয়। সোহার হাতটা শক্তভাবে ধরে বলে
” সেইদিন তোমার কথা গুলো শুনে আমার পুরো দুনিয়া ভেসে গিয়েছিলো। প্রথম ভালোবাসাই যে এভাবে দূরে চলে যাবে আমি ভাবতে পারিনি। তোমাকে দেখলেই আমি তোমার মাঝে হাড়িয়ে যাই। তোমার বাচ্চা স্বভাব গুলো সত্যি আমার মনে বারবার জায়গা করে নিচ্ছে। তবে আমি যেই কষ্ট একবার পেয়েছি সেটা আবার পেতে চাই না তাই তোমাকে এখন নিজের থেকে দূড়ে রাখি আর অবহেলা করি। আমি তো এখনও জানি না সেই ছেলেটা কে ছিলো। আজকে আমার অবহেলার জন্য তোমার এই অবস্থার জন্য আমি সত্যি খুব দুঃখিত। নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না। i am really very sorry. আজকের পর থেকে আমি কখনো তোমার অবহেলা করবো না। তবে তুমি আমার সেই ভালোবাসা পাবে না। সেটা আমার মনেই থাকবে।” শান কথা শেষ করে সোহার হাত ধরে বসে থাকে। কিছুক্ষণ পরে দরজায় নক হতেই শান দ্রুত উঠে দাঁড়ায়। দরজা খুলে দেখে শাহানাজ বেগম খাবার হাতে দাঁড়িয়ে আছে। শানকে দেখে শাহানাজ বেগমের চেহারায় গম্ভীরতা দেখা দিলো পাশে সালমা দাঁড়িয়ে আছে। শান দরজার সামনে থেকে পথ ছেড়ে বলে
” ভেতরে এসো। ” শাহানাজ বেগম কিছু না বলে ভেতরে ঢুকে টেবিলের উপর খাবারটা রেখে সোহার পাশে বসে। সোহার মাথা হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় ডেকে উঠে সোহাকে। কিন্তু সোহার কোনো নড়চড় দেখা যায়না। শাহানাজ বেগম আবার সোহাকে ডাকতে থাকে
” সোহা !! সোহা মা একটু উঠ!! খাবার খেতে হবে তো !! সারাদিন সেলাইন ছাড়া তো পেটে আর কিছু পরেনি।”
একটু নড়েচড়ে সোহা আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকায়। চোখ খুলতেই সামনে শাহানাজ বেগমকে হাসি মুখে বসে থাকতে দেখে অজান্তেই সোহা মলিন হাসি দেয়। সোহা চোখ কচলে উঠে বসতেই শাহানাজ বেগম সোহাকে হেলান দিয়ে বসিয়ে দেয়। সোহা মুচকি হাসি দিয়ে শাহানাজ বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে
” কি হয়েছে মামনি এখন তুমি এখানে কি করছো ?? ঘুমাবে না তোমার ঘুমের টাইম হয়ে গিয়েছে তো।” শাহানাজ বেগম হেসে বলে
” আমার মেয়ের সব দিকে খবর থাকে। আমি তোকে খাওয়াতে এসেছি। আচ্ছা বল এখন কেমন লাগছে তোর !!”
সোহা মলিন হেসে বলে
” filling Better.” শাহানাজ বেগম খাবার হাতে নিয়ে বলে
” ঠিকাছে এবার এই সব গুলো খাবার খেয়ে মাও লক্ষী মেয়ের মতো।” সোহা চোখ বড়বড় করে তাকায় খাবারের দিকে। শাহানাজ বেগম ধমক স্বরে বলে
” এভাবে কি দেখছিস ?? আজকে একটা খাবারও যদি থাকে তাহলে তোকে লাঠি দিয়ে মারবো। আমি সালমাকে দিয়ে বাগান থেকে লাঠি আনিয়ে রেখেছি। না খেয়ে দেয়ে শরীরের কি অবস্থা করেছে !! বাতাসের আগে উড়তে থাকিস।” সোহা কাঁদোকাঁদো চেহারা বানিয়ে বলে
” তুমি আমাকে বকছো ??” শাহানাজ বেগম সোহার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে
” বকছি কোথায় ?? তুই তো সব বুঝিস তাই না ?? তাহলে এইটুকু কেনো বুঝিস না তুই নিয়মিত খাবার না খেলে অসুস্থ হয়ে পরবি। ইশানও বলেছে এমন থাকলে পরে প্রবলেম হবে। মা এখন থেকে প্লিজ ভালো করে খাওয়া দাওয়া কর।” সোহা বিরক্তকর চেহারা বানিয়ে বসে থাকে। শাহানাজ বেগম সোহার মুখের সামনে সুপ ধরতেই সোহা মুখ ঘুড়িয়ে নাক, মুখ কুচকে বলে
” ছিঃ !! মামনি আমি মাত্র ঘুম থেকে উঠেছি এখন কিভাবে খাবো ?? মুখ,টুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নেই তারপর আমি নিজে খেয়ে নেবো।” শাহানাজ বেগম ভ্রু কুচকে বলে
” তুই কি আমাকে বোকা পেয়েছিস নাকি ?? আমি এখন চলে গেলে যে তুই খাবি না সেটা আমি ভালো করেই জানি। তাই আমি বসে আছি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয়।” শান এগিয়ে এসে মিনমিম স্বরে বলে
” মা আমি পরে খাইয়ে দেবো তুমি চিন্তা করো না।” শাহানাজ বেগম শানের কথা শুনে কোনো কথাই বললো না একপ্রকার এভোয়েড করে বলে উঠে
” খাবার টা যেনো খাওয়ানো হয়। আজকে অবহেলা কারণে যেই কাজটা হয়েছে সেটা যেনো এখন বা দ্বিতীয় বার না হয়।” কথা শেষ করে হনহন পায়ে শাহানাজ বেগম রুম থেকে বেরিয়ে যায়। সালমা একবার শানের দিকে তাকিয়ে চলে যায়।

শান মায়ের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সোহার কাছে এগিয়ে আসে। সোহা শানকে দেখে গম্ভীর ভাবে বসে থাকে। শান সোহার পাশে বসে মাথা নিচু করে মৃদু স্বরে বলে
” আজকের কাজের জন্য আমি খুবই লজ্জিত। আমার অফিসে ইম্পরট্যান্ট কাজ ছিলো সাথে অফিস থেকে ভার্সিটি যেতেও সময় লাগতো তাই আর তোমার কথা এতোটা গুরুত্ব দেইনি। আমি ভাইয়াকে বলেছিলাম। very very sorry, please forgive me !!” সোহা কোনো কথা না বলে বিছানা থেকে নিচে নামতে গেলে শান থামিয়ে দিয়ে বলে
” দাঁড়াও আমি হেল্প করছি তোমাকে।” সোহা গম্ভীর গলায় বলে
” দরকার নেই। ওয়াসরুম পর্যন্ত আমি নিজেই যেতে পারবো। যখন দরকার ছিলো তখন তো গুরুত্বই দেওয়া হয়নি। এখন গুরুত্ব দেওয়ার দরকার নেই।” শান অসহায়ভাবে তাকালো সোহার দিকে। সবাই শানকে এভোয়েড করছে যেটা শান সহ্য করতে পারছে না। সোহা উঠে দাঁড়াতেই শান এবার শক্ত চেহারায় সোহার কাছে এসে সোহার হাত চেপে ধরে। সোহা শানের হাত ঝাড়া দিয়ে সড়িয়ে দিয়ে বলে
” বলেছি না আমি !! আমার কাউকে দরকার নেই।” শান শক্ত গলায় বলে
” সেটা আমি বুঝে নেবো তোমার কাকে দরকার আর কাকে দরকার নেই !! আমি তোমার হাসবেন্ড সো, তোমাকে ধরা-ছোঁয়া , চুমু দেওয়া, ভালোবাসা , রাগ দেখানোর সবকিছু করার রাইট আছে আমার। তাই আমার যা ইচ্ছে তাই করবো তুমি কোনো কথা বলবে না।” সোহা কিছুক্ষণ চোখ বড়বড় তাকিয়ে পরে শান্ত গলায় বলে
” হুম !! অবহেলা করে মেরে ফেলারও রাইট আছে।” শান কিছু না বলে মাথা নিচু করে সোহাকে ওয়াসরুমের সামনে নিয়ে যায়। সোহা ওয়াসরুমে ঢুকে হালকা শব্দ করেই দরজা লক করে দেয়। শান দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সোহার অপেক্ষা করতে থাকে। কিছুক্ষণ পর দরজা খোলার শব্দ পেয়ে শান এগিয়ে আসে। সোহাকে বিছানায় বসিয়ে খাবার হাতে নেয়। সুপে ফু দিয়ে সোহার মুখের সামনে ধরতেই সোহা অবাক হয়ে বলে
” আপনি খাইয়ে দেবেন আমাকে ??”
শান ঠান্ডা গলায় বলে
” হ্যা চুপচাপ খেয়ে নাও।” বলে সোহাযে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মুখে খাবার ঢুকিয়ে দেয়। সোহা চুপচাপ খেতে থাকে। খাওয়া শেষ করতেই নিলা আর সিমি এসে উপস্থিত হয়। নিলা সোহার হাতে একটা মেডিসিন দিয়ে বলে
” নাও সোহা মনি খেয়ে নাও এটা।” সোহা পিলটার দিকে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে বলে
” কিসের ঔষধ এটা ??” নিলা টেবিল থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে গ্লাসটা সোহার হাতে দিয়ে বলে
” এটা তোমার ভাইয়া দিয়েছে এটা খেলে নাকি তোমার ভালো লাগবে আর ঘুমও হবে ভালো।” সোহা ঔষধটা খেলে নিলা সোহার হাত থেকে পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে বলে
” আচ্ছা তোমার ইনহেইলার কোথায় ?? তুমি সেটা সাথে রাখতে পারো না ?? সেটা থাকলে তো আজকে এতোবড় ঘটনাই ঘটতো না। কিছুটা হলেও সুস্থ থাকতে।” সোহা ইনোসেন্ট ফেস করে বলে
” আমি তো ভুলেই যাই ওইটা নিতে।” নিলা শ্বাসন স্বরে বলে
” তুমি দেখি আসলেই কেয়ারলেস একটা মেয়ে।নিজের খেয়ালটাই রাখো না অন্যকারো খেয়াল কিভাবে রাখবে তুমি ?? কালকে থেকে তোমার সব জিনিস আমি গুছিয়ে দেবো। তোমাকে এখন থেকে নাইসার মতো শ্বাসন করতে হবে।” সোহা দাঁত কেলাতেই নিলা হেসে চলে যায়। নিলা চলে গেলে শান গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।দরজা বন্ধ করে পেছনে ঘুরে দেখে সোহা বালিস হাতে নিয়ে সোফায় এসে বসে পরেছে। শান এগিয়ে এসে ভ্রু কুচকে বলে
” তুমি এখানে বসেছো কেনো ??” সোহা মুখ ফুলিয়ে বলে
” তো কি মাটিতে বসবো নাকি ??” শান সোহার কোলের উপর থাকা বালিশটা উড়িয়ে বিছানায় ফেলে দিয়ে বলে
” তুমি বিছানায় ঘুমাবে। এই অসুস্থ শরীর নিয়ে সোফায় ঘুমানোর প্রয়োজন নেই।” সোহা দাঁড়িয়ে বলে
” আপনি কি আমার সাথে ঘুমা.. মানে বেড শেয়ার করবেন নাকি ??” শান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে
” এক,দুইদিন বেড শেয়ার করলে প্রবলেম হবে না তাই করতেই পারি। তুমি ঘুমিয়ে পরো।” সোহা শানের দিকে তাকিয়ে বেডে এসে একপাশে ঘুমিয়ে পরে। শান লাইট অফ করে নিঃশব্দে অপর পাশে এসে শুয়ে পরে। দুইজনের মাঝে আরো দুইজন বাচ্চা মানুষ ঘুমাতে পারবে সেই রকম দূরত্ব বজায় রেখে দুজন ঘুমিয়েছে। কিছুক্ষণ পর সোহার ঘন ঘন নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পেয়ে শান বুঝতে পারে সোহা ঘুমিয়ে গিয়েছে। শান বিছানার একদম কিনারে ঘুমিয়েছে তাই সোহা ঘুমিয়ে গিয়েছে টের পেতেই শান এই সুযোগে একটু এগিয়ে আসে সোহার দিকে।

চলবে~ইনশাল্লাহ……..

#তুমিময়_ভালোবাসা
#পর্ব: ১৩
#লেখিকা: মার্জিয়া রহমান হিমা

কিছুক্ষণ পর সোহার ঘন ঘন নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পেয়ে শান বুঝতে পারে সোহা ঘুমিয়ে গিয়েছে। শান বিছানার একদম কিনারে ঘুমিয়েছে তাই সোহা ঘুমিয়ে গিয়েছে টের পেতেই শান এই সুযোগে একটু এগিয়ে আসে সোহার দিকে। রাতের আধারে ব্যালকনি দিয়ে আসা চাঁদের রশ্মিজাল সোহার মুখের উপর পরছে শান সোহার নিষ্পাপ চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটার মুখে আলাদা এক মায়া রয়েছে সেটা শান সবসময় দেখতে পায়। কিন্তু সিমির বিয়ের দিনে ঘটা দিন গুলো শান কিছুতেই ভুলতে পারে না। শান এবার শোয়া থেকে উঠে পরে। কোলবালিশ বের করে সেটা এনে দুজনের মাঝের রেখে শুয়ে পরে শান। কিছুক্ষণ পর নিজেও গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়।
শহরের ব্যস্ত কোলাহল যুক্ত রাস্তাঘাট,যানবাহনের শব্দ কাকের একঘেয়েমি কা কা গলার শব্দে শানের ঘুম ভেঙে যায়। কয়েক দিনের মতো আজকে আর সোহার সেই গানের শব্দে শানের ঘুম ভাঙেনি। শান মাথা ঘুড়িয়ে সোহার দিকে তাকায়। সোহা রাতে যেভাবে ঘুমিয়ে ছিলো সেইভাবেই এখনও ঘুমিয়ে আছে। শান ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সকাল ৮:৩০ বাজে। সোহা প্রতিদিন শানের আগে ঘুম থেকে উঠে যায় কিন্তু আজকে না উঠায় শান কিছুটা অবাক হয়। শান উঠে হালকা ভাবে সোহার কপালে হাত রেখে সোহার গায়ের তাপমাত্রা বোঝার চেষ্টা করে। তাপমাত্রা স্বাভাবিক দেখে শান দূড়ে সরে আসে। অসুস্থ থাকায় হয়তো আজকে দেড়ি করে ঘুম থেকে উঠছে ভেবে শান চলে যায় ফ্রেশ হতে।
অফিসের ড্রেস পরে টেবিলে এসে শান সবার দিকে চোখ বুলালো। সবাই চুপচাপ বসে আছে শানের দিকে তাকাচ্ছেও না। শান অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে চেয়ার টেনে বসে পরে। শাহানাজ বেগম ইশানকে উদ্দেশ্য করে বলে
” তোর আজকে দরকারি কোনো অপারেশন আছে ??” ইশান খেতে খেতে বলে
” না তো কেনো ??” শাহানাজ বেগম রাগান্বিত স্বরে বলে
” আর কেনো ?? কালকে যারা সোহাকে স্টোর রুমে বন্ধ করে রেখেছিলো তাদের তো শাস্তি দিতে হবে নাকি !! ওদের জন্য আমার মেয়েটা মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছে। সবগুলো ছেলে মেয়ের নামে বড়সড় একটা complain করবি আজকে গিয়ে।” ইশান দাঁতেদাঁত চেপে বলে
” হুম সেটা তো আমিও ভাবছিলাম আজকে ভার্সিটিতে যাবো। সবগুলো ছেলে মেয়েকে দেখে আসবো কারা এসব করেছে।” শান মৃদু স্বরে বলে
” আমিও যাই ভাইয়া ??” ইশান কিছু না বলে গম্ভীরভাব নিয়ে চুপচাপ খাওয়ায় মন দেয়। শান আর কিছু বললো না। ইশান খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়ায় বাইরে যেতে যেতে বলে
” যার যাওয়ার ইচ্ছা আছে আসতে পারে নাহলে অযথা গিয়ে ভির না করাই ভালো।” শান কথাটা শুনে তাড়াতাড়ি খাবার মুখে ঢুকিয়ে পানি খেয়ে দৌড়ে বেড়িয়ে যায়। সিমি ফিকফিক করে হেসে দেয় শানকে দেখে। সামির রুমে যেতে যেতে বলে
” না হেসে রুমে এসো।” সিমি নিলা আর শাহানাজ বেগমের দিকে তাকিয়ে দেখে ওরা সিমির দিকেই তাকিয়ে আছে সিমি লজ্জায় পরে যায়। দ্রুত পায়ে সেখান থেকে প্রস্থান করে। সিমি যেতেই নিলা আর শাহানাজ বেগম হেসে দেয়।

প্রিন্সিপ্যাল স্যারের রুমে হৃদয়, রিমি, প্রমা, লিমন সহ আরো নাম না জানা দুই চাঙ্গোপাঙ্গো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে এক পাশে। ইশান আর শান এসে ইতিকে নিয়ে প্রিন্সিপ্যাল স্যারের কাছে উপস্থিত হয়। ইতি সব বলার পর প্রিন্সিপ্যাল স্যার হৃদয়দের ডেকে পাঠায়। প্রিন্সিপ্যাল স্যার এখম মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে হৃদয়রা যে এমন কাজ করে বসে আছে সেটা এখনও পর্যন্ত তার কানেই আসেনি। হৃদয় ভার্সিটির ভিপির ছেলে। দুইবছরের নিতুন ভিপি হওয়ায় ইশানদের কারোর সঙ্গে তার পরিচয় নেই। ভার্সিটিতে বাবার এই পদের জন্যই হৃদয় বেশি ক্ষমতা দেখিয়ে থাকে। যদিও ইশানরা মাত্র জানলো এর পাশাপাশি হৃদয়ের বাবা একজন ব্যাবসায়ি মানুষ। প্রিন্সিপ্যাল স্যার হৃদয়ের বাবাকে ফোন দিয়ে আসতে বলেছেন তাই সবাই এখন তারই অপেক্ষায় আছে। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে হৃদয়ের বাবা এসে প্রিন্সিপ্যাল স্যারের রুমে প্রবেশ করে। প্রিন্সিপ্যাল স্যার ইশান আর শান কুশল বিনিময় করে তাকে নিয়ে বসে। হৃদয়ের বাবা হালকা হেসে বলে
” তা আজকে এতো জরুরি ডাক কিসের জন্য ?? কিছু হয়েছে নাকি ??” প্রিন্সিপ্যাল স্যার নিশ্বাস ফেলে বলে
” হয়েছে তো অনেক কিছুই। হৃদয় এতোদিন অনেক কিছুই করেছে সেসব নিয়ে আমি কোনোদিন আপনার সাথে কথা বলিনি। হৃদয়কে ডেকে একটু বুঝিয়ে বলতাম তবে হৃদয়কে আমি আজ পর্যন্ত বদলাতে দেখিনি। কালকে যেই ঘটনা ঘটিয়েছে সেটার পর আর আপনাকে আর না ডেকে থাকতে পারলাম না।” হৃদয়ের বাবা হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলে
” আমার গুনিছেলে কখন কি করে সেই সব খবরই আমার কাছে আসে। তবে কয়েকদিন ব্যস্ত থাকায় আর কোনো খোঁজ খবব নিতে পারিনি। কি হয়েছিলো কালকে ??” ইতি কালকের ঘটা সব ঘটনা খুলে বলে। হৃদয়ের বাবা রেগে হৃদয়ের দিকে তাকাতেই হৃদয় চোখ নামিয়ে নেয়। হৃদয়ের বাবা উঠে হৃদয়ের সামনে দাঁড়ায় হৃদয় কিছু বলার আগেই তিনি সজোরে হৃদয়ের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। পুরো কেবিন চুপচাপ হয়ে যায় হৃদয়ের বাবা রেগে বলে
” তোমাকে আমি এই কারণে পড়াশোনা করাচ্ছি ?? তুমি ভার্সিটিতে এসে এইসব করে বেড়াও ?? আমার ছেলের জন্য একটা মেয়ে কালকে প্রাণে মরতে যাচ্ছিলো। আমার লজ্জা করছে তোমাকে ছেলে বলতে। চলে যাও আমার সামনে থেকে !!” হৃদয় চুপচাপ কেবিন থেকে বেড়িয়ে যায় সবাইকে নিয়ে। হৃদয় বাবাকে ভয় পাওয়ায় বাবার মুখের উপর কোনো টু শব্দ করেনি। হৃদয়ের বাবা ইশান আর শানের সাথে কথা বলতে থাকে। ছেলের কাজের জন্য হৃদয়ের বাবা খুবই লজ্জিত অনুভব করে শানদের কাছে। কথা শেষ করে হৃদয়ের বাবা চলে যায়। শান আর ইশানের হৃদয়ের বাবাকে খুবই ভালো লেগেছে। হৃদয়ের বাবার সাথে কথা বলে বুঝতে পারলো তিনি হৃদয়ের মতো নয়, দুইজন দুই জাগতে মানুষ। ইতি প্রিন্সিপ্যাল স্যারের ক্রবিন থেকে বের হতেই সামনে হৃদয় এসে দাঁড়ায়। ইতি ভ্রু কুচকে বলে
” কি চাই ??” হৃদয় এগিয়ে দুইপা এগিয়ে এসে রেগে বলে
” আজ যেই থাপ্পড় টা আমার গালে পড়েছে তার প্রতিশোধ আমি তোদের দুই বান্ধবীর থেকে নেবো। খুব সাহস তাই না ?? এমন হাল করবো পরের বার সাহস দেখাতেও সাহস লাগবে।”
দুইজনের মাঝে হুট করে শান এসে দাঁড়ায়। শান হৃদয়ের বুকে হালকা ধাক্কায় দিয়ে দূড়ে সরিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে
” দূড়ে থেকে যা করার করে নাও। এই দুজনের দিকে চোখ তুলে তাকানোর দুঃসাহস করবে না। আজকে যা হয়েছে এখানেই এসবের সমাপ্তি করো নাহলে সামনে তোমার জন্যেও অনেক কিছু অপেক্ষা করছে। চলো !!” শানের শীতল গলার হুমকি স্বরুপ কথাগুলো শুনে হৃদয়ের চোখ-মুখে শক্ত হয়ে যায়। ইশান, শান ইতিকে নিয়ে চলে যায়।
সোহা ঢুলতে ঢুলতে টমিকে কোলে নিয়ে সিরি দিয়ে নামছে। নিলা দেখতে পেয়ে বিরক্তকর স্বরে বলে
” উফফ এই মেয়েটা যে বাচ্চাদের কি করে !! সোহা !! এভাবে নামছো কেনো ?? পরে হাত-পা ভাঙলে তখন ভালো লাগবে নাকি তোমার ??” সোহা সোফায় বসে হাত দিয়ে চোখের পাতা খুলে নিলার দিকে তাকিয়ে ঘুম ঘুম গলায় বলে
” ভাইয়া কালকে কি ঔষধ দিয়েছে নামটা বলবে প্লিজ ??” নিলা অবাক হয়ে বলে
” কেনো ?? তোমার খারাপ লাগছে নাকি ??” সোহা আবার চোখ বন্ধ করে সোফায় হেলান দিয়ে বসে বলে
” আরে না। পিলটা খাওয়ার পর থেকে চোখই খুলতে পারছি না আমি। শুধু ঘুম পাচ্ছে আমার।” নিলা হেসে বলে
” তাহলে তো ভালোই । তোমার ভাইয়াকে বলবো এই ঔষধ গুলো তোমাকে প্রতিদিন খাওয়াতে। তাহলে আর তোমাকে খাওয়ার জন্য আমাদের এতো পরিশ্রম করতে হবে না। তুমি তুমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই মোটা হয়ে যাবে।” সোহা মুখ কুচকে বলে
” হুহ আমি খাবো না কিছু। নাইসুকে খাইয়ে দেবো।” নিলা হেসে রান্না ঘরে চলে যায়। সোহা চেঁচিয়ে বলে উঠে
” ভাবি !! নাইসু বাবু কোথায় ??” নিলা রান্না ঘর থেকে উঁচু স্বরে বলে
” তোমার নাইসু তার বড় মামার বাসায় গিয়েছে। বিকেলে চলে আসবে।” সোহা মন খারাপ করে বসে থাকে। নাইসা আর টমি ছাড়া সময়ই কাটে এখন সোহার।

অফিস থেকে ফিরে শান রুমে ঢুকে দেখে সোহা টেবিলে মাথা রেখে গলা ছেড়ে গান গাইছে আর খাতায় আঁকাআঁকি করছে। শান ব্যাগ রেখে বিরক্তিকর স্বরে বলে
” পড়ালেখা নেই তোমার ?? সারাদিন কি করো এগুলো তুমি ?? খাতায় কি আঁকছো ??” সোহা গান গাইতে গাইতে শানের দিকে খাতা ধরে। শান ছবিটা দেখেই রেগে গেলো। সোহা আজকেও সেইদিনের মতো একটা ছবি এঁকেছে তবে আজকে সেটার সাথে একটা অদ্ভুত ছবি ছিলো। শান রেগে বলে
” তুমি আবার এসব এঁকেছ ?? এগুলো একদম ভালো লাগে না আমার তুমি জানো না ?? আর পাশেরটা কি এঁকেছ??” সোহা গান থামিয়ে মিটমিট করে হেসে হলে
” এটা !! এটা তো টমি। টমি বড় হলে ওর সঙ্গেই আপনার বিয়ে দেবো সেটারই ছবি।” শান রেগে যায় সোহার কথা শুনে। বইখাতার নিচ থেকে একটা স্কেল বের করে। সোহা স্কেল দেখে থতমত খেয়ে কিছুক্ষণ চুল থেকে পরে মিনমিন স্বরে বলে
” কি করবেন এটা দিয়ে ??” শান বড় একটা হাসি দিয়ে বলে
” এটা দিয়ে আপনাকে মারবো আমি। আমার কোনো কথাই তো শোনেন না তাই এখন এটা দিয়ে শোনাবো। এখন চুপচাপ বই খুলে পড়তে বসো নাহলে প্রথম দিনেই মার খাবা।” সোহা তাড়াতাড়ি করে একটা বই খুলে পড়তে থাকে। শান স্কেলটা সোহার চোখের আড়ালে রেখে ফ্রেশ হতে যায়।

চলবে~ইনশাল্লাহ……..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে