ঘরকন্না পর্ব-০৭

0
569

#ঘরকন্না
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্বসংখ্যা_০৭

দরজার বাহিরে আমি আর মামা দাঁড়িয়ে আছি৷ আমার বুকের ভেতরটা যেন কোন একটা অজানা ভয়ে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। এরপর কী হবে সেটা ভেবে যেন মাঝ সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছি।

আমাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মামা বললেন,” বেশিরাত হয়ে গেল, মা?”

নিশিতা ওপাশ থেকে হেসে বলল,” না না মামা, ভেতরে আসুন।”

মামা ভেতরের দিকে গেলে নিশিতা এবার আমার হাত ধরে ভেতরে টেনে নিয়ে দরজা আটকে দিয়ে বলল,” তোমাকে কিন্তু দারুণ লাগছে। একদম নতুন বউ বউ লাগছে।”

নিশিতার কথা যেন আমার মাথার ওপর দিয়ে গেল। সকালের ব্যবহারের সাথে যেন আকাশ-পাতাল পার্থক্য। সকালের সেই মানুষটার সাথে এখনকার মানুষের কোন মিলই দেখছি না আমি।

আমি তখনও থ’ মেরে দাঁড়িয়ে আছি৷ নিশিতার দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে ভাবছি মানুষের কত রঙ তাই না!

আমাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিশিতা বলে উঠল,” এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে? ভেতরে যাবে না? এসো এসো। ”

নিশিতা এবারও আমার হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে এলো। বাড়িতে যেন জমজমাট আয়োজন৷ বাসায় আম্মার আর নিশিতা ছাড়াও কয়েকজন রয়েছে। আমাকে দেখে আমার দিকে একজন এগিয়ে এসে আমার শাশুড়িকে ডেকে বললেন,” আপা তোর ছেলের বউ তো চলে এসেছে৷ দেখ লাল টুকটুকে বউ এসেছে বাসায়। ”

আমার শাশুড়ির রুমে উঁকি দিয়ে দেখলাম মামা আর আম্মা কথা বলছেন। আমাকে চেয়ারে বসানো হলো। চারপাশের সবকিছু যেন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। সবাই আমাকে নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কেন কিছুই বুঝতে পারছি না।

আমাকে রেখে নিশিতা নিজের রুমে গিয়ে আবার ফিরে এসে বলল,” চলো, আমার রুমে যাই৷”
” কিন্তু…”
” কী হয়েছে? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কী করছ তোমরা?”
” কিছুই করছি না আপাতত তবে করব। এখন আমার রুমে চলো জলদি। ”

নিশিতা আমাকে তার রুমে নিয়ে এসেছে অনেকক্ষণ আগে। আমাকে আবার প্রথম থেকে তৈরি করে দিচ্ছে। আরেকটা নরম লাল টকটকা শাড়ি পরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সাজিয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রথম থেকে৷ আগে শুধু হালকা লিপস্টিক দেওয়া থাকলেও এবার যেন কিছুই বাদ গেল না। নিশিতা ছোট একটা আয়না আমার সামনে ধরে বলল,” দেখো তো কেমন লাগছে?”

আয়নাটা নিজের মুখের ঠিক সামনে ধরায় পুরো মুখ সেখানে দেখা যাচ্ছে৷ এর আগে কখনো আমার এরকম ভারী সাজে সাজা হয়নি। আমাকে সাজলে যে এত সুন্দর লাগবে এটাও কখনো ভাবিনি৷ নিজের দিক থেকে নিজেই যেন চোখ ফেরাতে পারছি না।

নিশিতা আমাকে চুপ থাকতে দেখে বলে উঠল,” আমার ভাইয়া আজ তোমার ওপর থেকে চোখ ফেরাতে পারবে না৷ একদম পরী লাগছে তোমাকে৷ বুঝতে পারছি না তুমি বেশি সুন্দর নাকি আমি বেশি সুন্দর করে সাজাতে পারি!”

আমি নিশিতার কথার পরিপ্রেক্ষিতে কোন কথা না বলে মামা কোথায় জিজ্ঞেস করলাম৷ নিশিতা পূর্বের মতই একগাল হেসে বলল,” মামা তো আম্মার সাথে দেখা করে কথা বলেই চলে গিয়েছে।”
” আমার সাথে দেখা করে গেল না?”
” তোমাকে তো সাজাচ্ছিলাম তাই আর আসেনি। চিন্তা কোরো না কাল ঠিক চলে আসবে।”

এখনও আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আবিরকেও বাড়িতে কোথাও দেখিনি আসার পর থেকে। এদিক ওদিক কয়েকবার খুঁজেও তাকে এক পলকের জন্যও দেখতে পাইনি আমি। নিশিতা আমাকে বসিয়ে রেখে বলল,” দাঁড়াও আম্মাকে ডেকে নিয়ে আসি। আম্মা তো তোমাকে এই সাজে দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।”

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,” কী হচ্ছে এসব নিশিতা? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না৷ সকালে আমাকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বললে আবার এখন নিজে থেকে সাজিয়ে দিচ্ছ, আম্মাও নাকি দেখার জন্য অপেক্ষা করছে আবার এদিকে আবিরকেও দেখছি না। ”

নিশিতা একগাল হেসে বলল,” এখন এসব ভুলে যাও। কী হচ্ছে সেটা শুধু দেখতে থাকো। আমি যাই বাহিরের সবাইকে এখন বিদেয় করি অনেক রাত হয়ে গেছে। তুমি এখানে বোসো।”
” নিশিতা, প্লিজ এরকম করো না। আমি সবকিছু জানতে চাই। সকাল থেকে আমার সাথে সব অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে। ”
” বললাম তো এখন কিচ্ছু বলব না।”
নিশিতা আর কিছু না বলে রুম থেকে চলে গেল৷ রুমে আর কেউ নেই। একাই বসে ভাবতে থাকলাম, কী হচ্ছে আমার সাথে!”
হঠাৎ মনে পড়ল আসার পর আমি মামিকে কল করিনি৷ তাড়াতাড়ি করে ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করলাম।

মামিকে কল দেওয়ার সাথে সাথে মামি কল রিসিভ করল। কল রিসিভ করেই বলে উঠল,” কে যেন যাওয়ার সময় বলে গেল ও বাড়িতে গিয়েই কল দেবে?”
” স্যরি মামি।”
” মানুষ এভাবেই ভুলে যায় তাই না?”
” প্লিজ মামি, স্যরি প্লিজ। এ বাড়িতে সবাই যা শুরু করে দিয়েছিল যে আমি সব ভুলে গিয়েছিলাম। মনে হতেই আপনাকে কল দিয়েছি, একটুও দেরি করিনি সত্যি।”
” এখন মনে পড়ে আর কী হবে? ”
” মামি আমি এখানে কিছুই বুঝতে পারছি না। সকালে আমাকে চলে যেতে বলল, সন্ধ্যায় শাশুড়ি কল দিয়ে ডিভোর্সের কথা বলল এখন আবার আমাকে নতুন বউ সাজানো হয়েছে। আবিরকে এখনো দেখিনি, বাড়িতে বোধ হয় নেই।”
” চিন্তা করতে হবে না কিছু নিয়ে৷ তোর চিন্তার দিন শেষ। ”
” মানে? চিন্তার দিন শেষ কেন?”
” এখন ইন শা আল্লাহ সবকিছু ভালোই হবে।”
” জানি না কী হবে। ওহ, মামা গিয়েছে?”
” হ্যাঁ, তার থেকেই তো সব শুনলাম। তুই তো ভুলেই গিয়েছিস আমাকে।”
” ভুলিনি মামি। ”
” খুব মনে রেখেছেন। আচ্ছা শোন এখন থাক মা, আমরা কাল সকালে চলে আসব।”
” আমার চিন্তা হচ্ছে মামি।”
” চিন্তার কিচ্ছু নেই৷”
” হুম।”
” আচ্ছা রাখলাম।”
” ঠিক আছে।”

ফোন রাখার সাথে সাথে নিশিতা আর আম্মা রুমে প্রবেশ করল। আম্মার মুখোমুখি হতেই আমার নিজেকে খুব ছোটো লাগছে। সন্ধ্যায় কত খারাপ ব্যবহার করলাম! শাশুড়ির মুখোমুখি হতেই আমার লজ্জা লাগছে। কিন্তু আমার তো কিছু করার ছিল না৷ দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল আমার।
আমি দুজনকে আসতে দেখে মাথানিচু করে অপ*রাধীর মতো বসে রইলাম। আম্মা এসে আমার পাশে বসলেন। আমি তখনও মাথা নিচু করে বসে আছি।

আম্মা থুতনিতে হাত দিয়ে আমার মুখ উঁচু করে বলে উঠলেন,” মাশাআল্লাহ। কি সুন্দর লাগছে আমার বৌমাকে!”

আমি আম্মার দিকে তাকিয়ে বললাম,” আম্মা…”
” কোন কথা না।”
” আম্মা তখনকার জন্য আমি দুঃখিত, প্লিজ আমাকে মাফ করে দিন।”
” এখন সব ভুলে যাও মা। এসব কথা আর মনে রেখো না।”
” আম্মা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, বিশ্বাস করুন। আমাকে প্লিজ ক্লিয়ার করে বলবেন আমার সাথে কী হচ্ছে এগুলো?”
” তোমাকে আজ নতুন বউ হিসেবে আবার নিয়ে আসা হলো।”
” আমাকে তো নিয়ে আসা হয়নি, আমি নিজেই এসেছি। ”
” ওই একই তো হলো। তোমাকে আসতে বাধ্য করা হয়েছে জন্যই তো এসেছ৷ এখন আর কোন কথা না। যাও এখন সোজা ছাদে চলে যাবে।”
” এখন ছাদে যেতে হবে?”
” হ্যাঁ যেতে হবে।”
” কিন্তু কেন?”

নিশিতা পাশে থেকে বলে উঠল,” আমার ভাইয়া তার নতুন বউয়ের জন্য অপেক্ষা করছে। তার সামনে যাবে না?”

আমি কিছু না বলে চুপ করে বসে রইলাম। আম্মা নিজেই এবার নিশিতাকে বলল আমাকে এগিয়ে দিতে৷ আম্মা আমার মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করে নিজের রুমে চলে গেলেন৷

নিশিতা এবার আমাকে নিয়ে সিঁড়ির কাছে এসে বলল,” যাও, এবার একাই চলে যাও৷ ভাইয়া অনেকক্ষণ ধরে তার বউয়ের জন্য অপেক্ষা করছে৷ অল দ্যি বেস্ট ভাবি।”

নিশিতা চলে গেলে আমি এক হাত দিয়ে শাড়ির কুচিগুলো ধরে সামান্য পরিমাণে উঁচু করে ছাদের দিকে অগ্রসর হলাম।
ছাদে পা রাখতেই বুঝলাম বাম পাশে একজন দাঁড়িয়ে আছে। বেশ উঁচুলম্বা পুরুষটি বিশালাকার দেহের অধিকারী। পুরুষটি রেলিংয়ে হাত দিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার পায়ের শব্দ পেতেই তিনি আমার দিকে ফিরে তাকালেন। ছাদের এপাশটায় স্বল্প আলোর ঝাড়বাতি লাগানো হয়েছে। আলো নিভছে আর জ্বলছে।
একপা দু’পা করে এগোচ্ছি আর আমার হৃৎস্পন্দন বাড়ছে। আমাকে এগোতে দেখে সামনে দাঁড়ানো পুরুষটিও আমার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করল।
আমরা দুজন একে অপরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এতদিনের হাজার হাজার মাইল দুরত্বকে জয় করে আমরা আজ সামনাসামনি দাঁড়িয়ে।

উনার মুখের দিকে তাকাতেই দেখলাম উনি আমার দিকে মুগ্ধচোখে চেয়ে আছেন। আমি চোখ নামিয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার ভীষণ অস্বস্তি লাগছে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে। লজ্জা লাগছে ভীষণ।

নীরবতা ভেঙে তিনি বলে উঠলেন,” কেমন আছো অনু?”

আমি চোখ তুলে চাইলাম। আমার চোখ টলমল করছে৷ এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না আবির আমার সামনে দাঁড়িয়ে। এই মানুষটা সত্যিই আমার সামনে দাঁড়িয়ে!

আবিরের প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে বলে উঠলাম,” আপনাকে একটু ছুঁয়ে দেখি? আপনাকে আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। কেমন সব স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। মনে হচ্ছে এখনই ঘুম ভেঙে যাবে আর স্বপ্নটা ভেঙে যাবে। আপনাকে প্লিজ একটু ছুঁয়ে দেখি?

#চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে