#ঘরকন্না
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্বসংখ্যা_০৩
” দুই বছরে বিদেশী স্বামীর সাথে সেরকম সম্পর্ক গড়তে পেরেছিস? কত বিদেশীর বউরে দেখি সারাটাক্ষণ এখানে ওখানে বসে স্বামীর সাথে কথা বলে৷ স্বামীকে আঙুলের ইশারায় ওঠায় আর বসায় কিন্তু তোর বেলায়? আবার কত বউরা একটু সেজেগুজে শাড়ি পরে স্বামীর সাথে ভিডিয়ো কলে কথা বলে কিন্তু তোরে আমি শাড়ি পরা দেখি নি কোনদিন। শুধু সুন্দর হইলেই হয়না স্বামীরে আটকে রাখার উপায় জানতে হয়। মেয়েরা তার স্বামীরে অন্যদিকে তাকাতে পর্যন্ত দেয় না আর তোর স্বামী? তোকে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাড়িতে পাঠাবে না তো কাকে পাঠাবে?”
ভাঙা মন নিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে মামার বাড়ি এসে ঘরে ব্যাগটা রাখতেই মামি কথাগুলো অনবরত বলেই যাচ্ছেন। মামা শুধু পাশে থেকে বলেছেন,” শরিফা চুপ করো৷ এত কথা কইও না তো নিজের কাজ করো।”
ব্যাগটা হাত থেকে নামিয়ে বললাম,” মামি, কোন পুরুষকে জোর করে নিজের করা যায় না। শুধু পুরুষ কেন, কোন নারীকে জোর করে নিজের করা আরও অসম্ভব ব্যাপার। সেক্ষেত্রে আমি নিজেই সেই পুরুষের সান্নিধ্য চেয়েছিলাম৷ নারী যেমন খুব সহজে কোন পুরুষের হতে পারে তেমনি সে না চাইলে কেউ তাকে নিজের করতে পারে না। আমি তার জন্য অপেক্ষা করব।”
মামি আমার দিকে কয়েক কদম এগিয়ে এসে বলল,” মামার ঘাড়ে বসে বসে আবার খেতে এসেছিস। এতদিন তো কম জ্বা*লাসনি মা।”
” আমি তো আপনাদের এক টাকাও খরচ করি নি মামি। উলটো আমি টাকা দিয়েছি আপনাদের। আমার মায়ের তো কম ছিল না বা কম নেই। আমি কেন কারও ভালো ব্যবহারটুকুও পাই না মামি? কী করেছি আমি আপনার?
” শ্বশুরবাড়ির মানুষের কাছে থেকে অবহেলা পেয়ে এখানে চলে এসেছিস, আমারও এমন দিন এসেছিল। যে সময়ে কথা ছিল আমি আমার স্বামীর কাছে বেশি গুরুত্ব পাব তখন সে তোকে নিয়ে পড়ে থেকেছে।”
মামা ধমকের সুরে মামিকে শাসিয়ে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে থাকলেন। মামির কথায় যেন বুকে চিনচিন ব্যথা শুরু হলো। মামির মন বিষিয়ে যাওয়ার কারণ আমার প্রতি মামার ভালোবাসা! এতিমদের হয়তো আসলেই ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার নেই। সৎমায়ের অবহেলা দেখে মামা এ বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। আমার এখানে আসার কারণে মামি এতগুলো বছর আমাকে সহ্য করেছে!
আমাকে চুপ থেকে মামি আবার বলে উঠলেন, ” ভেবেছিলা এবার বুঝি এসবের পাঠ চুকিয়ে শান্তিতে থাকব। নাহ, আবার এসে হাজির।”
মামির কথার উত্তরে আসলে আমার আর কিছুই বলার নেই৷ শুধু মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে বললাম- আল্লাহ, আমার মাকে তো নিয়ে নিয়েছ এবার কথা আর কষ্ট সহ্য করার হিম্মতটুকু নিও না দয়া করে। এটাও যদি হারাই তাহলে নিজের মনটাকে আমি আর বাঁচিয়ে রাখতে পারব না।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের রুমটায় চলে গেলাম। দরজা খুলেই দেখলাম আমি ও বাড়িতে যাওয়ার সময় যেভাবে রেখে গিয়েছিলাম ঠিক ওভাবেই আছে। আমার রুমে কারও আসার প্রয়োজন পড়েনি। আমি থাকতেও কখনো কারও প্রয়োজন পড়ত না।
রুমটা পরিস্কার করার কাজে লেগে পড়লাম। সব কাজ শেষ করতে করতে প্রায় বিকেল হয়ে গেলে গোসল সেরে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।
ফোনটা হাতে নিতেই অচেনা নম্বর থেকে দুইবার কল এসেছিল। ব্যালেন্স চেক করে দেখলাম সেখানে মিসকল দেওয়ার টাকাও নেই। বিকাশ থেকে রিচার্জ করে নম্বরটায় কলব্যাক করলাম। রিং হতেই ওপাশ থেকে কেউ কল রিসিভ করল।
ফোন রিসিভ হতেই সালান দিলাম। ওপাশ থেকে ভরাট পুরুষালী গলায় কেউ বলে উঠল, ” আপনি অনামিকা বলছেন?”
” জি বলছি। আপনি কে?”
” আমি কুরিয়ার থেকে বলছি। আপনার নামে একটা পার্সেল এসেছে। বড়সড় একটা পার্সেল, ভেতরে কী আছে সেটা বলতে পারছি না। এসে ওটা নিয়ে যাবেন।”
আমার নামে পার্সেল! তাও আবার বড়সড়! বিষয়টা আমাকে উদগ্রীব করে তুলল। কে পাঠালো আমাকে পার্সেলটা?
নিজের প্রশ্নগুলো দমিয়ে বলে উঠলাম,” কোথায় থেকে এসেছে ওটা? কে পাঠিয়েছে, প্রেরকের নাম লেখা আছে?”
” অ্যা, ইংরেজিতে কোন পেইজের নাম লেখা হয়তো। মানুষের নাম নাই বাপু। তাড়াতাড়ি নিয়ে যাও, সব দেখতে পাবা।”
” ঠিক আছে।”
লোকটা ওপাশ থেকে কলটা কেটে দিতেই যেন চিন্তাটা বেড়ে গেল। ফোনটা রাখতেই দেখি মামি দরজার পাশে দাঁড়িয়ে। উনার মুখটা দেখেই আমার মখটা মলিন হয়ে গেল৷ এই মানুষটাকে আমি না চাওয়া সত্ত্বেও কষ্টে রেখেছি৷ আমি কারো ওপর জুলুম করছি!
আমাকে কিছু না বলতে দেখে মামি বলে উঠলেন,” বিকেল হয়ে গেছে৷ ক’টা খেয়ে উদ্ধার করলেও তো করতে পারেন৷ আপনার মামা এসে আবার আমার ওপর চড়াও হবে৷ বাড়ির সব দোষ তো সবসময় আমারই হয়। ”
মামির দিকে তাকিয়ে মিথ্যে হাসির চেষ্টা করে বললাম,” আমাকে ভালোবাসা যায় না তাই না মামি? ভালোবাসা গেলে কি আর আমার মা আমাকে ছেড়ে চলে যেত! চিন্তা করবেন না, আমি না চাওয়া সত্ত্বেও যে আপনার কষ্টের কারণ হয়েছি না? এই কষ্টে আমি আর আপনাকে রাখব না৷ আমি আমার জন্য একটা আলাদা বাড়ি করব। আমার একলা জীবন একাই পার করব। আমি চাই না আমার জন্য কেউ অসুখী হোক। আর কয়েকটা দিন একটু সহ্য করে নিন মামি।”
কথাটা তো আবেগে বলে দিলাম। আমার কি আসলেই এই মানুষ গুলোকেও ছেড়ে থাকতে হবে। নিজের ওপর নিজেরই মায়া হচ্ছে। এই মানুষটার ভালোবাসা পেতে শাড়ির আঁচল ধরে পিছন পিছন ঘুরতাম। কখনো আদর করে কোলে নিত আবার কখনো চোখেও দেখত না।
আমার কথায় মামির মুখটা যেন আরেকটু কালো হয়ে গেল। আমার কথায় দমে গেলেন উনি? কি জানি! আমার দিকে চোখ রেখেই বললেন,” পরে গিয়ে উদ্ধার করবেন আপাতত খেয়ে নেন। বিকেল হয়ে গেছে। ”
বিছানা থেকে উঠে আলমারি থেকে বোরখাটা বের করতে করতে বললাম,” আমার বিরিয়ানি খেতে ইচ্ছে করছে। কুরিয়ার থেকে কল এসেছিল, আমার নামে নাকি কিছু একটা এসেছে। ওগুলো আনার সময় রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়ে আসব।”
” আপনি বাড়িতে এসেছেন জন্য আপনার মামা গরুর মাংস আর খিচুড়ি রান্না করতে বলেছিল। খুব কষ্ট হয়েছে রান্না করতে। ওগুলো খেয়ে যেখানে যাওয়ার সেখানে যান। না খেয়ে এক পা-ও বাহিরে যেতে পারবেন না। যখন যেটা ইচ্ছে সেটা করতে পারবেন না এ বাড়ি থেকে।”
মামির কথায় বেশ অধিকারবোধ বুঝতে পারলাম। এই মহিলাকে আমি বিশ বছরেও চিনে উঠতে পারলাম না। কেমন মানুষ উনি? কেন একেক সময় একেক আচরণ করেন?
বোরখাটা বিছানার ওপর রেখে বললাম,” ভালো তো বাসেন না। শ*ত্রু ভাবেন। সেই মেয়ের খাওয়া বা না খাওয়া নিয়ে এত চিন্তা কেন আপনার? এত ভাবতে হবে না আমাকে নিয়ে। আমার জন্য আমার আল্লাহ যথেষ্ট।”
মামি আর কোন কথা না বলে দ্রুতপায়ে আমার হাত ধরে খাবার টেবিলে নিয়ে আসলেন৷ চেয়ার টেনে নিজের ঠেলে বসিয়ে দিলেন। নিজেই একা একা খাবার প্লেটে দিয়ে বকবক করতে থাকলেন। আমি উনার দিকে এক পলকে চেয়ে রইলাম। এই মানুষটা আমাকে অনাদর করলেও হয়তো একটু হলেও এই এতিম মেয়েটার মায়ায় জড়িয়েছে। নইলে শ*ত্রুকে কে হাত ধরে টেনে এনে খাবার খেতে দেয়? এই মানুষটা কি জানে, তাকে আমি আমার মায়ের আসনে বসিয়ে রেখেছি? আমার পালক মা।
_______
কুরিয়ার থেকে বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা। শুধু বড়সড় একটা পার্সেল না একটা ট্রলিব্যাগ নিয়ে আসতে হয়েছে ওখান থেকে৷ রিকশা বাড়ির সামনে নিয়ে আসতে হয়েছে। রিকশাওয়ালা নিজেই ট্রলিব্যাগটা আমার রুম পর্যন্ত দিয়ে গিয়েছে। ভাড়া মিটিয়ে রুমে এসে বোরখা খুলে ফ্রেশ হয়ে নিই। ওয়াশরুম থেকে দেখি মামি এসে বিছানায় এসে বসেছেন।
আমার রুমে মামিকে দেখে কৌতুকের স্বরেই বললাম, ” কী মামি? আমার মায়ায় কি বেশি টানছে? চোখে হারাচ্ছেন আমাকে?”
মামি আমার প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে বললেন,” ট্রলিব্যাগের ভেতরে কী আছে? এটা এসেছে?”
” হ্যাঁ। ”
” কী আছে এতে? মনে হচ্ছে যেন বিয়ের কনের জন্য বিয়ের জিনিসপত্র পাঠিয়েছে।”
” বিয়ের জিনিস? আমার তো মনে হচ্ছে কারো লা**শ কয়েক টুকরো করে আমাকে পাঠানো হয়েছে নাকি!”
মামি আমার দিকে বিরক্তমুখে চেয়ে বললেন,” ও বাড়ি থেকে কল দিয়েছিল? আবির কথা বলেছে?”
” আমার তো মনে হয়, আমার সংসার ভেঙেছে। আবার কল দেবে সেটা সরাসরি জানিয়ে দিতে?”
#চলবে……..