#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি
৫.
ব্যাচের আজ প্রথম দিন কিন্তু অন্তি ব্যাচ করলো না। কিভাবে করবে? আজ যে তার পড়ায় মন বসবে না। আজ তার খুশির দিন। দিহানের দেওয়া ধমকের কথা সে অনেক আগেই ভুলে বসেছে। মন ছটফট করছে। ইশশ! মানুষটা তবে তাকে পছন্দ করতে শুরু করেছে! নুহাশ তো তার একদম কাছের মানুষ। সে নিশ্চই মিথ্যা বলবে না! অন্তির গাল গরম হয়ে আসছে। শরীরের তাপ ও বেড়েছে। তার কি জ্বর আসছে? প্রেমের জ্বর!
ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতেই অন্তির চোখ পড়লো রাস্তার পাশের মিষ্টির দোকানের সামনে কতেক পথশিশু দাঁড়িয়ে আছে। তাদের দৃষ্টি দোকানের সামনে সাজিয়ে রাখা গরম জিলাপির দিকে। কি মিষ্টি গন্ধ! চারদিক যেন মৌ মৌ করছে ঘ্রাণে। সেদিকেই অপলক দৃষ্টি তাদের। তাদের না আছে কিছু কিনে খাওয়ার ক্ষমতা আর না আছে চেয়ে খাওয়ার সাহস। কেবল ব্যাথাতুর চোখে ট্রেতে সাজিয়ে রাখা জিলাপির দিকে তাকিয়ে থেকেই মনের ভেতরের ছোট্ট খায়েশ পূরণ করছে যেন। অন্তির মায়া হলো। এই ছোট ছোট প্রাণ গুলোর জন্য তার বুক ভার হয়ে আসে। নিজেকে শুধায়,আজ এই সুন্দর দিনে সুন্দর একটা কাজ করা যেতেই পারে!
এই রাস্তায় বড় কোনো গাড়ির চলাচল নেই। রিকশি,ভ্যান,ট্যক্সি আর মানুষের ব্যক্তীগত গাড়ি চলাচল করে। অন্তি আশপাশ দেখে রাস্তা পার হয়ে ওপাড়ে এলো। বাচ্চাগুলোর সামনে হাঁটু মুড়ে বসলো। মুচকি হেসে বললো,
‘জিলাপি খাবে?’
কথাটা শোনা মাত্রই কতক চোখ ঝলমলে দৃষ্টিতে তাকালো। মাথা উপর নিচ করে সম্মতি জানালো। তারা খাবে। অন্তি মুচকি হাসলো। দোকানিকে একজন মাঝ বয়সী মহিলা। পরনের রঙচটা শাড়ি। একমনে দাড়িয়ে তেলে জিলাপির প্যাচ দিচ্ছে।
‘একশ টাকার জিলাপি দেন তো।’
দোকানি ছোট চোখে তাকালো। আগা মাথা দেখে নিয়ে বললো,
‘জিলাপি কেজিতে বিক্রি হয়। টাকায় না।’
অন্তি বোকা হাসলো। সে কি জানে নাকি!
‘আচ্ছা এক কেজি দেন।’
দোকানি প্যাকেট এগিয়ে দিতেই অন্তি তার পার্স বের করতে করতে বললো,
‘কত হলো?’
‘ এক হাজার।’
অন্তির মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। এক হাজার!
‘এত?’
‘জিলাপির কেজি এক হাজার এই কতা সবাই জানে। দাম কমছে কিছু। মাঝে ১২০০ তে বিক্রি করছি।’
অন্তি অবাক হয়ে বললো,
‘কি বলেন চাচি? পোস্ট অফিসের পাশের দোকানটাতেও তো ২০০/২৫০ করে বিক্রি করছে!’
দোকানি মহা বিরক্ত হলো।
‘ঐগুলিনের সাথে এগুলিন মিলালে তো চলবেনা আফা। এগুলা জাফরান দিয়ে বানানো।’
অন্তি দোকানি মহিলার দিকে তাকালো। রোগা শোকা দেহে ছোট্ট একটা মুখ। চোখ মুখে লেপ্টে আছে দারুন বিরক্তি। এমন মুড নিয়ে নিশ্চই কেউ মিথ্যা বলবে না! তাছাড়া জাফরান জিলাপির দাম বেশি এটা সে জানে। মিষ্টি পছন্দ না বলে এসব চেনেনা সে।
অন্তির পার্সের এক কোণে পাঁচশ টাকার একটা নোট পড়ে আছে। এ ছাড়া আর একটা কানাকড়িও নেই তার কাছে। তার খুব অসহায় ফিল হচ্ছে। করুন চোখে দোকানির দিকে তাকালো। মহিলা যেন দেখতে পেয়েও দেখল না। থমথমে গলায় বললো,
‘তাড়াতাড়ি করেন আফা। হাতে সময় কম।’
অন্তি আশপাশে অসহায় দৃষ্টি ফেলল। বাচ্চা গুলো ততক্ষনে জিলাপির প্যাকেট থেকে জিলাপি খেতে শুরু করেছে। ওদের খাওয়া দেখে মন জুড়ালেও মাথা জুড়ালো না। চিন্তায় অস্থির সে। এতগুলো টাকা কই পাবে সে?
বিধাতা অন্তির ভাগ্য বোধহয় সোনা দ্বারা বাঁধিয়েছে। এজন্যইতো আশার আলো হিসেবে দেখা মিলল দিহান মির্জার। দিহানরা তখন এদিকেই কোনো এক কাজে আসছিলো। দিহান তার জিপ আনেনি। হেঁটেই আসছে এদিকে। দিহানকে দেখতেই অন্তির মাথায় চিন্তা যেন নিমিষেই হাওয়া হয়ে গেলো। যে মানুষটা তাকে এক দন্ড প্রশ্রয় দেয়না তাকে দেখতেই এত ভরসা পাওয়ার কারণ অন্তির জানা নেই। তবে তার বুকের উপর থেকে যেন পাথর নেমে গেল। তবে দিহান মির্জা তো সাধারণ লোক না! তার কাছ থেকে সাধারণ ভাবে সাহায্য পাওয়া যাবে না তা অন্তি বেশ জানে। সমস্যা কি? মানুষটাকে সব ভাবে মোকাবেলা করার ক্ষমতা নিয়েই তো অন্তি জন্মেছে!
অন্তি দোকানিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘ইশশ! চাচি টাকা যে বাসায় ফেলে এসেছি! চিন্তা করবেন না। ঐ যে দিহিন মির্জা! চিনেন নিশ্চই? আমি ওর ফিয়ন্সে। ওকে বললেই টাকা দিয়ে দিবে।’
অন্তি উইদআউট ফেয়ার মিথ্যা কথাগুলো বলে শ্বাস নিলো। বাপের জনমেও সে এতগুলো মিথ্যা বলেনি। দোকানি কেমন করে যেন তাকালো। বিশ্বাস করলো না নাকি? অন্তি ছোট করে ঢোক গিলল। দোকানি অবাক হয়ে বললো,
‘ফেন্সি কি?’
অন্তি ভুল শুধরে দিলো,
‘ফেন্সি নি চাচি ফিয়ন্সে। হবু বউ! বুঝেছেন?’
কথাটা বলে লাজুক হাসলো অন্তি। এটা তার অভিনয় ছিল না। নিজেকে দিহানের বউ ভাবতেই তার লজ্জা লাগে। লজ্জায় ডুব দিতে মন চায়। শ্যাম মুখখানা লাল আভায় রাঙিয়ে ওঠে।
.
.
বিশ্বাস জিনিসটা কঠিন। বরফের থেকেও কঠিন বস্তু। সহজে লাভ করা যায় না। অন্তি প্রাণপনে চাইছে দোকানি তাকে বিশ্বাস করুক। একবার বিশ্বাস করলেই চলবে। অন্তি দোকানিকে বিশ্বাস করানোর জন্য তার শেষ অস্ত্র ব্যাবহার করলো। এটাই তার শেষ চাল। এতে কাজ না হলে আজ হয়তো তাকে দোকানের থালাবাসন মেজে টাকা শোধ করতে হবে।
দিহান তাকে উপেক্ষা করবে এটা অন্তি জানে। মানুষটা কখনো একটু ভালো করে তাকায় অব্দি না। তার কাছে অপশন হিসেবে আছে কেবল এবং কেবল মাত্র নুহাশ। দিহানরা তার থেকে কিছুটা দূরেই দাঁড়িয়েছে। বয়স্ক এক লোকের সাথে কিছু নিয়ে কথা বলছে। মুখভঙ্গি খুব গম্ভীর। এটা নতুন কিছু না। অন্তির মতে দিহান এমন গম্ভীর কঠোর রূপ নিয়েই জন্মেছিল।
অন্তি হাত উঁচিয়ে নুহাশকে ইশারা করলো। একবার, দুবার, তিনবারের সময় নুহাশ তাকে দেখলো। নুহাশ তাকাতেই অন্তি হেসে হাত নাড়িয়ে হায় জানালো। উত্তরে নুহাশ ও হেসে হাত নাড়ালো। ব্যাস! অন্তির প্লান কাজে দিলো। এবার নিশ্চয়ই দোকানি তাকে সন্দেহ করবে না! অন্তি বাঁকা চোখে তাকালো।
দোকানি এক গাল হেসে বললো,
‘মাশআল্লাহ! বাবার লগে তোমারে ভালোই মানাবো।’
অন্তি লাজুক হাসলো। মাথা নিচু করে লাজুক হেসে বললো,
‘আমাদের জন্য দোয়া করবেন চাচি।’
______________
সকাল সকাল মায়ের সাথে নানুর বাড়িতে হানা দিয়েছে অন্তি। এখানে আসার নূন্যতম ইচ্ছা না থাকলেও মায়ের জোরাজুরিতে বাধ্য হয়েই এসেছে। অন্তির গ্রাম পছন্দ না। গ্রামের এই নিস্তব্ধতা তার ভালো লাগে না। তার মতো ছটফটে প্রাণ কি গ্রামের এই নিরব পরিবেশে চুপটি করে ঘাপটি মেরে থাকতে পারে নাকি?
এই গ্রামের বাতাস সুন্দর। সতেজ। শহরের বাতাস বিষাক্ত। ধোয়া আর ধুলা মিশানো অস্বাস্থ্যকর বাতাস। গ্রামে এলে কেবল সতেজ বাতাসে প্রাণ ভরে শ্বাস নেওয়া যায়। তবে মনকে ধরে রাখা যায় না। মন বারবার উঁচু উঁচু দালানে ঘেরা শহরের এক মস্তো বড়ো গুন্ডার কাছে ছুট লাগায়। মন এত বেহায়া হলে অন্তির কি করার আছে?
অন্তির মায়ের দাদা জমিদার ছিলেন। বিশাল জমিদারি ছিলো তার। সে আমলের তৈরি বারোটা কক্ষবিশিষ্ঠ দোতালা বাড়িটা আজ ও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। অন্তির নানা বাড়ির মানুষের মধ্যে জমিদারির ভাবটা আজ ও রয়ে গেছে। তাদের পোশাক আসাক, খাওয়া-দাওয়া সবকিছুতেই তার ছাপ পাওয়া যায়। অন্তির মা জমিদার ওয়াহেদুজ্জামানের একমাত্র মেয়ে। তিন ছেলের পর এক মেয়ে বলে খুব আদরেই বড়ো করেছেন মেয়েকে।
অন্তির বাবার পরিবার ছিলো হতদরিদ্র। অভাবে দিন কাটতো। অন্তির দাদু ছিলো পোস্ট অফিসের পিয়ন। অন্তি ওর বাবার কাছে শুনেছিলো তার দাদু সকল জমি বন্ধক রেখে ছেলেদের পড়াশোনা করিয়েছেন। এভাবেই তাদের উন্নতি। কিন্তু অন্তির মায়ের ব্যাপারটা ভিন্ন। তাকে অভাব ছুঁতে পারেনি। সোনার চামচ মুখে জন্ম তার। অভাব কাকে বলে তা সে জানে না। এই যে প্রতি মাসে তার নানু মেয়ের বাড়িতে মাসিক বাজার পাঠান। চাল,ডাল থেকে শুরু করে ক্ষেতের সবজি সহ নিজস্ব ঘেরের মাছ। এত এত বাজারের অর্ধেকটাই প্রিয় কাজের খালাকে দিয়ে দেওয়া হয়। অন্তির বাবার শশুরের এমন কান্ড পছন্দ না। তবুও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেন না।
বাড়িতে নানা নানু, আর মেজ মামা মামী ছাড়া কেউ নেই। বড়ো মামা মামী থাকেন অস্ট্রেলিয়া। বছর পাঁচেক হবে ওখানে পাড়ি জমিয়েছে। ছোট মামা মামী কুষ্টিয়া থাকেন। মামার বদলি ওখানে। বাদ রইলো মেজ মামা আর মামী। তারা এখানে থেকেই বাবা মার সেবা যত্ন করছে সাথে ব্যাবসা আছে মামার। ছেলে মেয়ে নেই। স্বামী, শশুর,শাশুড়ি নিয়েই মামীর জীবন চলছে।
অন্তির মেজ মামীকে ভিষণ পছন্দ। কেমন যত্ন নিয়ে মাথায় তেল মালিশ করে দেয়। কত রকম করে চুল বেঁধে দেয়! অন্তি মাঝে মধ্যে আহ্লাদ করে বল,
‘ইশশ! তুমি যে কেন আমার মা হলেনা!’
মেজ মামী তখন হাসে। শব্দ করে হাসে। বলে,
‘আমিতো তোমারই মা অন্তি!’
দেখতে দেখতেই কেমন বেলা পেরিয়ে গেল। আজ যেন সময় ফুরাতে চাইছে না। এক এক মিনিট যেন এক এক ঘন্টার সমান মনে হচ্ছে। অস্থিরতায় কাবু অন্তি কল লাগালো তন্নিকে। মেয়েটা আজ কল ধরছে না কেন?
অন্তি ব্যাচে না গেলে সেদিন তন্নির জন্য ও বন্ধের দিন। আজ অন্তি নেই তাই সেও মরার মতো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। ঘুমের সাথে তার অদ্ভুত টান আছে। ঘুম থেকে জেগে উঠলে তার আরো ঘুম পায়। ঘুমের হ্রেস কাটে ফোনের জগৎ কাঁপানো শব্দে। ঘুম ঘুম গলায় হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে তেঁতে ওঠে অন্তি।
‘মরার মতো ঘুমাস? এদিকে আমার প্রাণ যাই যাই করছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে কেমনে ঘুমাচ্ছিস? মানে কেমনে পারিস!’
অন্তির কথায় চোখ মুখ কুঁচকে তন্নি বললো,
‘তুই কেমন পরিস্থিতিতে আছিস এত মাইল দূরে থেকে আমি কেমনে জানবো?’
‘ওসব জানা জানি বাদ। শোন! এখন বেড থেকে নেমে মুখ ধুয়ে একটা রিকশা নিয়ে সোজা কলেজ মোড় যাবি। ওখানে রাগি কুমরাটাকে পেলে তার নাম্বার নিয়ে আসবি। যেমনে হোক নম্বর চাই। বুঝতে পারছিস কেমন দমবন্ধ অবস্থায় আছি আমি!’
অন্তির কথায় ঘুম সুর সুর করে পালিয়েছে। এক লাফে উঠে বসেছে তন্নি। চোখে মুখে রাজ্যের বিষ্ময় নিয়ে বললো,
‘আমি যাব দিহান ভাইয়ার সামনে? আমি? সিরিয়াসলি? তা-ও আবার নম্বর চাইতে!’
অন্তি তন্নির কথার জবাব দিলো খুব বিরক্ত ভঙ্গিতে।
‘এমন করছিস যেন তুই গেলে উনি তোকে খেয়ে ফেলবে! আশ্চর্য!’
‘ছিঃ। নাউজুবিল্লাহ! এসব খাওয়া খাওয়ির কথা আমি স্বপ্নেও ভাবি না দোস্ত। তাও আবার কিনা জিজুর সাথে! ছিঃ!’
‘উফফ! নাট অফ কর। যাচ্ছিস তো?’
তন্নি এবার কিছুটা সিরিয়াস হলো। গলার স্বর নরমাল করে কিছুটা চিন্তিত হয়ে বললো,
‘দোস্ত! আমার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা এবার বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। মানে উনার কাছে নাম্বার চাওয়া মানে বুঝতে পারছিস? আমি আমার কথা ভাবছি না। আমি জাস্ট তোকে নিয়ে চিন্তিত। এতদিনের ব্যাপারগুলো মেনে নিলেও এটা কেমন ভাবে দেখবে ভাইয়া আমি ভাবতে পারছি না। আরো একবার ভেবে দেখ!’
তন্নির কথা যুক্তিযুক্ত। অন্তির নিজের ও মনে হচ্ছে সে তার লিমিট ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তার কি এবার থামার সময় এসে পড়েছে? তার মন আর মস্তিষ্ক একে অপরের বিরুদ্ধে চলতে চাচ্ছে। মন চাচ্ছে আরো বেহায়া হতে। সকল সিমা লংঘন করে দিহান নামক পাথরকে আকরে ধরতে। কিন্তু মস্তিষ্ক বলছে থেমে যেতে। এ পথ তার জন্য নয়। পাথরে কখনো ফুল ফোটে না। আদেও কি তাই! দিহান নামক মানুষটা ছাড়া তার যে চলবে না। তার যে অন্তর পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে!
চলবে……….