Monday, October 6, 2025







বাড়ি"ধারাবাহিক গল্প"তাহার উম্মাদনায় মত্ততাহার উম্মাদনায় মত্ত পর্ব-১৯+২০

তাহার উম্মাদনায় মত্ত পর্ব-১৯+২০

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

১৯.
রাত ঘন হয়েছে। ঝিঁঝিঁ পোকার ঝিম ধরা ডাক যেন রাতের পরিবেশকে আরো গম্ভীর করে তুলেছে। এখন মধ্যরাত। চারপাশ ভিষণ নিরব। হাইওয়ে তাদের বাসা থেকে বেশ খানিক দূরে। এজন্য মাঝে মাঝে দু একটা গাড়ির হর্ন ব্যাতীত কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। এই মধ্যরাতে অন্তি ছাদে চুল খুলে দিয়ে বসে আছে। ঘনকালো চুলগুলো রাতের আঁধারের সাথে মিশে আছে। রাতে মেয়েদের একা ছাদে উঠতে নেই, চুল খোলা রাখতে নেই, জিনে আঁচর করে। এসব তার মায়ের মুখে শোনা কথা। তার নানার বাড়ির দিকে এসব কথার প্রচলন খুব বেশি। শহরের দিকে এসব ব্যাপারে খুব একটা শোনা যায় না। এমন না যে সে এসবে বিশ্বাস করে না। তবে চার ধারণা গ্রামের সতেজ পরিবেশ রেখে জিন ভূত কখনোই শহরের ধুলামাখা এ পরিবেশে আসবে না। ভূত হলেও মাথায় ঘিলু তো আছে তাই না! তবুও কেন জানি মনের কোথাও একটা ভয় লাগছে। যদি হঠাৎ করেই ভয়ংকর চেহারার কেউ একজন এসে তার পাশে বসে? কেমন হবে ব্যাপারটা? অন্তি নাক চোখ কুঁচকে নিলো। নিজেই উত্তর দিলো,

‘ভিষণ জঘন্য ব্যাপার।’

খুলে দেওয়া চুলগুলো তৎক্ষণাৎ হাত খোপা করে কাঠের তৈরি চুলে পড়ার কাঠি গুঁজে দিলো তাতে। গায়ে জড়িয়ে রাখা ওড়নাটা দিয়ে ভালোভাবে মাথা ঢেকে নিয়ে একইভাবে বসে রইল। ভয় কিছুটা লঘু হলো বোধহয়!

সময়ের কাটা যখন তিনটার ঘরে থামলো অন্তি ব্যস্ত হাতে কাঙ্খিত মানবটিকে কল করলো। এটাই সময় তার সাথে কথা বলার। দু বার রিং হতেই কল রিসিভ হয়। অন্তি শক্ত হাতে ফোন কানে চেপে ধরে। নিদারুণ উত্তেজনায় তার মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হতে চায় না। কতশত কথা বলার আছে তার তবুও শব্দগুলো গলার কাছে এসে আটকে থাকে। শক্ত হয়ে আসা মনটা নিমিষেই ভেঙে পড়ে। কান্নায় লেপ্টে যায় চোখ। ওপাশের মানবটা তখনও নিশ্চুপ। অন্তির কষ্ট হয় খুব। লোকটা তাকে কাঁদতে শুনেও কিভাবে চুপ করে আছে? তার ভেতর সত্তা তৎক্ষণাৎ তাকে কল কেটে দিতে উৎসাহ দেয়। এমন পাষাণ পুরুষকে ভালোবেসে নিজেকে বলি দেওয়ার থেকে আরাবের মতো সুপুরুষকে বিয়ে করে সংসার করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কিন্তু অন্তির হাত অবাধ্যতা করে। শক্ত হয়ে ফোন কানে আঁকড়ে ধরে থাকে। ওপাশের মানবটির নিস্তব্ধতা তার মনের কষ্টকে যেন বাড়িয়ে তুলছে দ্বিগুণ হারে। কেটে যায় কয়েকটা মুহূর্ত। অন্তির কান্না থেমে এসেছে। দুর্বল হয়ে আসা ডহৃদয় কঠিন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার জোগাড় করতেই অপাশের মানবটি কথা বলে উঠলো,

‘নিচে দাঁড়িয়ে আছি। আসবে?’

গম্ভীরতায় ঘেরা স্নিগ্ধ কথাটুকু কর্ণরন্ধ্রে প্রবেশ মাত্র চমকে উঠলো অন্তি। প্রিয় পুরুষটির থেকে এমন লোভনীয় প্রস্তাব পেয়ে তার উথাল মন নিমিষেই শান্ত হয়ে এলো। কি হবে? কি হতে পারে? সেসব প্রশ্নকে এড়িয়ে গিয়ে অন্তি প্রায় সাথে সাথেই জবাব দিলো,

‘আসছি।’

কল কেটে গেল। দিহান বাড়ির সামনের ল্যাম্পপোস্টের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। হাতে জ্বলতে থাকা সিগারেট রাস্তায় ফেলে পা দিয়ে পিষে ফেলল। জ্বলতে থাকা লাল আগুন নিভিয়ে গেলো নিমিষে। দু মিনিটের মাথায় অন্তি নেমে এলো। ল্যাম্পপোস্টের হলদে আলোতে সে মেয়েটার ভেঙে যাওয়া মুখখানা দেখলো। বুকের বা পাশটা খানিক জ্বলে উঠলো। কেমন মলিন হয়ে এসেছে আদুরে মুখটা। চঞ্চল চোখদুটো কেমন ডেবে গেছে। দিহানের মুখ শক্ত হয়ে আসে। সাহেদ নওয়াজ খানকে সে অবশ্যই এর সুন্দর সাজানো জবাব দিবে।
দুদিন বাদে মানুষটাকে চোখের সামনে দেখতেই কান্নার ভেঙে পড়ে অন্তি। আশপাশে না তাকিয়ে এক ছুটে এসে বিশাল দেহী শক্ত বুকে আছড়ে পড়ে। দুহাতে শক্ত করে পিঠের শার্ট আঁকড়ে ধরে। দিহান শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বাঁধা দেয়না তবে আঁকড়েও নেয় না। পাঁচ মিনিটের মাথায় অন্তি শান্ত হয়ে আসে। তবে মাথা তোলে না বুক থেকে। নড়াচড়া না করে ওভাবেই বুকের সাথে লেগে থাকে। দিহান হাত ঘড়িতে সময় দেখে। তিনটা বেজে বত্রিশ মিনিট। তার শরীরের সাথে লেপ্টে থাকা ছোট্ট শরীরটাকে সরাতে চাইলে তা সরতে চায়না। দিহান দ্বিতীয়বার আর চেষ্টা করে না। কেবল ভারী শব্দে বলে ওঠে,

‘এভাবে আমাকে পাবে না তুমি রূপ। আমাকে পেতে হলে তোমাকে আমাকে জয় করতে হবে। আমাকে জয় করা তোমার জন্য মোটেই সহজ হবে না। আমার গোটা তোমাকে চাই। তোমার প্রতিটা অংশে আমি আমাকে চাই। তোমার জীবনে আমার আগমনটা অন্য সবার মতো হবেনা রূপ। আমি ধ্বংসের আগুন। যে কোনো সময় প্রলয় ঘটাতে পারি। তুমি কি নিশ্চিত আমায় সবভাবে গ্রহণ করতে পারবে তুমি?’

অন্তি মাথা উঁচু করে দিহানের চোখে তাকায়। এত ভারী শব্দ বোঝার ক্ষমতা তার নেই, তবে এই পুরুষটার প্রতি তার ভরসা আছে। এজন্যই তো সে এতো ভালোবাসে। বারবার অবহেলা পাওয়ার পরও ভালোবাসে। অন্তি নাক টেনে জবাব দেয়,

‘আমি অলরেডি আপনাকে গ্রহণ করেছি। আপনার নাক উঁচু স্বভাবের কথা জেনেও গ্রহণ করেছি। আর কি চাই?’

না চাইতেও দিহান হেসে ফেলে। মুচকি হেসে বলে,

‘এবার ঠিক আছে। এতক্ষণ তোমাকে অপরিচিত লাগছিলো। এখন মনে হচ্ছে না আসলেই তোমায় চিনি আমি। আমার হরিণ চোখি রূপরাণী!’

প্রিয় মানুষদের ডাকা প্রতিটা নাম সুন্দর। সবথেকে সুন্দর দিহানের ডাকা এই রূপ নামটি। যা সবার থেকে তাকে আলাদা করে রাখে। তাকে এ নামে কেউ ডাকে না। নিঃসন্দেহে লোকটার সাইকোলজি সম্পর্কে ভালো ধারণা আছে।

‘এভাবেই জড়িয়ে ধরে থাকবে? তোমার এখন বাসায় যাওয়া উচিত। আর নয়তো আমাকে সাথে নিয়েই চলো!’

অন্তি সাথে সাথে দিহানকে ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে দাঁড়ায়। সে বেমালুম ভুলে বসেছিলো যে সে দিহানকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণ লজ্জা না পেলেও এখন ভিষণ লজ্জা লাগছে। দিহান ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হাসে। বাকা চোখে তাকিয়ে বলে,

‘তুমি ভয়ংকর মেয়ে রূপ। নিজ থেকে কাছে এসে নিজেই লজ্জায় লাল নীল হয়ে যাও। আমার বুঝি লজ্জা নেই?’

অন্তি মুখ বাঁকিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে লোকটা তাকে লজ্জা দিতে দিতে মেরেই ফেলবে। সুযোগ সন্ধানী লোক কিনা! সুযোগ পেতেই জোঁকের মতো আঁকড়ে ধরে। অসভ্য লোক।

_____________

অন্তিদের বাড়িতে যে মেয়েটা কাজ করে ওর নাম পারু। ঘরের কারো সাথেই তার তেমন সখ্যতাপূর্ন সম্পর্ক নেই। বিশেষ করে নাহারের সাথে। প্রতিদিন টুকটাক ঠুকোঠুকি লাগবেই। এতসব জেনেও সাহেদ ওকে কাজের জন্য রেখে দিয়েছে। তার মতে মেয়েটা একটু অকাজের হলেও মন ভালো। মানুষ হিসেবে সৎ। কিন্তু তার সেই আস্থাকে ভেঙে দিয়ে পারু দিহানের গুপ্তচর হয়ে কাজ করছে। ঘরে কি হচ্ছে না হচ্ছে তার সবটাই তো তার জানা। সেই কথা কাউকে বলায় যদি মোটা অংকের টাকা মেলে তাতে দোষের কি?

‘বইলেন না ভাইজান! আফারে চাচি যেমনে কয়দা থাপ্পর মারছে আফায় মাতা ঘুরাই পইরা গেলো। আফায় শক্ত মানুষ। আফার জায়গায় আমি থাকলে প্রত্তম থাপ্পরেই ফিট খাইতাম।’

‘পুরোনো কথা বাদ। নতুন করে কি হইছে সেইটা বল।’

‘নতুন কইরা আর কি হইবো। আফার বাইরে যাওন বন্দ হইছে। এইডা অবশ্য ভালোই হইছে। মাইয়া মানুষের বাইরে না যাওন ভালো।’

দিহান বিরক্ত হয়ে বলে,

‘ভালো খারাপ আমি বুঝবানি। ফোন রাখ। দরকার ছাড়া কল দিবিনা। নয়তো থাপ্পরের আগায় মাথায় তোকে ফিট খাওয়াবো।’

পারু কিছু না বললেও মুখ বাঁকায়। শুধু কয়টা টাকা পায় বলে কিছু বলেনা নয়তো মানুষ হুমকি ঝুমকিকে পারু ভয় পায়না। হুহ। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই যে সে দারুণ খবর জানালো তাতে কোনো শুকরিয়া নেই মানুষদের।
তখনি নাহার ডাকলো তাকে।

‘পরাটা করতে হবে জলদি ময়দা মেখে নে তো পারু। আমি ভাজি বসায় দিচ্ছি।’
.
.
তন্নির দিন খুব খারাপ কাটছে। অন্তিকে‌ ছাড়া একা একা তার দিন কখনোই ভালো কাটে না। এই যে আজ সে একা একা ব্যাচে গেলো, কোনো ম্যাথ তার মগজ অবদি পৌঁছায়নি। সবকিছু মাথার দু ইঞ্চি উপর থেকে চলে গেছে। ব্যাপারটা নিঃশন্দেহে ভয়ানক। অন্তির বিয়ে শাদি হয়ে গেলে তার কি হবে? আর যাই হোক একজন গ্রাজুয়েট মা হতে গেলেও তাকে অন্তত পড়াশোনা করে পরীক্ষায় পাশ করতে হবে। কিন্তু এভাবে চললে তার কিভাবে হবে?

এসব ভাবতে ভাবতেই কল করলো অন্তিকে। অন্তি তখন সবে ঘুম থেকে উঠেছে। তন্নির কল দেখে ফোনটা ওভাবেই ফেলে রাখলো। কিন্তু তন্নি থেমে যাওয়ার মেয়ে নয়। সে আবারো কল লাগালো। অন্তি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন তোলে।

‘দোস্ত কলেজে আসতেছিস তো? পেটের মধ্যে গ্রুম গ্রুম করছে। তুই না আসলে হচ্ছে না।’

‘কি হচ্ছে না? ওয়াশরুমে যা। পেটের ময়লা ফেলে দে। আর গ্রুম গ্রুম করবে না।’

‘এটা ওয়াশরুমে ফেলা চলবে না দোস্ত। পেটে কথা জমে আছে। চাইলেও ওয়াশরুমে ফেলতে পারছি না। কলেজে চলে আয়।’

‘হুম। এখন কল রাখ।’

সকাল সকাল ফুরফুরে মেজাজে জল ঢেলে খুব গদগদ ভাবে কল কাটলো তন্নি। অন্তি আস্তধীরে বিছানা ছেড়ে নামলো। রাতের ঘটনা মনে পড়তেই ভালোলাগা ছড়িয়ে পড়লো। তার রাগি কুমরাটা ফাইনালি তার কাছে ধরা দিলো! এই খুশিতে তন্নিকে একটা ট্রিট দেওয়া যেতেই পারে।

অন্তিকে হাসিখুশি ভাবে নাস্তার টেবিলে বসতে দেখে নাহার খানিক অবাক হলো। মেয়ে তো তার দেবদাসী হওয়ার পথে ছিলো। হঠাৎ এ পরিবর্তন কিসে? কিন্তু মেয়ের মুখে হাসি দেখে সে এসব ভাবনা দূরে ঠেলে দিলেন।

‘পরাটা দেই? নাকি নুডুলস করে দিবো?’

‘যেটা আছে সেটাই দাও।’

চলবে…..

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

২০.
পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে চলেছে। কেউ বাদররের মতো লাফঝাপ করে কেউবা মেধা দিয়ে। কিন্তু অন্তির সাথে ঘটা আশ্চর্য জনক ঘটনাটা ভিন্ন। অন্যসকল দিনের মতো আজও কলেজ ছুটি হলে তন্নির সাথে গল্প করতে করতে কলেজ গেটের পাশে দাঁড়ানো হয়। অসম্ভব ব্যস্ত রাস্তার ধারে কুঁচকানো কপাল নিয়ে অতিব বিরক্ত মাখা মুখে তন্নির কথার হুঁ হা জবাব দিচ্ছিলো সে। বিরক্তিটা মূলতো কাঙ্খিত কোনো রিকশা খুঁজে না পাওয়ায়। এ শহরে রিকশার সংখ্যা অসংখ্য হলেও তার প্রয়োজনে তাদের দেখা মেলা ভার হয়ে পড়ে। এই যে ত্রিসীমানায় রিকশার টিকিটাও দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু অন্যসব সময় ‘আপা যাবেন কোই?’ প্রশ্ন শুনতে শুনতে হাঁটার মুডের ধফারফা হয়ে যায়। বাসা থেকে হেঁটে না যাওয়ার কড়া নিষেধ রয়েছে। এটা তার জন্য তার মায়ের তৈরি নতুন নিয়ম। আজ সকালেই বাবার মাধ্যমে তার সামনে পেশ করা হয়েছে। অন্তিও দ্বিমত করেনি। এসব ছোটখাটো ব্যাপারে সে মাথা খাটানো বন্ধ করে দিয়েছে বেশ কিছুদিন হয়েছে।
অন্তি বিরক্তে কুঁচকে আসা ভ্রুজোড়া আরো কিছুটা সংকুচিত করে বলে ওঠে,

‘আজ কি রিকশা ওয়ালাদের সরকারি ছুটি? আশ্চর্য!’

তার কথায় তন্নিও সমান ভাবে হতাশা প্রকাশ করে। পরক্ষণে কিছু মনে পড়েছে ভাব নিয়ে বলে,

‘দোস্ত? দিহান ভাইকে কল লাগা। দু মিনিটে রিকশা হাজির হয়ে যাবে। পাক্কা!’

তন্নির আইডিয়া অন্তির পছন্দ হলো না। থমথমে জবাব দিলো,

‘সামান্য রিকশার জন্য তাকে কেন লাগবে? আই ক্যান হ্যান্ডেল ইট!’

তন্নি বিপরীতে কিছু বলতে নিবে তার পূর্বেই ফরমাল গেটআপে একজন সুদর্শন পুরুষ এসে তাদের সামনে দাঁড়ায়। অপরিচিত কাউকে এভাবে সামনে দাঁড়াতে দেখে তন্নির কন্ঠনালি ওখানের বন্ধ হয়ে যায়। অন্তি তখনো ব্যাপারটা খেয়াল করেনি। তন্নির হাতের চিমটিতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই ব্যাপারটায় সেও খানিক ঘাবড়ে যায়। এভাবে অচেনা কেউ সামনে অদ্ভুত নজরে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে অস্বভাবিক। অন্তি মুহূর্তের মধ্যে বুঝে নেয় লোকটা নিঃসন্দেহে তন্নির কোনো সিক্রেট প্রেমিক। রূপবতী মেয়েদের অনেক প্রেমিক থাকে, হোক সেটা গোপনে কিংবা প্রকাশে। লোকটার চোখ ঘুরিয়ে বারবার তন্নির দিকে তাকানোর ব্যাপারটায় আপাতত তার সেটাই মনে হচ্ছে। কিন্তু ভদ্র সমাজে দাঁড়িয়ে লোকটার এমন অভদ্রের মতো আচরণ অন্তির পছন্দ হলো না। কাউকে পছন্দ হলেই বুঝি কথা বার্তা ছাড়া এভাবে মুখের সামনে এসে দাঁড়াতে হয়? কথায় ভদ্রতা ধরে রাখতে চেয়েও অন্তি ব্যার্থ হলো। কিছুটা রুক্ষ কন্ঠে বলে উঠলো,

‘আপনাকে দেখে যথেষ্ট ভদ্র মনে হলেও আপনার কাজে তা চরম অভদ্রের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। তো এখানে কি চাই?’

এতক্ষণে লোকটা পুরোপুরি ভাবে অন্তির দিএ তাকায়। মোটা গ্লাসের চশমা গলিয়ে কিছুটা কৌতুহলি দৃষ্টি ফেলে বলে ওঠে,

‘আপনাদের মধ্যে রূপন্তি কে?’

পরপর তন্নির দিকে ইশারা করে বলে ওঠে,

‘বাবার বর্ণনা মতে অত্যন্ত চমৎকার দেখতে বলতে তাকে মনে হলেও কথার ধরণটা আপনাকে ইঙ্গিত করছে। আ’ম কনফিউজড!’

লোকটার কথার সারমর্ম বুঝতে না পারলেও তাকে কেন খোঁজ করছে ব্যাপারটায় ভিষণ কৌতুহল বোধ করলো। সে কিছু বলার আগেই তন্নি উঠলো,

‘কনফিউজড হওয়ার কি আছে? আমরা দুজনেই রূপন্তি। এবার ঝটপট বলে ফেলুন কি চাই?’

তন্নির জবাবে লোকটা মুচকি হেসে জবাব দিলো,

‘তাহলে তো বেশ হয়। ওয়াইফ হিসেবে আমার দুজনকেই পছন্দ হয়েছে।’

তন্নি‌চুপ হয়ে যায়। দেখতে সভ্য মনে হলেও লোকটা চরম অসভ্য। অন্তির হঠাৎ টনক নড়ে। সে সন্দিহান গলায় বলে,

‘আপনি আরাব?’

‘এতক্ষণে চিনতে পারলেন! যাক চিনতে পেরেছেন তাতেই খুশি আমি।’

‘কিন্তু এখানে কেন এসেছেন?’

‘আপনাকে দেখতে। অবশ্য অনেক দিন ধরেই আসার‌ প্লান করছিলাম, কিন্তু সময় করে উঠতে পারিনি। আজ কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হওয়ায় ভাবলাম আপনাকে ছোটখাটো একটা চমক দেই!’

আরাব লোকটাকে অন্তি মোবাইলের মাঝে দেখে যেমনটা ভেবেছিলো লোকটা পুরোটাই তার ভিন্ন। যথেষ্ট সুন্দর হলেও লোকটা ভিষণ রকম ফ্লার্টি। কথার ধরণেই তা প্রকাশ পাচ্ছে। ছবিতে চোখে চশমা ছিলো না। কিন্তু বাস্তবে মোটা গ্লাসের চশমা চোখে থাকায় চিনতে পারেনি। এরকম একটা ছেলে কিভাবে তার বাবা তার জন্য পছন্দ করতে পারে? আর মা! তার মা কি জানে আরাব এমন ধরণের মানুষ? না জেনেই এই লোকটার প্রশংসায় মত্ত হয়ে পড়েছে সবাই। অন্যদিকে কোনো কিছু না জেনেই দিহানকে খারাপ চরিত্রের লোক বলে আক্ষায়িত করলো! অন্তার বুক আবারো ভারী হয়ে আসে। বিয়ের ব্যাপারটা এখনো দিহানকে বলা হয়নি। সে ভেবেছিল তাকে ভয় দিতে তর বাব মা অমন বলেছিলো কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তাদের কথা সত্যি ছিলো, মাঝখান থেকে তাদের উপর বিশ্বাস করে সে নিজেই বোকা সাজলো।

‘কি ভাবছেন এতো? চলুন কোথাও বসি?’

অন্তি সরাসরি না করে দেয়।

‘আজ হচ্ছে না। দুঃখিত। আমার একটু কাজ রয়েছে।’

‘কি কাজ?’

অন্তি কিছুটা বিরক্ত গলায় জবাব দেয়,

‘এটা পার্সোনাল। আল্লাহ হাফেজ।’

তন্নির হাত শক্ত করে ধরে সামনে হাঁটা দিতেই চোখ পড়ে রাস্তার ওপারে। দিহান বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাইকটা নুহাশের। তবে আশপাশে নুহাশকে দেখা যাচ্ছে না। লোকটা সরু চোখে তাকিয়ে আছে।

‘দোস্ত! কথা বলবি না? তোর দিকেই তাকাই আছে।’

‘উহু। আমার থেকেও তার ওতবড় বুকে ভয় বেশি। রাস্তার মাঝে তার সাথে কথা বলা আমার মানা। ঢং সব।’

আরাব বোকার মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে উল্টো পথে পা বাড়ায়। তাকে এভাবে ইগনোর করাটা তার সম্মানে আঘাত করেছে। কোনো মেয়ের থেকে সে এমন জবাব পায়নি। ব্যাপারটা ভিষণ অপমানজনক। এতটুকু মেয়ের কথার তেজ দেখে সে কিছুটা অবাক। যদিও তার কাছে চুপচাপ শান্ত সুন্দরী মেয়েটাকে ভালো লেগেছে খুব।

_______________

তন্নি খুব মনোযোগ দিয়ে অন্তিদের বাসার কাঠামো আকাচ্ছে। এটাকে ম্যাপ বললেই চলে। আঁকাআঁকি ব্যাপারটায় সে কখনোই ভালো না। মানুষ আঁকালে সেটাকে গরু বলেই বেশি মনে হয় দরণের দক্ষতা তার। এমন দক্ষতা নিয়ে বাড়ির ম্যাপ আঁকা বেশ চ্যালেন্জিং তার জন্য। এই চ্যালেন্জটাই গ্রহণ করেছে সে।‌ সেচ্ছায় নয়, নুহাশ নামক লোকটার গম্ভীর চাহনিতে। আজকাল তার মাথায় কিছু একটা ঘুরছে। লোকটার এমন নির্যাতনের জন্য তার নামে কেস ঠুকে দিলে কেমন হয়? পুলিশের ডান্ডির দু তিনটা আঘাতে ঠিক সোজা হয়ে যাবে। বজ্জাত লোক।
তন্নির ফোনে কল আসে। নম্বর দেখতেই তন্নি বিরবির করে বলে,

‘শয়তানের নাম নিতেই সে হাজির।’

ফোন রিসিভ না করেই ছোট ছোট পায়ে বারান্দায় যেয়ে দাড়ায়। এখন অল্প রাত। রাস্তায় মানুষের আনাগোনা খুব। নুহাশ দাঁড়িয়ে আছে তার বারন্দার নিচে। তন্নির তার আঁকা ম্যাপট ফোল্ড করে নিচে ছুঁড়ে ফেলে দৌড়ে রুমে ঢুকে যায়। কেউ তকে দেখে নিলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

রাত বেজে বারোটা। অন্তি দিহানের ফোনের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছে। রোজ নিয়ম করে এই সময়ে কল দেয় দিহান। কখনো বাসার সামনে এসে দাঁড়ায়। অন্তি তখন চুরি করে দেখা করতে যায় তার নাক উঁচু প্রেমিকের সাথে।‌ অন্তির ঘুম ভাঙে ফোনের শব্দে। ঘুম চোখে কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আদেশ আসে,

‘ছাদে আসো।’

অন্তি বুঝতে না পেরে অস্পষ্ট গলায় বলে,

‘হু?’

‘তোমার বাসার ছাদে আসো। অপেক্ষা করছি। দেরী হলে রুমে চলে আসবো। সো ফাস্ট।’

অন্তির কপাল কুঁচকে আসে। বুঝতে দু মিনিট সময় লাগে। ফোন কেটে গেছে ততক্ষনে। যতক্ষণে বুঝতে পারে তার বুক ধক করে ওঠে। এই লোক ছাদে কিভাবে আসলো? নাকি ঘুমের ঘোরে সে স্বপ্ন দেখেছে? ফোনের ডায়াল লিস্টে দিহানের নাম্বার দেখতেই শিওর হয় সে। কোনো রকম গায়ে ওড়না জড়িয়ে পা টিপে ঘর থেকে বের হয়। ছাদ পুরোপুরি অন্ধকার। লাইটটা দুদিন হলো কেটে গেছে। লোহার গেট ঠেলে ছাদে পা‌ রাখতেই তার‌ ভেতর হাল্কা ভয় লাগা কাজ করে। যদি দিহান এখানে না থাকে? এর বেশি ভাবার অবকাশ পেলো‌না সে। শক্ত একটা হাত তার নরম হাতকে আঁকড়ে ধরে তার দিকে টেনে নিলো। হাতের কঠিন বন্ধন অনুভব হতেই অন্তির বুক শান্ত হয়ে আসে। এই হতের অধিকারীকে তার চেনা। খুব বেশিই চেনা।

চলবে…….

গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ