#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি
২৭.
পড়ন্ত বিকেল। আকাশে সোনালী রঙের মিষ্টি রোদ ভেসে বেড়াচ্ছে। বাহিরে ছোট ছেলেমেয়েদের ছোটাছুটি আর হকারদের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। অন্তির রুমের জানালা খোলা। অন্তি খোলা জানালা থেকে বাহিরে চোখ রেখে বসে আছে। খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা ভাবছে সে। দীর্ঘসময় ধরে এক ভদ্রলোক তাকে ডেকে চলছে সেদিকে লক্ষ নেই তার। অধৈর্য হয়ে ভদ্রলোক স্কেল দিয়ে টেবিলে শব্দ করে আঘাত করতেই অন্তি চমকে তাকায়। ভদ্রলোকের মুখ থমথমে। সামনে খুলে রাখা বই বন্ধ করে দু হাত বুকে ভাঁজ করে বসেন তিনি। রয়ে সয়ে বলেন,
‘তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে? আমি যতটুকু জানি তুমি একজন ভালো স্টুডেন্ট। শুরুরদিকেও তোমার প্রতিভা দেখেছি আমি। এখন কি সমস্যা হচ্ছে? পড়াশোনায় মন নেই কেন?’
অন্তি মাথা নিচু করে চুপ করে থাকে। জবাব দেওয়ার মতো ভাষা নেই তার কাছে। অন্তিকে চুপ থাকতে দেখে ভদ্রলোক ভারী নিঃশ্বাস ফেলেন। পুনঃরায় বলেন,
‘কিছুদিন বাদে পরীক্ষা। তোমার পড়াশোনায় ফোকাস করা উচিত। আজেবাজে সকল চিন্তা থেকে বের হয়ে আসা উচিত। দরকার হলে খানিক ব্রেক নাও। কোথাও বেড়াতে যাও। তারপর পুরোদমে পড়াশোনা শুরু করো। আমি তোমার বাবাকে এ ব্যাপারে জানাবো।’
অন্তি তখনো চুপ করে নিচমিচ তাকিয়ে থাকে। সে কিভাবে স্যারকে বলবে যে, তার পরিবার তার জন্য সবকিছু আরো কঠিন করে ফেলছে। সাময়িক ব্রেক তার কোনো কিছুই পরিবর্তন করতে পারবে না।
টেবিলে খুলে রাখা চশমাটা চোখে পড়ে ভদ্রলোক চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। এক পলক অন্তিকে দেখে নিয়ে বলেন,
‘আমি তোমাকে এ সপ্তাহে পড়াতে আসবো না। এই সপ্তাহ কোথাও বেড়াতে যাও। মাইন্ড ফ্রেশ করে এসো। আজ আসি।’
অন্তি মাথা নাড়িয়ে কেবল সম্মতি জানায়। পরপর স্যারের পিছু পিছু দরজা অবদি যায়। স্যার চলে যেতে ছোট ছোট পায়ে রুমে এসে ফোন হাতে ছাদে উঠে যায়। ছাদের লোহার গেটটা ভেতর থেকে বন্ধ করে চেয়ার টেনে বসে। মিষ্টি রোদ তখন বিলিনের পথে। হালকা বাতাসে শীত শীত গন্ধ। মাথার উপর থেকে দু একটা কাক উড়ে যাচ্ছে। ছাদের রেলিংয়ে পাশের ছাদ থেকে উড়ে আসা দুটো পায়রা বসে। ধবধবে সাদা রঙের দুটো পায়রা। পাশাপাশি বসে ডানা নাড়ছে। ওরা কি প্রেমিকযুগল? সঙ্গীদের থেকে আলাদা হয়ে কিছুটা একান্ত সময় কাটাতেই এখানে এসেছে বোধহয়। অন্তি চট করে একটা ছবি ক্লিক করলো। এমন সুন্দর নিরব প্রেমিকযুগলকে ফ্রেমে বন্দী করতে মন চাইলো খুব। প্রেম সুন্দর! সেটা হোক অবলা কোনো প্রাণীর মাঝে!
আকাশের আলোটুকু ফুরিয়ে এসেছে। বিশাল আকাশ কালো চাদরে ঢেকে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। শেষ আলোটুকু ফুরিয়ে যাওয়া অবদি অন্তি অসহায়ের ন্যায় চেয়ে রইল আকাশ পানে। কোনো কারণ ছাড়াই আকাশ পানে এমন করে চেয়ে থাকতে ভালো লাগে তার। মন খারাপের এই সময়টা তাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য এই আকাশটাই রয়েছে কেবল।
হুর হুর করে ছুটে আসা শীতল বাতাসে কেপে কেপে উঠছে শরীর। অন্তি গায়ের ওড়না দিয়ে ভালোভাবে শরীর পেঁচিয়ে নেয়। শরীর সাথে সাথে বুকের ভেতরটাও শীতলতায় ছেয়ে গেছে তার। হৃদয়টা বোধহয় বরফের ন্যায় জমে গেছে। উষ্ণতা দেওয়ার মানুষটা যে হারিয়ে গেছে! অন্তি খুব করে চায় মানুষটা ফিরে আসুক। সেদিনের মতো তাকে চমকে দিয়ে ছাদে আসুক। জড়িয়ে নিক উষ্ণ ভালোবাসায়।
ছটফটে হৃদয় নিয়ে দিহানের নম্বরে ডায়াল করে অন্তি। এই বুঝি কেটে যাবে কল, রিসিভ হবে না! ভাবনায় ঢিপঢিপ করতে থাকে ছোট্ট হৃদয়। অন্তির ছুটতে থাকা শ্বাসকে রোধ করে ওপাশ থেকে পুরুষালি রুষ্ট কন্ঠস্বরটা বলে উঠলো,
‘কে রূপ?’
অন্তির শ্বাস আটকে থাকলো কয়েক মুহূর্ত। চোখ থেকে ঝুম ধারে জল গড়ালেও মুখ থেকে একটা শব্দ বের হলো না। মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পড়েছে। এতদিন বাদে প্রিয় কন্ঠস্বরটা শোনার পরও কেন তার এমন শূন্য অনুভব হচ্ছে? মনে হচ্ছে এক রাশ দুঃখ তাকে আলিঙ্গন করেছে। এই কন্ঠটা এতশত দুঃখ বয়ে আনলো কেন? কেন মাদকতা নেই এই কন্ঠে? অন্তির নিরবে ফুঁপিয়ে ওঠার শব্দটা ওপাশের মানুষটা অনুভব করলো হয়তো। এজন্যই মানুষটার কন্ঠে চঞ্চলতা প্রকাশ পেলো।
‘রূপ! কাঁদে না। এই মেয়ে? না করেছি না? শুনতে পাচ্ছ আমায়? থামো। কান্না থামাও। কথা বলো আমার সাথে। এমন করলে কল কেটে দিব কিন্ত। চাও সেটা?’
লক্ষী বাচ্চার মতো চুপ করে যায় মেয়েটা। শান্ত হয় সময় নিয়ে। দিহান ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করে তার প্রেয়সীর শান্ত হওয়ার। কান্নার আঁচ কমে এলে সে নরম গলায় বলে,
‘কাল আমি যখন সামনে আসবো তখন কাঁদবে। তুমি কাঁদবে আমি তোমায় দেখবো। কান্নাটা কালকের জন্য তুলে রাখ।’
দিহানের এমন হেঁয়ালি কথা অন্তির ভালো লাগে না। সে চাচ্ছিলো লোকটা তাকে স্যরি বলুক। এতদিনের জন্য অনুশোচনা করুক। কিন্তু তার মাঝে তেমন লক্ষণ নেই। যা অন্তিকে আহত করছে। খানখান করে দিচ্ছে হৃদয়। কতশত অদৃশ্য ছুড়িঘাতে রক্ত ঝড়ছে তার হৃদয় থেকে তা এখনো বুঝতে পারছে না লোকটা। অন্তির খুব দুঃখ হয়। অভিযোগ করতে নিলেও যেন শব্দরা আটকে যায়।
ওপাশ থেকে দিহান তার নিরবতায় ধৈর্য হারা হয়। প্রেয়সীর কোমল গলার স্বর শোনার জন্য ব্যস্ত হয় সত্তা। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলে দিহান গম্ভীর স্বরে বলে,
‘কথা বলছো না কেন? তোমার নিরবতা আমার পছন্দ না রূপ।’
‘আপনার অবহেলাটাও আমার পছন্দ না দিহান। তবুও কেন এত অবহেলা করেন আমায়?’
এমন অভিযোগে দিহানের কষ্ট হলো না। ঠোঁট কোণে হাসির দেখা মিললো। এই অভিযোগের আড়ালে লুকিয়ে থাকা যত্নটুকু সে খুব করে অনুভব করছে। তাইতো উত্তরে বলে,
‘তোমার ভালোবাসাকে খাটি করে নিতে। বুঝেছ মেয়ে?’
অন্তি ডানে বায়ে মাথা নাড়ায়। সে বোঝেনি। কিন্তু মুখে জবাব দেয় না। চোখ থেকে তখনো অনর্গল জল গড়াচ্ছে। মান অভিমানের পাঠ শেষ হলে অন্তি কান্না ভেজা গলায় আবদার করে বলে,
‘দিহান! দেখা করবো।’
‘উহু। কাল।’
অন্তি জেদ করে। একরুখে ভাবে বলে,
‘এখন। আমি এখন আপনাকে দেখতে চাই। আপনি না আসা অবদি আমি ছাদে অপেক্ষা করবো।’
‘মেয়ে! ভরসা করো না আমায়? কাল আসবো। সত্যি।’
‘আবার হারিয়ে যাবেন না তো?’
দিহান মলিন হাসে। সে তো কখনোই হারাতে চায়নি। সে বাধ্য হয়েছে। তার এ জীবনে পুরোপুরি ভাবে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাটা তীব্র। তবুও সে চায় হারিয়ে যাওয়ার আগ অবদি এই ছোট্ট মেয়েটাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে। নিজ থেকে প্রেম কুড়িয়ে আনা এই মেয়েটার হাত ছাড়তে খুব ভয় হয় তার। এজন্যই তো নিজের বিনাশ জেনেও স্বার্থপরের মত আঁকড়ে ধরার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
দিহান মুচকি হেসে মিথ্যা ভরসায় আবদ্ধ করে অন্তিকে।
‘এবার আঁকড়ে ধরার জন্য আসছি। হারিয়ে যাওয়ার অপশন নেই। তুমি কেবল আমার হতে নিজেকে প্রস্তুত করো।’
_______________
‘মাহবুব? মেয়েটার খোঁজ পেয়েছো?’
‘জ্বি না স্যার।’
‘দ্রুত খোঁজ নাও। বেশরম ছেলেটার একটা ব্যবস্থা না করলে সত্যিই শান্তি পাচ্ছি না।’
‘স্যার একটা কথা বলবো?’
‘হুম বলো।’
আপনার আর ছোট সাহেবের ভিতর অনেক মিল আছে।’
রেজওয়ান মির্জা কপাল থেকে হাত সরিয়ে ভ্রু বাঁকিয়ে বলে,
‘কেমন মিল?’
মাহবুব সাহেব সরল হেসে জবাব দেয়,
‘আপনারা দুজনেই খুব স্পষ্ট ভাষী। কথা বলতে কিছুর পরোয়া করেন না। যেমনটা ছোট সাহেব আজ বললেন। আমি হলে আমার বাপের সামনে লজ্জায় ওমন কথা তুলতে পারতাম না।’
‘বয়স কতো তোমার?’
মাহবুব সাহেব খানিক চমকায়। তার চাকরির এত বছর জীবনে কেউ তার বয়স জানতে চায়নি। এই বয়সের ব্যাপারটা তার কাছে ভিষণ অস্বস্তিকর বিষয়। তাছাড়া কারো কাছে তার বয়স জানতে চাওয়াটা ম্যানারসের বাহিরে। রেজওয়ান মির্জা এখন সেই ম্যানারলেস প্রশ্নটাই তাকে করেছে। মাহবুব সাহেব ভিষণ দ্বিধান্বিত স্বরে বললেন,
‘এইতো চল্লিশ পেরুলো বোধহয়।’
রেজওয়ান মির্জা ভিষণ অবাক হয়ে বললেন,
‘বিয়ে শাদি কবে করবে আর?’
মাহবুব সাহেব একটু লজ্জা পেলেন। নরম করে বললেন,
‘এইতো বাপজান বললেই করে ফেলবো।’
রেজওয়ান মির্জা বড়ো করে শ্বাস ফেলে বলেন,
‘আমার ছেলের নির্লজ্জতা এখন আমার কাছে গর্বের ঠেকছে। আমি গর্বিত যে আমি একটা নির্লজ্জ বাঘের বাচ্চা জন্ম দিয়েছি।’
নুহাশ বিষন্ন মনে ছুড়ি দিয়ে আপেল স্লাইস করছে। হাতের কাজের দিকে তার মনোযোগ নেই। পাশেই দিহান আড়চোখে তার কাজ পর্যবেক্ষণ করছে। যে কোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনা বশত নুহাশের হাত কেটে যেতে পারে। এক পর্যায়ে দিহান চট করে তার হাত থেকে ছুড়ি কেড়ে নেয়। এক স্লাইস আপেল গালে দিয়ে চিবুতে চিবুতে বলে,
‘দেবদাসেন ভন নিছোস কেন? কি সমস্যা?’
নুহাশ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
‘তুই শিওর রূপন্তিকে ছাড়ছিস না?’
দিহান খাওয়া থামিয়ে গভীর চোখে তাকায়। ভ্রু উঁচিয়ে বলে,
‘ধরা ছাড়ার কথা কেন আসছে?’
নুহাশ চেয়ার টেনে দিহানের কাছে আগায়ে আসে। দিহানের হাত থেকে আপেলের প্লেট টেনে নিয়ে পাশের টেবিলে রাখে। মুখভাব সিরিয়াস করে বলে,
‘সোজা পয়েন্টে আসি। আমাদের জীবনের নিশ্চয়তা নেই। তোর উপরের হামলা থেকে তো বুঝতেই পারছিস। যখন তখন লাশ হয়ে ফিরতে পারি। এমন জীবনে ওদের জড়ানো ঠিক হবে?’
দিহান সাবলীল জবাব দিলো,
‘পৃথিবীর কারো জীবনেরই নিশ্চয়তা নেই। জন্ম যখন নিয়েছি মরতে হবেই। তাই বলে ভয় পেয়ে সব ছেড়ে দেবদাস হওয়ার মতো থার্ডক্লাস লজিকে আমি বিশ্বাসী নই।’
দিহানের জবাব নুহাশকে হতাশ করলেও এক ফোঁটা আশার আলোয় জ্বল জ্বল করে ওঠে মুখ। নিঃসন্দেহে দিহানের কথায় লজিক আছে। না বুঝে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানুষ না দিহান। তারও উচিত তার জীবনের সবকিছুকে আঁকড়ে ধরা। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অন্তত যা কিছু তার সেসব কিছু তার হওয়া চাই। নুহাশ হঠাৎ করেই উৎসাহ নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। দিহান আড়চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
‘কি সমস্যা?’
নুহাস হাসে। পকেট থেকে বাইকের চাবি বের করে আঙ্গুলে ঘোরাতে ঘোরাতে বলে,
‘কোনো উইস আছে তোর? কয়েক মুহূর্তের জন্য আমাকে জিনি ভাব। আমি তোর একটা উইস পুরোন করবো। ফর ইউর এক্সিলেন্ট ওয়ার্ডস।’
চলবে………….
#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি
২৮.
‘দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে।
আমার সুরগুলি পায় চরণ,
আমি পাই নে তোমারে।
দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে।
বাতাস বহে মরি মরি,
আর বেঁধে রেখো না তরী।
বাতাস বহে মরি মরি,
আর বেঁধে রেখো না তরী।
এসো এসো পার হয়ে মোর
হৃদয় – মাঝারে।
দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে।’
পুরোনো রেডিওতে ক্যাসেটে ভাঙা স্বরে বেজে চলছে গানটা। সাহেদ প্রায় রাতেই এমন ভাবে গান শোনে। রবীন্দ্র সংগীতের প্রতি তার আলাদা রকম ঝোঁক রয়েছে। এই ঝোঁকটা কেন যেন হুটহাট করে রাতের বেলাতেই মাথা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। মৃদু শব্দের এ গান ভোর হওয়া অবদি ক্লান্তহীন বাজতে থাকবে। পাশাপাশি রুম হওয়ায় অন্তির রুম থেকে খুব স্পষ্ট শোনা যায় গানের প্রতিটা চরণ। গানের এ মৃদু শব্দ অন্তির পছন্দ না হলেও সে রাতে তার ঘুম হয় ভালো। তবে আজ অন্তির চোখে ঘুম নেই। দিহানের সাথে কথা হওয়ার পর থেকেই কেমন অস্থিরতার মধ্য দিয়ে তার সময় যাচ্ছে। আশ্চর্য জনক ভাবে আজ বাবার রুম থেকে আসা মৃদু গানের শব্দটা তার বিরক্ত ঠেকছে না। বরং অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছে।
অন্তির রুমে ছোট একটা বুক শেলফ আছে। হাতে গোনা কতেক বই তাতে। এই বইগুলো তার ষোলতম জন্মদিনের উপহার হিসেবে তখর বাবা দিয়েছিলো। কিন্তু কখনো পাতা উল্টে দু লাইন পড়া হয়নি তার। আজ এতদিন বাদে বুক সেলফ থেকে তার একটা বই পড়তে মন চাইলো। বইয়ের মলাটে এক আঙুল সমান ধুলা জমেছে। কতদিন সেলফ পরিস্কার করা হয়না তার ঠিক নেই। পারুটা শুধু কাজে ফাঁকি দেয়। ওর নামে বিচার ঠুকতে হবে। নাহার জানতে পারলে এক চুল ছাড় দেবে না।
অন্তি যে বইটা পড়তে নিয়েছে তার নামটা বড়ই অদ্ভুত। ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’। কোথায় যাবে মেঘ? অন্তির উপন্যাস পড়া হলো না। এসবে তার আগ্রহ সবসময় শূন্যের কোঠায়। তবুও খুব সময় নিয়ে সে ভূমিকা পড়লো। বই বন্ধ করে যত্নে তুলে রাখলো পূর্বের ন্যায়। বিছানায় পড়ে থাকা ফোনটা হঠাৎ করেই জ্বলে উঠলো। টুং করে ম্যাসেজ আসার শব্দ হলে অন্তি এগিয়ে এসে ফোন হাতে তুলে নেয়। অপরিচিত এক নম্বর থেকে ছোট্ট একটা ম্যাসেজ এসেছে।
‘নিচে আসো। অপেক্ষা করছি।’
অন্তির এই ম্যাসেজের ব্যক্তিকে চিনতে দেরী হয়না। বুকটা হঠাৎ করেই ধুক করে ওঠে। দিহান এসেছে! আজ আসবেনা বলেও এসেছে। রোকটা নিজের কথা রাখতে পারেনা। কোনো কাজ করবে না বলেও করে ফেলে। আজ আসবেনা বলেও এসেছে। সে তো এটাও বলেছে আর হারিয়ে যাবেনা, সেই কথাটা কি রাখবে?
দিহান অপেক্ষা করছে যেনেও অন্তির মাঝে দ্রুত যাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। সে সময় নিয়ে একটা সুতির শাড়ি পড়েছে। এই শাড়িটা রাতে খাওয়া শেষে মায়ের রুম থেকে চুপি চুপি এনে রেখেছিল সে। কাল এটা পড়েই দিহানের সাথে দেখা করতে যাওয়ার চিন্তা করেছিল। কিন্তু মানুষটাতো আগেই এসে পড়েছে। তাই বলে তার প্লান চেঞ্জ করা যাবে না। ইতিমধ্যে সে বেশ কয়েকবার ইউটিউব দেখে দেখে শাড়ি পড়েছে। তাই খুব একটা সমস্যা হলো না। শাড়ির রঙটা টকটকে লাল। অন্তির পড়নের জামাটা ছিল সাদা। ব্লাউজ পড়ার ঝামেলার মধ্যে সে যায়নি। পড়নের জামার উপরেই পেঁচিয়ে নিয়েছে লাল রঙা শাড়িটা। লাল সাদার কম্বিনেশনটা সুন্দর। এঅটু বেশেই সুন্দর। খুব বেশি সাজের মধ্যে ও সে যায়নি। ঠোঁটে লাল টকটকে লিপস্টিক আর চোখ ভরা কাজল। লোকে বলে শ্যাম মেয়েদের গাড় লাল রঙে মানায়না। শ্যামদের পড়তে হয় হালকা রঙ। অন্তি ওসব কথায় বিশ্বাস করে না। তার চোখে যে রঙ ভালো লাগে সে সেটাই পড়ে। এইযে সে টকটকে লিপস্টিক পড়েছে, তাকে কি জংলি টাইপ লাগছে? লাগলে লাগুক। আজ সে এভাবেই দিহানের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করবে।
ঘড়িতে তখন প্রায় একটা। অন্তি নিজের রুমের লাইট বন্ধ করে চুপি চুপি রুম থেকে বের হয়ে সবার আগে পারুর ঘরে উঁকি দেয়। সে এখন ভারী ঘুমে আছে। নাহার ঘুমের ওষুধ খেয়ে অনেক আগেই শুয়ে পড়েছে। সাহেদকে নিয়ে চিন্তা নেই। সে ঠিক এগারোটায় বিছানায় যায়। শোয়ার দু মিনিটেই ভুস ভুস শব্দ তুলতে শুরু করে।
গেটে দারোয়ান নেই। রাতের সময় তার কড়াভাবে বাড়ি পাহারা দেওয়ার কথা। কিন্তু সে সেটা না করে ছোট ঘরটায় পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। এ বাড়িতে দারোয়ানের জন্য ও ছোট একটা ঘরের ব্যবস্থা আছে। দারোয়ান কাজে ফাঁকি দিচ্ছে জেনেও অন্তি এ ব্যাপারে কিছু করতে পারবে না। নিজের ফেঁসে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে তাতে। লোহার গেটটায় বড় একটা তালা ঝুলছে। এই তালার চাবি কেবল দারোয়ানের কাছে থাকার কথা। কিন্তু অন্তির কাছেও আছে। অতি গোপনে সে এই কাজটা করেছে।
অন্তি যখন বাহিরে আসে তখন আশপাশে একটা কুকুরের ও উপস্থিতি নেই। অত্যন্ত রকম শান্ত পরিবেশ। কনকনে ঠান্ডায় দাঁতে দাঁত লেগে যাওয়ার অবস্থা। এমন শীতের রাতে অচেনা নম্বর থেকে টেক্সট পেয়ে কাঁপতে কাঁপতে দেখা করতে চলে আসাটা বোকামির পর্যায়ে ফেলা যায়। অন্তি সেই বোকামিটাই করেছে। এখন তার চোখ ফেটে পানি আসার উপক্রম। তার নিজের সিদ্ধান্তের উপর কোনো অভিযোগ নেই। দিহান আসবেনা ভাবতেই তার কান্না পাচ্ছে। তার মন খুব করে চাইছে দিহান দিহানের কথা না রাখুক। সে সত্যিই আসুক দেখা করতে। অচেনা নম্বর থেকে আসা ম্যাসেজটা দিহানের হোক।
রাস্তার ধারের ল্যাম্পপোস্টটায় কিছুদিন যাবত সমস্যা দেখা দিয়েছে। মূলত সমস্যাটা ল্যাম্পপোস্টে নয় বাল্বে। আজ কালের মধ্যেই হয়তো ডেড হয়ে যাবে। কেমন জ্বলা নেভা করতে থাকে সারাক্ষণ। এমন আলোর নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে মাথায় চক্কর দিচ্ছে অন্তির। তবুও সে দাঁড়িয়ে আছে। তার বিশ্বাস দিহান আশপাশে কোথাও আছে। লুকিয়ে তাকে দেখছে। হয়তো একটু পরীক্ষা করতে চাইছে। এই পরীক্ষায় সে একশ তে একশ পেতে চায়।
ফোনে পুনরায় ম্যাসেজ এলে অন্তি দ্রুত চেক করলে দেখতে পায় সেখানে বলা আছে,
‘সামনে আগাও। কালো রঙের গাড়িটার ঠিক পাশে যে বাড়িটা ওখানে আসো।’
অন্তির বুক ঢিপঢিপ করে ওঠে। এটা যদি দিহান না হয়? তার কি একবার কল করা উচিত? কিন্তু পরক্ষণে সে উক্ত চিন্তা ঝেড়ে ফেলে। সাহসী প্রেমিকাদের ভয় পেলে চলে না। প্রেমিককে চিনতে না পারলে সে কেমন প্রেমিকা?
বাড়ি থেকে কিছুটা দূরেই কালো রঙের বিশাল এক গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। পাশে এক তলা বিশিষ্ট একটা ভবন। যা বেশ কিছুদিন যাবত বন্ধ রয়েছে। বাড়ির মালিক পরিবার সহ বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। এতদিন বাদে সে বাড়ির গেট খোলা হয়েছে। তাও এত রাতে! অন্তির বুকের ভেতর অস্বাভাবিক হারে কাঁপছে। সে কি ভুল করছে? কিছু হয়ে গেলে সাহায্যের জন্য কাউকে পাওয়া অসম্ভব। অন্তির ভাবনার মাঝেই একটা শক্ত হাত তাকে টেনে নেয় গেটের ভেতরে। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নেয় বুকের ভেতর। হঠাৎ ঘটনায় চমকে গিয়ে নড়ে উঠতেই তীব্র ব্যাথায় কঁকিয়ে ওঠে দিহান। তার শরীরের যখম ঠিক হতে বহু দেরী। পায়ের ফ্রাকচারটার জন্য এখনো মাস খানেক লাগবে। হুইল চেয়ারে বসা অবস্থায় অন্তিকে টেনে নিতেও তার বেশ কষ্ট হয়েছে। অন্তি পুনরায় চমকে উঠে দ্রুত সোজা হয়ে দাঁড়াতে গেলে দিহান আবারো আঘাত পায়। পেটের কাছের ব্যান্ডেজটা ভিজতে শুরু করে। কিন্তু এবার সে মুখ থেকে কোনো আওয়াজ বের করে না। কেবল কাতর গলায় বলে,
‘বাসার ভেতরে চলো? সমস্যা হবে? এখানে ঠান্ডা অনেক।’
চলবে……..
#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি
২৯.
নিভু নিভু হলুদ রঙের আলো জ্বলছে ঘরটায়। বেশ বড়সড় আকারের এই ঘরটার একপাশ জুড়ে সোফা। আশপাশের অন্যকোনো আসবাবপত্র বোঝা যাচ্ছে না। সবকিছুই সাদা কাপড়ে ঢেকে রাখা। যার উপর ধুলা জমে স্থুপ আকার ধারণ করেছে। বাকি ঘরগুলো বন্ধ। দেয়ালের অবস্থা শোচনীয়। রঙ খসে খসে পড়েছে। ঘরের দুটো জানালাই বন্ধ। এই ঠান্ডায় জানালা খোলা রাখার প্রশ্নই আসে না।
অন্তি জুবথুব হয়ে বসে আছে সোফার এক কোণে। তার সামনেই টেবিলে পা তুলে আধবসা হয়ে শুয়ে আছে দিহান। নুহাশ খুব সাবধানে দিহানের শার্ট খুলে ব্যান্ডেজ পরিবর্তন করে দিচ্ছে। এই তিনজন বাদেও ঘরে আরো একজন মানবীর উপস্থিতি রয়েছে। এই মেয়েটাকে অন্তি চেনেনা। কখনো দেখেনি। দিহানদের বয়সের আশপাশে বয়স মেয়েটার। রুমের এক কোণে দাঁড়িয়ে ঘুমে ঢুলছে। নিশ্চই তাকে ঘুম থেকে তুলে আনা হয়েছে। কেন আনা হয়েছে সেটাও অন্তি জানেনা। আপাতত সে বিষয়ে তার মাথা কাজ করতে চাইছে না। মস্তিষ্ক আটকে আছে দিহানের উপর। লোকটার এমন অবস্থা কিভাবে হলো? অন্তির কষ্ট হচ্ছে ভিষণ। মন চাচ্ছে চিৎকার করে কাঁদতে। লাল হয়ে আসা সাদা ব্যান্ডেজগুলো অন্তির বুকে কাঁটার মতো বিঁধছে। অন্তি নিরবে চোখের জল ফেলছে। মুখ থেকে শব্দ বের হচ্ছে না। এর অবশ্য কারণ রয়েছে। দিহান ইতিমধ্যে দুবার ধমক দিয়েছে তাকে। শেষবার ধমকের সাথে বলেছে,
‘আর একবার যদি কান্নার শব্দ পাই, সোজা বাসায় পাঠিয়ে দিব।’
এমন একটা মুহূর্তেও মানুষটার রাগ কমেনি। সমানে ধমক দিয়ে চলছে। অন্তি দিহানকে জানে। মানুষটা ভিষণ নিষ্ঠুর। পাথুরে হৃদয়ের মানব সে। তাকে বাসায় পাঠিয়ে দিতে একবার ও ভাববে না।
দিহানের ব্যান্ডেজ ঠিক করা হয়েছে। অন্তি এখনো মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে চলছে। দিহান নিরবে বসে অন্তির কান্না দেখছে। দিহান কিছু বলছেনা দেখেই হয়তো মেয়েটা সাহস পায় খানিক। কান্নার শব্দটা বাড়ে। এ পর্যায়ে দিহান রাশভারী গলায় বলে ওঠে,
‘মেয়ে এদিকে আসো। কাছে এসো বসে তারপর কাঁদো।’
নুহাশ মুখ টিপে হাসে। একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে দিহানকে বলে,
‘এখানে আমার আর দরকার আছে বলে মনে হচ্ছে না। আমি কি এখন যেতে পারি?’
দিহান তার কথায় দারুন অবাক হয়ে বলে,
‘তোকে ধরে রেখেছে কে?’
নুহাশ জবাব না দিয়েই উঠে দাঁড়ায়। রুম ছেড়ে যেতে যেতে বলে,
‘আশপাশেই আছি। দরকার হলে কল দিস।’
যদিও নুহাশ জানে দিহানের কখনোই তাকে দরকার হবে না। কলটা সে ভুলেও দিবে না। তাকে নিজেকেই খানিক পরপর এসে দেখে যেতে হবে কোনো কিছুর প্রয়োজন আছে কিনা। এতবছরের বন্ধুত্বে এতটুকু সে চিনতে পেরেছে দিহানকে। দাম্ভিকতায় ভরপুর দিহান কখনো নিজ থেকে কারো সাহায্য নিতে পছন্দ করেনা। হোক সেটা যত জটিল পরিস্থিতি। তবে আশ্চর্য জনক বিষয় আজ দিহান তার সাহায্য নিয়েছে। অন্তির সাথে দেখা করার জন্য। ভাবা যায় দিহান মির্জা তার দাম্ভিকতা লুকিয়ে একটা মেয়ের সাথে দেখা করতে নুহাশের সাহায্য নিয়েছে! নুহাশ মিটিমিটি হাসে। বন্ধু তার খুব ভালো ভাবেই ফেঁসেছে।
দিহানদের সাথে আসা মেয়েটার নাম নুহী। দিহানদের সাথে একসাথেই পড়ত মেয়েটা। বেশ ভালো বন্ধুত্ব ওদের। দিহানের এত ক্লোজ কোনো মেয়ে ফ্রেন্ড আছে জানা ছিল না অন্তির। দূরে বসে থাকার কারণে তখন ভালোভাবে না দেখতে পেলেও এখন স্পষ্ট ভাবে মেয়েটার মুখ দেখতে পাচ্ছে অন্তি। মেয়েটা ভিষণ সুন্দরী। কত সুন্দর করে হাসে! কিন্তু সে তো অত সুন্দর না। উহু ঐ মেয়েটার ধারে কাছেও না। দিহানের আশপাশে এত সুন্দর মেয়ে থাকতে দিহান কেন তাকে পছন্দ করলো? মুহূর্তে অন্তি কথাটাকে শুধরে নিলো। দিহান মোটেই তাকে পছন্দ করেনি। সে দিহানকে বাধ্য করেছে।
‘তারপর বলো আমার বন্ধুকে কেমনে আটকালে? আমাদের ক্লাসের কত মেয়ে ওকে আঁচলে বাঁধার চেষ্টা করলো। কেউ পারলো না। তোমার মতো ছোট মিষ্টি মেয়েটা কেমনে পারলো ওকে আটকাতে? আমি সত্যিই ভিষণ কিউরিয়াস।’
নুহী নামের মেয়েটার চোখেমুখে সত্যিই কৌতুহলের ছড়াছড়ি। অন্তির এই কৌতূহল মোটেই ভালো লাগলো না। আর না ভালো লাগলো নুহী নামের এই মেয়েটাকে। ভালো না লাগার বিশেষ কোনো কারণ নেই। মেয়েটার মাঝে খারাপ লাগার মতো কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। এই না থাকার জন্যই হয়তো অন্তি তাকে মেনে নিতে পারছে না। অন্তি উপলব্ধি করলো সে এই মেয়েটাকে হিংসা করছে খুব। এই যে মেয়েটার কথায় দিহান মিটিমিটি হাসছে তাতেও তার হিংসা হচ্ছে। এতটাই হিংসা হচ্ছে যে এই মুহূর্তে তার কাঁদতে মন চাচ্ছে।
অন্তিকে এমন পরিস্থিতিতে বাঁচাতে দিহান কথা বলে উঠলো।
‘অনেক রাত হয়েছে। তোর এখন যাওয়া উচিত। নুহাশ বাহিরে আছে। ও তোকে পৌঁছে দিয়ে আসবে।’
নুহী হাসিমুখে উঠে দাঁড়ালো। ফোনের স্ক্রিনে সময় দেখে ব্যস্ত গলায় বললো,
‘সত্যিই অনেক বেজে গেছে। আসি গো পিচ্চি ভাবী। অন্যকখনো গল্প হবে তোমার সাথে।’
অন্তিও মুচকি হাসে। ভদ্রতা বজায় রাখতেই বলে,
‘আবার কখনো দেখা হলে অনেক কথা হবে আপু। ভালো থাকবেন।’
নুহী চলে যাওয়ার পর পরিবেশ নিরব। দিহান কিছু না বলে কেমন গভীর দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে আছে। অন্তির অনেক কিছু বলার আছে। অনেক কিছু জানার আছে। এভাবে বসে থাকলে কিছুই জানা হবে না। অন্তি দিহানের কাছ ঘেঁষে বসে। আলতো হাতে দিহানের মাথার ব্যান্ডেজে হাত বুলায়। ভীতু স্বরে বলে,
‘অনেক ব্যাথা?’
দিহান ডানে বায়ে মাথা নাড়ায়। তবুও অন্তির চোখ ভরে আসে। চোখের পাপড়ি ভিজে ভারী হয়ে আসে। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকাতে চায় মেয়েটা। দিহান হাত বাড়িয়ে চোখের জলটুকু মুছে দেয়। কোমল গলায় বলে,
‘টাইম আপ রূপ। এখন আর কাঁদা চলবে না। তুমি কাঁদলে আমি সুস্থ হবো কিভাবে?’
অন্তি নাক টানে। কান্না আটকাবার চেষ্টা করে। ইতিমধ্যে শ্যাম মুখখানি লাল বর্ণ ধারণ করেছে। দিহান হঠাৎ করেই হাঁসফাঁস করে ওঠে। অন্তির কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে,
‘তোমাকে লোভনীয় লাগছে রূপ! তোমার এখন ফিরে যাওয়া উচিত। আমার ভেতরের দুষ্টু সত্তা তোমার লোভনীয় রূপ সহ্য করতে না পেরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।’
কান্না ভেজা চোখ দুটো লজ্জায় নিভে আসে। কান গরম হয়ে ওঠে। নিমিষেই কান্না লজ্জায় রূপ নেয়। দিহান ঠোঁট কামড়ে হাসে। পাশ থেকে ফোন তুলে সময় দেখে চিন্তিত ভঙিতে নুহাশকে কল করে। নুহাশের ফিরতে পাঁচ মিনিটের মতো লাগবে।
‘এভাবে প্রতিদিন দেখা করবেন?’
অন্তির কথায় দিহান কিছুটা গম্ভীর জবাব দেয়,
‘এভাবে আর দেখা করা হবে না। দিনের বেলা সুযোগ করে দেখা করবো।’
অন্তি মন খারাপ করে মাথা নামিয়ে ফেলে। কিছু একটা ভেবে চট করে বলে,
‘চলুন বিয়ে করে ফেলি।’
‘করবো।’
‘আজই চলুন।’
‘আমার আরো কিছুটা সময় লাগবে রূপ। নিজেকে একটু গুছিয়ে নেই।’
অন্তির মন খারাপ হয়। দিহানের থেকে এমন উত্তর সে আশা করেনি। দরকার হলে তারা কুঁড়েঘর থাকবে। তবুও দিহানের উচিত ছিল রাজী হওয়া। অন্তির মনঃক্ষুণ্ণ হয় এতে।
‘বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে।’
দিহান ছোট করে বলে,
‘জানি।’
এই উত্তরটা অন্তিকে আরো কষ্ট দেয়। দিহান জেনেও চুপ করে আছে। সে কি চায় অন্তির অন্যকারো সাথে বিয়ে হয়ে যাক? অন্তির চোখে অভিমানের জল আসে। গলায় একরাশ বেদনা নিয়ে সে বলে,
‘আপনি আমায় ভালোবাসেন না দিহান। একদম বাসেন না।’
‘কখনো বলেছি সেটা?’
‘ভালোবাসেন সেটাও বলেননি।’
দিহান থামে। সে বুঝেছে মেয়েটার মাঝে জেদ চেপেছে। কথায় সমাধান হবে না। দিহান অন্তির মুখ ঘুরিয়ে চোখে চোখ রেখে তাকায়। বলে,
‘আমি সুস্থ হলে বিয়ে করবো। মাত্র কিছুদিনের ব্যাপার। এই কটা দিন একটু মানিয়ে নাও?’
অন্তি দিহানের নরম গলার কথা ফেলতে পারে না। দিহানের এই রূপটা বরাবর তাকে কাবু করে ফেলে। এবারো হলো তাই। ইচ্ছে থাকতেও সে জোর গলায় বলতে পারলো না যে আমার খুব দ্রুত আপনাকে চাই। আপনাকে ছাড়া দমবন্ধ লাগে আমার।
_____________
তন্নির বড় বোনের নাম তানিয়া। সরকারি একটা কলেজে অনার্স করছে। স্বভাবে সে কিছুটা তন্নির মতোই। শান্ত সভ্য। কিন্তু এই স্বভাবটা কেবল পরিবারের মানুষের সামনে। বাস্তবিক ভাবে সে ভিষণ অশান্ত প্রকৃতির মানুষ। ভাঁজা মাছ উল্টে খেতে না পারা টাইপ রূপের আড়ালে যে রূপটা আছে সেটা কেবল তন্নি একা জানে। নরম মনের দয়ার মানুষ হওয়ায় বোনের রাজ জানা সত্ত্বেও মুখ ফুটে রা উচ্চারণ করা হয়নি কখনো। এইতো কিছুদিন পরপর দুবোন ঘুরতে যাবে বলে বের হয় তারা। এ ব্যাপারে তাদের বাবার উৎসাহ একটু বেশি। দুই মেয়ে মাঝে মধ্যে একসাথে ঘুরতে বের হবে এতে মাইন্ড ফ্রেশ হবে। আলাদা রকম একটা ব্যাপার স্যাপার আছে। খুশি হয়ে হাজার দুয়েক টাকা বড় মেয়ের হাতে গুঁজে দেন তিনি। কিন্তু এই টাকার শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ ও ভাগে পায় না সে। বাদবাকি ঘুরতে যাওয়ার কাহিনী তো পুরোটাই যাচ্ছে তা। তন্নিকে নির্দিষ্ট একটা জায়গায় বসিয়ে রেখে প্রেমিকের সাথে পুরো দুনিয়া ঘুরে আসে সে। তন্নি কাঠের পুতুলের মতো পুরোটা সময় একই জায়গায় বসে থাকে। এজন্যই বোধহয় তার বোনটা তাকে একটু বেশিই পছন্দ করে।
আজ ও তন্নি তার বোনের সাথে ঘুরতে বের হয়েছে। তানিয়া বেছে বেছে তাকে গোলাপি রঙের একটা ওভারকোট পড়িয়েছে। সাথে হোয়াইট প্যান্ট। গলার মাফলার টাও সাদা রঙের। চুলগুলো উঁচু করে ঝুঁটি করা। তন্নি ভেবে পাচ্ছেনা বোনের ডেটে সে কেন এত সেজে যাচ্ছে।
‘কেন যেন মনে হচ্ছে ডেট টা তোমার না বরং আমার।’
তানিয়া তন্নির কানে ছোট স্টোনের দুল পরিয়ে দিতে দিতেই মুচকি হাসে। রহস্য করে বলে,
‘হতে কতক্ষণ!’
তন্নি ঠোঁট উল্টে তাকায়। না বোঝার মতো করে বলে,
‘মানে।’
‘মানে কিছুই না। ছোট মানুষের অত মানে টানে বুঝতে নেই। নিচে ওয়েট কর আমি রেডি হয়ে আসছি।’
তন্নিও বোনের কথা মেনে নেয়। তার সত্যিই অত মানে বোঝার দরকার নেই। এই পৃথিবীতে যে যত কম জানবে, কম বুঝবে সে হচ্ছে তত সুখী মানুষ। তন্নিও সুখী মানুষ হতে চায়। তাই তার জন্য কম জানা শ্রেয়।
চলবে……….