Monday, October 6, 2025







বাড়ি"ধারাবাহিক গল্প"তাহার উম্মাদনায় মত্ততাহার উম্মাদনায় মত্ত পর্ব-১৭+১৮

তাহার উম্মাদনায় মত্ত পর্ব-১৭+১৮

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

১৭.
আবেগ, এই জিনিসটা মানুষের মধ্য থেকে বিবেগকে টেনে হেঁচড়ে বের করে আনে। সাময়িকী ভাবে জ্ঞান বুদ্ধিকে শুন্যের কোঠায় নামিয়ে আনে। অন্তি নিজেও জানে না তার এই ছোট একটা স্বীকারোক্তি তার জন্য কতটা যন্ত্রণাদায়ক হতে চলছে। তার বোকা মন খানিকের জন্য ভেবে নিয়েছিল পরিবারকে তার পছন্দের কথা জানালে তারা হয়তো সবসময়ের মতো করে তার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বলবে,

‘এতে এত কান্নার কি আছে? আমার মেয়ে যা চাইছে সেটাই হবে।’

কিন্তু এটা কেবল তার ভ্রান্ত ধারণা হয়েই থাকলো। বাস্তবটাতো ছিল ভিন্ন কিছু! তার কথা শেষ না হতেই গালে দানবীয় আঘাতে ছিটকে পড়লো অন্তি। নিমিষে কি হলো কিছুই যেন বুঝে উঠতে পারলো না সে। মাথার ভেতরটা কেমন ঝিম ধরে গেছে। এত তীব্র আঘাত এর পূর্বে কখনো সে কারো থেকে পায়নি। জল ভরা দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকাতেই তার বুকের ভেতরা কেঁপে ওঠে। নাহার অত্যন্ত শীতল দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। এত জোরে মেয়েকে আঘাত করেও তার ভেতর নূন্যতম ব্যাকুলতা দেখা গেলো না। কিন্তু অন্তির ঠিক মনে পড়ছে বেশ কিছুদিন পূর্বে অন্তি নিজ থেকে ডিম ভাজতে গিয়ে সামান্য তেল ছিটে পড়েছিল হাতে। ঠিক কতটাইনা ব্যাকূল হয়েছিলো সেদিন নাহার! চোখ দুটো ছলছল করে উঠেছিলো। তার ফুলের মতো মেয়েটার হাতের ছোট্ট একটা অংশ জুড়ে লাল হয়ে ছিলো, এ সামান্য জিনিসটা তাকে কতই ঞা পিড়া দিয়েছিল! তবে আজ? অন্তি মাথা ঘুরিয়ে বাবার দিকে তাকায়। তার বুকটা আরো ভারী হয়ে আসে। সাহেদ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। অন্তি দিশেহারা হয়ে পড়েছে যেন। কি এমন ভুল করেছে সে? এমন অদ্ভূত আচরণ কেন করছে সবাই? কেউ কিছুই বলছে না। এই নিরবতা বড্ড যন্ত্রণা দেয় তাকে। সহ্য না করতে পেরে কেঁদে উঠে বলে,

‘কি ভুল করেছি আমি? কেন এমন করছো তোমরা?’

তার এ কথার জবাব কেউ না দিলেও তার বড় চাচা গম্ভীর স্বরে তার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘আমাদের পরিবারের এ সমাজে একটা মর্যাদা আছে সাহেদ। আমাদের পরিবারের ছেলে মেয়েরা শিক্ষিত এবং সভ্য। আমরা আমাদের পরিবারের সাথে তেমনি কোনো‌ ভদ্র সভ্য পরিবারের আত্মীয়তা করবো। তোমার মেয়েকে বোঝাও। এখনো সময় আছে। সময় থাকতেই ভুল শুধরে নাও।’

সাহেদ বড় ভাইয়ের কথায় লজ্জায় মাথা নুইয়ে নেয়। জবাবা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে সে। তার এত অহংকার যে মেয়েকে নিয়ে সেই মেয়ের কারণেই কিনা আজ তাকে এভাবে মাথা নামিয়ে রাখতে হাচ্ছে। বুকটা অসহ্য জ্বলছে তার। অতি আদরে কি সত্যিই মেয়েটাকে বিগড়ে ফেলেছে সে?

শাহিন সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। যাওয়ার জন্য প্রস্তুত নিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ে।‌ ফ্লোরে গুটিসুটি হয়ে বসে থাকা অন্তিকে একবার পরখ করে বলে ওঠে,

‘তোমাকে আমি এ পরিবারের ছেলে মেয়েদের মধ্যে সবথেকে বুদ্ধিমতী একজন ভাবতাম। ভাবতাম যে যেমনটা হোক না কেন তুমি হবে একজন পারফেক্ট মানুষ। যার প্রতিটা কাজে থাকবে সকলকে মুগ্ধ করার ক্ষমতা। তোমার ভেতর সেই প্রতিভা আমি দেখেছি। কিন্তু এভাবে লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে কিভাবে? ছেলেটা তোমায় ঠিক কতদিন ধরে বিরক্ত করছে? পরিবারকে জানাওনি কেন?’

অন্তি সরল দৃষ্টিতে মুখ তুলে তাকায়। তার চোখের পানি এখনো গাল গড়িয়ে পড়ছে। চোখদ্বয় ফুলে লাল হয়ে উঠেছে। তার ক্রন্দনরত মুখ দেখে শাহিনের মনটা অস্থির হয়ে ওঠে। এই আদুরে মেয়েটার সাথে এত কঠিণতা সত্যিই বেমানান। মেয়েটাকে ভালোবেসে বোঝাতে হবে। তার রক্ত কখনো ভুল পথ বেছে নিবে না! ভাইকে নিরবে ডেকে এ ব্যাপারে কথা বলবে।
এতক্ষণ নাহার চুপ থাকলেও বড় ভাসুরের প্রশ্নে মেয়েকে উত্তর না দিতে দেখে রেগে গেলেন খুব। রূঢ় গলায় বলে উঠলেন,

‘তোমাকে এতদিন এই শিক্ষা দেওয়া হয়েছে? বড়রা প্রশ্ন করলে জবাব দিতে হয় এই সামান্য ম্যানারসটাও দেখছি ভুলে বসেছ?’

নাহার যখন খুব রেগে যায় তখন কেবল তুমি করে কথা বলে। অন্তি মায়ের কথাতেই বুঝে নিয়েছে তার রাগের পরিমাণ। কিন্তু সে নিরুপায়। বড় চাচার প্রশ্ন সে ইচ্ছা করে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল কারণ সে চেয়েও দিহানকে পরিবারের কাছে খারাপ করতে পারবে না। যে মানুষটাকে সে এত ভালোবাসে পরিবারের কাছে সে মানুষটাকে কিভাবে সে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে খারাপ করে তুলবে? সে যদি সত্যিটা বলে তবে সেটাও তার পরিবারের কেউ ভালোভাবে গ্রহণ করবে না। এসব ভেবেই সে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু আজ হয়তো ভাগ্য বা নিয়তি কোনোটাই তার সাথে নেই। অন্তি ঢোক গিলল। সরাসরি কারো চোখে চাইতে পারলো না। মাথা নিচু রেখেই বিরবির করে বললো,

‘সে কখনোই আমায় বিরক্ত করেনি।’

নাহার মেয়ের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলেন। পরক্ষণে ক্ষুদ্ধ হয়ে বললেন,

‘অনেক বড় হয়ে গেছ দেখছি! আমিতো এতদিন লক্ষ্যই করিনি আমি নিজ হাতে পালছি যে মেয়েকে সে এত বড়ো হয়ে গেছে! মিথ্যা বলতে শিখে গেছ? রাস্তার একটা গুন্ডাকে বাঁচাতে চাইছো? এত অধঃপতন! তুমি না বললেও রাস্তার ছেলেরা কেমন হয় আমরা জানি। তোমার রুচি নিচে নামলেও আমাদেরটা নামেনি। ওসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল। বিয়ের জন্য প্রস্তুতি নেও।’

এতক্ষণ চুপ থাকলেও অন্তি এবার মাথা উঁচু করে মায়ের চোখে তাকালো। ভয়হীন ভাবে প্রতিবাদ করে উঠলো,

‘তোমাদের রুচি নিচে না নামলেও তোমাদের মানসিকতা নিচে নেমে গেছে মা। না জেনেশুনে তুমি কিভাবে কাউকে বারবার রাস্তার ছেলে বলতে পারো? কতটুকু জানো তুমি তার ব্যাপারে?’

সাহেদ অবিশ্বাস্য চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। কোনো কথা খুঁজে পেলেন না তিনি। নাহার ক্ষিপ্ত হয়ে দ্বিতীয় বারের মতো থাপ্পর লাগালেন অন্তির নরম গালে। একই গালে পরপর দুবার এহেন আঘাতে গাল অবশ হয়ে পরেছে অন্তির। হঠাৎ করেই চারপাশ কেমন করে দুলে উঠলো। চোখের সামনের সবকিছু কেমন অন্ধকার হয়ে আসতে লাগলো। একসময় ওভাবেই লুটিয়ে পড়লো। নাহার শক্ত হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল। শাহিন মেঝ ভাইয়ের বউয়ের এমন ক্ষিপ্ত স্বভাবে প্রচন্ড বিরক্ত হলেন। তার সামনে তার পরিবারের মেয়েদের গায়ে হাত তোলা চুড়ান্ত রকমের বিয়াদপি। যেখানে মা নিজেই সভ্যতা জানেনা সেখানে মেয়ে কিভাবে শিখবে? শাহিন কঠিন গলায় ভাইকে বললেন,

‘রূপন্তি তোমাদের মেয়ে হতে পারে কিন্তু মনে রেখো ও এই খান বংশের একটা অংশ। তোমরা শাসন করবে তা মেনে নিব কিন্তু গায়ে হাত তোলার মতো সাহস করো কিভাবে? আমি এখানে গুরুজন থাকতে তোমার স্ত্রী কিভাবে মেয়েকে আঘাত করে? আগে নিজের স্ত্রীকে সভ্যতা শিখাও।’

শাহিন ব্যাস্ত পায়ে উপরে চলে যান। বাড়িতে ডাক্তার ডাকা হয়। তেমন কিছুই হয়নি, দুর্বলতার জন্য সেন্স হারিয়েছে। সামান্য কিছু ওষুধ লিখে দিয়ে চলে যান তিনি। নাহার মেয়ের রুমের দরজায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মা হিসেবে কি সে অনেক খারাপ? কতটা খারাপ মা হলে আঘাত করে মেয়েকে এভাবে শয্যায় ফেলে দেওয়া যায়! বুকটা হাহাকার করে ওঠে। মুখে আঁচল চেপে কেঁদে ওঠেন তিনি। সাহেদ স্ত্রীকে রুমে নিয়ে যান। মেয়েকে আঘাত করা নিয়ে কোনো কথা বলেননা তিনি। ইতিমধ্যে নাহার নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। পুনরায় তাকে এ ব্যাপারে বলে আর কষ্ট দিতে চাননি তিনি। কেবল স্ত্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছেন,

‘তোমাকে আরো ধৈর্যশীল হতে হবে নাহার। অনেক কিছুর মোকাবেলা করতে হবে কিন্তু ধৈর্য হারালে চলবে না। ধরে নাও এটা একজন মা হিসেবে তোমার চ্যালেঞ্জ।’

______________

জীবনের অতিব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় হচ্ছে বিয়ে। যেখানে বাছাই করে নেওয়া হয় একজন জীবন সঙ্গীকে। দোকানে পছন্দ হওয়া ড্রেসটার মতো করে জীবন সঙ্গী বাছাই করা চলে না। এজন্যই বোধহয় এ সমাজের বাবা মায়েরা তাদের সন্তানের জন্য সেরা জীবনসঙ্গী বাছাইয়ের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিতে চায়। হোক জোর করে কিংবা সমঝোতার মাধ্যমে। তবে উদ্দেশ্য একই; সন্তানের সুখ! তবে সন্তানের চাহিদা কেন তারা বুঝতে চায় না? কেন বোঝে না যে ভালোবাসা ছাড়া সংসার হয় না?

এ প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পায়না অন্তি। চারদিক থেকে কেবল শুন্যতায় ঘেরা এক অদ্ভুত জবাব আসে। যার অর্থ তার জানা নেই। আচারের বোয়াম হাতে ডায়নিং এ যেতেই সাহেদ মেয়ের জন্য চেয়ার টেনে দেয়। বড় করে হেসে বলে,

‘আজকের রান্নাটা ফাস্টক্লাস হয়েছে। জলদি বসেপরো। টেস্ট করে দেখো। মাংসটা কিন্তু আজ আমি রেঁধেছি। সাহেদ নওয়াজ খানের হাতের ছোঁয়া পেতেই রান্নার স্বাদ দশগুণ বেড়ে গেছে বুঝলে। হেহে!’

তাকে হাসাতে বাবার এই সামান্য প্রচেষ্টা অন্তির বিফলে যেতে দিতে ইচ্ছা হলো না। কষ্ট চেপে বাবার সাথে তাল মিলিয়ে সে ও হেসে উঠলো। ইশশ! যদি সে গতকাল ওমন বোকামি না করতো আজ দিনটা তবে ভিন্ন হতো। এইযে বাবার সাথে তাল মিলিয়ে হাসতে তার কেমন জড়তা অনুভব হচ্ছে! একই টেবিলে খেতে বসতেও কতটা জড়তা! তখন হয়তো এমনটা হতো না। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। মনের কোণে প্রশ্ন জাগে ঐ মানুষটাকি জানে তাকে নিয়ে অন্তি নামক মেয়েটার জীবনে কেমন ঝড় চলছে? জানলে সে কি করবে? রাজকুমার রূপে তাকে উদ্ধার করতে আসবে? নাকি না জানার মতো করে মুখ ঘুরিয়ে নিবে?

চলবে……..

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

১৮.
পানি ছাড়া মাছের মতো ছটফট করতে করতেই সকাল গড়িয়ে দুপুর তারপর বিকেল এলো। ঘড়িতে চারটা বাজে। ঠিক পাঁচটায় অন্তির ব্যাচ। এই সময়টার অপেক্ষাতেই চাতক পাখির ন্যায় সময়ের কাটা গুনেছে সে। এই অপেক্ষার অল্প সময়টুকু তার কাছে কয়েকশত বছরের সমান ঠেকেছে। অপেক্ষার প্রহর সত্যিই ভিষণ বড় হয়। সময়ের কাটা যেন একই জায়গায় চক্রাকারে ঘুরছে। অপেক্ষার প্রহর কাটলো দীর্ঘ সময় নিয়ে। অন্যদিনের মতো আজ আর সাজগোজ করা হলোনা। চোখে লাগানো হলোনা কাজল আর না ঠোঁটে লাল রঙ। সাদামাটা ভাবেই পোশাক পাল্টে নিলো। চুল বাঁধার সময় আয়নায় নিজেকে লক্ষ্য করতে চমকে গেলো। সে যেন নিজের এক অন্যরূপ দেখতে পাচ্ছে। একদিনেই কেমন বদলে গেছে সে। চোখ গুলো গর্তে চলে গেছে। লাবন্যময়ী চেহারা ফ্যাকাসে রূপ ধারণ করেছে। মাত্র একটা দিনের তফাৎ এ কতকিছু ঘটে গেল! কি অদ্ভুত নিয়ম জীবনের।
অন্তি রুম ছেড়ে বেরহতেই দেখলো নাহার ডায়নিং এ বসে বাদামের খোসা ছাড়াচ্ছে। সাহেদ রোজ নিয়ম করে গুটাকয়েক কাঁচা বাদাম খায়। তার হাঁটুতে ব্যাথার রোগ রয়েছে। ডাক্তার তাকে ক্যালসিয়াম জনিত সকল প্রকার খাবার খেতে বলেছেন। এ জন্যই সে এই বাদাম খান।
অন্তিকে দেখা মাত্রই নাহার চোখ কুঁচকে ফেললেন। এমন সময় কোথায় যাচ্ছে মেয়েটা তা না জানার মতো করে প্রশ্ন করলেন,

‘কোথায় যাচ্ছিস?’

এমন প্রশ্নে অন্তিও খানিক অবাক হলো। সে তো রোজ এ সময়ে ব্যাচে যায়। এটাতো নতুন কিছু না। তবুও ছোট করে সে জবাব দিলো,

‘ব্যাচে।’

নাহার ভিষণ স্বাভাবিক ভাবে বলে উঠলো,

‘ব্যাচে যেতে হবেনা আর। তোর বাবা বাসায় টিচার ঠিক করেছেন। কাল থেকে পড়াতে আসবে।’

অন্তির পা থেমে যায়। চোখে মুখে বিস্ময় খেলে যায়। অবাক গলায় বলে,

‘বাবা টিচার ঠিক করেছে? আমাকে তো জানালো না?’

নাহার বাদাম গুলো একটা কাঁচের বোয়ামে রাখতে রাখতে বেশ সাবলীল ভাবেই বললেন,

‘এখানে জানানোর কি আছে? সে যেটা ঠিক মনে করেছে সেটাই করেছে। মেয়ের ব্যাপারে বাবা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এখানে তো অস্বভাবিক কিছুই দেখছি না।’

অন্তি টু শব্দ ছাড়া রুমে ফিরে এলো। মায়ের স্বভাব সম্পর্কে সে অবগত। এইযে সে অতি স্বাভাবিক আচরণ করছে এটাও অস্বভাবিক। কিন্তু বাবা? সে তো অন্তিকে বোঝে। তাহলে সে কেন এমন অদ্ভুত আচরণ করছে? অন্তির চিৎকার করে কাঁদতে মনে চাচ্ছে। নিজের পরিবারের প্রতিটা মানুষকে তার বড্ড অচেনা বলে মনে হচ্ছে। দম বন্ধ লাগছে। কাঁধের ব্যাগ খুলে দূরে ছুড়ে ফেলে। টানটান হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। রাগে দুঃখে চোখ গড়িয়ে পানি পড়ে মেয়েটার। বা হাতে চোখের পানি মুছে কাঙ্খিত মানবটার নম্বরে ডায়াল করতেই ওপাশ থেকে নারী কন্ঠ‌ জানালো, এ মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না…
মানুষটার নম্বর রাত ছাড়া দিনের যেকোনো প্রহরে বন্ধ পাওয়া যায়। দুশ্চিন্তায় অন্তির মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। দুশ্চিন্তা‌ গুলো যেন‌ গলায় কাঁটা আকারে আটকে আছে। এত বড় ঘটনা ঘটে গেছে কিন্তু এ ব্যাপারে তন্নি বা দিহান কেউ‌ কিছু জানে না। অন্তি তন্নিকে ইচ্ছা করেই কল করলো‌ না। মেয়েটা বড্ড ভীতু ধরণের। এমন কিছু জানলে কেঁদে কেটে সাগর বানিয়ে ফেলবে হয়তো। তখন সমবেদনা পাওয়ায় চিন্তা বাদ দিয়ে তাকে সমবেদনা জানাতে হবে। তাই ঐ চ্যাপ্টার সে আগেই অফ করে দিয়েছে।

_____________

সন্ধ্যা ঘনিয়েছে। সারাদিন বাইক কিংবা জিপে করে ছুটতে থাকা ছেলে গুলোকে আজ রাস্তার প্রাঙ্গনে দেখা গেলো না। না দেখা গেলো চায়ের দোকানে আড্ডা। দীর্ঘদিনের নিয়ম ভেঙে আজ দিহান মির্জা আজ নিজেকে গৃহবন্দি করেছে। ঠিক বন্দি বলা চলে না, তার নিজ মর্জিতেই আজ সে ঘরে রয়েছে। তার এই হঠাৎ পরিবর্তন সবথেকে যে ব্যক্তিকে আশ্চর্য করেছে সেটা হচ্ছে তার মা। রেহানা এ পর্যন্ত তিন থেকে চারবার ছেলের ঘর থেকে ঘুরে গেছে। দু একবার বুকে কপালে হাত রেখে চেক করে গেছেন ছেলেটা অসুস্থ হয়ে পড়লো কিনা। চিন্তায় তার প্রেশার ফল করেছে। ছেলেটাকে নিয়ে এমনিতেই তার দুশ্চিন্তার শেষ নেই, তার উপর হঠাৎ এমন পরিবর্তন তাকে আরো চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে। দিক শূন্য হয়ে সে নুহাশকে কল করে। ছেলের কাছের বন্ধু বলতে নুহাশকেই চেনেন তিনি। তার ব্যাকুলতায় নুহাশ তাকে আশ্বস্ত করলো কিছুক্ষণের মাঝেই সে আসছে। ঠিক তাই হলো। দশ মিনিটের মাথায় আগমন ঘটলো নুহাশের। রেহানা ড্রয়িংয়ে বসে ছিলেন। কাজের মহিলা দরজা খুলে দেয়। নুহাশকে দেখতেই রেহানা তাকে হাসিমুখে ভেতরে ডাকেন। মিষ্টি হেসে বলেন,

‘তোমাকে তো দেখাই যায়না বাবা। মাঝে মধ্যে তো আসতে পারো?’

নুহাশ বোকা হাসে। সে কেন আসে না তা যদি আন্টি জানতো!

দিহানকে আজকাল কেমন অন্যধরণের মানুষ বলে মনে হচ্ছে নুহাশ। যেই ছেলে সারাদিন শুয়ে বসে থেকে আড্ডা আর রাজনীতি নামক ঝামেলায় জড়িয়ে থাকতে পছন্দ করে সে আজকাল নিজেকে আড্ডা, মারামারি থেকে দূরে দূরে রাখছে। এই তো আজ সকাল সকাল কল এসেছে পার্টি অফিস থেকে। অন্যান্য সময় কল আসা মাত্র সে প্রস্থান করে কিন্তু আজ সুস্থ সবল মানুষটা অসুস্থতার দোহাই দিয়ে থেকে গেল। দিহান মির্জাকে অবিশ্বাস করার কথা কেউ ভুলেও ভাববে না। এমন শক্ত সমর্থ এক কথার পাথুরে মানুষটাকি মিথ্যা বলতে পারে? নিজ চোখে না দেখলে হয়তো নুহাশ ও কখনো বিশ্বাস করতে পারতো না। নুহাশকে অন্যমনষ্ক দেখে দিহান ওর দিকে কুশান ছুঁড়ে মারে।

‘তোকে আমার নীতিবান বাপ দেখেনি আসতে?’

নুহাশ অসহায়ের মতো মুখ করে জবাব দেয়,

‘দেখলে তোর রুম অবদি আসার ক্ষমতা আমার থাকতো না ভাই। দরজা থেকেই জুতো হাতে পালাতে হতো। বুঝিনা ভাই আমি কি করলাম? আমার উপর এত জুলুম কেন?’

এর উত্তর দিহান খুব ভালো করেই জানে। তার পিতা মহাশয় ভাবেন তার ছোট বেপরোয়া ছেলেটা বিগরে যাওয়ার একমাত্র কারণ এই নুহাশ। এমন বাউন্ডুল ছেলের সাথে মিশেই তার সোনার ছেলে তামায় পরিণত হয়েছে। দিহান পিঠের পেছনে বালিশ দিয়ে হেলান দেয়। নুহাশের কথাকে পুরোপুরি ভাবে এড়িয়ে গিয়ে প্রশ্ন করে,

‘রূপের সাথে যে ছোট খাটো করে মেয়েটা ওর নাম যেন কি?’

নুহাশ না বোঝার মতো করে বললো,

‘কার কথা বলিস ভাই? মাইয়া মানুষের খোঁজ খবর কি আমি রাখি?’

দিহান ফিচেল হাসে। বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলে,

‘বেশ! আমি লোক পাঠিয়ে নাহয় খোঁজ নিব। ভাইয়ার জন্য মা মেয়ে দেখতে বলছে। ভাইয়া খুব চুজি জানিস তো! ভাবলাম ভাবী হিসেবে ঐ মেয়েটাকে বেশ মানাবে! মেয়েটা একদম ভাইয়ার টাইপ।’

নুহাশের মুখ কালো হয়ে এলো। এই মির্জা বংশটাই খারাপ। বাপ ছেলে কেউ তাকে সহ্য করতে পারে না। এদের কোন জমিতে আগুন দিয়েছিল সে? মন চায় গুল্লি মেরে উড়াই দিতে সব। কিন্তু মনের এসব আক্ষেপ সে প্রকাশ করলো না। মিনমিনে গলায় বললো,

‘কি জানতে চাস বললেই তো হয় ভাই। শত্রুর মতো আচরণ করোস কেন?’

দিহান সোজা হয়ে বসে। বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে জবাব দেয়,

‘ওর থেকে রূপদের বাসার নকশাটা ম্যানেজ করবি।’

কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যাওয়ায় যেমন রিয়্যাকশন হওয়ার কথা তার থেকেও ভয়ানক রিয়্যাকশন দেখা দিলো নুহাশের মাঝে। যেন সে আকাশ থেকে টুপ করে পড়ে পাতালের গভীরে হারিয়ে গেছে।

‘কি বলিস? ডাকাতি করবি ভাই?’

দিহান বাঁকা হাসে। ল্যাপটপ অন করে কোলে নিয়ে খুব মনোযোগ সহকারে কিছু একটা করতে লাগে। মাঝ পথে কথা থামানোতে নুহাশ মহা বিরক্ত হয়। দিহানের এই স্বভাবগুলো তার কাছে বড্ড অসহ্য ঠেকে। ব্যাটা যা বলবি সরাসরি বলবি। ধর তক্তা মার পেরেক টাইপের। তা না করে এত ভনিতা কেন?

‘বা*ল মেজাজ খারাপ হয় কিন্তু। ক্লিয়ার করনা ভাই।’

নুহাশ ভাবেনি দিহান এত দ্রুত মুখ খুলবে। অবশ্য আজকাল দিহানের সকল কার্যক্রম তার ভাবনার বিপরীতে হয়। এক্ষেত্রে ও তেমন হলো। দিহান ভিষণ দাম্ভিকতার সহিত জানালো।

‘না হওয়া শ্বশুর সাহেব আমার প্রেম হওয়ার আগেই বিরহের ব্যাবস্থা করতেছে। ভাবতে পারিস? এমন বোকামি কেউ করে? বাঘের সামনে থেকে খাবার টেনে নিতে চাইছে! অথচ এটাই জানেনা যে, তার মেয়েকে তুলে আনতে আমার দু মিনিট সময়ের দরকার হবে না। বোকা শ্বশুর!’

নুহাশের অক্ষিকোটর থেকে চক্ষুদ্বয় বেরিয়ে আসার উপক্রম। তার কানদ্বয় সত্যি শুনছে? নাকি সবটা ভ্রম? ব্যাটা প্রেমে পড়েছে তা সে বহুআগেই বুঝেছে কিন্তু মুখ ফুটে এভাবে শ্বশুর বলার মতো প্রেমে পড়েছে এটা তার জানা ছিলো না। মানে ব্যাপারটা এতোটা গভীরে কখন এবং কিভাবে গেলো? সে কেনো জানলো না?
দিহান নুহাশের এহেন রিয়্যাকশনে কপাল বরাবর ভাঁজ ফেলে কাঠকাঠ গলায় বললো,

‘ঠিক যতটুকু বলেছি ততটুকুই ভাব, কম বেশি ভাবতে যাবি না। নয়তো তোর পথে কাঁটা হতে দুবার ভাববো না।’

নুহাশ দমে গেলো। চিন্তা ভাবনাকে ওখানেই ছুঁড়ে ফেললো। মেকি হেসে বললো,

‘তোর শ্বশুর, তোর শ্বশুরের মেয়ে, সবই তোর। অযথা আমি ভাবাভাবি কেন করবো? নো ওয়ে। আন্টি মাংস রান্না করছে। সেটাই ভাবছিলাম। আজ না খেয়ে যাচ্ছি না। তোর নীতিবান বাপটা মাঝখান থেকে না আসলেই হচ্ছে!’

চলবে………

গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ