চোখের_বিষ – পর্ব_২

0
2557

চোখের_বিষ।পর্ব_২
#তিতিশ্মা_মুসাররাত_কুহু।

-আপনাদের অন্যের পরিবার নিয়ে লাফালাফি করতে খুব ভালো লাগে তাইনা?তাদের পারসোনাল বিষয় ঘাটাঘাটি করতে খুব মজা পান তাইনা?ঠিকাছে আজ আমিই সব খোলাসা করছি।
আপনাদের আর কষ্ট করে রহস্য উৎঘাটন করতে হবেনা।

আজ থেকে ২০ বছর আগের কথা।

রাস্তায় একটা মেয়েকে দেখে আমার চোখ ওর চোখেই আটকে যায়।
বলতে পারেন লাভ এট ফার্স্ট সাইড হয়েই যায়।ওকে এক দেখাতেই মন হারিয়ে ফেলি।

যেখানে যাই সেখানেই ওর ছবি চোখের সামনে ভাসতে থাকে।
রাতে ঘুমাতে পারিনা।
কিন্তু ওর তো আমি কোন ঠিকানাও জানিনা যে ওকে খুঁজে বের করবো।

এভাবে কেটে যায় অনেক গুলো দিন।কিন্তু ওর মায়া আমাকে ছাড়ে না।
এক দিন কলেজে বন্ধুদের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম।
আর তখনি দেখি মেয়েটা আমার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।

আমি তো খুশিতে আত্মহারা।
কিন্তু ওকে দেখতে দেখতেই ও যেন কোথায় মিলিয়ে গেলো।কিছুই বলা হলোনা ওকে।না জানা হলো নাম টা।
কিন্তু মনে তো একটা শান্তি যে এই কলেজেই পড়ে ও।দেখা হবেই একদিন।

বন্ধুরা আমাকে জিজ্ঞেস করলো কি হলো?
এভাবে কি দেখছিস?
ওদের সব কিছু খুলে বললাম।

-আরে ধুর ব্যাটা,আগে বলবিনা।
ওকে খুঁজে বের করা লাগবে নাকি,ও তো আমার বোনের বান্ধবী।
-সত্যি দোস্ত?
-হ্যাঁ।তোর আর ওকে খুঁজতে হবেনা।
-নাম কি ওর?
-ওর নাম তৃপ্তি।

পরের দিন ওর ক্লাসের বাইরে থেকে দাঁড়িয়ে ওকে খুঁজতে লাগলাম।
হঠাৎ চোখের সামনে দেখতে পেলাম আমার তৃপ্তিকে।

দিন যাচ্ছে ওর জন্য ভালবাসার অনুভূতি গুলোও বাড়ছে।

একদিন তৃপ্তির সামনে গিয়ে সাহস করে উপস্থিত হলাম।

-কি হলো সাইড দিন।
-একটা কথা বলার ছিলো।
-জ্বী বলুন।
-আমি তোমাকে ভালবাসি।তুমি কি আমার নাতী নাতনীর দাদীমা হবে প্লিজ?
-হুয়াট?
-ভেবে দেখবে প্লিজ।
সময় দু দিন।

কোন রকম প্রপোজ করেই চলে এলাম তৃপ্তির সামনে থেকে।
প্রপোজের পর মনে পড়লো,গোলাপ টাই তো দিতে ভুলে গেছি।
পকেটেই রয়ে গেলো।
থাক পরে দুইটা গোলাপ দিয়ে দিবো।তাতেই হবে।

দুদিন নিদ্রাহীন কাটিয়েছি।
কোন কিছুতেই মন বসছিলোনা।
তৃপ্তি রাজি হবেতো?

দুদিন পর।
-দাঁড়াও দাঁড়াও, দুদিন হয়ে গেছে।
-তো?
-উত্তর দাও আমার নাতী নাত্নীর দাদী হবে কিনা?
-প্লিজ আপনি আমার সামনে আর আসবেন না।
-কেন আসবোনা?
-কারণ আমার বাবা মা কখনোই আপনাকে মেনে নিবেন না।
-কেন মেনে নিবেন না?
-কারণ আপনি একজন স্টুডেন্ট।আর তারা কোন স্টুডেন্টের সাথে আমাকে বিয়ে দিতে রাজি হবেন না।
তাছাড়া আমার বিয়েও ঠিক করছেন বাবা তার বন্ধুর ছেলের সাথে।
ছেলে ইউরোপ কান্ট্রিতে থাকে।
দেশে আসলেই আমাদের বিয়ে।
প্লিজ আমাকে ভুলে যান।
আর ক্ষমা করবেন আমাকে।

-আমার ভালবাসাটা কোন ফেলনা জিনিষ নয়।যে চাইলেই ফেলে দিলাম।
আমি তোমাকে ভালবাসি।আর ভালবাসবো।এটাই কথা।

সেদিন আমি তৃপ্তিকে এ কথা বলেই চলে এসেছিলাম।
তৃপ্তি নিষেধ করার পর আমি আর ওর সামনে যাইনি।দূর থেকে শুধু ওকে দেখতাম।

খেয়াল করতাম তৃপ্তিও আমার দিকে তাকিয়ে তাকে আমার অলক্ষ্যে।

একদিন কলেজে আসার পথে আমি রোড এক্সিডেন্ট করি।
বন্ধুরা সবাই মিলে আমাকে ক্লিনিকে নিয়ে যায়।
সারা কলেজ জানাজানি হওয়ায় তৃপ্তির কানেও যায় নিউজ টা।

ডাক্তার আমাকে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে যেই বাইরে চলে যায়।আর ঠিক সেই মুহূর্তে তৃপ্তি দৌড়ে রুমে প্রবেশ করে।

চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে ওর কাঁদতে কাঁদতে।

-কিভাবে পথ চলেন হ্যাঁ?একটু দেখে শুনে পথ চলা যায়না?
জানেন কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম?
যদি কিছু হয়ে যেতো?
-কিছু হলেই বা কার কি।আমি মরলে তোমার আপদ বিদায় হয়।
বেঁচে যাবে তুমি।
-বেঁচে যাবো আমি না?বাঁচবোনা,এক মুহূর্ত বাঁচবোনা।সোজা উপরে চলে যাবো।

এই বলে তৃপ্তি চলে যায়।
ওর কথার মিনিং ই আমি বুঝলাম না।

একটু সুস্থ হয়ে কলেজে গিয়ে শুনি তৃপ্তির বিয়ে কিছু দিন পরেই।

ছেলে দেশে ফিরেছে।
ছেলে পক্ষ বার বার দেখতে আসে বলে তৃপ্তি কলেজেও আসেনা।
তৃপ্তির বাবা ভয়ংকর পাজি একজন মানুষ।
ওর পরিবারের সবাই তার কথায় উঠে আর বসে।

-তুই ওকে ভুলে যা আরাফ।
– কেন রে দোস্ত?
-কারণ তৃপ্তি বিয়েতে রাজি।আর বিয়েটা করে নিচ্ছে।
আমার বোন কেও ওর বাবা দাওয়াত দিয়েছে বিয়ের।
যেকোন সময় ডেইট পরে যাবে।
তুই ওকে ভুলে যা দোস্ত।

-মানুষ কয়বার ভালবাসে রে দোস্ত?সত্যিকারের ভালবাসা একবারই হয় রে দোস্ত।আমার পক্ষে ওকে ভুলে যাওয়া সম্ভব না।
হ্যাঁ আমি জোর করবোনা,কিংবা বাধাও দেবোনা ওর বিয়েতে।
কেননা আমার ভালবাসাটা এক তরফা।তৃপ্তি আমাকে ভালবাসেনি।
ও যদি বাসতো,
তবে পৃথিবীর কোন শক্তিই ওকে আমার কাছ থেকে আলাদা করতে পারতোনা।
এমন কি ওর বাবাও না।

-কোথায় যাচ্ছিস?ক্লাস করবিনা?
-আর ক্লাস।যেখানে জীবন থেমে যাচ্ছে,সেখানে ক্লাস করেই বা কি হবে।

বাসায় এসে বাথরুমে ঢুকে গোসল করছি আর কাঁদছি চিৎকার করে।
রুমে ফুল সাউন্ডে গান প্লে করে এসেছি।যাতে বাসার কেউ না পায় কান্নার আওয়াজ।

আমি যে তৃপ্তিকে খুব ভালবেসে ফেলেছি।
বুকটা ফেটে যেতে চাচ্ছে।
কিভাবে থাকবো ওকে ছাড়া আমি।
কিছুই ভাবতে পারছিনা।কিছুইনা।

তৃপ্তির বিয়ের ডেইট ফাইনাল হয়ে গেছে।
আজ ওর গায়ে হলুদ।
আমি যেন ধীরেধীরে জীবিত লাশ হয়ে যাচ্ছি।
যেই আমি জীবনে ভুল করে একটা সিগারেটও খাইনি,সেই আমি একের পর এক সিগারেট খাচ্ছি।

হে আল্লাহ্‌! তোমার কাছে কি খুব বেশি কিছু চেয়ে ফেলেছিলাম?কেন তুমি তৃপ্তিকে আমার করে দিচ্ছোনা?
প্লিজ আমার তৃপ্তিকে আমার করে দাও।
আমি যে ওকে ছাড়া মরণ জ্বালা সইছি।
তুমি কি বুঝতে পারছোনা?

রাত হয়ে গেছে।
আমি ছলিম চাচার দোকানে বসে আছি।
রাত ১২ টা বাজে।
তৃপ্তির হলুদ ছোঁয়া হয়ে গেছে।
এইতো আর কয়েক ঘন্টা পর তৃপ্তি অন্য কারো হয়ে যাবে।
চোখ থেকে জল পড়ছে।থামছেইনা কিছুতে।
আর জ্বলছে একের পর এক সিগারেট।
ছেলেরা সহজে কাঁদেনা।যত ক্ষণ পর্যন্ত না তার সহ্য ক্ষমতা হারায়।
আমি আর সহ্য করতে পারছিনা।
পারছিনা সহ্য করতে।

-বাবা,আমি তো এখন দোকান বন্ধ কইরা ফেলুম।কেউ নাই দোকানে।তুমি বাসায় যাইবানা?
-আর বাসা।চাচা আমার সব শেষ চাচা।
স্বপ্ন,আশা।
আর বাসা।বাসায় যেয়েই কি হবে?

তখনি মোবাইল টা বেজে উঠলো।
রিসিভ করতে ইচ্ছে করছেনা।
যে ইচ্ছা সে হোক।
ধরার দরকার নাই।
একের পর এক রিং বেজে যাচ্ছে।
তাই বাধ্য হয়ে ধরলাম।
চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।
নাম্বার টাও দেখতে পাচ্ছিনা ঠিক মত।

-হ্যালো।
-হ্যালো, আপনি এখন কোথায়?
-জাহান্নামে আছি।কে আপনি?
-জ্বী আমি তৃপ্তি।
-ওহ তৃপ্তি,নাম্বার পেলে কই?কেন ফোন করেছো?বিয়ের দাওয়াত দিতে?
আচ্ছা আচ্ছা,কাল আমি অবশ্যই আসবো।তোমায় দোয়া করতে।অনেক সুখী হবে তুমি।অনেক সুখী।

-প্লিজ বলুন না,কোথায় আপনি?
-আমি ছলিম চাচার দোকানে।
-আচ্ছা প্লিজ ৫ টা মিনিট।আপনি ওখানেই থাকুন।
-কেন থাকবো?কিসের জন্য থাকবো?কি আছে এখানে?
কেন শুনবো আমি তোমার কথা?কে হও তুমি আমার?

হ্যালো,হ্যালো।যাহ শালা লাইন টাও কেটে দিয়েছে।

-বাবা বাসায় চইলা যাও অনেক রাইত হইছে।
-আরেকটু পরে যাবো চাচা।আপনি আমাকে আর কয়টা সিগারেট দিয়ে যান।
-এ পর্যন্ত অনেক গুলান খাইছো বাবা।আর খাইওনা।
-চাচা আজ থেকে আপনার দোকানে প্রতিদিন সিগারেট খেতে আসবো।প্রতিদিন।
-কেউ খুব বেশি আঘাত দিছে বাজান তাইনা?

-চাচা বাড়ী যান আপনি।চাচী অপেক্ষা করছে।
-হ বাজান,তা তো করতাছেই।খুব ভালবাসে আমারে।না খাইয়া বইসা থাকবো আমার জন্য।ভালবাইসা বিয়া করছিলাম যে।
-আপনি খুব লাকি চাচা।খুব লাকি।
সবার কপালে ভালবাসা সয়না।
ভালবাসার মানুষকে সবাই পায়না।
-তুমি তাড়াতাড়ি চইলা যাইও।
আমি যাই।
-আচ্ছা যান।

চাচা চলে যাবার দু মিনিট পরই দেখি আমার কাঁধে হাত।

-কে রে?কে এত রাতে?
-আমি।
-তুমিহ?তুমি এখানে?এত রাতে এখানে কেন তুমি?আমাকে দেখতে এসেছো?
এখনো বেঁচে আছি কিনা দেখতে এসেছো?বেঁচে আছি।খুব ভালো আছি।
যাও যাও বাসায় যাও।কেউ দেখলে তোমার সমস্যা হবে।

-আমাকে তোমার নাতী নাতনীর দাদী বানাবেনা?
-হা হা হা।নতুন বউ টা কি বলে।হলুদ শাড়ী পরে,গায়ে হলুদ মেখে,ফুলের গহনা পরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা কি বলে রে আমায়।
হা হা হা।

-আমি তোমার কাছে চিরদিনের জন্য চলে এসেছি।চলো পালিয়ে যাই।এ ছাড়া আমাদের আর কোন পথ নেই।
-মানে?
-মানে তোমার নাতী নাতনীর দাদী হতে তোমার কাছে চলে এসেছি আমি,সবাইকে ছেড়ে।
প্লিজ আমাকে ফিরিয়ে দিওনা।
প্লিজ আরাফ।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে