ঘরকন্না পর্ব-০২

0
639

#ঘরকন্না
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্বসংখ্যা_০২

ছেলে এতদিন পর বিদেশ থেকে বাড়িতে আসবে আর সেই ছেলের বউকে বাড়ি থেকে মামারবাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই বিষয়টা কারো কাছে অস্বাভাবিক কেন লাগছে না সেটা কিছুতেই বুঝতে পারছি না। আমার মামাকে এত করে নিষেধ করলাম যে আমাকে নিতে এসো না তবুও আমার শাশুড়ি একবার বলা মাত্রই তিনি চলে আসলেন। মামা তো কখনো আমার খারাপ চাইতেন না তাহলে আজ কেন এমন করলেন! মামা কি কোনভাবে চাইছে না আমি এখানে সংসার করি?

আমি দুঃখ-ভারাক্রান্ত মনে মামার সামনে আসলাম। মামা তখনও হাসছেন। আমি মামার হাসিমুখ দেখে ভাবছি এটা কি আসলেই আমার মামা! আমার বিয়ে দুই বছর হলেও এই বাড়িতে খুব একটা আসা হয়নি। নতুন বউ উপাধি-টা এখনো বিদ্যমান।

মামা হেসে মিষ্টির প্যাকেটটা দিয়ে বললেন,” তোর শাশুড়ি কোথায় রে মা? দেখছি না যে!”

আমি আম্মার ঘর দেখিয়ে দিয়ে বললাম,” আম্মা ঘরেই আছে।”

মামা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,” যা মা, রেডি হ’। তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে হবে দুপুর হয়ে যাচ্ছে। আমার অনেক কাজ পড়ে আছে।”
” মামা আমি তো ফোন করে তোমাকে এখানে আসতে নিষেধ করলাম তাও কেন আসলে? আমাকে তুমি ভালোবাসো না? তুমি কীভাবে এখানে আজকে আমাকে নিতে আসতে পারলে গো?”
” এভাবে কেন বলছিস মা? তোর শাশুড়ি এমন করে বলল যে আমি না এসে পারলাম না। উনি চাইছেন তুই আপাতত কিছুদিন আমাদের ওখানে থাক। জামাই এসে তোকে একদিন নিয়ে আসবে।”
” আমি আমার স্বামীকে আজ নিজের চোখে দেখার অধিকার রাখি না?”
” অবশ্যই রাখিস। তোর শাশুড়ি গুরুজন। এ বাড়িতে তার কথাই শেষ কথা। তিনি আশা করছি ভুল কিছু করবেন না।”
” আম্মাকে একদম ভালো লাগছে না আমার। তার মেয়ের স্বামী যদি এতদিন পর বিদেশ থেকে আসতো তাহলে কি মেয়েকে এখানে নিয়ে আসতো?”
” এসব এখন বাদ দে। যা রেডি হয়ে নে। আমি আসছি আপার কাছে থেকে।”

মামা আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আম্মার রুমে চলে গেলেন। আবিরকে কল দেওয়ারও সুযোগ নেই৷ এখানে এসে নতুন সিম না নেওয়া পর্যন্ত কোন যোগাযোগ করা যাবে না। কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না। এদিকে আমার সবকিছু অসহ্য লাগছে। ঠিক করলাম আম্মার সাথে কথা বলব। খাবার টেবিলে মিষ্টির প্যাকেট রেখে গুটিগুটি পায়ে আম্মার রুমের দিকে গেলাম। আম্মা আর মামা সাথে আমার ননদ ভালো আসর জমিয়েছিলেন। আমাকে দেখেই যেন সবার মুখের হাসি উবে গেল।

আম্মা কঠোরভাবে বললেন,” এখনো এদিক সেদিক কী করছো? তোমাকে তো রেডি হতে বলা হয়েছে।”

মামাও পাশে থেকে বলে উঠলেন,” তোকে তো আমি তৈরি হতে বললাম মা। দেরি করিস না যা মা, যা।”

মামাকে আজ খুব অচেনা লাগছে। সবকিছু কেমন অচেনা লাগছে! কিছুটা বিরসভাবেই আম্মাকে বললাম,” আম্মা, আপনার ছেলে আসার পরই নাহয় যাই? উনি আমাকে বাড়িতে রেখে আসবেন। আমি তো উনাকে কখনো ফোনে ছাড়া আর কখনো দেখিনি। আপনারা সবাই এখানে আনন্দ করবেন আর আমি…”

আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে আমার ননদ বলে উঠলো,” শোনো, আমরা কেউ আমার আম্মার মুখের ওপর কিছু বলি না৷ ভাইয়াও বলে না আর আমিও না৷ আশা করছি তুমি নিজেকে সংবরণ করবে।”

নিশিতার এমন কথায় আমার শাশুড়ি তাকে বললেন,” নিশিতা, যাও চা এনে তোমার মামাকে দাও।”

মায়ের আদেশ পেয়ে নিশিতা রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আম্মা এবার আমাকে বললেন,” দুই বছর ধৈর্য্য ধরে থেকেছ, আমার ছেলেকে না দেখে বিয়ে করেছ, আমার ছেলে কেমন সেটাও জানতে না৷ এতকিছু করতে যেহেতু পেরেছ আজ মামার বাড়িও যেতে পারবে৷ এটা এমন কঠিন কোন কাজ না অনামিকা।”

আমি এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে কী বলব সেটা ভেবে পাচ্ছি না। হয়তো এরপর আর কিছু বলা হলে আমাকে নোংরা কিছু ট্যাগ লাগিয়েও দেওয়া হতে পারে। আমি মুখে মিথ্যে হাসি ফুঁটিয়ে আম্মাকে বললাম,” ঠিক আছে আম্মা৷ আপনারা যেহেতু চাইছেন আমি এখান থেকে চলে যাই সেহেতু আমি যাচ্ছি৷ আমার মা ছোটবেলায় আমাকে ছেড়ে চলে গেছে, বাবাও বিয়ে করে আমাকে পর করেছে৷ মামা- মামিও আমাকে বিয়ে দিয়ে পর করে দিয়েছে আপনারা প্লিজ আমার হয়ে থেকে যাবেন। আমার শুধু একটু ভালোবাসা চাই৷ আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি।”

রুমে এসে তৈরি হয়ে নিলাম তাড়াতাড়ি করে। বাড়ির একটা মানুষও যেহেতু চায় না আমি এখানে থাকি সেখানে যু**দ্ধ করে তো আর টিকে থাকা যাবে না। যু*দ্ধ করে টিকে গেলেও সময় অতিবাহিত করা কঠিন হবে। একা ভালো থাকা গেলেও অনেকের মাঝে এভাবে এই পরিস্থিতিতে থাকা যায় না।

তৈরি হয়ে ব্যাগ টেনে রুমের বাহিরে নিয়ে আসতেই আম্মার রুম থেকে সবাই বেরিয়ে এলো। রান্নাঘরের ওখানে থাকা মহিলাগুলো কেমন হাসছে। হাসি দেখেই শরীরের মধ্যে কেমন একটা করে উঠছে। আমার হাতে ব্যাগ দেখে মামা এগিয়ে এসে ব্যাগটা নিজের হাতে নিলো।

আম্মাকে হাসি মুখে বলে বাড়ির বাহিরে গাড়ি ঠিক করতে চলে গেলেন। আমিও সবার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে বের হলাম।

বাড়ি থেকে বের হয়ে আসার সময় বুঝলাম সবাই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। সবার মুখে জিতে যাওয়ার হাসি লেপ্টে আছে।

মামা গাড়ি ঠিক করে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িতে গিয়ে উঠে পুরো বাড়িটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। এ বাড়িতে কি আমার আর আসা হবে!

গাড়িতে মামার সাথে কথা বলার আর রুচি হলো না। মামা নিজেই একা একা অনর্গল এটা ওটা বলে গেলেন আমি শুধু মাঝে মাঝে হ্যাঁ হু করলাম।

বাড়ির প্রায় কাছাকাছি এসে মামা বলল,” শোন মা, নিজের সাথে যাই হয়ে যাক কখনো মন খারাপ করবি না। খারাপ কিছু হলেও সেটায় ভালো কিছু আছে নাকি সেটা দেখবি।”

আমি বাহিরের দিকে তাকিয়েই বলে উঠলাম,” মামা, আজ আমার বাড়ি ছেড়ে আসায় কোন ভালোটা হলো বলতে পারো?”

মামা আমার দিকে তাকিয়ে নিম্নস্বরে বললেন,” তুই কাঁদছিস!”
” না তো! ”
” তোর চোখে পানি।”
” তাহলে হয়তো মন ভেঙেছে, সংসার ভাঙতে কতটুকু দেরি সেটা বুঝতে পারছি না। আমি তো শুধু মন দিয়ে সংসারটাই করতে চেয়েছিলাম মামা। তোমরা সেটাও করতে দিলে না। আমার স্বামীকে দেখার ভাগ্য আমার বোধ হয় আর হলো না। আমি শান্তশিষ্ট, মেনে নেওয়ার মেয়ে বলে তোমরা আমাকে এভাবে চুপ করিয়ে দিতে পারলে? একটুও বাধলো না তোমাদের? মা মরা মেয়েকে কীভাবে এত বাজেভাবে ঠকালে মামা? আমার মা বেঁচে থাকলে হয়তো সবকিছু এত খারাপ হতো না। সবার নাকি কেউ না থাকলেও মা কখনো ছেড়ে যায় না অথচ আমার মা সবার আগেই আমাকে ছেড়ে গেল। অন্যরা আর থাকবে কেন!”

মামা আমার কথায় আর কিছু বলল না। তার মনে কি কিছু নাড়া দিল? বুঝতে পারলাম না ঠিক। মামা আমার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে বাহিরে তাকালো। আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস হয়তো আর মামার নেই।

চোখের পানি মুছে মামাকে আবার বললাম,” নিজের বর দেখার আগেই আমার সংসার ভেঙে গেল তাই না মামা?”

মামা এবারও আমার দিকে তাকালেন না৷ বাহিরে তাকিয়েই বলে উঠলেন,” তুই তো সবর-কারী, এখন কেন এত ভেঙে পড়ছিস?”

” সংসার নষ্ট হওয়ার আগে জীবন নষ্ট হয়ে গেলে পারতো না মামা?”

আমার কথায় মামা এবার আঁৎকে উঠলেন। আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টি ফেলে বললেন,” অনু ধৈর্য্য ধরতে শিখো, আজেবাজে কথা বোলো না।”
” আমার তো সব শেষ মামা। কীসের আশায় আর ধৈর্য্য ধরব বলো তো!”

#চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে